নিশিদলে এখন পর্যন্ত হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। এবারও তেমন কিছু ঘটলো না। তবে ট্রিপ শেষে জুয়েলের বাম হাতের কব্জির দিকটায় বড়সড় একটি ক্ষত আবিষ্কৃত হলো। ক্ষত থেকে তখনো রক্ত ঝড়ছে। আর তুহিনের কনুইয়ের নিচ বরাবর চামড়ার সামান্য অংশ চেঁড়া। দূর্ঘটনাগুলো কখন, কিভাবে ঘটলো এ ব্যপারে কারো কোনো পরিষ্কার ধারনা নেই।

অবশ্য পুরো ট্রিপে আমাদের ভেতর এতটাই রোমাঞ্চ কাজ করেছে যে, নিজের দিকে কারো খেয়াল ছিলো না। কে কোথায় হুমড়ি খেলো, কোথায় আঁচর লাগলো এসব নিয়ে ভাবার সময়ই ছিলো না হাতে। আমরা আগে থেকে আঁচ করতে পারিনি ঠিক একটু পরের মুহুর্তে কী ঘটতে যাচ্ছে। ধারণা করতে পারিনি অন্ধকারের সুড়ঙ্গ ধরে আমরা সেঁধিয়ে যাবো পানি হাটার পাহাড়ি বনের ভেতর, একেবারে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে। একবারের জন্যও ভাবতে পারিনি রাতের বন্য ঘ্রাণে সম্মোহিত হবে নিশিদল। এই সম্মোহনী শক্তি আমাদের টেনে নিয়ে যাবে সীমান্ত রেখায়।আমরা  ভেবেছিলাম ময়মনসিংহের হালুয়াঘাটে যাবো। সেখান থেকে পানিহাটায়। বনের ভেতর ক্যম্পফায়ার করবো। সুযোগ হলে একটি মুরগি জোগাড় করে আগুনে ঝলসে খাবো। গারো পল্লীতে ঘুরবো, দেখবো তাদের রাতের জীবনযাত্রা। অবশ্য সাধারণ রোমাঞ্চকর পরিস্থিতির জন্য তৈরিই ছিলাম।
গল্পটা তাহলে শুরু থেকেই বলা যাক-

শুরুর দিকটা খুবই অস্বস্তিকর। সড়কপথে যানজট ভেদ করে হালুয়াঘাট পৌঁছতে রাত আটটা বেজে গেলো আমাদের। ঢাকা থেকে জাফর হায়দার তুহিন, মফিজুর রহমান রোমন ও সাইমুম সাদসহ চার নিশাচর এবং দুই নিশিপ্রার্থী আলমগীর কবির ও সাইফুল ইসলাম জুয়েলকে নিয়ে মোট ছয়জন রওয়ানা হয়েছিলাম। আর কিশোরগঞ্জ থেকে রওয়ানা হয়ে দুপুর একটায় হালুয়াঘাটে পৌঁছে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন নিশাচর আহমদ আমিন। সেখানে আমাদের অপেক্ষায় ছিলেন নিশিপ্রার্থী শেখ মোস্তফা আহমেদও। ভদ্রলোকের বাড়ি হালুয়াঘাট উপজেলায়ই। তিনি সম্পর্কে আমাদের কয়েকজনের দুলাভাই। তাই নিশিদলের বাকি সবার কাছেও দুলাভাই হিসাবেই পরিচিত হলেন।
দুলাভাইকেসহ এবারের দলটা হলো মোট আটজনের।

বাস থেকে নামার পর সবাই ক্লান্ত। চার ঘন্টার পথ সাত ঘন্টায় পাড়ি দিয়ে নেতিয়ে পড়েছে রোমন। বাস যাত্রায় সে অন্যদের তুলনায় একটু বেশিই কাহিল হয়ে যায়, এটা অস্বীকার করার নয়। তবে ওর মনের জোর আকাশচুম্বি। আর এই জোরের ওপর ভর করেই সে পাল্টে দিতে চায় সমাজের অসঙ্গতি। আঁধারে তৈরি করতে চায় নতুন এক অন্ধকার আতঙ্ক। ওর বিশ্বাস- অন্ধকারের কীটেরা কখনো আলোর মশাল দেখে আকৃষ্ট হয় না। ওরা আলোর নয়, কালোর পুঁজো করে। আবার কালোকেই ভয় পায়। মানুষের জন্য অন্ধকারের চেয়ে বড় বিভীষিকা আর নেই, এটাই রোমনের উপলব্ধি।

এই উপলব্ধি থেকেই মাঝে মাঝে উদভ্রান্ত হয়ে যায় রোমন। এটা ছাড়া আর কিছুই করার নেই তার। করার নেই আমাদেরও। তবে আমরা এতটুকু জানি যে, পৃথিবীর সব রঙ একসাথে মেশালে যে রঙটি হবে সেটা হলো কালো। কালো রঙই সব রঙের শক্তি ধারণ করে। তাই নিশিদল কালোতে বিচরণ করে। রাতের অন্ধকার দলের ভেতর প্রাণসঞ্চার করে।
হালুয়াঘাটের আবছা অন্ধকার দেখে প্রাণবন্ত হয়ে উঠলাম আমরা। বিশেষ করে তুহিনের চঞ্চলতাটা একটু বেশিই দেখা গেলো। তুহিন বরাবরই চাপা স্বভাবের, শরীরের ওপর দিয়ে ধকল গেলেও বাহ্যিক আচরণে প্রকাশ ঘটায় না। ওর মানসিক শক্তি প্রবল। কোনো কিছুতেই না নেই। দুঃসাহসিক ও বিপজ্জনক অনেক ক্ষেত্রেই তার ভ’মিকা প্রশংসনীয়। সে কারনেই নিশিদলের আর্থিক ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব ছাড়াও অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসাবে প্রতিরক্ষার দিকটিও তাকেই দেখভাল করতে হয়।

নিশিদল স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি দল। এখানকার সবাই নিজ নিজ দায়িত্বের ব্যপারে সচেতন। বিশেষ করে যথাযথভাবে দায়িত্বপালনের ক্ষেত্রে সাইমুম সাদের ভ’মিকা প্রশংসনীয়। যদিও একবার তুহিনের যোগসাজসে তার একটি বড় ধরনের দুর্নীতি প্রকাশ্য দিবালোকের মতো স্পষ্ট হয়ে ওঠেছিলো!  থাক, সেকথা নিয়ে ঘাঁটাঘাটি করতে চাই না। দলের ভেতরকার দূর্নীতি ও কোন্দলগুলো নিয়ে বাইরের লোককে মাথা ঘামানোর সুযোগ দেয়া উচিত নয়। বাইরের লোক কেবল এতটুকু জানবে যে, খাওয়া থেকে শুরু করে দলের প্রয়োজনীয় সব ব্যপারেই নিশিদল সচেতন এবং স্বয়ংসম্পূর্ণ।

আর স্বয়ংসম্পূর্ণ এই দলটিকেও এবার বাধ্য হতে হলো দুলাভাইয়ের আতিথেয়তা গ্রহণে। ব্যপারটি ছিলো আমাদের যাত্রাসূচির জন্য হুমকিস্বরুপ। তাই নিশাচর ও নিশিপ্রার্থীদের মধ্যে তখন অরণ্যচারনের প্রস্তুতি। সেই মুহুর্তে দুলাভাইয়ের বাড়ির অতিথি হওয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে ছিলো না কারো। বিশেষ করে আহমদ আমিন একেবারেই নারাজ। সেই দুপুর থেকেই তিনি হালুয়াঘাটে অবস্থান করছেন। এই দীর্ঘ অপেক্ষর পর একটি নিশি এবং অন্ধকারাচ্ছন্ন অরণ্যের মোহে তখন তিনি অন্ধ। অন্যদের অবস্থাও একই। তবু কিছু আহ্বানকে একেবারেই এড়ানো যায় না।

কুলিয়ে উঠতে না পেরে অনেকটা হঠাৎ করেই দুলাভাইয়ের বাড়িতে যেতে রাজি হয়ে গেলো আলমগীর। তারপর কেউ আর না করতে পারলো না। দুলাভাইকেসহ নিশিদলের আট সদস্য মোটর সাইকেলে করে রওয়ানা হলাম তার বাড়ি মাছাইল টঙ্গীঘাট গ্রামের উদ্দেশ্যে। মোট চারটি মোটরসাইকেল। সামনে চারজন চালক। এবং চালকের পেছনে দুইজন দুইজন করে ওঠে বসলাম আমরা আট যাত্রী। এ এলাকায় মোটরসাইকেলে করে যাত্রী বহন করা হয়। সড়ক, মহাসড়ক, কাঁচা-পাকা এবং কর্দমাক্ত ও পিচ্ছিল পথেও যাত্রীবাহি মোটরসাইকেল চলাচল করে।
হালুয়াঘাট থেকে ধারাবাজার হয়ে হাতের বাম দিকে মোড় নিলাম আমরা। ইট বিছানো পথে সার ধরে এগিয়ে চললো চারটি বাহন। সামনে আবছা অন্ধকার। হেডলাইটের আলোর দন্ডটা যখন অন্ধকারকে ভেদ করতে চাইছে, বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে কুয়াশা। আমরা ঢাকা থেকে রওয়ানা হবার আগে ওখানকার শীতের পরিমাণের ব্যপারে তেমন ধারণাই ছিলো না। আহমদ আমিন আগে থেকে শীতের ব্যপারে সাবধান করেছিলেন বলেই আমি পোশাকের নিচে হালকা একটি টি শার্ট গায়ে দিয়ে এসেছি। তুহিন অবশ্য সাথে করে ভারি পোশাকই নিয়েছে। মহাখালী বাস টার্মিনালে কটকটে সূর্য্যরে নিচে তার এ পোশাক নিয়ে আমরা হাসাহাসিও করেছি। ভেবেছি, ঢাকায় যেখানে ফ্যান ছেড়ে খালি গায়ে ঘুমাতে হয়, সে তুলনায় গ্রামে শীত নামলে আর কতটাই বা নামবে। কিন্তু দুলাভাইদের বাড়িতে যাওয়ার পর বুঝতে পারলাম কত ধানে কত চাল।

লাজ-লজ্জা ভেঙে প্রথমে উদ্যোগ নিলো হাফ হাতা গেঞ্জি গায় দেয়া রোমন। বেচারা নিজের জন্য দুলাভাইয়ের কাছে শীত পোশাক দাবি করেই বসলো। তারপর একে একে বাকি সবাই। কেউ নিরাশ হয়নি। সব শ্যলকের প্রতিই দয়াপরবশ হলেন দুলাভাই। কারো ভাগ্যে জুটেছে জ্যকেট, কারো সোয়েটার, চাদর। মোটামোটি বাড়ির সবার শীত পোশাকই দখল করে নিলাম আমরা। তবুও তারা এতটুকু বিরক্ত নন। বরং আমাদের ভালো-মন্দ’র কথা বিবেচনা করে নিজেদের উজার করে দিতে চাইছেন। চার-পাঁচ রকমের তরকারি দিয়ে ভরপেট খাইয়ে কৈফিয়ত দিলেন, ঠিকমতো খাওয়াতে পারলাম না। উষ্ণ ভালোবাসায় আমাদের আপন করে নিয়ে বললেন, ঠিকমতো যতœ করতে পারলাম না।
একসময় এই চিত্রটাই ছিলো গোটা বাংলাদেশের। কিন্তু দিন যাচ্ছে আর যান্ত্রিকতার খাপে বন্দী হয়ে মানুষগুলোও এখন যন্ত্রের মতো চলে। মানুষের মন থেকে ক্ষয়ে যাচ্ছে ¯েœহ ও শ্রদ্ধার মতো বিষয়গুলোও।

তবে অনেক অনেক দিন পর, সত্যিকারের শ্রদ্ধায় বিগলিত হলাম আমি। কেবল আমি নই, দলের সবাই বিগলিত হলো দুলাভাইয়ের চাচা আকামুদ্দিনের হাতের  উষ্ণতায়।
লাঠিতে ভর করে এসে তিনি আমাদের খাওয়ার টেবিলের পাশে বসলেন। আমাদেরকে খুশি করার জন্য দলের সবার সাথে খেতেও বসলেন। প্রোঢ় এই ভদ্রলোক আমার মাথায় হাত রাখলেন, হাতের উষ্ণতায় অবনত হয়ে এলো মাথা। তারপর এক এক করে  বর্ষণ দিলেন সবার চোখে।  শ্রদ্ধায় অবনত হলো নিশিদলের কয়েকজোড়া চোখ।
নিশিদল সম্পর্কে তেমন ধারণা নেই তাঁর। শুধু এতটুকু জানেন, আজকের রাতটা আমরা বাইরে বাইরে কাটাবো। তাই আমাদের কাজে আসতে পারে এমন কিছু তথ্যও দিলেন নিজের অভিজ্ঞতা থেকে। আমরাও প্রশ্রয় পেয়ে তার সাথে জমিয়ে আলাপ করলাম।

