ভাটার সময় সুন্দরবনের মাঝারি নদী ও খালগুলোর পাড়ের কাদায় লক্ষ করলেই দেখা যায়, কারা যেন আলতো পায়ে কাদা মাড়িয়ে হেঁটে গেছে। পায়ের ছাপ অনেকটা হাঁসের পায়ের মতো। কখনো খাল থেকে ওঠানামার ছাপ, কোথাও তীর বরাবর দলে অথবা একা হেঁটে যাওয়ার ছাপ। কখনো কখনো ছাপ খুঁজতে গিয়ে এদের বিকট গন্ধ পাওয়া যায়। অভিজ্ঞজনেরাও এ গন্ধকে বাঘের গন্ধ বলে ভুল করতে পারেন। এটি হচ্ছে ভোঁদড় বা উদবিড়ালের গন্ধ। সুন্দরবনবাসী এদের ‘ধাইরা’ বলতে পছন্দ করে।

জঙ্গলে এদের দেখতে পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। দলবলে যখন থাকে, তখন ভারি চেঁচায়। অধিকাংশ সময় এরা বাচ্চা নিয়ে শিকার খোঁজে। ভোঁদড় গোত্রের অন্যান্য প্রজাতি যেমন বেশির ভাগ সময় নিশাচর, বাদার ধাইরা (সুন্দরবনের স্থানীয় নাম) সব সময়ই কর্মতৎপর।

সুন্দরবনের তারাজালি জেলেরাও ভোঁদড় দিয়ে মাছ ধরেন। প্রথম দেখায় মনে হতে পারে, এগুলো জংলি ভোঁদড়। অনেকেই এই ভুল করেন। এগুলো আকারে বড়, গায়ের রং হালকা। বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে পাওয়া বিভিন্ন নদ-নদী ও খাল-বিলে চরা ভোঁদড়ের বৈজ্ঞানিক নাম Lutra perspicillata, ওজন সাত থেকে নয় কেজি। বাদার ধাইরার বৈজ্ঞানিক নাম Amblonyx cinereus, ওজন হয় তিন থেকে পাঁচ কেজি। পৃথিবীতে যত প্রজাতির ভোঁদড় পাওয়া যায়, তার মধ্যে বাদার ধাইরা আকারে সবচেয়ে ছোট। এদের ইংরেজি নাম Clawless otter— নখহীন ভোঁদড়। আসলে এদের নখ ঠিকই আছে, তবে আঙুল ছাড়িয়ে খুব একটা বাইরে নেই। অন্যান্য ভোঁদড়ের মতো বাদার ধাইরারও হাত-পায়ের আঙুলগুলো পাতলা চামড়ায় জড়ানো। দেহের রং কালচে বাদামি, দেহের নিচের অংশ ময়লা হলদে। ঠোঁট ও গলার দিককার রং প্রায় সাদা।

ভোঁদড়ের বৈশিষ্ট্য হলো এদের দেহে দুই স্তর লোম রয়েছে। প্রথম স্তর আকারে ছোট। এই লোমগুলো ‘ওয়াটার প্রুফ’। দ্বিতীয় স্তরের লোম লম্বা। এই লোমই আমাদের চোখে পড়ে, এগুলো জলে ভিজে ওঠে। এদের লেজ চ্যাপ্টা, ১০ থেকে ১২ ইঞ্চি (মাথা থেকে লেজ পর্যন্ত ১৮ থেকে ২২ ইঞ্চি) লম্বা। নৌকার দাঁড়ের মতো হাত-পা (পা হাতের চেয়ে বড়), শক্ত খাড়া গোঁফ জলে শিকার করার অত্যন্ত উপযোগী।

মাটিতে হাঁটার সময় ধাইরা খুব স্বচ্ছন্দ নয়। কিন্তু এদের লম্বাটে সিলিন্ডারের মতো দেহের গড়ন, চওড়া-চ্যাপ্টা মাথা, ছোট কান, নাকের ছিদ্রে ঢাকনা থাকায় এরা হয়ে উঠেছে জলে চলাচলের আদর্শ জীব। হাত-পা না নাড়িয়ে এরা শুধু মাথা জাগিয়ে যেমন ভেসে থাকতে পারে, তেমনি ছোটার দরকার হলে হাত-পা ও লেজের সাহায্যে তীব্র গতিতে জলের তলায় ছুটতে পারে। সুন্দরবনের ঘোলা জলে ভোঁদড়ের দৃষ্টিশক্তি খুব কাজে লাগে না। এদের গোঁফ যেহেতু খাড়া, জলে ভিজে গায়ে লেপ্টে যায় না, ঘোলা জলে এই স্পর্শকাতর গোঁফ শিকারের উপস্থিতি জানান দেয়। ধাইরার হাত-পায়ের পাতাও খুব স্পর্শকাতর। ফলে কাদায় লুকানো ঝিনুক, শামুক, চিংড়ি, কাঁকড়া এদের হাত থেকে রক্ষা পায় না। এদের শক্তিশালী ছুঁচালো দাঁত, মাড়ি পিচ্ছিল শিকার ধরতে বা মাছের মুড়ো চিবোতে অত্যন্ত কার্যকর।

অন্যান্য ভোঁদড়ের যেমন প্রথম পছন্দ মাছ, বাদার ধাইরার সবচেয়ে পছন্দের শিকার চিংড়ি, কাঁকড়া, ঝিনুক, শামুক ইত্যাদি শক্ত খোলসের প্রাণী।

ধাইরা বাসা তৈরি করে জোয়ার-সীমানার উঁচুতে কোনো বড় গাছের তলায় গর্ত করে। গর্তের কয়েকটি মুখ থাকে। গর্তে ঢুকতে হয় জলের তলা দিয়ে। কিন্তু বাচ্চা প্রসবের জায়গাটি থাকে শুকনো এলাকায়। মায়ের সঙ্গে দুই-তিনটির বেশি বাচ্চা দেখা যায় না। সামুদ্রিক ভোঁদড় ছাড়া অন্য কোনো ভোঁদড় বাদার ধাইরার মতো লবণ সহ্য করতে পারে না। বাদার ধাইরার শত্রু বাঘ, কুমির, হাঙর, মেছোবিড়াল ও মানুষ।