হঠাৎ করে বুকের ভেতর আচমকা একটা ব্যাথা অনুভূত হলো–বুঝতে পারিনি কেন?? এর মধ্যেই মনে হচ্ছে কি জানি নেই নেই, বুকটা খালি খালি মনে হলো, মুহূর্তে কষ্টে মনটা ভরে গেল। ঘুম থেকে উঠে কাজে গেলাম। কাজে গিয়ে, কাজের মধ্যেই মনে হলো আমার রাতে দেখা স্বপ্নটা, আমার সংসার, আমার ঘর, আমার পাশের মানুষটা, কয়েকটা জিনিস পত্র নিয়ে টুংটাং করছি-স্বপ্নেই শুনতে পাচ্ছি–বউ! আমায় শশা কেটে দে, বউ তেঁতুলের ভর্তা বানায় দে, আমি বলতেছি আজ শিং মাছের ঝোল না করলে হয়না? উত্তরে বলল – তাহলে ভাতই খাবনা, স্বপ্ন গুলি মনে পড়ছে আর কষ্টে বুকটা ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে।
আনমনে অনুভব করি একটা স্পর্শের – এই মাতোয়ারা স্পর্শ যখন পাইনা কেন তখনই উন্মাদ হয়ে যাই, রাগ হয় আমার ছোট একটা পৃথিবী চারণক্ষেত্রের উপর, মন চাই আমার পৃথিবীটাকে দুমড়ে মুচড়ে, ভেঙ্গে চুরে, চুরমার করে দেই। তৈরী হয় ক্ষোভ, ইচ্ছা হয় চিমটি দিয়ে ১০ টা আংগুলের ছাপ বসিয়ে দেই হাতে। তবুও মনে হয় কম হবে। তখনই রাগে হো হো করে চিৎকার দিয়ে কাঁদি, একটা স্পর্শের কত বড় শক্তি, আমার চিরসবুজ বিচরণ ক্ষেত্র কেমন জানি লালচে, ফিকে হয়ে যাচ্ছে, আমি আমার ইচ্ছা মত দৌড়াইতে পারিনা, হাসতে পারিনা। কেবলই মনে হয় আমি হারিয়ে যাচ্ছি, ভেসে যাচ্ছি অজানার কোণ এক কষ্টের দেশে। কবে ফিরে আসবে আমার হারিয়ে যাওয়া সেই সব দিন। কবে আবার আমার সকালটা শুরু হবে হাসি দিয়ে।
রান্না ঘরে অজান্তে গুন গুন করে গান করছি—“আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে বিরাজ সত্য সুন্দর” হঠাৎ দরজায় কলিং বেলের শব্দ, গান থামিয়ে জিজ্ঞেস করলাম কে? দরজা থেকে চেঁচিয়ে উঠল খোল- আমি ! তার মানে আমার পতিদেবতার আগমন ঘটেছে । আমার স্বামী নাম দিয়েছি তার চারণক্ষেত্র। পেশায় সফ্টওয়ার ডেভেলপার। পাঁচ বছর প্রেমের পরিসমাপ্তি ঘটে ২০১০ বিয়ের মাধ্যমে। আমার ছোট্ট একটা পৃথিবী,নাম দিয়েছি তার “চারণক্ষেত্র” আর এই পৃথিবীর নাম নিজের মতো করেই রেখেছি।
আমার এই চারণক্ষেত্রের ভিতরে আমি নিজের ইচ্ছা মত-হাসি, খেলি, চৈ বৈ করি-রাগ করি,কাঁদি, কষ্ট দেই, কষ্ট পাই!আমার সীমাবদ্ধতা ছোট হলেও আমার পৃথিবীটাকে আমার অনেক বড় মনে হয়। কেননা এই চারণক্ষেত্রের মধ্যেই আমার বিচরণ,এপাশ থেকে ওপাশ কত যে ঘুরে বেড়ায়;মনের আনন্দে, মাঝে মাঝে হাঁটি;কখনো কখনো দৌঁড়ায়,কখনো থেমে যায়, আর এতেই আমার আত্নতৃপ্তি।
বিয়ের পর কোন স্বামী স্ত্রী কি আলাদা থাকতে চায়? আমিও চাইনি বাসা খুঁজতে খুঁজতে অবশেষে খোঁজে পেলাম বনশ্রীতে। ছোট্ট একটি ছিমছাম ঘর, দুজনের জন্য অবশ্য ভালই চলবে, আগাম টাকা দিয়ে আসলাম। বাড়ীওয়ালা বাড়ী ভাড়া দেয়ার সাথে আমাদের বিয়ের কাগজটাও সাথে নিল-পাছে যদি ঝামেলা হয় তা ভেবে।
তারপর শুরু হলো কেনাকাটা, মাসের প্রথমে বাসায় উঠলাম, ঘরে জিনিস বলতে ছিল আমার স্বামীর ব্যবহার করা খাট, তোষক, রান্না করার জন্য কিছু হাড়িপাতিল আর আমার কেনা কিছু থালা, বাটি, গ্লাস। আমি বাসায় এসে দেখি আমি আসার আগেই বাসা গুছিয়ে ফেলেছে, ভেবেছিলাম রান্না ঘরের জন্য আমার পছন্দ মত সুন্দর দুটো চুলা কিনব, কিন্তু সেই আশা পূরন হলো না আমার। রান্নাঘরে গিয়ে দেখি সেটাও কিনে ফেলেছে, জিজ্ঞেস করলাম কত দিয়ে কিনলে? উত্তর দিল পছন্দ হয়নি তোমার? চারশ টাকা দিয়ে কিনেছি। প্রতিত্তর দিলাম হয়েছে, হয়নি বলে মন খারাপ করে দিতে চাইনি, আমার উত্তর শুনে খুব খুশি যে হয়েছে তা দেখেই বুঝতে পেরেছি।
তেমন জিনিস ছিলনা তাই গোছাতে বেশি সময় লাগলনা। গোছানো শেষে আমায় বলল, আমি দোকান থেকে চাল, ডাল, আলু নিয়ে আসি। যে বাসায় ভাড়া ছিলাম, সেই বাসার নিচেই মুদির দোকান ছিল, সেজন্য নিয়ে আসতে সময় লাগলনা, ১০ মিনিট পরে ফিরে এসে বলল- ভাত আর ডাল হলেই চলবে। আমি ভাত, ডাল আর আলু ভাজি করলাম দুই চুলা ছিল বিধায় এক ঘন্টায় রান্না হয়ে গেল।
রান্না শেষে আমি বললাম গোসলে যাচ্ছি তুমি ল্যাপটপ ছেড়ে একটু খাবারের পানি দোকান থেকে নিয়ে এসো গোসল শেষ করে দেখি ল্যাপটপের সামনে বসে মুচকি হাসি দিচ্ছে। কারণ জিজ্ঞেস না করে সামনে গিয়ে দেখলাম আমার ব্লগের লেখার কমেন্ট দেখে পিট পিট করে হাসছে, আমি কিছু না বলে দুটো প্লেটে খাবার নিয়ে এসে বললাম- নাও ধর – খাও । আমায় উত্তর দিল, আমি খেতে পারবনা, আমি বললাম মানে? খাবেনা? বলল খাব!! তবে আমি পারবনা ব্যস্ত আছি দেখনা? তাহলে কি করব আমি? -ল্যাপটপের দিকে তাকিয়ে থেকেই আমায় বলল ‘তুই খাওয়ায় দিবি’ আমি মজার একটা পোষ্ট পড়ছি। আমার হাত মানে বৌ এর হাত, ঐ হাত দিয়েই খাব।
খাইয়ে দিচ্ছি, খাচ্ছে আর ব্লগের পোষ্ট পড়ে হাসছে, কমেন্ট লিখছে, আর আমায় কমেন্ট লেখার ফাঁকে ফাঁকে বলছে তুইও খাঁ। শেষ পর্যন্ত ঐদিন ট্যাপের পানিই খেলাম। লাইট জ্বালিয়ে আমার ব্লগের সামনে বসে হাহাহাহা হাসি আর থামছেনা তাই বেশ আগ্রহ নিয়েই চোখ বুলালাম।
এরপর আমিও হাসছি, আমার হাসি দেখে বলে তুই হাসস কে?? আমি হাসতে হাসতে আর বলতেই পারছিনা যে আমিও লেখাটা পড়েই হাসছি। এখন আমার ঘুমানোর পালা। ঘুমাতে গিয়ে দেখি মশার কামড় কাকে বলে, মশারি নাই, তার মধ্যে কয়েলও নেই। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে আমার মশা মারার শব্দ শুনে বলে—কি হলো তর। আমি বলি কিছুনা। সকাল হলো-অফিস যাওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে গেল-আমি তাড়াতাড়ি করে ডিম দিয়ে ভাত ভাজি করছি, বাথরুম থেকে ডাক আসল-বউ, বউ তোওয়ালে দে, দৌড়ে এসে তোওয়ালে দিলাম। গোসল সেরে এসে দেখলো তাঁর কাপড় রেডি, নাস্তাও রেডি- কাপড় পড়ছে আর বলছে-খাওয়ায় দে বউ। খাওয়ালাম, আবার বলে বসল চা খাব, চা দিলাম এরপর ল্যাপটপ ব্যাগে ভরে দরজা খুলে বিদায় দেওয়া না পর্যন্ত আমার ছুটি ছিলনা, গেইটের বাইরে চলে গেলেও তাকিয়ে থাকতাম যতক্ষন গেইটের নিচ দিয়ে পা দেখা যেত ততক্ষন।
এরপর চলত আমার সংসারের কাজ, বাজারে যাওয়া, ঘরের জিনিস পত্র কেনা—সোফা কেনার পর্যাপ্ত পরিমান টাকা ছিলনা। তাই আমি বসার ঘরে বড় ছোট মিলিয়ে প্রায় অনেক গুলো কুসন আর কার্পেট কিনে বসার ঘরটা সাজিয়ে ফেললাম। সন্ধ্যায়, স্বামী ঘরে ফিরবে তাই সন্ধার আয়োজন সুপ কিংবা নুডুলস সাথে এক কাপ কফি সন্ধ্যার এই খাবার তার চাই। এরপর আবার ল্যাপটপ নিয়ে বসা মেইল, চেক করা, আমার ব্লগে পোষ্টের জন্য লেখা তৈরী করা, পোষ্ট দিয়ে কমেন্ট করা আবার হাসি শুরু ,খাওয়া দাওয়া ভুলে যেত, রাতের খাবারের কথা বললেই বলত পরে খাব। আর আমার হাঙ্গামা শুরু হতো। মুখে তুলে খাওয়ানো টা আমার নয় মাসের রুটিন হয়ে গিয়েছিল, মাঝে মাঝে আমি বলতাম হাতে খেতে মনে হয় ভুলে গেছ।
বিয়ের আগে আমি চাকরী ছেড়ে দিয়েছিলাম। আবার চাকরি শুরু করলাম টুরিজম একটা কোম্পানি তে, আমার অফিস শুরু হতো সকাল ৮টা থেকে, তাই ভোর সাড়ে পাঁচটায় ঘুম থেকে উঠে নাস্তা বানিয়ে চা রেডি করতাম, তাও আবার হাতে বানানো রুটি হতে হবে অন্যটা হলে চলবেনা, এরপর নিজে রেডি হয়ে অফিস যেতাম,এমনও দিন গেছে নাস্তা রেডি করে যেতে পারিনি, তাই অফিসে গিয়ে দু-ঘন্টার ছুটি নিয়ে বাসায় এসে নাস্তা রেডি করে খাইয়ে গেছি।
একদিন নাস্তা রেডি করে যেতে পারিনি তাই আবার ফিরে এসেছি বাসায়, দরজা চাবি দিয়ে খুলে ঘরে ঢুকতেই দেখি দরজার শব্দ পেয়ে চারণ আমার দরজার দিকে তাকাতে গিয়ে কোল বালিশ নিয়ে মশারির ফাঁক দিয়ে খাট থেকে ফ্লোরে পড়ে গেছে-কিন্তু ঘুমে চোখ দুটো খুলতে পারছেনা।
আর আমার হাসি ধরে রাখতে পারলাম না। আদো আদো গলায় জিজ্ঞেস করলো কে? আমি বললাম চোরের মা—আমারে বলে আল্লাহ ওয়াস্তে আমারে ঘুমাইতে দে। আমি বলতাম আমার ব্লগ নিয়ে রাত ৪টা পর্যন্ত বসে থাকলে তো তাই হবে।
আর এভাবেই আমি আমার ব্লগের সাথে পরিচিত হয়, পোষ্ট না দিলেও আমার স্বামীর সাথে বসে পোষ্ট, কমেন্ট গুলো পড়তাম আর আমিও হাসতাম, আর সেই সময় আমার স্বামীও নিয়মিত পোষ্ট দিত। ব্লগের সামনে বসে রাত ৩টা বাজিয়ে ঘুমাত, আর আমি রাগ করে লাইট নিভিয়ে দিতাম কিন্তু কোন কাজ হতোনা, মশার কামড় খেতে খেতে বলত বউ একটু জ্বালাই, ঘুমাই পড়ব, রাগ করিস না। আমি আর রাগ করে থাকতে পারতাম না। মাঝে মাঝে রাগ করে তার দিকের মশারিটা টানাতাম না, একদিন তাই রাগ করে টেনে মশারি ছিঁড়ে ফেলে মশারি ছাড়াই ঘুমলো, একটু পরে মশার কামড়ে বিরক্ত হয়ে বলে-উহ!উহ! আর বলতে ছিল আমার মত জামাই পাবিনা, তর ভাগ্য ভাল তাই আমি তর জামাই,বলে ঘুম থেকে উঠে সুঁই, সুতা নিয়ে মশারি সেলাই করছে, আমিও কিছুই বলিনি। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে তার রাগের কান্ড দেখে।
মনে মনে হাসতেছিলাম, কেননা পরের দিন ছুটির দিন ছিল। ছুটির দিনে ঘুম থেকে উঠে বাজার করে সারাদিন ক্যামেরা নিয়ে আসপাশের ছবি উঠাতো বারান্দা দিয়ে, কেননা আমাদের বাসার পিছনে বড় ফাঁকা জায়গা ছিল, ছবি উঠানোর সাবজেক্টের অভাব হতো না তাঁর। ছবি উঠাতে উঠাতে অনেক সময় রান্নাঘরের জানালায় এসে বলতো-বউ, খুব বেশি ব্যস্ত নাকি? একটু শসা কেটে, কাঁচা মরিচ লবন মিলিয়ে দে, দিতাম আবার একটু পরে এসে বলতো বউ দয়া করে একটু তেঁতুলের ভর্তা শুকনো মরিচ ভেজে বানিয়ে দে,বানিয়ে দিতাম কেননা আমি জানি এগুলো তার খুব পছন্দের। আমি রান্না ঘরে রান্না নিয়ে ব্যস্ত-আর উনি, রান্না ঘরে ঢুকে বলতো-ইলিশ মাছ ভাজা হয়নি??
অল্প ভাজা হলেই চুলা থেকে একটা মাছের টুকরো নিয়ে খাওয়া শুরু করতো, এরপর ল্যাপটপ নিয়ে মেইল চেক করে আমার আমার ব্লগের সামনে-আর বলতো মাছ ভাজা বাটিতে করে দিয়ে যাও এভাবে ঐ দিনে পুরো একটা মাছ শেষ হয়ে যেত।
গরু মাংস খুব পছন্দের, তাই যেদিন মাংস রান্না হতো-একটু সেদ্ধ হলেই রান্না ঘরে ঢুকে মাংস তুলে গরম মাংসটাই মুখে পুড়ে, গরমের জন্য ছটফট করত, এরপর বলতো মাংস কষানো হলে বাটিতে দিয়ে যা,এরপর দুপুরের খাবার নিয়ে আসার পর মাংস দেখে বলতো-রান্না টা হয়নি, আমি চেয়েছিলাম-ছোট ছোট গোল আলু দিয়ে ঝাল করে বেশি ঝোল দিয়ে গ্রামের মানুষের মত রানবি, আচ্ছা কি আর করব-??