তাদের বাড়ির সামনের আঙিনাটা পেরিয়ে বায়ে মোড় নিলে একটি মেঠো পথ। এ পথ ধরে একটু এগুলেই চোখে পড়বে গারো পল্লী। জন্মের সময় থেকেই এ পল্লীটা দেখে আসছেন তিনি। শুধু তাই নয়, তাঁর বাপ-দাদারাও বড় হয়েছেন এই উপজাতি নৃ গোষ্ঠীর প্রতিবেশী হয়েই। ছোটবেলায় তিনিও গারোদের সাথে স্কুলে পড়েছেন। একসাথে মিলেমিশে খেলেছেন। এর ওর বাড়িতে আসা যাওয়াও করেছেন। এখনো করছেন। তবে আগের চাইতে এখনকার সময়টা অনেক তফাৎ। এখন গারোরা ভ’লে যাচ্ছে নিজস্ব আচার। এদের গতর থেকে হারিয়ে যাচ্ছে নিজস্ব ধাঁচের পোশাক। এরা লেখাপড়া করছে, চাকরি নিচ্ছে। বরং অনেক বাঙ্গালী পরিবারের চেয়ে গড়পরতায় এদের আর্থিক অবস্থা উন্নত।

তিনি জানালেন বর্তমানে এই গারো পল্লীতে সাত-আট শ’ ভোটার রয়েছে। হালুয়াঘাটের অনেক গ্রামেই গারোদের বসতি। সমতলে, পাহাড়ে যেখানেই বসত হোক না কেন, বৈশ্বিক পরিবর্তনের যুগে এরাও ধীরে ধীরে হয়ে উঠছে যান্ত্রিক। এদের পাশে আছে অনেক বিদেশী সহায়তা সংস্থা। আছে খ্রিস্টান মিশনারি। এখন সবাই বড়দিন পালন করে। খ্রীস্টান রীতি অনুযায়ী অন্যান্য উৎসবেরও আয়োজন করে জাকজমকভাবে। তবে কবে থেকে এরা খ্রীস্টান ধর্মে দীক্ষ্মিত হয়েছে এর সঠিক তথ্য তাঁর জানা নেই- আমরা ছোটবেলা থেকেই দেখছি হ্যরা খ্রীস্টান। আমাদের বাপ-চাচারাও হ্যদেরকে বড়দিন পালন করতেই দেখছে।

এই অমীমাংসিত প্রশ্নের মিমাংসার স্বার্থে এগিয়ে এলেন দুলাভাই- এরা আগে কালিপূজা করতো। কট ন্যঙটি পড়তো।
কিন্তু কবে থেকে এই কট ন্যঙটি আর কালিপূজার আচার পরিবর্তন হয়েছে এই তথ্যটা অজানাই রয়ে গেলো।
অবশ্য অজানা অনেক বিষয়ই আমরা আগে থেকেই জেনে নিয়েছিলাম। এই যেমন- ‘হালুয়াঘাট’ নামের ইতিহাস।

কী কারণে এমন অদ্ভ’ত একটি নাম হতে পারে!
ওখানকার লোকজন কী কেবল হালুয়া খেতে পছন্দ করে?
নাকি ওরা হালুয়া তৈরিতে পাকাপোক্ত?
ওসবের কিছুই নয়। মূলত যারা হাল চাষ করে তাদেরকে বলা হয় ‘হালুয়া’। ধারণা করা হয় এ এলাকায় নদীর ঘাটে একসময় হালচাষিরা এসে বসতি শুরু করে, তাই এর নাম হয় হালুয়াঘাট। আবার অন্য একটি ধারণা রয়েছে যে, ‘হালুয়া’ নামের এক চাষির নামানুসারেই ‘হালুয়াঘাট’ নামটির উৎপত্তি।

আমরা খাওয়ার পর্ব শেষ করলাম। শরীর ভারি হয়ে এলো। ঝিমুনিতে পেয়ে বসলো নিশিদলকে। এমনটা আগেই ধারণা করেছিলাম। তাই সাথে করে নিয়ে এসেছিলাম বিশেষ ধরনের কফি। আশ্চর্য্য ক্ষমতাধর এই কফি আমি পেয়েছিলাম নিশিদলের পর্যবেক্ষক ও সমালোচক সাবরিনা সোবহানের কাছ থেকে। ওগুলো দেখতে অনেকটা চা পাতার মতো। পানিতে সেদ্ধ করে তৈরি করতে হয়। খাওয়া মাত্র ঝিমুনি তো দূর হয়ই। গাঁটের ব্যথা, গিঁটের ব্যথাও উধাও হয়ে যায়।

আমরা কফি খেয়ে গাঁটের ব্যথা, গিঁটের ব্যথা উধাও করলাম। তারপর চাঙ্গা শরীর নিয়ে আবার রওয়ানা হলাম হালুয়াঘাটের উদ্দেশ্যে। মোটরসাইকেলে চড়ে ধারাবাজার পর্যন্ত যেতে পারলাম। এর পরের পথটুকু যাওয়ার জন্য ওদের সাথে বনিবনা হলো না। রাত তখন এগারটা ছুঁই ছুঁই। তারিখটা ছিলো ৮ নভেম্বর, শুক্রবার (২০১৩)। ধারাবাজার থেকে পানিহাটায় পৌঁছুতে হলে আরো বিশ-বাইশ কিলোমিটার পাড়ি দিতে হবে।

পানিহাটা গ্রাম হালুয়াঘাট উপজেলায় নয়, ওটা শেরপুরের নালিতাবাড়ি উপজেলার সীমান্তবর্তী একটি গ্রাম। শেরপুর জেলা শহর থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার সোজা উত্তর দিকে নাকুগাঁও স্থলবন্দর। তার পাশেই ভোগাই নদীর সেতুর ওপর দিয়ে প্রায় দুই-তিন কিলোমিটার যাওয়ার পর ঘন সবুজ পাহাড়ি গ্রাম পানিহাটা ও তারানি। আমরা শেরপুর থেকে নয়, হালুয়াঘাটের ধারাবাজারে এসে স্থির হয়েছি পানিহাটায় যাবো বলে। এখান থেকে যাত্রার একটি সুবিধা হচ্ছে, ভারতের সীমান্ত ঘেঁষে পাহাড়, জঙ্গলের ভেতর দিয়ে অনেকটা পথ যাওয়া যাবে।
পানিহাটার পাশ দিয়েই বয়ে গেছে পাহাড়ি নদী ভোগাই। এই জলসীমা ছাড়াও বনের ভেতর অঙ্কিত হয়েছে বাংলাদেশ-ভারত সীমারেখা। ওখানে কোনো কাঁটাতারের বেড়া নেই। সীমান্তের ওপারে ভারতের মেঘালয় রাজ্য। ওপাশের পাহাড়ি এলাকাগুলো মেঘালয়ের তুরা জেলার অন্তর্গত। আর এ পাশের পানিহাটা আমাদের শেরপুর জেলায়।

আমাদের জানা আছে, রাতের অন্ধকারে ভারতের তুরা এলাকার পাহাড় থেকে নেমে আসে বন্য হাতি। ওরা সীমান্ত পেরিয়ে ধ্বংসযজ্ঞ চালায় পানিহাটা, তারানি ও পেকামারিসহ কয়েকটি গ্রামে। পত্রপত্রিকায় পড়েছি, বন্য হাতির আক্রমনে অসংখ্য লোকের মৃত্যুর খবর। হাতির পাল এক রাতের ভেতর নস্ট করে দেয় মৌসুমজুড়ে আবাদ করা কৃষকের ফসলি জমি, ভেঙে তছনছ করে বসতঘর। সবই আমাদের জানা।

তবুও আমরা যাবো। রাতের অন্ধকারেই যেতে হবে আমাদের।
কিন্তু কিভাবে?
খুঁজতে গিয়ে খেয়াল করলাম, কোনো বাহন নেই। পানিহাটা তো দূরের কথা, ওখান থেকে হালুয়াঘাট যাওয়ার মতো বাহনও পাওয়া যাচ্ছে না। অথচ একটু আগেই ছিলো। ছিলো মানুষের আনাগোনাও। মুহুর্তের ভেতর ভোজবাজির মতোই ফাঁকা হয়ে এলো জমজমাট ধারাবাজার!
ঠিক করলাম, আগে অন্তত হালুয়াঘাট যাওয়া যাক। তারপর সেখান থেকে চেষ্টা করা যাবে।
অপেক্ষায় রইলাম বাসের জন্য। বাস এলো বটে, তবে আমাদের কাছাকাছি এসে ওটার গতি যেন দ্বিগুণ হয়ে গেলো। সাথে সাথেই মিইয়ে গেলাম আমরা। এরপর কয়েকমুহূর্ত অপেক্ষা। কিন্তু বাসের দেখা নেই। এমন কোনো বাহনও নেই, যা দিয়ে অন্তত হালুয়াঘাট যেতে পারি। কিছু সময়ের মধ্যেই পুরোপুরি খালি হয়ে এলো ধারাবাজার। হাতে সময়ও কম। আমরা ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না, এখানে অপেক্ষা করবো, না কি করবো। বুকের ভেতর শুরু হলো ঢিপ ঢিপানি। তাহলে কি আমরা পানিহাটায় যেতে পারছি না?
পানিহাটায় যেতে হলে প্রথমে যেতে হবে হালুয়াঘাট। তারপর সেখান থেকে আবার নতুন করে শুরু করতে হবে বাহনযুদ্ধ। ধারাবাজার থেকে হালুয়াঘাটের দূরত্ব পাঁচ কিলোমিটারের মতো।

এই পথটা যাবো কিভাবে?
এতটা পথ কী হাঁটার ঝুঁকি নেবো?
মনে হয়ে গেলো টাঙ্গাইল ট্রিপের তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা। তবে এই ভেবে সাহস পেলাম যে, ওখানে উপুষ পেটে হেঁটেছিলাম খাবারের সন্ধানে। আর এখানে সবার ভরপেট।
কিছুক্ষণের জন্য বোবা হয়ে গেলাম আমরা। চোখ চাওয়াচাওয়ি করলাম। জুয়েলের দিকে তাকিয়ে মায়া হলো। পাঁচ কিলোমিটার হাঁটার পর বেচারার নাদুস-নুদুস শরীরটা কী আর অবশিষ্ট থাকবে?
তাকালাম সাদের দিকে, ছিপছিপে শরীর নিয়েও সাহস দেখালো সে। সাহস দেখালেন দুলাভাইও। আহমদ আমিন, আলমগীরকে নিয়ে কোনো দ্বীধা নেই। আর তুহিন এবং রোমনের ব্যপারে প্রশ্ন তোলাই অন্যায়।
সুতরাং, পা চালাও।

মুহূর্তসময় দ্বীধা না করে দখল করে নিলাম রাজপথ। পেশী টান টান করে আটজোড়া পা এগিয়ে চললো ধারাবাজারকে পেছনে রেখে।
একবারের জন্যও পেছনে দৃষ্টি দিলাম না। বাজারের ল্যম্পপোস্টগুলো পেরিয়ে ঢুকে গেলাম অন্ধকারে। পা যখন চালাতেই হবে, তখন কোনো দ্বীধা নয়। নয় কোনো পিছুটান।
আমাদের সামনে অন্ধকার। দলের সাথে আছে দু’ দুটো টর্চ লাইট। হাতের টর্চগুলো যখন অন্ধকারকে ভেদ করতে চাইছে, তখন কুয়াশাগুলো সাদা রঙের চাদর তৈরি করছে। কালো অন্ধকার আর কুয়াশা ছাড়া আশপাশে কিছুই নেই। নেই জনমানব।

রাজপথে আছে কেবল নিশিদলের আটজোড়া পা। আর এই পাগুলোই বহন করে নিয়ে চলেছে শীতপোশাকে আবৃত আট হন্টকের ভারি শরীর।
কিন্তু হঠাৎ আমাদের থামতে হলো। ঘড়িতে তখন রাত এগারটা বেজে তিরিশ মিনিট। একটা ছায়ামূর্তির আগমনে চমকে উঠলাম আমরা। বাম দিক থেকে এলো লোকটা। আমার চোখ ভুল না করলে যা দেখলাম, দুলাভাইয়ের পথটা আগলে দাঁড়ালো সে।

দলের সবাই বিষ্মিত। এক লাফে আমি এগিয়ে গেলাম দুলাভাইয়ের দিকে। তারপর যেদিক থেকে লোকটা এলো, তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে একবার তাকালাম সেদিকে। কিন্তু সড়কে সন্দেহজনক অন্য কাউকে দেখলাম না। তারপর চোখ রাখলাম দলের মাঝ বরাবর দাঁড়ানো লোকটার ছিপছিপে গড়নের দিকে। বয়স বত্রিশ কি চৌত্রিশ হবে। পরনে প্যন্ট। গায়ে জ্যকেট। পরিশ্রমী গড়ন। দুই চোয়ালে খানিকটা ভাঙ্গনের খাঁজ। ছিপছিপে হলেও চর্বিহীন শরীরটা পেশীবহুল।
ধারণা করেছিলাম এই পেশীশক্তিটাই হয়তো প্রদর্শন করবে সে। কিন্তু কথা বলার ভঙ্গির মধ্যে সরলতার ছাপ ফুটে উঠলো- আপনেরা যাইবাইন কই?
পরিস্থিতি সামলে নেয়ার চেষ্টা করলেন দুলাভাই- আপাতত হালুয়াঘাট যেতে পারলেই হয়।
লোকটার পক্ষ থেকে আগ্রাসী কোনো আচরণ না দেখে তাকে একরকম ঘিরে দাঁড়ালাম সবাই। কিন্তু মোটেও বিশ্বাস করতে পারলাম না।
হালুয়াঘাট কি রাইতের বেলা হাইটা যাইতে পারবাইন?
আমরা পাত্তা দিতে চাইলাম না তার কথায়।
না না, এইটা হয় না। আমার এলাকা থেইকা আপনারা হাইটা যাইবাইন!
ভ্রু কুঁচকে এলো আমাদের।

উহু, এইটা কোনো কথা হইল? আমার সামনে যহন পইরা গেছুইন, আপনাগোরে হাইটা যাইতে দিমু না। আল্লাই একটা না একটা ব্যবস্থা করবো। আসেন আমার লগে।
আমাদের অবিশ্বাস আরো বেড়ে গেলো। মুখ চাওয়াচাওয়ি করলাম সবাই। লোকটা আমাদের মনের অবস্থা পড়তে পারলো কি পারলো না সেটাও বোঝা গেলো না। সে অনর্গল কথাই বলে যাচ্ছে। এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। বাহনের সন্ধান করছে। আর একটু পর পর খেদুক্তি ঝাড়ছে- ধূর, একটু আগেও তো বাস আছিলো। অহনতো কিছুই দেখি না।
আমরা সন্দেহের চোখে তাকিয়ে থাকলাম কিছুক্ষণ। তারপর লোকটা ইশারা করলো তাকে অনুসরণ করতে। কি কারণে যেনো সবাই অনুসরণও করতে শুরু করলাম। সম্ভবত সন্দেহের দোলাচালেও একটি ক্ষীণ আশা কাজ করছিলো, যদি একটি বাহন পেয়েই যাই। তাছাড়া আরো একটি ভরসা কাজ করলো, সংখ্যায় আমরা আটজন। এই ছায়ামানবের কোনো বদ মতলব থাকলেও, আটজনের সাথে কুলিয়ে ওঠা একেবারে সহজ হয়ে উঠবে না।

আমাদের দলটাকে নিয়ে কিছুক্ষণ এদিক ওদিক উদভ্রান্তের মতো পায়াচারি করলো লোকটা। তারপর ইশারায় ডাকলো মহাসড়কের ওপর বিছানো অন্ধকারের দিকে। মুখে বললো- আমার লগে লগে আইয়ুইন। আমার বাচ্চাডা অসুস্থ। বাড়িত ওষুধটা দিয়া আই।
আমরাও বোকার মতো ওর পিছু পিছু এগিয়ে গেলাম সড়ক ধরে। ও আগে আগে হাঁটছে। মিনিট চারেক এগুতে হলো আমাদের। তারপর সড়ক থেকে একটি মেঠো পথ ধরে নেমে গেলো লোকটা। মুখে উচ্চারণ করলো- আপনারা দাঁড়ান। আমার দেরি অইবো না।
ড্যবড্যবে চোখ নিয়ে দাঁড়িয়েই থাকলাম আমরা। আর প্রস্তুত রইলাম যে কোনো ধরনের বিপদ মোকাবেলা করার। বিপদটা কি ধরনের হতে পারে তা নিয়েই আলোচনা চলছিলো।
এরি মধ্যে দূরে একটি কুঁড়ে থেকে ঠিকড়ে আসা বৈদ্যুতিক আলোয় লোকটার ছায়া দেখা গেলো। হাঁপাতে হাঁপাতে ফিরে আসছে সে। পেছন থেকে ভেসে এলো মহিলা কণ্ঠ- এতো রাইতে কই যাইতাছ তুমি?

জবাব দিলো লোকটা- আরে, কাম আছে। ঠিকমতো ওষুধগুলা খাওয়াইয়ো।
আপনার বাচ্চা অসুস্থ নাকি? জিজ্ঞেস করলো আলমগীর।
হ, আতকা মাইরা অসুখ অইয়া গেছে। জ্বরে চিকরাইতাছে।
বাচ্চা অসুস্থ রেখে আপনাকে আসতে হবে না। বাড়িতে যান।
আরে, ওইসব নিয়া চিন্তা কইরেন না। বাড়িত পরিবার (স্ত্রী) আছে না।
তারপর আবার উদভ্রান্তের মতো হাঁটা ধরলো ধারাবাজারের দিকে। আমরা তখনো তার পিছু নিলাম। বাজারের কাছাকাছি এসেই বললো- আপনেরা একটু খারইন। আমার ভাইগনার একটা গাড়ি আছে। দেহি ওইটা ম্যানেজ করতে পারি কি না।
আপনার ভাইগনা কি জেগে আছে?
জাইগা না থাকলে ঘুমেত্তে ডাইকা তুলুম। বিপদে তো মানুষই পরে। আর মানুষইতো মানুষেরে বিপদ থেইকা উদ্ধার করে। আমারে কি মানুষ মনে অয় না।
সেই মুহুর্তে সত্যি সত্যিই মানুষের মতো মানুষ মনে হলো লোকটাকে। আমরা তাকিয়ে থাকলাম তার দিকে। কিন্তু মোটেও সময় অপচয় করতে রাজি নয় সে। আবার একটি মেঠো পথ ধরে হারিয়ে গেলো। ফিরেও এলো কিছুসময় পর। সাথে করে নিয়ে এলো ভাইগনাকে। যদিও দেখে মনে হলো মামার চেয়ে সে কমপক্ষে পাঁচ বছরের বড়।
লোকটার নাম নাজমুল। আর তার ভাইগনা গাড়িচালকের নাম ছাইদুল। মিনিট দশেকের মধ্যেই গাড়িটাও সড়কে নিয়ে এলো ছাইদুল।
দেখতে বড়সর একটি লেগোনার মতো। সামনের দিকটায় ডিজেল ইঞ্জিন। পানি সেচের এই ডিজেল ইঞ্জিনটিই টেনে নিয়ে যায় পেছনের বডিটাকে। এই গাড়িকে একেক এলাকায় একেক নামে ডাকা হয়। কোথাও নছিমন, কোথাও করিমন। আবার কোথাও বা টমটম।
আমরা একে নছিমন নামেই ডাকলাম। প্রথমে ঠিক হলো, এই নছিমনটি আমাদেরকে হালুয়াঘাট পর্যন্ত দিয়ে আসবে। তারপর নাজমুলই জিজ্ঞেস করলো, হালুয়াঘাটের পর আমরা অন্য কোথাও যাবো কি না?

আমরা আমাদের গন্তব্য পানিহাটার কথা জানালাম।
ছাইদুল জানালো, এখন কেবল পানিহাটা কেন আমরা যদি তাকে নিয়ে গোটা বাংলাদেশ ঘুরে বেড়াই তবু তার কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু ইঞ্জিনে যতটুকু তেল আছে, তাতে বড়জোর হালুয়াঘাট পর্যন্ত যাওয়া যাবে।
প্রথমে তেমন হতাশ হলাম না। ভাবলাম হালুয়াঘাট যাওয়ার পর একটা না একটা বাহনের ব্যবস্থা হবেই। কিন্তু নাজমুল যা জানালো তাতে হতাশা আরো ঘিরে ধরলো আমাদের। হালুয়াঘাটে বাহন পাওয়া যাওয়ার সম্ভাবনা নাকি একেবারেই শূন্যের কোঠায়। বরং রাস্তায় যদি কোনো তেলের দোকান খোলা থাকে, তবে সেখান থেকে তেল নিতে পারলে ছাইদুলের নছিমনে চড়েই পানিহাটায় যেতে পারবো আমরা।
ভাগ্য প্রসন্ন ছিলো। হালুয়াঘাট অতিক্রম করে কিছুদুর যাওয়ার পরই একটি দোকান খোলা পেলাম এবং তেল নিয়ে নিলাম।
এবার পানিহাটা আমাদের হাতের মুঠোয়।
নছিমনে চড়ে বসার পর থেকেই অদ্ভ’ত একটি ফুরফুরে ভাব চলে এসেছিলো পুরো দলে। আর এই ভাবটি প্রথম তৈরি করেছিলেন আমাদের দুলাভাই শেখ মোস্তফা আহমেদ।
গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে জেড আকৃতির হাতল ঘুরিযে ইঞ্জিন স্টার্ট করলো ছাইদুল। তার পাশে ওঠে বসলো নাজমুল। সেও আমাদের সাথে যাবে পানিহাটায়। তারপর অন্ধকার ভেদ করে চলতে শুরু করলো নছিমন। ইঞ্জিনের ধুকপুকানি ছাড়া কানে আসছিলো বাতাস কেটে যাওয়ার সাঁ সাঁ শব্দ। এছাড়া চারদিক স্তব্ধ। নিশিদলের চোখের সামনে একটি স্বপ্ন। পানিহাটার পাহাড়ি জঙ্গল।
ঠিক তখনি পরিবেশটা পাল্টে দিলেন দুলাভাই।

প্রথমে দুই হাতে দুটি তুড়ি বাজালেন। তারপর গলা ছেড়ে ধরলেন দ্রুত তালের একটি গান। উজ্জীবিত হলো নিশাচর ও নিশিপ্রার্থীরা। শুরু হলো ছন্দে ছন্দে তালি বাজানো।
এই তালিয়া তবলায় ছেদ পড়লো সেকেন্ড পাঁচেক পরই। আচমকা থেমে গেলো নছিমন। চালকের পাশ থেকে নেমে আসতে দেখলাম নাজমুলকে। তারপর উঠে বসলো আমাদের সাথে। জানালো সেও গান গাইবে। আমাদের উষ্ণ অভ্যর্থনা পেয়ে গলা ছাড়লো- মা……../ তুমি আমার আগে যেয়ো নাকো মরে/ অনেক আদরের ছেলে আমি তোমার/ আমায় একলা ফেলে যেয়োনাকো চলে …
বিষণœ একটি রেখা এঁকে গেলো মনে। নিশিদলে নেমে এলো থমথমে আবহ।
নাজমুলের এই অবুঝ আবেদনের সূঁতো ধরে আমরা হারিয়ে গেলাম মায়ের আাঁচলে। মা ছাড়া পুরো পৃথিবীটাই শীতল, নিষ্ঠুর। এই নিষ্ঠুর জগতে মায়ের উষ্ণতা অবিনশ্বর নয়। ¯্রস্টা মানুষকে ক্ষমা করেন, কিন্তু সময় কাউকে ক্ষমা করে না। সময়ের ভাঁজে ঘুরপাক খেয়ে মানুষগুলোকে হারিয়ে যেতে হয়। চলে যেতে হয় মাকেও।
এই বাস্তবতা এড়ানো যাবে না সেটা আমাদের জানা। অস্বীকার করা যাবে না ভাগ্যকেও। তবুও আমার ভেতরটা অস্থির হয়ে উঠলো। ¯্রস্টার কাছে স্বার্থপরের মতো চাইলাম- আমি আমার আম্মাকে হারাতে চাই না। হারাতে চাই না আব্বাকে। তাদের আগেই হারিয়ে যেতে চাই কালের ধূলোয়।

