‘সামাজিক দায়বদ্ধতার প্রশ্নে সাংবাদিকতা একটি মহৎ পেশা’ এ কথা আজ নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। উদ্ভব ও বিকাশের পটভূমিতে সাংবাদিকতা আজ সত্য, ন্যায় ও শান্তি প্রতিষ্ঠার অবিরাম প্রয়াস। এই প্রয়াসের মূল চালিকাশক্তি একজন সাংবাদিকের নিজ পেশার প্রতি আপসহীন নীতি, দায়িত্ববোধ ও সাহস।
সাংবাদিকদের এই সাহসিকতা রোধে সুবিধাবাদী গোষ্ঠী বরাবরই সাংবাদিক সমাজে ভয় ও আতঙ্ক তৈরি করতে চায়। কখনও তা করে হুমকি দিয়ে, কখনও বা হত্যা করে, কখনও জেলে পুরে বা মামলা দিয়ে, আবার কখনও তা সাংবাদিকদের শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতনের মাধ্যমে। আমরা যাঁরা এই পেশার সাথে প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে জড়িত কেবল তারাই ভাল জানেন, সাংবাদিক নির্যাতনের এই বহুমাত্রিক পথ আমাদের এই ঘুণেধরা গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় দিনকে দিন কতটা প্রসারিত হচ্ছে। এর পেছনে মূলত দায়ী জাতীয় কিংবা স্থানীয় রাজনীতির ক্ষমতার নষ্ট বলয়ে বেড়ে ওঠা কায়েমী স্বার্থবাদী মহল, ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা ব্যক্তির আত্মীয়-স্বজন, রাজনৈতিক দলের সমর্থক ও বিভিন্ন পেশাজীবী গোষ্ঠী; যাদের মূল কাজ অন্যের, কখনো বা সরকারি সম্পদ জবরদখল বা দখল করতে সহায়তা, অবৈধ ব্যবসা, ঘুষ ও তদবির এবং এ অন্যায় পথে বাঁধা সৃষ্টিকারীদের ওপর নির্যাতন, গুম ও খুন।
এই নির্যাতনের পথে সাম্প্রতিক বলি কিশোরগঞ্জের সাহসী সাংবাদিক, নিবেদিত সংস্কৃতিকর্মী, কবি ও কালের কন্ঠের হাওরাঞ্চলের নিজস্ব প্রতিবেদক নাসরুল আনোয়ার। তিনি দুর্বৃত্তদের হামলায় প্রাণে বেঁচে গেলেও গুরুতর জখম হয়ে অসহ্য শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণা বুকে চেপে নিরাপত্তাহীন পরিস্থিতিতে দিন কাটাচ্ছেন। পেশাগত কারণে এ দুর্বিষহ জীবন শুধু আজ নাসরুলের একার নয়; এ দায় বয়ে বেড়াতে হয় তাঁর মতো নির্ভীক সাংবাদিকদের পরিবার আত্মীয় পরিজনেরও।
গণমাধ্যমের কল্যাণে কিশোরগঞ্জ তথা বাংলাদেশের সুধী সমাজ জেনে গেছেন, গত ৩ আগস্ট রবিবার ভোররাতে বাজিতপুর পৌরশহরের বসন্তপুরে তাঁর বাসায় একদল মুখোশ পরা দুর্বৃত্ত ঢুকে তাঁকে হত্যার চেষ্টা চালায়। বল্লমটি তাঁর বুকের বাম পাশে বিদ্ধ না হয়ে বাম বাহু এফাড়-ওফোড় হয়ে যায়। এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বাজিতপুর, ভৈরব, কুলিয়ারচর, কটিয়াদী, নিকলী, অষ্টগ্রাম তথা কিশোরগঞ্জের সাংবাদিক সমাজ ঘটনার মূল রহস্য উৎঘাটন, সত্যিকার অপরাধীকে খুঁজে বের করে আইনের আওতায় নিয়ে আসাসহ আহত সাংবাদিকের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে সপ্তাহব্যাপী মিছিল, সমাবেশ, মানববন্ধন করেন।
এছাড়াও তাঁরা জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপারের কাছে স্বারকলিপি প্রদানের মাধ্যমে শান্তিতপূর্ণভাবে লাগাতার কর্মসূচি পালন করে আসছেন। আমরা জানি যে, নাসরুলকে হত্যাচেষ্টার ঘটনা এটাই প্রথম নয়। বিগত বিএনপি জোট সরকারের আমলেও তাঁকে একাধিকবার হত্যা এবং অপহরণের চেষ্টা করা হয়। প্রতিবারই তিনি ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেছেন।
