“ব্রেইন স্ট্রোক” নিয়ে এই টিউনটি লিখতে বসলাম।  চিকিৎসা বিজ্ঞানের ঈষর্ণীয় উন্নতির ফলেও কিছু কিছু রোগ আজ ও বিজ্ঞানীদের ভাবিয়ে যাচ্ছে। সেই সমস্ত ভয়বহ রোগের মধে্য একটি হল স্ট্রোক (stroke)। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় স্ট্রোক এর অর্থ হল *প্রকট স্নায়ুরোগ*। স্ট্রোক বলতে অনেকেই হার্ট এ্যাটাক মনে করে থাকেন। কিন্তু আসলে তা নয়। স্ট্রোক মানে ব্রেইন স্ট্রোক। এটা মস্তিস্কের এক ভয়াবহ সমস্যা।  মস্তিষ্কের কোষগুলোর কাজ চালিয়ে যাওয়ার জন্য নিরবচ্ছিন্ন রক্ত সরবরাহ ব্যবস্থা গুরুত্বপূর্ণ। কারণ মস্তিষ্কই পুরো দেহের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করে। রক্তের মাধ্যমে মস্তিষ্ক প্রয়োজনীয় অক্সিজেন এবং গ্লুকোজের সরবরাহ পায়। কোন কারণে এই সরবরাহে ব্যাঘাত ঘটলে সে অংশের কোষগুলো নষ্ট হয়ে যেতে পারে, চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় এটিই ব্রেইন স্ট্রোক নামে পরিচিত।

স্ট্রোকের কারণে শরীরের কোন একটি অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হলে ঐ অংশ শরীরের যে অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে চালিত করত তা অবশ হয়ে যেতে পারে। মস্তিষ্কের ডান অংশ শরীরের বাম অংশকে পরিচালিত করে, আর বাম অংশ শরীরের ডান অংশকে পরিচালিত করে। কাজেই স্ট্রোকের কারণে মস্তিষ্কের কোন একটি অংশ পুরোপুরি ক্ষতিগ্রস্ত হলে শরীরের বিপরীত অংশ অবশ হয়ে যেতে পারে। যদি শরীরের এক অংশ অচল হয়ে যায় তখন তাকে হেমিপ্লেজিয়া(hemiplegia) বলে। আর যখন এক অংশ অবশ হয়ে যায় তখন তাকে হেমিপেরেসিস(hemiparesis) বলে।

প্রকারঃ স্ট্রোক মোটামুটি দুই ধরনের হয়ে থাকেঃ
১। ইসচেমিক(ischemic):
এক্ষেত্রে মস্তিষ্কের কোন এক অংশে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
২। হেমোরোজিক(hemorragic):

এক্ষেত্রে রক্তনালি ফেটে গিয়ে রক্ত মস্তিস্কে ছড়িয়ে পড়ে এবং মস্তিস্কের উপরে চাপ সৃষ্টি করে। এতে মস্তিস্ক তার স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলে।
উভয় ধরনের স্ট্রোকই মারত্তক। তবে তুলনামূলকভাবে হেমোরোজিক স্ট্রোকে মৃত্যুর সম্ভাবনা বেশী।

স্ট্রোক কাদের হয়: আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষ এখনো বিশ্বাস করে ব্রেইন স্ট্রোক সাধারন বয়স্কদের হয়ে থাকে, আর মহিলাদের তুলনায় পুরুষের বেশী হয়ে থাকে। কিন্তু তাদের এই ধারনা সম্পূর্ণ ভূল। স্ট্রোক নারী-পুরুষ যে কারোই হতে পারে। আরে অল্প বয়সে স্ট্রোক হওয়া ও অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিছুদিন আগে আব্বুকে যে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলাম সেখানে দেখলাম প্রায় ১৫-১৬ বছরের একটা ছেলে বেডে শুয়ে আছে। তার চিকিৎসা চলছে। পরে ডাক্তারের কাছ থেকে জানতে পারলাম তার ব্রেইন স্ট্রোক হয়েছে।

লক্ষণসমূহঃ দু’ধরনের স্ট্রোকের ক্ষেত্রেই একই ধরনের লক্ষণ দেখা যায়। মস্তিষ্কের কোন এলাকায় রক্ত চলাচলে ব্যাঘাত ঘটলো, কতটা এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হল ইত্যাদি বিষয়ের ওপর লক্ষণগুলো পরিবর্তিত হয়। যে কোন ধরনের স্ট্রোকের ক্ষেত্রেই দ্রুত চিকিৎসককে দেখানো উচিত। দেরি করলে নতুন নতুন লক্ষণ দেখা দেয় এবং এক পর্যায়ে সেটি সারিয়ে তোলা কঠিন হতে পারে।