নাজমুলের হৃদয়ছেঁড়া গানে কোরাস ধরলো সবাই। তার সুর, তাল এবং কণ্ঠ চমৎকার। তবে উচ্চারণ তেমন যুতসই নয়। ছোটবেলায় শিল্পী হতে চেয়েছিলো নাজমুল। বড়বেলায়ও অনেকে বলেছে, একসময় সে বড় শিল্পী হবে। কিন্তু সেই একসময়টা আর হাতের নাগালে এলো না। এখন হালুয়াঘাট বাজারে পানের দোকানদারি করে সে- লেহাপড়া করতে পারি নাই। দরিদ্রর সাথে বড় অইছি। অহনো দরিদ্রর সাথেই আছি। কিন্তুক ভাই মনডা আমার ছোডো না। গরীবের মন বড় থাকে।
সত্যিই নাজমুলের বিশাল মন। নয়তো এই রাতের বেলায় অসুস্থ সন্তানকে রেখে একদল অনাহুত আগন্তুকের পাশে দাঁড়াবে কেন? নাজমুলের এই পাহাড়ছুঁয়া মনের পরিচয় পেয়ে, তাকে নিশিদলের একজন হিসাবেই ধরে নিলাম আমরা। এবং নিশিদলীয় রীতি অনুযায়ী তখন থেকে সেও একজন নিশিপ্রার্থী।
আচমকা নিশিপ্রার্থী নাজমুলকেসহ এবারের যাত্রায় আমাদের সংখ্যা এসে দাঁড়ালো নয়তে। পাঁচ নিশাচর এবং চার নিশিপ্রার্থী। সবাই প্রাণবন্ত হয়ে উঠলাম নাজমুলকে নিয়ে।
ইঞ্জিনের ধুকপুকানি চলছে। পিচঢালা সড়ক ধরে হেডলাইটের আলোয় এগিয়ে চলছে নছিমন। এছাড়া পুরো এলাকাটা অন্ধকারে ঢাকা। আর আমরাও দু’টি সারি করে ডুবে আছি নছিমনের ভেতরকার অন্ধকারে। হঠাৎ হঠাৎই জ্বলে উঠছে নিশিদলের দুই দুটি টর্চ। এই টর্চগুলো নাজমুলের গানের সাথে সামঞ্জস্য রেখে অনেকটা লেজার শো’র কাজেও দিচ্ছে। ও গলা ছেড়ে গাইছে- দয়াল তোমারো লাগিয়া যোগিনী সাজিবো গো…

গানের ভাঁজে ভাঁজে নছিমনজুড়ে ঝলকে উঠছে টর্চের আলো। আর হাতের তালিয়া- আমি একদিন তোমায় না দেখিলে/ তোমার মুখের কথা না শুনিলে/ পরাণ আমার রয়না পরানে …
রুপ সাগরে ঝলক মারিয়া/ কি রুপ মোরে দেখাইলি…
কয়েকটা জমজমাট গানের পর সে টান দিলো লোক সঙ্গীতে- পূবালি বাতাসে…/ বাদাম দেইখা চায়া থাকি…/ আমার নি কেউ আসে রে…/ আষাঢ় মাইসা ভাসা পানি রে…
কয়েকটা লোক সঙ্গীত ও হৃদয়ছেড়া গানের পর শ্রোতামহল থেকে দাবি উঠলো আরো একটি জমজমাট গানের। সাথে সাথেই হিন্দি একটি গানে টান দিলো নাজমুল- তেরে ইশ্কে মে…
এরপর থেকে যতবার জমজমাট গানের দাবি উঠলো ততবারই সে হিন্দি সুর তুললো। ওর ধারণা জমজমাট মানেই হিন্দি। কেবল নাজমুলের নয়, আমাদের দেশের একটা বড় অংশই হিন্দিকে গিলে খাচ্ছি। চেটে পুটে নিচ্ছি।

নাজমুল যখন সুর তুললো- তেরে ইশকিনা রাইফেল, ইশকিনা রাইফেল/ ওহু ওহু …
আমার হাতটা তখন নিজের অজান্তেই কপালে ওঠে গেলো। স্যলুট করলাম ভারতীয় সংস্কৃতিকর্মীদের। তাদের ভাষা, চলচ্চিত্র, টেলিভিশন ধারাবাহিক, গানের কথা এবং সুরে এতটাই শক্তি রয়েছে যে, আমরা নিজেদের অস্তিত্ত্ব খুঁজি তাদের ভেতর। আমাদের ভালোবাসা, আনন্দ-উচ্ছ্বাস আর বেদনার বহিঃপ্রকাশও ঘটাতে চাই তাদের মতো করেই। এটা অনেকের ক্ষেত্রে খাপ খেয়ে যায়। অনেকে আবার বাস্তবতার সাথে দ্বন্দে জড়াই। তখনই একটি মনের ঘরে তৈরি হয় একাধিক সত্ত্বা। আমি গাইলাম- তোমার ঘরে বসত করে কয়জনা মন জানো না…/ তোমার ঘরে বসত করে কয়জনা…/ তোমার ঘরে বাস করে কারা ওমন জানো না…/ তোমার ঘরে বসত করে কয়জনা…/ একজনে ছবি আঁকে একমনে ও…ওও.. ওমন/ আরেকজনে বসে বসে রঙ মাখে…

কোরাসের সাথে সত্যিকারের জমজমাট হয়ে উঠলো নিশিদল। এই গানটিই ঘুরে ফিরে চললো অনেকসময়। তারপর বিরতি না দিয়েই ধুমাদ্ধুম তালে রবীন্দ্রনাথের একটি কবিতাকেই গান বানিয়ে ফেললাম- আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে
সাথে বাজলো দুই আঙ্গুলের তুড়ি। ব্যস, কয়েকবার করে কোরাস উঠলো- আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে।
তারপর কোরাসটাকে টেনে নিয়ে গেলাম দ্বিতীয় লাইনে- বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে।
আবার তিনবার কোরাস উঠলো- বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে।
এবার কবিতাটা আপন গতিতে গান হয়ে ভাসতে লাগলো সবার মুখে- আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে/ বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে/ হাঁটু জল থাকে রে.. হাঁটু জল থাকে।/ পার হয়ে যায় গরু পার হয় গাড়ি/ দুই ধার উঁচু তার ঢালু তার পাড়ি/ ঢালু তার পাড়ি রে.. ঢালু তার পাড়ি….
জসিম উদ্দীনের আসমানি কবিতায় সুর তুললো রোমন- আসমানিদের/দেখতে যদি/ তোমরা সবে/চা…ও/ রহিমুদ্দির/ ছোট্ট বাড়ি/ রসুলপুরে/ যা…ও
প্রথমে ভেঙে ভেঙে গাওয়ার পর কোরাসটা উঠলো একটানে- আসমানিদের দেখতে যদি/ তোমরা সবে চাও/ রহিমুদ্দির ছোট্ট বাড়ি/ রুসুলপুরে যাও।/ বাড়ি তো নয় পাখির বাসা/ ভেন্না পাতির ছানি/ একটুখানি বিষ্টি হলেই/ গড়িয়ে পড়ে পানি…

তুহিন ধরলো- আমারো পরানো যাহা চায়/ তুমি তাই তুমি তাই গো…/ আমারো পরানো যাহা চায়…
তার এই গানকে গানে গানেই টিপ্পনি কাটলেন দুলাভাই- প্রেমের গান গাইলেই কেবল প্রেমিক হওয়া যায় না …
আর আহমদ আমিন আমার পছন্দের শিল্পী কফিল আহমেদের একটি গান ধরলেন- বানিয়েছি ডুগডুগি/ বাজাও বাজাও/ শ্মশানে কবরে ঘুম/ জাগাও জাগাও…
তারপর তিনি পিছু হটলেন। এগিয়ে এলাম আমি। কফিল আহমেদের অন্য একটি সুর ধরে টান দিলাম- আর যাবো না ঠাকুর বাড়ি/ আমার রাধার নাইরে শাড়ি…
গাইলাম- গঙ্গাবুড়ি গঙ্গাবুড়ি শোনো/ এতো সুন্দর নামটি তোমার কে দিয়েছে বলো/ নামে চুম নাইরে আমার/ নামে ঘুম নাই…
এবং- পাখির ডানায় দারুণ শক্তি দারুণ শক্তি/ গরুর চোখে মায়া…

গান এবং তালির ছন্দে ছন্দেই আমাদের নছিমন প্রবেশ করলো অরণ্যের ভেতর। সাথে যোগ হলো নতুন আরেক ছন্দ: অর্থাৎ ঝাঁকুনি। কতটুকু ইট বিছানো, আবার কতটুকু মাটির কাঁচা এবড়োথেবড়ো পথ। এই দূর্গম রেখা ধরেই নছিমনটাকে এগিয়ে নিয়ে চললো চালক ছাইদুল। আমাদের দু’পাশে জঙ্গল। পাতলা পাতলা বসতভিটা। আর একটু পর পর চৌকোনা ফসলি মাঠ। কোথাও কোথাও আবার জঙ্গলের পাশ দিয়ে নদীর মতো এঁকেবেঁকে চলে গেছে ফসলি জমির রেখা।

এখান থেকে ডান দিকের জঙ্গল ভেঙে একটু এগিয়ে গেলেই ভারতের সীমা। এরপরই শুরু হয়েছে পাহাড়ি উপত্যকা। পানিহাটায় যেতে হলে এই পাহাড়ি সীমান্তকে ডানে রেখেই আমাদের এগুতে হবে বাকি পথটা। ফেরার সময় সকালের সূর্য্যরে আলোতে বনের ভেতর দিয়ে পুরো পথেই পাহাড়টাকে দেখতে দেখতে ফিরেছি। মনে হয়েছে এই উপত্যকাতেই থেকে যাই।
এখন প্রকৃতিতে অন্ধকার। ওসব কিছু দেখা যাচ্ছে না। কেবল ঠাহর করতে পারছি, চারদিকেই গাছ। জঙ্গলের বুকে শুধু এই নছিমনটাকে এগিয়ে যাওয়ার জন্য সরুমতো একটা পথ এঁকে দেয়া হয়েছে। এই পথটাতে নেমেই গানের উচ্ছ্বাসটা হারিয়ে গেলো। আরম্ভ হলো অরণ্যের আনন্দ। সবাই অন্ধকারে নিমজ্জিত। কেউ কারো মুখ দেখতে পাওয়া তো দূরের কথা। ছায়ার মতো শরীর পর্যন্ত ঠাহর করতে বেগ পেতে হচ্ছে। আমার হাতের টর্চটা হঠাৎ নিশানা করলাম জুয়েলের দিকে। চমকে উঠলো সে। টর্চের আলো ছড়িয়ে গিয়ে জুয়েলের পাশে বসা সাদ এবং আলমগীরের চেহারাও স্পস্ট হলো। ওদের ভেতর তখন এক ধরনের চাপা উত্তেজনা কাজ করছে। উত্তেজিত জুয়েলও। কিন্তু তবুও তাকে এই জঙ্গলের ভেতর নামিয়ে দিয়ে, বনবাসে রেখে যেতে চাইলাম আমরা।

কিন্তু কী অপরাধ তার!
কারণ, গান গাওয়ার সময় সবার গলা উচ্চকিত ছিলো। জুয়েলের সাড়াশব্দ ততটা পাওয়া যায়নি।
কি কারণ?
জুয়েল জানালো, গান গাওয়ার সময় সে সবচেয়ে বেশি আপ্লুত ছিলো। তাই নিজের গলায় তেমন জোর পায়নি। তবে বাকি সবার গলাগুলোকেই নিজের মনে করে চালিয়ে দিয়েছে।
আপ্লুত ছিলো সবাই। এই অন্ধকারের ভেতর কেউ স্বাভাবিক ছিলো না। এই অস্বাভাবিকতাগুলোর প্রকাশ ঘটেছে একেকজনের ক্ষেত্রে একেকভাবে।
রাত একটা বেজে তিরিশ মিনিট। আমরা তখনো নছিমনে। মেঠো পথ ধরে আমাদের টেনে নিয়ে যেতে ইঞ্জিনটাকে বেগ পোহাতে হচ্ছে। কোথাও আমাদেরকে নেমে ধাক্কা দিতে হচ্ছে। তাই সময়ও লাগছে বেশি। আর এ কারণে সন্দিহান হয়ে উঠলেন দুলাভাই। আমরা পানিহাটা পেরিয়ে যাইনি তো! দুলাভাই এর আগেও ওখানে গিয়েছেন। ওনার এতটুকু স্মরণে আছে যে, একটি চার রাস্তার মোড় থেকে হাতের ডানে বাঁক নিয়ে সরু পথ চলে গেছে পানিহাটায়। কিন্তু ইতোমধ্যে আমরা বেশ কয়েকটি চার রাস্তার মোড় পেরিয়ে এসেছি। তাহলে কী, পানিহাটা পার হয়ে আমরা ঢোকে পড়েছি বিপজ্জনক কোনো এলাকায়?