খাই এখন খাওয়া, খাওয়া মানে আমাকে খাওয়ায় দিতে হতো, অনেক সময় গেছে, আমার হাতে খাওয়ায়নি দেখে রাগ করে না খেয়ে ঘুমাই যেত, ঘুম থেকে জাগিয়ে শেষ পর্যন্ত আমাকেই খাওয়াতো হতো। খেতে খেতে বলতো কাল অফিস থেকে আসার সময়-শিং মাছ নিয়ে আসব-শিং মাছ এতটাই প্রিয় ছিল যে-এক কেজি করে নিয়ে এসে বলতো বড় হাঁড়িতে ভিজিয়ে রেখে দে, প্রতিদিন ধনে পাতা দিয়ে শিং মাছের ঝোল চাই-আমি মাঝে মাঝে বিরক্ত হয়ে বলতাম-পারবনা।
আমি চাকরি করে ঘরে এসে প্রতিদিন কালো শিং মাছটাকে ঘষে ঘষে সাদা করতে, কিন্তু আমি মন থেকে বলতাম না, সে জানে আমি করে দিব। তার হাই ব্লাড প্রেশার, সাথে রক্তে কোলেষ্ট্রল, তাই আমি ডিম খেতে দিতাম না, আর চিল্লাচিল্লি করত ডিম খাওয়ার জন্য, আমায় বলত আমায় না খাইয়ে মারবি, একটু ভালমন্দ খেতে হয়, কেননা ডিম তার খুব প্রিয় ছিল।
মুখ ফুলিয়ে থাকত তেল ছাড়া খাবার আমি খাবনা বলে, ঔষধও খেতে চাইতনা, মাঝখানে পিঠে চুলকানি হয়েছে এলার্জির জন্য কিন্তু ঔষধ খাবেনা তাই ঔষধটা আমি গুড়া করে ভাতের সাথে খাইয়েছি,পরে বলত দেখসস-ঔষধ ছাড়াই ভাল হয়ে গেছে,আমি হাসতাম আর বলতাম-ঔষধ খেয়েছ তাই ভাল হয়েছে।
মাঝে মাঝে তুমুল ঝগড়া হতো আর ঝগড়ার বিষয় ছিল তার ফেইসবুকের বান্ধবী, এ বান্ধবী সম্পর্কে সে আমায় মিথ্যে বলেছিল, একটা সময় আমায় ফাঁকি দিয়ে কথা বলত ফেইস বুকের বান্ধবীর সাথে, প্রথমে ফেইসবুক, মেইল, পরে সেল ফোনে-আমার স্বামী বলতো তার সাথে আমার কোন সম্পর্ক নাই, কিন্তু একদিন মেয়েটাকে আমি ফোন করেছিলাম বলে আবার ফোন করে আমায় সরি বলিয়েছে-অবশেষে আমাদের সম্পর্কটায় ফাটল ধরে। আমি দূরত্ব তৈরী করার চেষ্টা করছিলাম, আর সেই সময় বুঝতে পেরে আমায় বিয়ে করেছিল আমায় হারানোর ভয়ে কিন্তু বিয়ের পর দেখতাম –মেয়েটা তাকে ফোন করছে, টেক্সট করছে, তা দেখে আমি তো ঝগড়া করবোই।কেননা মেয়েটা বেহায়ার মতো ফোন দিত,একটা সময় মেয়েটা আমায় বলেছিল-আপু! আপনার তো বিদেশ যাওয়ার কথা-তো ভাইয়ার সাথে আমি কথা বলি?? ভাইয়ার কি কি পছন্দ আর না পছন্দ আমায় বলবেন??? আমি ভাবতাম-শিয়ালের হাতে মুরগি বাগি দিয়ে যাব??
আর এটা নিয়ে যখন ঝগড়া হতো-আমি কান্নাকাটি করে লিভিং রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিতাম-আর আমার স্বামী গিয়ে দরজায় নক করে বলতো – দরজা খুল, আমার সামনে থেকে কানবি দরজা বন্ধ করে, না —দরজা না খুললে বারান্দা দিয়ে গিয়ে কলম, সিগারেটের প্যাকেট দিয়ে ঢিল মারত আর বলতো-খুল দরজা খুল। যতক্ষন পর্যন্ত না খুলবো ততক্ষন এরকম করতো, এ কদিন তো দরজার লক্টায় ভেঙ্গে ফেলেছিল-আরেকদিন এই বান্ধবী নিয়ে ঝগড়া করে আমিও তার সামনে ফোন করে আমার সহপাঠিকে বলেছিলাম চন্দ্রিমা উদ্যানে আস-আমিও আসছি আজ তোমার সাথে দেখা করব-আর এই কথা শুনে স্বামী আমার বললো কোথায় যাবি??
বলেই দুইটা থাপ্পর দিল, আমি কাদঁতে বলেছি তুমি পারলে আমি পারবনা কেন? ঝগড়া আধা ঘন্টা থাকত, পরে আবার হাসা হাসি, দুষ্টমি শুরু হয়ে যেত, কেননা আমি ৫ মিনিটের বেশি রাগ করে থাকতে পারিনা। আমি বলতাম কেন যে তোমায় বিয়ে করলাম, মাঝে মাঝে শুক্রবারেও অফিস করতো, যাওয়ার সময় বলে যেত-সাড়ে পাঁচটায় আমার অফিসের নিচে থাকিস-শিল্প কলায় যাব, প্রতি শুক্র বারে মঞ্চ নাটক দেখতে যেতাম, কালচারাল মনোভাব হওয়ায় সাধারণত এসব মিস করতনা, এমন দিন গেছে তার ভাবির কাছ থেকে টাকা ধার করে মঞ্চ নাটক দেখতে আমাকে নিয়ে গেছে। দিন আমাদের ভালই গেছে-দেখতে দেখতে আমার ভিসা হয়ে গেল—ভিসা পাওয়ার ৫ মাস পর বিদেশ পাড়ি জমিয়েছি ,আসার দুই মাস আগে থেকে আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করত,আর আমি কান্না কাটি করতাম।
অবশেষে প্রিয় মানুষটাকে রেখে আসলাম, কিন্তু পারলাম কই – ব্যাকুল হয়ে যেতাম একটা একটা সেকেন্ড, মিনিট, মনে হতো একেকটা যুগ- আমার দিনের অর্ধেক দিন আর আমার স্বামীর রাত কাটতো স্কাইপের সামনে বসে , সামনা সামনি কাঁচের ভিতর বসে একে অপরকে স্পর্শ করতে না পারার বেদনা কত যে মর্মান্তিক। আমায় যখন বলতো বউ আমি তোরে ছাড়া থাকতে পারবনা, তোর হাতে কতদিন খায়না, যখন দেখি কেউ নিজের বউ কে নিয়ে ঘুরছে আমি খুব কষ্ট পাই, হিংসে হয়, আমার বুকটা খালি খালি লাগে, ঘুমের ঘোরে ভুলে করে আমার হাত এখনো তরে বিছানায় খোঁজে, কেন সোলমেট হলি যদি আমার কাছে না থাকিস বউ এই মুহূর্তে আমার খুব দরকার তরে। আর আমি কান্নায় বুক ভাসাতাম- একপ্রান একআত্মা হলে আসলে আর দূরে থাকা যায়না—বিয়ে সংসার ভালোবাসা মানে একে অপরের পাশে থাকা, সহযোগিতা, সহমর্মিতা সহভাগিতা, ত্যাগস্বীকার করা। আমিও পারিনি আমার চারণক্ষেত্রও পারেনি-অবশেষে উন্নত দেশ বিলাস বহুল জীবন যাপন রেখে পাগলের মতো ফিরে এসেছি আমার চারণক্ষেত্রের কাছে যেখানে আমার আত্মার বাধঁন, যে আত্মায় আমার অস্থি মজ্জা নিমজ্জিত, যেখানে আমার সুখ, হাসি কান্না রাগ অভিমান লুকানো- যে আমার প্রকৃত চারণক্ষেত্র।।
লিখেছেনঃ শিশির দেশাই