• মাথা ঘোরা,
• হাটতে অসুবিধা হওয়া,
• শরীরের ভারসাম্য রক্ষায় অসুবিধা হওয়া
• কথা বলতে সমস্যা হওয়া
• অবশ, দুর্বলতা লাগা, শরীরের এক পাশ অকেজো হওয়া
• চোখে ঘোলা লাগা, অন্ধকার লাগা বা ডাবল দেখা, হঠাৎ চোখে কিছু না দেখা
• হঠাৎ খুব মাথা ব্যথা

স্ট্রোকের কারণঃ এই ব্যপারটায় আমাদের সবচাইতে বেশী সচেতন হওয়া জরুরী। স্ট্রোক ও হৃদরোগ(heart attack) দুটো আলাদা হলেও কারনগুলো প্রায়ই একই।

• উচ্চ রক্তচাপ স্ট্রোকের বড় কারণ।
• বেশি কোলেস্টেরল
• ডায়াবেটিস বা বহুমূত্র রোগ
• ধুমপান
• স্থূলতা
• মদ্যপান
• পরিবারে অন্য কারো স্ট্রোকের ইতিহাস
• হৃদরোগ। ইত্যাদি…
করণীয়ঃ
• রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা
• সম্পৃক্ত চর্বি যেমন যেমন প্রাণীজ তেল, ডিমের লাল অংশ, ঘি, মাখন, অথবা জমে যায় এমন ধরনের যে কোন তেল খাওয়া কমিয়ে দিতে হবে।
• ধূমপান একেবারেই করা যাবে না।
• পলি আনস্যাচুরেটেড ফ্যাট যেমন সয়াবিন তেল খাওয়া যাবে। মাছ এবং মাছের তেলও উপকারী।
• এন্টিঅক্সিডেন্ট যেমন ভিটামিন সি, ই এবং বিটা ক্যারেটিন সমৃদ্ধ খাবার স্ট্রোকের ঝুঁকি কমায়।
• একবার স্ট্রোকে আক্রান্ত রোগীদের জন্য লো ডোজ অ্যাসপিরিনও বেশ উপাকারী, আবার স্ট্রোকের ঝুঁকি কমায়।
• নিয়ম মাফিক খাবার খাওয়া
• সতর্ক ভাবে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করা
• নিয়ম করে হাটা বা হালকা দৌড়ানো
• দুশ্চিন্তা নিয়ন্ত্রণ করা
• মাদক না নেয়া , মদ্যপান না করা

স্ট্রোক হয়েছে কিনা বোঝার সাধারণত জন্য যেসব পরীক্ষা করা হয়:

• রক্তচাপ, কোলস্টেরল, ডায়াবেটিস, এমিনো এসিড ইত্যাদি মাপা
• আলট্রা সাউন্ডের মাধ্যমে ঘাড়ের আর্টারির ছবি নিয়ে রক্তনালি সরু হয়েছে কিনা সেটা দেখা
• এনজিওগ্রাফি: এক ধরনের রং শরীরে প্রবেশ করিয়ে এক্স-রে-এর মাধ্যমে শরীরে রক্ত চলাচলের চিত্র নেয়া হয়।
• এছাড়া সিটি স্ক্যান এবং এমআরআই-এর মাধ্যমে মস্তিষ্কের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করা হয়।
• ইকোকার্ডিওগ্রাফির মাধ্যমে হৃদপিন্ডের ছবিও নেয়া হয়।

চিকিৎসককে জিজ্ঞাসা: চিকিৎসা শেষ করে রোগীকে বাসায় নিয়ে আসার সময় ডাক্তারকে এই প্রশ্নগুলো জিজ্ঞাসা করা জরুরী।

১। কোন ধরনের খাবার-দাবার রোগীর জন্য উপযোগী?
২। ওষুধপত্র কতদিন খেতে হবে?
৩. কী ধরনের কাজ করা যাবে অথবা যাবে না।
৪. ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া কোনো ওষুধ খাওয়া যাবে কি?
৫. অন্য কোনো চিকিৎসকের পরামর্শের প্রয়োজন আছে কি?
৬. কোনো কারণে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হলে কী করা উচিত?
৭. রাতে ঘুম না এলে ঘুমের ওষুধ খাওয়া যাবে কি না?
৮. দ্বিতীয়বার স্ট্রোক হওয়ার আশঙ্কা বা ঝুঁকি কতটুকু?
৯। স্বাভাবিক জীবনযাপন কি করা যাবে?
১০। স্ট্রোক প্রতিরোধের জন্য কি কি করতে হবে?
১১। কতদিন পর আবার যোগাযোগ করতে হবে?

আমাদের সকলকে অন্তত এই সাধারন জিনিসগুলো মাথায় রাখতে হবে। তাতে অন্তত একটু সচেতনার সাথে রোগির পরিচর্যা কিংবা রোগিকে সঠিক চিকিৎসা প্রদানে সহযোগিতা করতে পারবো।