অন্ধকারে তেমন ঠাহর করা যাচ্ছে না। তবুও সাহস করে চালক ছাইদুলকে এগিয়ে যেতে বললেন দুলাভাই। কিছুদুর এগিয়েই বুঝতে পারলাম, আমরা পথ ভ’ল করিনি। নছিমনের আলোয় স্পস্ট দেখা যাচ্ছে একটি সড়ক ফলক- বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ, তেলিখালী সীমান্ত ফাঁড়ি।
ফলকের বিপরীত দিকেই বিশাল এলাকা নিয়ে বিজিবির স্থাপনা। ভরসা পেলাম আমরা। অন্তত বিজিবি সদস্যদের কাছ থেকে জেনে নেয়া যাবে পানিহাটার পথ। ফাঁড়ির সামনেই নছিমনটি থামলো। ধীর্ঘসময় বসে থেকে পায়ে জঙ ধরে গেছে। হাত-পা ছুঁড়াছুঁড়ি করতে করতে সবাই নেমে এলো সড়কে। আর আমি এগিয়ে গেলাম চেকপোস্টের ফটকের দিকে। কাউকে দেখা গেলো না। হাতের টর্চটা জ্বাললাম। আলো ফেললাম নিচের দিকে। যেনো এই আলোটা দেখে কেউ এগিয়ে আসে। কিন্তু কারো সাড়াশব্দ নেই। এবার টর্চের রশ্মি ফেললাম লোহার গ্রীলের ফটক গলিয়ে। তারপর ফটকপ্রহরীর কুঠুড়িতে। স্পস্ট দেখলাম কুঠুড়িটা খালি। প্রহরী নেই।
অবাক হলাম। টর্চের আলোটাকে সোজা চালান করে দিলাম ফটকের ওপাশের আঙিনায়। প্রশস্ত আঙিনা পেরিয়ে ফাঁড়ির স্থাপনায় গিয়ে ঠিকড়ালো। তবু কারো সাড়াশব্দ নেই।
ইতোমধ্যে আমার পাশে এসে জড়ো হয়েছে তুহিন, রোমন এবং আরো কয়েকজন। এবার হাঁক ছাড়লাম- ফাঁড়িতে কেউ আছেন? আর আলোটাকে সাপের মতো খেলাতে থাকলাম। আমার হাঁক প্রতিধ্বনিত হয়ে আবার আমার কানেই ফিরে এলো।
হতাশ হলাম আমরা।

ব্যপারটা পীড়াদায়ক। বিড়াল কিনলাম ইদুর মারার জন্য। তবুও আমার গোলাঘরে ইদুরের রাজত্ব। কুটকুট করে ফসল কাটে, বাসে বাঁধে, ছানাপুনার সংখ্যা বাড়ায়। অন্যদিকে গোলাঘরে যেতে ভয় পায় বিড়াল। সে সদরকক্ষে থাকে। দুধভাত খায়। আমার বিছানায় ঘুমায়। আবার রাতের বেলায় আমাকেই আঁচড়ে দেয়!
পর পর কয়েকটি হাঁক ছাড়ার পর আঙিনার ওপাশ থেকে একটি ক্ষীণ টর্চের আলো দেখা গেলো। প্রতি উত্তরে আমিও আলোটা জ্বাললাম। ওপাশের আলোটাকে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসতে দেখলাম। কিন্তু আমাদেরকে অবাক করে দিয়ে মাঝপথেই থেমে গেলো ওটা। আমরা আবার হাঁক ছাড়লাম। কিছু একটা প্রতিউত্তর পেলাম, ঠিক বুঝতে পারলাম না।
আলোটাকে আহ্বান করলাম এগিয়ে আসতে। কিন্তু এগিয়ে এলো না ওটা। বরং জানিয়ে দিলো, যা শোনার ওখানে দাঁড়িয়েই শুনবে।
কোনো উপায়ান্তর না দেখে চিৎকার করেই আমাদের পরিচয় দেয়ার চেষ্টা করলাম। ওপাশ থেকে শুনলো কি না বুঝতে পারলাম না। তারপর অভয় দিলাম। অনুরুধ করলাম এগিয়ে আসতে।

দুই সদস্য এগিয়ে এলেন বটে, তবে বহু ইতস্ততার পর। দুইজনের পরনেই লুঙ্গি। তবে একজনের গায়ে সাধারণ শীত পোশাক এবং অন্যজন বিজিবির ইউনিফর্ম গায়ে দিয়েই এসেছেন।
তেলিখালী সীমান্ত ফাঁড়ি থেকে পাওয়া তথ্যমতে আবার এগিয়ে চললো আমাদের নছিমন। আবার সেই উঁচু-নিচু মেঠো পথ। জঙ্গলের ভেতর দিয়ে এঁকেবেঁকে কিছুদূর আসার পর একটি চার রাস্তার মোড়ে এসে থামলাম। দুলাভাইয়ের ধারণা এটাই চায়নার মোড়। আর এই চায়নার মোড় থেকেই আমাদের বাঁক নিতে হবে হাতের ডানে।
ঘড়িতে তখন দুইটা বেজে নয় মিনিট। আমরা আবার নামলাম নছিমন থেকে। মেঠো পথে টর্চের আলো ফেলে এলাকাটা ঠাহর করার চেষ্টা করলেন দুলাভাই। নিশ্চিত হতে হবে, সত্যিই এটা চায়নার মোড় কি না।

কিন্তু কিভাবে?
কোথাও জনমানবের চিহ্ন নেই। মোড়ের এক কোনায় ছোট একটি দোকানের ওপর জ্বলছে বিদ্যুৎবাতি। হাতের ডানে, সামনে এবং পেছনে জঙ্গল আর জঙ্গল। কাকে জিজ্ঞেস করবো আমরা?
বাম দিকে যে পথটা এগিয়ে গেছে, ওদিকে হাঁটতে শুরু করলেন দুলাভাই। পেছন পেছন দলের একটা অংশ। দূরে দেখা যাচ্ছে মেঠো পথের পাশেই কয়েকটি বসতবাড়ি।
বাকিরা তখনো চার রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে। কিছুক্ষণ পর ওদিক থেকে ফিরে এলেন তারা। সাথে করে নিয়ে এলেন আরো কয়েকজনকে। দুই মহিলা আর পুঁচকে একটি ছেলে।
কী ঘটনা, দুলাভাই কিভাবে ওদের যোগার করলেন?
তিনি ওদের ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলেছেন।
এরা কি দুলাভাইয়ের পরিচিত?
মোটেই না। তিনি পায়চারি করতে করতে একটি বসতঘরের পেছন দিকটায় স্থির হলেন। তারপর সহযোগিতার আহ্বান জানিয়ে হাঁক ছাড়লেন- কেউ কি জেগে আছেন?
দুই একটি হাঁক দেয়ার পর ভেতর থেকে সাড়া দিলেন এক মহিলা- কেডা গো আপনারা?
আমরা পথ চিনতে পারছি না।
যাইবাইন কই?
পানিহাটায়।
পশ্চিমের রাস্তা ধইরা যাইন।
কোনটা পশ্চিম, কোনটা পূর্ব আমরা চিনতে পারছি না। যদি পথটা একটু দেখিয়ে দিতেন।
এবার শরীর মোচড়াতে মোচড়াতে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন দুই মহিলা। তাদের আগে আগে হেঁটে এলো পুঁচকে এক বাচ্চাও। ওর নাম ইসমাইল, রামচন্দ্রকুড়া বিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ে ।

ইসমাইলদের দেখার পর আমরা যেমন বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে রইলাম, সেও কৌতুহল নিয়ে আমাদের পর্যবেক্ষণ করতে শুরু করলো। জিজ্ঞেস করলো আমরা কোথা থেকে এসেছি। তারপর নিজের উদ্যোগেই আমাদের সাথে এটা ওটার গল্প করতে শুরু করলো। আর তার সাথের দুই মহিলা অভিভাবক আমাদের নিশ্চিত করলেন, এটাই চায়নার মোড়। আর পানিহাটায় যেতে হলে আমরা যেদিক থেকে এসেছি, সে হিসাবে হাতের ডানে মোড় নিতে হবে।

আমরা জানতে চাইলাম, এদিকে বিজিবির কোনো সদস্যকে পাওয়া যাবে কি না?
মাঝে মইধ্যেই তো থাহে। এই মোড়েও তো বইয়া থাহে। বলে টঙ দোকানের সামনের বেঞ্চির দিকে ইঙ্গিত করলেন মহিলা।
দোকানের ঝাঁপ লাগানো। সামনে বাঁশের কঞ্চি পেতে বড়সর বেঞ্চির মতো বানানো হয়েছে। বেঞ্চির পাশেই একটি খুঁটিতে বিদ্যুৎবাতি ঝোলানো- এই জঙ্গলের ভেতরও বিদ্যুৎ আছে? জানতে চাইলো আলমগীর।

আরে কি কইন, কারেন্টের বাল্ব জ্বালানি না থাকলে বাবু আইসা সব মিছমার (ধ্বংশ) কইরালতো না?
আবারো বিষ্ফোরিত হলো চোখ। কে এই বাবু, যে কিনা বিদ্যুৎবাতি জ্বালানো না থাকলে সব ধ্বংশ করে দেয়?
জবাবের জন্য মহিলাদের দ্বারস্থ হতে হলো না। দুলাভাই বিষয়টা ব্যখ্যা করে বললেন আমাদের। বাবু কোনো ব্যক্তির নাম নয়। ওরা বন্য হাতিকেই বাবু বলে ডাকে। রাতের বেলায় উপত্যকা থেকে নেমে আসে বাবুর পাল। কিন্তু ওরা খুব একটা আলো মাড়ায় না। বিদ্যুৎবাতি দেখলে এগুয় না। তাই এখানকার অনেক এলাকায় বিদ্যুৎ না থাকলেও বন্য হাতির আক্রমণপ্রবণ এলাকাগুলোতে বিদ্যুৎ সংযোগ রয়েছে।

এর মানে, আমরা ইতোমধ্যে হাতির আক্রমণপ্রবণ এলাকায় ঢোকে পড়েছি?
শিরশির করে মেরুদন্ডের মধ্য দিয়ে ঠান্ডা একটা ভয়ের শিহরণ বয়ে গেল। সেই থেকেই শুরু। তারপর ভয়টাকে একেবারে এড়াতে পারেনি কেউ। চায়নার মোড় থেকে মেঠো পথ ধরে শ্লথ গতিতে নিছমনটাকে এগিয়ে নিয়ে গেলাম। ও পথটা আরো সরু, আরো অন্ধকার। মহিলাদের নির্দেশনামতে এগুচ্ছি। একটু পর পর দুলাভাই নেমে যাচ্ছেন। এলাকাটা ঠাহর করার চেষ্টা করছেন। তার উদ্দেশ্য, ওখানকার একটি খ্রিস্টান চার্চ খুঁজে বের করা। তিনি জানালেন, এই চার্চের সামনে গিয়েই আমরা নছিমনটাকে থামাবো।
কিন্তু চার্চটা ঠিক কোনদিকে সেটা আন্দাজ করতে পারছেন না। জঙ্গলের ভেতর দিয়ে যেদিকেই পথ, উপপথ চলে গেছে সবগুলোকেই সম্ভাবনাময় মনে হচ্ছে তার। তবুও আমরা চললাম। নছিমনের ধুকপুকানি দিয়ে জঙ্গলের স্তব্ধতা খান খান করে এগিয়ে চললাম। যতদূর যাওয়া যায় এই নছিমনটাকে নিয়েই যাবো।
দুলাভাই আশ্বাস দিলেন, চার্চ পর্যন্ত নিশ্চিন্তে ওটা যেতে পারবে।

তবে আমরা নিশ্চিন্ত রইলাম না। সীমান্তের দিকে মুখ রেখেই এগুচ্ছি। যে কোনো সময় পথ ভ’ল করে ভারতের স্থল সীমায় ঢুকে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। তাই অন্ধকারে পথ পরিষ্কার না হলেও মহিলাদের নির্দেশনামতোই এগুনোর চেষ্টা করলাম। যদি পথের হিসাব ঠিক থাকে, তবে এতক্ষণে চার্চে চলে আসার কথা।
কিন্তু কোথায় সেই চার্চ?

আমরা তো বোকার মতো নছিমনে বসেই আছি। কখনো নেমে ওটাকে ঠেলে-ঠুলে খানা-খন্দক পার করছি। এ ক্ষেত্রে নাজমুলের পাশাপাশি ভালো দক্ষতা দেখিয়েছে জুয়েল। আর বাকি সবার দক্ষতা গড়পরতায়। সাদের ধাক্কায় নছিমন কতটা এগিয়েছে তার হিসাব বড় করে দেখার নয়, বরং সে নছিমনকে ঠেলার জন্য কতবার নেমেছে সেটাই বিবেচ্য। যতবার নছিমন আটকে গেছে ততবারই সাদকে নামতে দেখা গেছে। নেমেছে অন্যরাও। তবে খুব সম্ভবত আহমদ আমিনকে একবারের জন্যও নামতে দেখা যায়নি। নছিমন যাত্রার পুরো সময়টাতেই ভদ্রলোকের ভেতর ঝিমুনি ভাব লক্ষ্য করা গেছে। তিনি যেনো ভিন্ন জগতের বাসিন্দা। তার ভেতর কি কোনো দুঃখ কাজ করছে?
হতে পারে, তিনি তার ছেলে জায়সিকে বাড়িতে রেখে নিশিদলে চলে এসেছেন। জায়সি বাবা ছাড়া আর কিছুই বুঝে না। বাবার মুখে গল্প না শুনে ঘুমুতে যায় না। সেও বাবার মতো ছড়াকার হতে চায়, হতে চায় লেখক। তাই বানিয়ে বানিয়ে গল্প বলে, বাবাকে অনুরুধ করে ওর বানানো গল্পগুলো লিখে পত্রিকায় ছাপতে।
এই জায়সির কাছে বাবাই সব। আর সেই বাবা কি না এতটা নিষ্ঠুর! ছেলেকে বাড়িতে রেখে চলে এসেছেন নিশিদলে!

জায়সি কি এখন বিছানা হাতড়ে বাবাকে খুঁজছে?
আর সেজন্যই আহমদ আমিনও নিশিদলে থেকেও মনটাকে ফেলে রেখেছেন জায়সির কাছে। অথবা অন্ধকারের সুড়ঙ্গ ধরে তিনি হারিয়ে গেছেন অন্য কোনো অন্ধকার স্মৃতিতে।
আহমদ আমিনের এই ধ্যন সহজে ভাঙলো না।
তবে যখন ভাঙলো, তখন তিনি একেবারে বাঘের খাঁচায়!
না, পানিহাটার জঙ্গলে বাঘ নেই। বাঘকে আটকে রাখার জন্য কোনো খাঁচাও নেই। আছে কেবল নিস্তব্ধতা। আর এই নিস্তব্ধতার ভেতরই স্তব্ধ হয়ে গেলেন আহমদ আমিন। হঠাৎই লক্ষ্য করলেন, বিশ্বচরাচরে তিনি একা।

একটা তিন পথের মোড়ে এসে নতুন করে পথ ঠাহর করার জন্য নছিমনটা থামলো। এই প্রথমবারের মতো মাটিতে পা রাখলেন তিনি। আনমনে সেলফোনের বোতাম চাপতে চাপতে কয়েক কদম এগিয়ে গেলেন। ফিরে এসে দেখলেন মরা কচ্ছপের মতো নছিমনটি পড়ে আছে তিন পথের মোড়ে । আর কেউ কোথাও নেই!
আত্মাটা ধক করে উঠলো তার। ঘন ঘন ওঠা-নামা করতে শুরু করলো বুক। এতটুকু সময়ের ভেতর কোথায় উধাও হলো সবাই! তবে কি কোনো দূর্ঘটনা?
ধীর পায়ে নছিমনের দিকে এগিয়ে এলেন আহমদ আমিন। ভালো করে দৃষ্টি দেয়ার চেষ্টা করলেন। এবং আত্মায় কিছুটা জল ফিরে এলো। চালক ছাইদুলকে দেখলেন গুটিশুটি মেরে ভেতরে বসে থাকতে। তবে একেবারে দুশ্চিন্তামুক্ত হওয়া গেলো না। দলের অন্যরা কোথায় হারিয়েছে এ ব্যপারে ছাইদুলেরও ধারণা নেই।
আচমকা এলোমেলো হয়ে গেলো দল। কিছুসময়ের জন্য মূলত কারোরই হুঁশ ছিলো না।
আমি কেবল বলতে পারি, নছিমনটা থামার পরই ডান দিকের দু’পেয়ে পথটা ধরে এগিয়ে গেলেন দুলাভাই। যাচ্ছেন তো যাচ্ছেনই, থামার যেনো ইচ্ছে নেই। আমি তাকিয়ে আছি ওদিকে। সময় দেখলাম, দুইটা বেজে পনেরো মিনিট।

দেখলাম আবছা একটা পথের চিহ্ন ধরে আবার বাম দিকে হারিয়ে যাচ্ছেন তিনি। অন্যদিকে লক্ষ্য করলাম নছিমনের পাশে তিন পথের মোড়কে কেন্দ্র করে বাকি সবাই উদ্বেলিত। দুই দিকে ঘন জঙ্গল। আর একদিকে জঙ্গলাকীর্ণ টিলা। আমার তখন ওসবে খেয়াল নেই। তাকিয়ে আছি দুলাভাইয়ের গতিপথে। শেষে নিজেকে স্থির রাখতে পারলাম না। পিছু নিলাম আমিও।
প্রথমে ধীরে, তারপর একরকম দৌড়ে। তিনিও যেনো দৌড়োচ্ছেন। আমার উপস্থিতি ঠাহর করতে পারেননি। দৌড়াতে দৌড়াতেই হঠাৎ কানে এলো শব্দটা ।
বামের জঙ্গলে যেনো মড় মড় করে ভেঙে পড়লো কলাগাছ।
চমকে উঠলাম আমি। কলাগাছ ভাঙার শব্দ!
কে ভাঙলো?

তাহলে কি বন্য হাতিরা নেমে এসেছে উপত্যকা ছেড়ে?
নাকি ওটা মনের ভূল?
যদি ভ’ল না হয়ে থাকে, তবে ফেরাতে হবে দুলাভাইকে। এগিয়ে চললাম আমি। একপশলা শীতের শুকনো বাতাস চলে গেলো বনভ’মি গলিয়ে। সাঁই সাঁই করে শব্দ উঠলো গাছে। মৃদু কেঁপে উঠতে দেখলাম পুরো জঙ্গল। কান খাঁড়া করে হাতির পায়ের শব্দ আবিষ্কারের চেষ্টা করলাম।
এরি মধ্যে দুলাভাইয়ের নাগালও পেয়ে গেলাম। প্রথমে তিনি চমকে উঠলেন। কলাগাছ ভেঙে পড়ার শব্দটা তার কানেও এসেছে। তবুও তিনি সেটাকে ভ’ল ভেবে এগিয়ে চলেছেন।
কিন্তু ভূল হলে একজনের হতে পারে, দু’জনের নয়। তিনি বললেন, হতে পারে সেটা কলাগাছ নয়। হাতিরা নেমে এলে কেবল একটি কলাগাছের শব্দই হতো না। এমন মড় মড় মড়াৎ করে শব্দের রোল উঠতো। ভরসা পেলাম আমি।
কিন্তু তিনি কেনো উদভ্রান্তের মতো ছুটছেন?

পথ চেনার জন্য। এই তিন পথের মোড়ে এসে আবার তিনি বিভ্রান্তিতে পড়েছেন। তিনি জানেন, আমরা সীমান্ত রেখার পিঠ ঘেঁষে হাঁটছি। আর এর আশপাশেই কোথাও আছে সেই খ্রিস্টান চার্চ। কিন্তু অন্ধকারের বিভ্রান্তিতে পথের রেখাটা আবিষ্কার করতে পারছেন না। আরো কিছুদূর এগুলাম আমরা। তারপর আরো একটি তিন পথের বিভ্রান্তি। ওখান থেকে সোজা সামনের দিকে এক প্রস্থ নিচু ঝোঁপ। তারপর খাড়া টিলা। আর বাম দিকে চলে গেছে ঘেসো পথ। অর্থাৎ ঘাসের মাঝখান দিয়ে নামে মাত্র একটি পথের সরু রেখা টানা। শিশির ভেজা ঘাস মাড়িয়েই চলতে শুরু করলেন দুলাভাই। পেছন পেছন আমিও। টর্চের আলোয় মনে হলো সরু সবুজ সুড়ঙ্গ ধরে এগিয়ে চলছি। একটু এদিক ওদিক হলেই কোনো না কোনো গাছে হুমড়ি খেতে হবে।
ঘেসো পথ ধরে কয়েক কদম এগুনোর পরই লক্ষ্য করলাম ব্যপারটা। পেছন থেকে কে যেনো দ্রুত পায়ে আসছে। অবশ্য ভরকানোর আগেই টর্চের আলোয় স্পষ্ট দেখতে পেলাম চেহারাটা- তুহিন। আমাদেরকে হারিয়ে যেতে দেখে পিছু নিয়েছিলো সেও।

তিনজনের এই উপদলটা তখন রোমাঞ্চের তুঙ্গে অবস্থায়। টর্চের আলোয় দেখে নিচ্ছি বনভ’মি। উপরে আকাশছুঁয়া গাছ। পায়ের নিচে শিশিরভেজা ঘাস, শীতঝড়া পাতা। এগুলোই দেখতে পাচ্ছি আমরা। তবে চোখের দেখার বাইরেও যে লুকিয়ে থাকতে পারে বিষাক্ত সাপ-খোপ, তা নিয়ে বিন্দুমাত্র ভয় কাজ করেনি। এমনকি ওখানে আমাদের জন্য উৎ পেতে থাকতে পারে হাজার রকম বিপদ, এসব শঙ্কাও মনে রেখাপাত করলো না। কী এক অপার্থিব আনন্দে মজে গেলাম তিনজন। তখন বেমালুম ভূলে গেলাম চার্চের সন্ধান। ভ’লে গেলাম দলের অন্যদের কথাও।

কিন্তু এই ঘেসো পথটা ধরে কিছুদূর এগুনোর পর থমকে দাঁড়াতে হলো আমাদের। সামনে ডালপালা দিয়ে বেড়ামতো কিছু একটা দেখা যাচ্ছে। হুম, এই ডালপালার বেড়াই আগলে দিয়েছে পথটাকে। টর্চের আলোয় দেখলাম, এর পর আর পথের কোনো রেখাও দেখা যাচ্ছে না।
আঁৎকে উঠলাম তিনজন। হতে পারে পরের অংশটা ভারতের সীমায়। আর সত্যিই যদি এমনটা হয়ে থাকে, তবে এখানে দাঁড়িয়ে থাকাও বিপজ্জনক। ভারতীয় সীমান্তরক্ষীর কবলে পড়লে রক্ষে নেই। তাছাড়া গুলি করা ওদের জন্য মামুলি।  আচমকা গুলি শুরু করলে বুক ঝাঁজরা করে তবে ক্ষান্ত হবে ।
ফিরতি পথ ধরলাম আমরা।

অন্যদিকে আমাদেরকে কেন্দ্র করে ঘটে গেলো তুলকালাম। দলের বাকি সদস্যরা হঠাৎ করেই আমাদের হারিয়ে যাওয়া নিয়ে কৌতুহলী হয়ে উঠলো। ওদের ভেতর থেকেই কেউ হয়তো দেখেছিলো আমরা কোন পথ ধরে এগিয়েছি। আরো তিনজন এগিয়ে গেলো সেই পথ ধরে- রোমন, আলমগীর ও জুয়েল।

এগুচ্ছে, এগুচ্ছে এবং এগুচ্ছে। অন্ধকার ভেদ করে এগিয়ে যাচ্ছে। তবুও আমাদের দেখা নেই। পরিকল্পনা আঁটলো, আমাদের খুঁজে পেলে জঙ্গলের ভেতর উৎ পেতে থাকবে ওরা। তারপর ভয় দেখাবে। কিন্তু কিছুদূর এগিয়ে নিজেরাই ভরকে গেলো। মনে হলো ভারতের সীমায় চলে এসেছে ওরা। অশুভ শঙ্কায় দোলে উঠলো মন। ধারণা করলো আমাদের নিশ্চয়ই কোনো বিপদ হয়েছে। চার্জ বাঁচানোর স্বার্থে মোটামোটি সবারই সেল ফোন বন্ধ। খোঁজ নেয়ারও পথ নেই। এতো সময়ের জন্য আমাদের হারিয়ে যাওয়াটা মোটেও স্বাভাবিক মনে হলো না ওদের কাছে। তাছাড়া ওরাও নিজেদের অবস্থান নিয়ে শঙ্কিত হয়ে উঠলো। ওরা যে দিকটায় মোড় নিয়েছিলো সেখানকার অবস্থাও দূর্গম। পথগুলো যেনো কোথায় নাই হয়ে যাচ্ছে। নিজেদের এবং আমাদের উপদলকে নিয়ে আতঙ্কিত হলো তিনজন। আর নিজেদের আতঙ্কের ভেতরও আমাদেরকে খুঁজে পেলে ভয় দেখানোর কিঞ্চিৎ একটা ইচ্ছে জিইয়ে রাখলো। এবং খোঁজার চেষ্টা করলো। চায়নার মোড়ের সেই দুই মহিলার দেয়া ধারণা অনুযায়ী এই এলাকায় এসেই বাংলাদেশের ভূখন্ডের সমাপ্তি।

অর্থাৎ এখানে যে কোনো মুহূর্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের হাতে বন্দী হওয়া কিম্বা গুলি খাওয়ার শঙ্কা প্রকট। তবুও ওরা ঘাপটি মারলো ঝোঁপের আড়ালে। সাথে সাথেই ভ’লটা ধরতে পারলো। এভাবে ঘাপটি মেরে থাকলে নিশ্চিত চোরাচালানি ভেবে গুলি করে বসতে পারে বিএসএফ।
ঠিক তখনি বাম দিকে দেখা গেলো আলোটা। থ হয়ে রইলো তিনজন। এর পর ঝাড়া মেরে ওঠে দাঁড়ালো। গুলি করার আগেই আত্মসমর্পন করতে হবে। দুই হাত উঁচু করা প্রয়োজন …
এদিকে আমাদের উপদল ফিরতি পথে । টর্চের আলোয় দেখে-শুনে পা ফেলছি। ঘেসো পথটার বাঁক ঘুরেই সোজা সামনের দিকে আলো ফেললেন দুলাভাই। তখনি ঘটে গেলো কা-টা। আমি বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে থাকলাম ওদিকে। চাদরের মতো কিছু একটার অবয়ব ভেসে উঠলো দৃষ্টিতে।
কী ওটা?

মানুষের মতোই দেখা যাচ্ছে। টর্চের আলো পড়তেই ঝোঁপ থেকে লাফিয়ে উঠলো এই রহস্য অবয়ব। মানুষের মতোই কাঠামো। মাথা নেই, মুখ নেই। ঝোঁপের উপর যতটুকু দেখা যাচ্ছে কেবল ঘিয়ে রঙের একখ- কাপড়ে পেঁচানো শরীর। ওটা মানুষ নাকি অন্য কিছু?
অশুভ শঙ্কায় চিৎকার করে উঠলাম আমি- মানুষ!
চিৎকার শুনে আলোটাকে এদিক ওদিক খেলালেন দুলাভাই।
শুকিয়ে যাওয়া কলজেটা এবার একটু একটু করে ভিজতে শুরু করলো। ওটা মানুষ বটে, তবে আমাদের পরিচিত। আর এই মানুষটার নাম সাইফুল ইসলাম জুয়েল। দুলাভাইয়ের বাড়ি থেকে যে শীত পোশাকগুলো নেয়া হয়েছিলো সেগুলো থেকে ওর ভাগে পড়েছিলো ঘিয়ে রঙের চাদর। আর ঝোঁপের আড়াল থেকে তখন কেবল এই চাদরটাকেই দেখা যাচ্ছিলো। আর জুয়েলের পাশেই দেখা গেলো রোমন এবং আলমগীরকে।

আমরা অবাক হলাম, ওরা এখানে কী করছে। আরো অবাক হলাম, ওদের আতঙ্কিত অবস্থা দেখে। তখনো আমাদের উপদলটাকে ঠিক ঠাহর করতে পারেনি ওরা।
তবে বেশিক্ষণ ওদের আতঙ্কিত করে রাখা যায়নি- ওরা দেখছি আমাদেরি লোক। বলে চেঁচিয়ে উঠলেন দুলাভাই।
তারপরই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে এলো। দুই উপদল একসাথে হয়ে ফিরতে শুরু করলাম নছিমনের দিকে। কয়েক কদম এগিয়েই লক্ষ্য করলাম আরো দু’টি ছায়ামূর্তির অস্তিত্ব। এগিয়ে আসছে, আমাদের দিকেই। দূরত্ব কমে এলে টর্চের আলোয় স্পষ্ট হয়ে এলো মূর্তিদুটো- সাদ এবং নাজমুল।
জঙ্গলের ভেতর থেকে তিনজন, তিন থেকে ছয়জন এবং সর্বশেষ আরো দুইজন মিলিয়ে মোট আটজন এসে উপস্থিত হলাম নছিমনের পাশে। আহমদ আমিনের তখন ত্রাহি অবস্থা। ঘটনা শুনে আফসোসের শেষ নেই তার।

সেই যে তার উদাসিনতা ভাঙলো, তারপর জোর করেও আর উদাসিন করা গেলো না। বরং তখন থেকে তিনিই ছিলেন বেশি সক্রিয়।
এবার সঠিক পথের সন্ধান পেলাম। এবং নছিমনের ইঞ্জিনটা স্টার্ট করে চালককে বললাম সোজা চালিয়ে যেতে। আর হেডলাইটের আলোয় আমরা হাঁটতে শুরু করলাম সুশৃঙ্খল পদাতিক বাহিনীর মতো। একেবারে চার্চের ফটকের সামনে এসে থামলাম। টর্চের আলোয় ফটকের লেখাগুলো স্পষ্ট পড়তে পারলাম- চার্চ অব বাংলাদেশ, সাধু আন্দ্রিয়ের মিশন। পানিহাটা, নালিতাবাড়ি।

দুলাভাই জানালেন দিনের আলোতে চার্চের ভেতর প্রবেশ করা যেতো। এখানে আছে ছোট একটি চিকিৎসা কেন্দ্র, বিদ্যালয় এবং শিক্ষার্থীদের থাকার জন্য হোস্টেল। চার্চের পশ্চিম পাশেই উঁচু টিলা। ওখানে দাঁড়িয়ে উত্তর দিকে তাকালে চোখে পড়ে সবুজ। মনে হয় ভারতের পাহাড়ি জেলা তুরাকে যেন আবছা আবরণের চাদরে জড়িয়েছে কুয়াশার মতো মেঘ। ভারতের মেঘালয় রাজ্যের ছোট ছোট পাহাড় গলিয়ে তুরার পাশ দিয়ে পশ্চিমে চলে গেছে পাহাড়ি নদী ভোগাই। চার্চের একশ গজ উত্তরের ভারত অংশে পিচঢালা পথ পাহাড়ের বুক চিরে চলে গেছে পূর্ব থেকে পশ্চিমে। আর পূর্বদিক থেকে ভোগাই নদীতে এসে মিশেছে ছোট একটি পাহাড়ি ঝরনা।

ঝরনাটা থেকে পানি ঝরছে কি না, অন্ধকারে ঠিক ঠাহর করতে পারলাম না। তবে এর পাশ দিয়েই ছোট্ট একটি শুকনো গিরিখাদ গলিয়ে আমরা হাজির হলাম ভোগাই তীরে।
সময় তখন তিনটা ছুঁই ছুঁই। আমরা এসে দাঁড়িয়েছি বাংলাদেশের মানচিত্রের শেষ রেখায়। আর এ রেখাটা জল দিয়ে অঙ্কিত হয়েছে বলে, ওখানে অবস্থান করা অনেকটা নিরাপদ। গিরিখাদ পেরিয়ে যেখানটাতে এসে দাঁড়িয়েছি, যায়গাটা খুব বড় নয়। চৌকোনো সমতলের মতো।
পেছনে রেখে এসেছি খাদ। ডানে এবং বামে খাড়া পাহাড়। আর সামনের অংশটা সোজা নেমে গেছে গভীর এবং খর¯্রােতা নদী ভোগাইতে। তারপরই ভারতের ভ’মি।
আমরা যে চৌকোনো যায়গাটিতে দাঁড়িয়ে, সেটা সমতল। কিন্তু নদীর জল থেকে যতটা উচ্চতায় রয়েছি, সে তুলনায় মনে হলো এই চৌকোনো যায়গাটি, অর্থাৎ আমরা ছোটখাট একটি পাহাড়ের চ’ড়ায় দাঁড়িয়ে।

খুব সাবধানে এগিয়ে গেলাম কিনারায়। ফন্দি-ফিকির করলাম, জলের স্পর্শ নিতে। কিন্তু তাতে যা বুঝলাম, আরো একটু চেষ্টা করলে পায়ের নিচে ধ্বস নামতে পারে। এবং আমাদেরকে টুপ করে পড়ে যেতে হবে জলে। নদীর তীরটা ঢালু হলে না হয় গড়াগড়ি করে পরার সময়টুকু পাওয়া যেত।
আর একবার পড়লে রক্ষে নেই, দূর থেকে দেখলে ভোগাইকে মনে হয় প্রচ- শান্ত। একপাশে পাহাড় আর একপাশে কাশবন রেখে সুবোধ হয়ে বয়ে চলেছে।
কিন্তু কাছে গিয়ে যা বুঝলাম, এই পাহাড়ি নদী মোটেই সুবোধ নয়। সুবোধের ভান করে থাকে। জলে আলো ফেলে রীতিমতো আঁতকে উঠতে হলো আমাদের। প্রচ- খর¯্রােতা! পাঁচ-সাত ফুট পর পরই একটি করে ঘূর্ণি উঠছে। আর ঘূর্ণিগুলো ভীষণরকম ভয়ঙ্কর। তবে জলের রঙ টলটলে। অনেকটা স্বচ্ছ।
একটু উবু হয়ে আলো ফেললাম জলে। স্বচ্ছ জলের নিচে গড়াগড়ি খাচ্ছে নুড়ি পাথর।

ভারতের পাশটায় আমাদের সোজাসোজি কিছু ঝোঁপ। আরো দূরে কাশবন। আর ডান দিকে একটি সংযোগ সেতু। এই সেতুর দিকটায় নদীর তুই তীরই ভারতের অংশ। আর এদিকটায় এক তীরে আমরা দাঁড়িয়ে। অর্থাৎ আমাদের ডান দিকে যে উঁচু টিলাটা দেখা যাচ্ছে, এর পরের ভ’মিটুকুও ভারতের অংশে। বামদিকে নদীর তীর ঘেঁষে যে উঁচু টিলা এর সবটুকুই আমাদের।
টর্চের আলোয় এপাশ ওপাশ পর্যবেক্ষণ করছিলাম আমরা। আলোটা পায়ের দিকে ধরার পরই চনমনে হয়ে উঠলো মন। নিচে পড়ে রয়েছে অসংখ্য শুকনো কাঠ। ছোট ছোট ফালি করা। মনে হয়ে গেলো ক্যম্প ফায়ার করার পরিকল্পনার কথা। তুহিন, রোমন, আলমগীর এবং সাদ রীতিমতো কাঠ জড়ো করা শুরু করলো। আমিও কুড়ালাম। কে যেন আমাদের জন্য এতগুলো চেড়া কাঠ জড়ো করে রেখেছে।

পাশেই দেখতে পেলাম কয়েকটি পোড়া কাঠ। আর এর একটু পরই আবিষ্কার হলো, গোলমতো একটা যায়গার ঘাসগুলোও পোড়া। বুঝতে বাকি রইলো না, এখানে কেউ না কেউ আগুন জেলেছিলো।
আরো উৎসাহ পেলাম সবাই। কিন্তু পরক্ষণেই দমে যেতে হলো দুলাভাইয়ের কথায়। তিনি দেখালেন, ভারতের দিকটায় ওয়াচ লাইট জ্বলে ওঠেছে।
তাতে আমাদের কী? আমরা তো নিজের দেশের ভ’খ-েই আছি।
আমরা নিজের দেশের ভূখন্ডে আছি, এটা ঠিক। তবে এও মনে রাখতে হবে, এখন মধ্যরাত। বিচার বিশ্লেষণ করে দেখলাম, এ এলাকাটা সাধারণত সন্ধ্যার আগেই স্তব্ধ হয়ে যায়। লোকজন খুব একটা ঘর ছেড়ে বের হয় না। সুতরাং এই মধ্যরাতের আগন্তুকদের কেউ স্বাভাবিকভাবে নিতে চাইবে না। তাই আগুন জেলে খামোখা আমাদের প্রতি কারো কৌতুহল বাড়িয়ে লাভ নেই। তাছাড়া এ পাশে আগুন দেখে বিএসএফও বিভ্রান্ত হতে পারে।

অবশেষে আমরা ক্যম্পফায়ার করা থেকে বিরত রইলাম। তবে যে উদ্দেশ্যে বিরত রইলাম, সেটাই প্রায় ভেস্তে যেতে বসেছিলো আলমগীরের কারণে। কে যেন ভ’ল করে ওর হাতে টর্চ লাইট ধরিয়ে দিয়েছিলো। আলমগীরের হাতে টর্চ যাওয়া মানে এলোপাতাড়ি আলোর ছড়াছড়ি। আলো জেলে সে গাছ দেখে, পাহাড় দেখে। আলোর পি-টাকে দূরে ফেলে নাচায়। কয়েক সেকেন্ড পর পরই টর্চের বোতাম চাপে। কারণে-অকারণে চাপে।

প্রকৃতিকে দেখার এবং নিবিড়ভাবে উপলব্ধি করার ক্ষমতাটা ওর আছে। সম্ভবত এ কারণেই দেখে আসা বিষয়গুলোর বর্ণনাও দিতে পারে চমৎকার। আলমগীরের মুখে বর্ণনা শুনেই একবার পাগলপারা হয়ে ছুটে গিয়েছিলাম গাজীপুরের কাপাসিয়া এলাকায়। ও ঠিক যেমন করে বলেছিলো, ওখানে শান্ত একটি নদী আছে। আছে পানকৌড়ির ঝুপঝুপানি। আর ওখানকার বিকেল মানেই একটি স্বপ্নের লুকোচুরি। ঠিক তেমনটিই পেয়েছিলাম আমি। আর এই শীতল, স্নিগ্ধ বিকেলটাই আমার হাতের মুঠোয় তুলে দিয়েছিলো সেরা কয়েকটি মুহুর্তকে।
সেই কৃতজ্ঞতায় তেমন কিছু বললাম না আলমগীরকে। কেবল টর্চটি কেড়ে নিলাম ওর হাত থেকে। তারপর ফিরতে শুরু করলাম গিরিখাদ ধরে। সবার সামনে আহমদ আমিন। তার বাম দিকে আমি। এবং আহমদ আমিনের ঠিক পেছনে নাজমুল। তার পেছনে সার ধরে তুহিন, দুলাভাই এবং রোমন।

সাদ, আলমগীর এবং জুয়েল আরো পেছনে। ঠিক এই যখন অবস্থা, তখনি পেছন থেকে ফ্ল্যাশবাতি জলে উঠলো জুয়েলের ক্যমেরায়। আমি চমকে উঠলাম। ভাবলাম, ছবিটা যেহেতু পেছন দিক থেকে তোলা হয়েছে, একবার দেখা প্রয়োজন। এগিয়ে যাওয়ার আগেই হৈ হৈ করে উঠলো জুয়েল-চমৎকার একটি ছবি তুললাম।
স্ক্রীনে দেখলাম সত্যিই অসাধারণ ছবি এটি। সাদ এবং আলমগীর ছাড়া দলের বাকি সবার কাঠামোই ধরা পরেছে জুয়েলের ক্যমেরায়। আর আমরা আলোর দিক থেকে সেঁধিয়ে যাচ্ছি অন্ধকার কোনো গুহায়। তখনি ঠিক করে নিলাম, এই ছবিটাই ব্যবহার করবো ‘নিশিদল’ এর প্রচ্ছদে।

গিরিখাদ থেকে বেরিয়ে আবার সেই সাধু আন্দ্রিয়ের মিশন। ওখানে কয়েক মিনিট দাঁড়িয়ে হাঁটা ধরলাম মিশনের ফটক বরাবর সোজা পথ ধরে। সামনের দিকটায় একটি ঝাপ আটকানো মুদি দোকানের মতো ঝুপড়ি। এরপর অন্ধকারে গুমোট হয়ে আছে ঝাপহীন চায়ের স্টল। ওটাকে দেখেই চায়ের তেষ্টা পেলো ভীষণ। কিন্তু করার কিছু নেই। হাতে সময়ও তেমন নেই, ঘড়িতে তখন তিনটা বেজে বিশ মিনিট।
মেঠো পথ ধরে এগুচ্ছি আমরা। হাতের বামে ঘন জঙ্গল। ডান দিকটায় জঙ্গল সাফ করে বিশাল এলাকাজুড়ে খেলার মাঠ করা হয়েছে। সহজেই ধারণা করা গেলো, মিশনের শিক্ষার্থীরা ওখানে খেলাধূলা করে। মাঠ পেরিয়েই উঁচু টিলা।

একরকম পাহাড়-জঙ্গল ঠেলেই হাঁটছি নিশিদলের হন্টকেরা। একটু পর পরই নাকে এসে ঠেকছে ফুলের কড়া ঘ্রাণ। তাতে তোয়াক্কা করছি না আমরা। চোখে পড়লো শিমুল গাছ। মাঝে মাঝেই জঙ্গলের ভেতর ঘাপটি মেরে আছে বসতবাড়ি। কিন্তু কোনো মানুষের দেখা নেই।
হঠাৎ হঠাৎ ফুড়–ৎ করে গাছের ফোকল গলে উড়ে যাচ্ছে একেকটি পাখি। আর অদ্ভ’ত অদ্ভ’ত শব্দে ডাকছে ওগুলো।
মেঠো সড়কটা একবার আমাদের উঁচুতে নিয়ে যাচ্ছে, আবার ঢাল বেয়ে নামিয়ে আনছে নিচুতে। এভাবে উঁচু-নিচু করতে করতে মোটামোটি ক্লান্ত হয়ে এলাম সবাই। তবুও হাঁটার বিরাম নেই। যেখানে সড়ক গিয়ে দু’ভাগ হয়ে যাচ্ছে, এদের যে কোনোটি ধরে এগিয়ে যাচ্ছি। কারণ আমাদের নির্দিষ্ট কোনো গন্তব্য নেই। যতটুকু হাঁটা যায়, যেদিকে খুশি সেদিকে।
কিন্তু একসময় বোধোদয় হলো আমাদের। এভাবে হেঁটে হেঁটে বনভ’মির অন্ত করা যাবে না। তাছাড়া যেভাবে যে পথ ধরে হাঁটছি, সে পথগুলো কি ঠিকমতো মনে রাখতে পারছি? বনভ’মিতে একবার পথ হারালে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।

যদিও এদিককার পুরো এলাকাটাই বাংলাদেশের অংশে। ভ’ল করেও ভারতের ভ’মিতে চলে যাওয়ার ঝুঁকি নেই। এখান থেকে ভারতকে আড়াল করে রেখেছে উঁচু টিলা। আর টিলার পর ভোগাই নদী। তবুও পথ হারানোর ভয়ে আবার ফিরে এলাম আন্দ্রিয়ের মিশনকে নিশানা করে।
আমরা থামলাম, মিশনের সেই ফাঁকা মাঠটায়। মাঠ পেরিয়ে এগিয়ে গেলাম টিলার গোড়ায়। অন্য দিক দিয়ে এই টিলাটা খাড়া উপরে ওঠে গেছে। কিন্তু এই মাঠের পাশটা থেকে দেখলাম একটা ঢাল রয়েছে। ঢাল বেয়ে আঁকা রয়েছে পায়ে চলার পথও।

নিশিদলের নয় জোড়া পা কামড়ে ধরলো উঁচু টিলার পাথুরে শরীর। সরু পথের রেখাটা যতটুকু আছে, তাও ঢেকে দিতে চাচ্ছে আশপাশের ঝোঁপগুলো। এগুলো মাড়িয়েই ঢাল বেয়ে আরোহন করছি আমরা। পাথরে পায়ের আঘাতে ঝন ঝন শব্দও উঠছে। তবে একটু পর পর পথটা কেমন যেন পিচ্ছিলও হয়ে যাচ্ছে। রাতের শিশিরঝড়া এই পিচ্ছিল অংশগুলো সতর্কতার সাথে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করছি। এখান থেকে পিছলে পড়লে হাড়গোড় চ’র্ণ হয়ে যাবে।
অবশেষে চ’ড়ায় আরোহন করতে পারলাম আমরা। টিলার ওপাশটা মোটেও ঢালু নয়। খাড়া হয়ে নেমে গেছে খর¯্রােতা ভোগাই নদীতে। আমরা যেখানটায় দাঁড়িয়েছি, চ’ড়ার এই সমান অংশটা খুব প্রশস্তও নয়। এর দুই দিকেই এবড়ো থেবড়ো।

সুতরাং এই অপ্রশস্ত সমান অংশেই গাঁদাগাঁদি করে অবস্থান নিতে হলো নিশিদলের নয়জনকে। আর এই গাদাগাদি অবস্থায়ও সতর্ক থাকতে হলো সবাইকে। ভ’ল করেও যেন কারো গায়ে অন্যজনের ধাক্কা না লাগে। একটি অসতর্ক ধাক্কা মানেই, ভোগাই নদীতে একজনের পতন। টুপ করে পতনের পর আর খুঁজেও পাওয়া যাবে না তাকে।
পাথুরে টিলায় চড়ে মনে হলো পৃথিবীর চ’ড়ায় ওঠে এসেছি। আমাদের একদিকে সবুজ চাদর জড়িয়ে রেখেছে বাংলাদেশকে। অন্যদিকে ভোগাই নদীর ওপারে অন্ধকারের চাদর ঢেকে রেখেছে ভারতকে। দুই দেশের মাঝখানে আমরা। দুটো দেশকে মনে হলো নিছক দুটো মানচিত্র। ইচ্ছে হলেই ভাঁজ করে গলিয়ে নিতে পারি বুক পকেটে।
কিন্তু আমাদের পকেট ততটা বড় নয়। এর সীমা বাঁধা আছে। আর এই পকেট এবং আমাদেরকেসহ গোটা জগৎ যিনি সৃষ্টি করেছেন, তিনিই কেবল অসীম। তিনি আমাদের স্রষ্ঠা।
নিজেদের সীমাবদ্ধতা নিয়ে অনুযোগ জানাতে চাইলাম অসীম স্রষ্টার কাছে।

মগ্ন হলাম মেডিটেশনে। আমরা তখনো দুই দেশের মধ্যবর্তী পাথুরে টিলার শৃঙ্গে। মাথার ওপর চাঁদের আবছা আলো। মিটমিট করে জ্বলছে কয়েকটি তারা।
বন্ধ হয়ে এলো নয় জোড়া চোখ। একশ’ থেকে উল্টো করে গুনতে গুনতে শুন্য পর্যন্ত এলাম। নয়টি মনকে স্থির করলাম একটি কেন্দ্রে। তারপর সসীম হয়েও ধর্না দিলাম অসীমের কাছে। অনুযোগ জানালাম যার যার মতো করে।
চল্লিশ মিনিট মেয়াদি মেডিটেশন শেষে চোখ খোলার পর এক পশলা হাওয়া এসে কাঁপিয়ে দিলো শরীর। তারপর কয়েক সেকেন্ড হাওয়ার শব্দ ছাড়া কিছুই শুনতে পাইনি। আরো কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষা…

এবং সবশেষে নিজেদের ভেতর যে বোধ তৈরি হলো- আমরা সসীম হয়ে জন্মেছি, সসীমই থাকবো। তবে সসীমের ভেতর খুঁজে নিতে হয় অসীমকে। কিন্তু আমরা পরিচয়হীন, উদ্দেশ্যহীন এবং গন্তব্যহীন।
সুতরাং আমরা বিভ্রান্ত। আর বিভ্রান্তদের জন্য অসীমের ফটক সিল করা।
মেডিটেশন থেকে ‘বিভ্রান্ত’ তকমা নেয়ার কিছু সময়ের মধ্যে জাগতিক জগতেও বিভ্রান্তিতে পড়লাম আমরা। সময় তখন পৌনে পাঁচটা।
দ্রিম দ্রিম করে কয়েকটি গুলির শব্দ ভেসে এলো কানে!
তারপর মুহুর্মুহু গুলিতে কেঁপে উঠলো পাহাড়ি উপত্যকা।
এই গুলিবর্ষণ চললো ঘন্টাখানেক।

ভয়ের কিছু নেই।
ওগুলো বিএসএফের নিয়মিত অনুশীলনের অংশ।

পূর্বের পর্বগুলোঃ  –