কিশোরগঞ্জে সাংবাদিক নির্যাতনের ইতিহাস খুব দীর্ঘ সময়ের না হলেও বিগত এক দশক ধরে এই মাত্রা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। জেলার অপর সুনামধন্য সাংবাদিক প্রথম আলোর ভৈরবের প্রতিবেদক সুমন মোল্লার বাড়িতে দুর্বৃত্তরা কয়েক বছর আগে হানা দেয়। গত ৬ আগস্ট জেলার অষ্টগ্রামের বাংলানিউজটোয়েন্টিফোরডটকমের হাওরাঞ্চল প্রতিনিধি ফরিদ রায়হানও হামলার শিকার হয়েছেন।
কিশোরগঞ্জ জেলার সাংবাদিক সমাজের জন্য সাম্প্রতিক কালের ঘটনাগুলো এক ধরণের অশনি সংকেত। জেলার হাওরাঞ্চল বিশেষ করে বাজিতপুর ও ভৈরব হচ্ছে সাংবাদিকতার ঝুঁকিপ্রবণ এলাকা; যা বিগত সাংবাদিক নির্যাতনের তথ্যাবলী এ কথা প্রমাণ করে। এই ঝুঁকির অন্যতম রহস্য ক্ষমতার পালাবদলে থাকা লোকজনের এলাকার অর্থনৈতিক প্রাণশক্তি হাওরের বিল-জলাভূমি এবং ক্ষেত্রবিশেষে এলাকার খাস জমি দখল। এসব জলাভূমি আজ পতিতা-সদৃশ। রাতের আঁধারে পতিতা যেমন খদ্দরের হাতবদল হয়; তেমনি জলাভূমিও ক্ষমতার পালাবদলের সাথে সাথে হাতবদল হয়।
এভাবেই প্রতিনিয়ত ক্ষমতাসীনদের দ্বারা ‘ধর্ষিত’ হচ্ছে হাওরের বেংলা-চরাবাধাসহ বহু জলাভূমি। তার সাথে নির্যাতিত হচ্ছে নাসরুলদের মতো সাংবাদিক; যাঁরা প্রকৃত জেলেদের হাতে জলাভূমি এবং প্রাপ্য মালিকদের হাতে খাস জমি ফিরিয়ে দেওয়ার আন্দোলনের সাহসী কলম সৈনিক। তাই নাসরুলকে হয়তো বারবার হত্যাচেষ্টার রহস্য আজ শুধু সরল রেখার ওপর দাঁড়িয়ে এর একরৈখিক বিশ্লেষণে বের করা সম্ভব নয়। এ গাঢ় রহস্যের ব্যাপ্তি ও প্রভাব অনেক গভীরে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে প্রধানত লেখালেখির কারণে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর স্বার্থ ক্ষুন্ন হলে সাংবাদিকের ওপর তারা এই ধরণের সহিংসতা বা নির্যাতন চালায়; এতে কেউ সাময়িক, কেউ বা চিরতরে পঙ্গুত্ব বরণ করেন, আবার কাউকে করা হয় হত্যা। দেশের ইতিহাসে ১৯৯০ পরবর্তী সময়ে প্রায় ৪০-৪৫জন সাংবাদিককে নিমর্মভাবে হত্যা করা হয়; যাঁদের একজনকেও ব্যক্তিগত কারণে নয় বরং সমাজের অপরাপর মানুষের পক্ষে মিডিয়ায় সত্য তুলে ধরার কারণেই তাদের জীবন দিতে হয়েছে।
এদের মধ্যে সংখ্যায় সবচে বেশি দক্ষিণাঞ্চলের সাংবাদিকরা। অথচ নিহতের স্বজনরা এইসব হত্যাকান্ডের এখনও সুবিচার পায়নি। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে লক্ষ করলে দেখা যায়, কায়েমী স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী সাংবাদিক নির্যাতনের সাথে সম্পর্কিত। তা দমনে সরকারের প্রয়োজন আশু পদক্ষেপ গ্রহণ। না-হয় সামনের দিনগুলোতে ফরিদপুরের নিহত সাংবাদিক গৌতম দাস, যশোরের জামালউদ্দিন, একুশে পদক প্রাপ্ত আফতাব আহমদ কিংবা সাগর-রুনি হত্যাকান্ডের মতো আলোচিত আরো বহু ঘটনার সামনের দিনগুলোতে জন্ম দিতে পারে এ গোষ্ঠী।
তথ্যমতে, ২০১২ সালে সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে ২১২টি। যেখানে ৫১২ জন সাংবাদিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন; যার মধ্যে সংবাদ প্রকাশের জের ধরে ১২৮জন, পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে ২৫৬জন সাংবাদিক নির্যাতনের শিকার হন এবং খুন হয়েছেন তিনজন সাংবাদিক। গেল বছর এ মাত্রা ছিল ৪০৪জনে। এরমধ্যে ২৪১জন পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে এবং ৬৩জন সংবাদ প্রকাশের জের ধরে নিগৃহের শিকার হন।
