মারুফ আহমেদ : বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের শতবর্ষী বিপ্লবী নেতা ডা: জগবন্ধু রায় (জে.বি. রায়) আর নেই। আজ বুধবার সকালে কিশোরগঞ্জ শহরের নগুয়া এলাকার নিজ বাসভবনে ১০১ বছর বয়সে তিনি মারা গেছেন। রুপকথার মত এক দু:সাহসিক সংগ্রামী জীবন শেষে তিনি আজ পাড়ি জমিয়েছেন না ফেরার দেশে। বার্ধক্যকে জয় করে তিনি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সচল এই মানুষটি নীতি আদর্শের প্রতি অবিচল ছিলেন।
আজীবন অসাপ্রদায়িক ও প্রগতিশীল চেতনার অনুসারী ডা: জে.বি. রায়ের মৃত্যুর খবর শুনে তাঁকে এক নজর দেখতে সর্বস্তরের অসংখ্য মানুষ বাসায় ভীড় করে। মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী, তিন ছেলে, দুই মেয়ে নাতি-নাতনিসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। জগবন্ধু রায় একেবারেই প্রচার বিমুখ হয়ে কিশোরগঞ্জ শহরের বাসভবনে নিরবে নিভৃতে জীবনের অন্তিম সময় অতিক্রম করছেন। গত ৫ অক্টোবর একশত এক বছরে পদার্পন করেছিলেন এই বিপ্লবী।
১৯৩৪ সাল। বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে। জগবন্ধু রায় তখন ৮ম শ্রেনীর ছাত্র। নেতাজি সুবাস বসু’র বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স পার্টির সভায় নেতাদের চোখে পড়েন তিনি। নেত্রকোনার জমিদার পুত্র বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স পার্টির নেতা বিপ্লবী জ্যোতিষ জোয়ারদারের হাত ধরেই তাঁর পার্টিতে যোগদান। স্বাস্থ্যবান, বুদ্ধিমান আর সাহসী যুবকদের সংগ্রহ করা হতো এ পার্টিতে। আন্ডারগ্রাউন্ড পলিটিক্যাল একটিভিটিস্ হিসেবে তাঁদেরকে কাজ করতে হতো। একজনের সাথে অন্যজনের যোগাযোগ থাকতো না। কমান্ড এসে যেত আর তাঁরা সে অনুযায়ী তাঁরা কাজ করতেন। দেশ মাতৃকার মুক্তির জন্য তিনি মৃত্যুতে পরোয়া করতেন না।
এমনি করে ১৯৩৭ সালে মাত্র চার বছরের মাথায় তাঁকে দায়িত্ব দেয়া হয় কিশোরগঞ্জের। নজরে আসেন তিনি বৃটিশ শাসকগোষ্ঠীর। তাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে কোন রকমে মেট্রিক পরীক্ষা দিতে পারলেও এর পর আর প্রকাশ্যে আসেননি তিনি। এর মধ্যে নেতাজি সুবাস চন্দ্র বসু, সত্য গুপ্ত, জ্যোতিস জোয়ারদার, জ্যোতিষ রায়, ভ’পেন্দ্র কিশোর, লেখক লক্ষিত রায় কিশোরগঞ্জ ও ময়মনসিংহ এলে একাধিকবার তাঁদের সঙ্গে দেখা ও কথা হয় জগবন্ধু রায়ের। পরে বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন করতে যেয়ে ১৯৪০ সালে এক পর্যায়ে তিনি গ্রেপ্তার হলে তাকে পাঠিয়ে দেয়া হয় ময়মনসিংহ জেলে। ১৯৪২ সালে জে.বি. রায়কে ময়মনসিংহ থেকে পাঠিয়ে দেয়া হয় ক্যালকাটা প্রেসিডেন্সি জেলে। ৬ মাস পর সেখান থেকে স্থানান্তর করা হয় দমদম সেন্ট্রাল জেলে। সেখানে প্রায় আঠারশ’ রাজবন্দীদের সংগে তিনিও ছিলেন একজন। সেখানে থেকেই তিনি হোমিও চিকিৎসা বিদ্যায় এমবিএইচ কোর্স সমাপ্ত করে সনদ অর্জন করেন।
তাঁর কাছে অনেকের প্রশ্ন ছিল অনেক বিপ্লবীর মতো আপনিওতো শিরোনাম হতে পারতেন অনেক আগেই। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম জানতে পারতো আপনাকে, আপনার সংগ্রামী জীবনকে।তবে কেন নিজেকে চেপে রেখেছেন ? এ প্রশ্নের উত্তরে তাঁর ছিল সত্যিকার নির্লোভ এক দেশপ্রেমিকের মত। সহাস্যে তিনি বললেন, নাম-যশ হোক আর আমি বড় নেতা হই, এ উদ্দেশ্যে বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন করিনি। বিপ্লবের জন্য জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন সময় উৎসর্গ করেছিলাম ও একনাগারে সাত বছর জেল খেটেছিলাম ভারতবর্ষের পিছিয়ে পড়া বিশাল জনগোষ্ঠীর মুক্তির জন্যে। তিনি বলেন, একজন স্বাধীনতাকামী সংগ্রামী মানুষের কাছে স্বাধীন মাতৃভূমি পাওয়াই সবচেয়ে গৌরবের। এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি আর কিছু নেই বলেও তিনি আজীবন বিশ্বাস করে গেছেন। আজ বুধবার বিকেলে কিশোরগঞ্জের আমলিতলা স্মশানঘাটে তাঁর শেষকৃত্য অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়।
রাষ্ট্রপতির শোক :
শতবর্ষী বিপ্লবী নেতা ডা: জে.বি. রায়ের মৃত্যুতে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। রাষ্ট্রপতি দেশের মুক্তি সংগ্রামে তাঁর অসামান্য অবদানের প্রতি সম্মান জানিয়ে শোক সন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছেন। এ ছড়া জেলার বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও পেশাজীবী সংগঠনের নেতৃবৃন্দ ডা: জে.বি. রায়ের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন।