মেঘমেদুর বর্ষায় আপনি যদি কখনো শাহবাগ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির দিকে হাঁটতে থাকেন, তাহলে ডান পাশের পথ ধরে হাঁটুন। জাদুঘরের গেট পেরোতেই কাঠগোলাপের সুগন্ধ আপনাকে মোহিত করবে। আরেকটু এগিয়ে গণগ্রন্থাগারের কাছে গেলে পাবেন স্বর্ণচাঁপার মধুগন্ধ। তারপর চারুকলা অনুষদের ভেতরে পাবেন বিখ্যাত দোলনচাঁপা। টিএসসি থেকে খানিকটা দূরে থাকতেই চোখে পড়বে অনেক উঁচু একটি গাছ। টিএসসির দেয়াল-লাগোয়া এই গাছটির নাম বুদ্ধনারকেল। অপরিণত পাতার আড়ালে ঝুলে আছে অনেকগুলো ফল। এর পাশেই জড়াজড়ি করে দাঁড়িয়ে আছে ফুলে ভরা আরও দুটি গাছ; পাতার গড়নের দিক থেকে দেখতে অনেকটা বুদ্ধনারকেলের মতোই। দেখুন তো, গাছগুলো চিনতে পারেন কি না? এদের নাম বেরিয়া। নাম শুনেই বুঝতে পারছেন, এগুলো আমাদের দেশি গাছ নয়। তবে এখানে এসেছে অনেক আগেই। শ্যামলী নিসর্গ গ্রন্থে অধ্যাপক দ্বিজেন শর্মা জানিয়েছেন, ‘এখানকার গাছের দুটি প্রজাতির মধ্যে সাদৃশ্য এতই স্পষ্ট যে পেশাদার বিজ্ঞানী কিংবা বর্ষব্যাপ্ত পর্যবেক্ষণ ছাড়া তাদের পার্থক্য নির্ণয় কঠিন।’
যা-ই হোক, এদের সামঞ্জস্য যতই স্পষ্ট হোক, বৈষম্যও কিছু কম নয়। তারা শুধু দুই প্রজাতিই নয়, দুটি স্বতন্ত্র গোত্রও। বেরিয়া পাটগোত্রীয় আর বুদ্ধনারকেল জংলি বাদামের আত্মীয়।
এ গাছ তুলনামূলকভাবে ঢাকাসহ প্রায় সারা দেশেই দুর্লভ। ধানমন্ডির ২২ নম্বর রোডে আবাহনীর মাঠ-লাগোয়া দেয়ালের ধারে বেশ বড় কয়েকটি বেরিয়ার (Berria cordifolia) পরিকল্পিত বীথি চোখে পড়ে। মিরপুর জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানে আছে চার-পাঁচটি গাছ। সব মিলিয়ে হাতেগোনা কয়েকটি।
বেরিয়া মধ্যমাকৃতির পত্রমোচি বৃক্ষ। কাণ্ড সরল, উন্নত, ধূসর, প্রায় মসৃণ। শাখা ঊর্ধ্বমুখী, পত্রঘন ও পত্রবৃহৎ, দীর্ঘ বৃন্তক, তাম্বুলাকৃতি, শিরাজালে সুচিহ্নিত, পাতলা, ঘন সবুজ, দন্তরপ্রান্তিক। গ্রীষ্মের একেবারে শেষ ভাগে প্রস্ফুটন প্রস্তুতি শুরু হয়। বর্ষার প্রথম ভাগে ফুল ফুটতে শুরু করে, থাকে কয়েক দিন। মূলত নতুন পাতা গজানোর পরপরই অজস্র মঞ্জরিতে আচ্ছন্ন হয় গাছ। সাদা পাপড়ির সঙ্গে সোনালি হলুদ পরাগচক্র এ ফুলের শোভা। ফল স্থায়ী বৃতিযোগে পক্ষল, ঘন বাদামি এবং সংখ্যায় ফুলের মতোই অজস্র।
কাঠ গাঢ় লাল, ভারী ও দীর্ঘস্থায়ী। ঘরের কড়ি-বরগা থেকে গরুর গাড়ি, নৌকা, চাষের যন্ত্রপাতি সবই এই কাঠে তৈরি হয়। শ্রীলঙ্কায় এটাই প্রধান কাঠ। বাকল থেকে স্থূল আঁশ পাওয়া যায়। আদি আবাস শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমার, আন্দামান ও দক্ষিণ ভারত। বেরিয়া নামাংশ ডা. অ্যান্ড্রু বেরিয়ার স্মারক। কলকাতার শিবপুর বোটানিক্যাল গার্ডেনে তাঁর অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে স্যার উইলিয়াম রক্সবার্গ গাছটির সঙ্গে এই মাদ্রাজি তরুবিদের নাম যুক্ত করেন। আর কর্ডিফোলিয়া অর্থ তাম্বুলাকৃতি পাতা। বেরিয়ার আরও কয়েকটি পরিকল্পিত বীথি করা সম্ভব হলে বর্ষায় উঁচু গাছের ফুলের দৈন্য কিছুটা হলেও কমবে। আইইউসিএনের পর্যবেক্ষণে এই গাছটি বর্তমানে সারা বিশ্বে বিপন্ন অবস্থায় রয়েছে। বংশবৃদ্ধি বীজ থেকে।
– লিখেছেনঃ মোকারম হোসেন
এর পরে টিএসসিতে গেলে দেখতে হবে তো !
সারা দেশের এসব দুর্লভ আর এ্যান্টিক শ্রেনির গাছগুলোকে চিন্হিত করে একটা ওয়েব ডাটাবেইজ করা উচিত। সরকার বা যে কেউ একটা সাইট করে সবাইকে আহবান করলেই, সবাই পরিচিত এসব বিশেষ গাছের সুনির্দিষ্ট অবস্থান (ল্যাটিচিউড-লঙ্গিচিউড সহ), ছবি সহ বিস্তারিত বর্ননা তাতে খুব সহজেই পোস্ট করতে পারবে। এমন কি গুগল আর্থ থেকে গাছটি সেই লোকেশনে কি অবস্থায় আছে, তাও চেক করা যাবে।