২০১৩ সালে তিনজন সাংবাদিক খুন হয়েছেন। সাংবাদিক নির্যাতন একটি উদ্বেগজনক প্রবণতা। এ প্রবণতা মুক্ত সাংবাদিকতার জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। সাংবাদিকতায় এত চ্যালেঞ্জ থাকা সত্ত্বেও একটি ইতিবাচক দিক হলো, প্রভাবশালী কায়েমী গোষ্ঠীর ভয়ে আজ পর্যন্ত একজন সাংবাদিকও পেশা ছেড়ে অনত্র চলে যাননি। বরং তাঁদের পেশাগত দায়িত্ববোধ আরও বেশি শাণিত হয়েছে। নিশ্চয় নাসরুলদের মতো সাংবাদিকদের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হবে না। তবে সাংবাদিক নির্যাতন রোধে প্রতিটি ঘটনার যথাযথ তদন্ত করে দুর্বৃত্তদের বিচারের আওতায় এনে সুবিচার নিশ্চিত করতে প্রয়োজন গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান ও সাংবাদিকতা সংশ্লিষ্ট পেশাজীবী সংগঠনগুলোর সুদৃঢ় ঐক্য এবং সর্বোপরি এ ক্ষেত্রে সরকারের কার্যকর পদক্ষেপ।
নির্যাতিত সাংবাদিকের মানসিক স্বস্তির দিকটিও ভাবা দরকার। এটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তা হচ্ছে, নির্যাতিত সাংবাদিকের পাশে তার নিজ গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের দুহাত প্রসারিত করে দাঁড়ানোর সংস্কৃতি এদেশে এখনো সেভাবে গড়ে ওঠেনি। আর কিছু না হোক, নির্যাতিত সাংবাদিকের আত্মসম্মানবোধ জাগিয়ে রাখতে তার প্রয়োজন রয়েছে।
সাংবাদিক নাসরুলকে হত্যাচেষ্টার সুবিচার নিশ্চিত করতে স্থানীয় প্রশাসনের প্রতি সাংবাদিক সমাজের দাবি, অবিলম্বে প্রকৃত হত্যাচেষ্টাকারী দুর্বৃত্ত ও নির্দেশদাতাকে খুঁজে বের করে আইনের আওতায় নিয়ে আসা। তবে নাসরুল তথা সাংবাদিকদের পেশাগত নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই যে শেষ কথা নয়, তা ভাববার সময় এসেছে। নাসরুল আনোয়ার যে কিশোরগঞ্জের পেশাদার ও প্রতিনিধিত্বকারী সাংবাদিকদের একজন, তা অস্বীকারের উপায় নেই। তাঁর মতো ব্যক্তি যেখানে নিজ বসতঘরে এতটা অনিরাপদ, সাধারণ মানুষ কেমন আছে তা না জানলেও চলে। ব্যাপকভাবে আজ এ দাবি তোলার সময় এসেছে, সকল নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পুলিশ প্রশাসনকে নিরপেক্ষ ও প্রভাবমুক্ত হয়ে যথাযথ ভূমিকা পালন করতে হবে।
রাষ্ট্র তার নাগরিকের সার্বিক জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে, এটাই শেষ কথা হওয়া উচিত। আমরা জানি, গণতন্ত্রের জন্য বহুমত ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা অন্যতম অনুষঙ্গ। একজন সাংবাদিক মুক্ত তথ্য প্রবাহের মাধ্যমে দেশের জনগণের মধ্যে কোনো বিষয়ে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় তুলতে পারেন। এরমধ্যে দিয়ে সরকারও সঠিক সিদ্বান্ত গ্রহণে সচেষ্ট হয়। তাই সাংবাদিকদের কন্ঠরোধ করা মানে আলোর বিচ্ছুরণ বন্ধ করে সমাজকে অন্ধকারে ঠেলে দেওয়া ও উন্নয়ন-অগ্রগতির পথকে বাধাগ্রস্থ করা। নাসরুল আনোয়ারের ওপর আক্রমণই হোক এদেশে সাংবাদিক নির্যাতনের শেষ ঘটনা; এ অনিরাপত্তার সংস্কৃতি থেকে মুক্তির প্রত্যাশার অধিকার আমরা হারাতে চাই না।
মাহবুবুর রহমান ভূঁইয়া:
উন্নয়ন প্রশিক্ষক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট