হবিগঞ্জের সাতছড়ির ফরেস্ট রেঞ্জার মুনির আহমেদ খান ও তাঁর স্ত্রী তানিয়া খানের নেশা পাখি ও জীববৈচিত্র্যের সন্ধানে বনবাদাড়ে ঘুরে বেড়ানো। সম্প্রতি লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানসংলগ্ন এক ঝরনার কাছে বেড়াতে গিয়ে তাঁদের চোখে পড়ে সাপের মতো এক প্রাণী। এমন প্রাণী তাঁরা আগে কখনো দেখেননি। দেখতে দুমুখো সাপের মতো, কিন্তু সাপ নয়। কিছুটা কুইচ্চার মতো, কিন্তু ঠিক তা-ও নয়। তানিয়া খান প্রাণীটির অনেকগুলো ছবি তুললেন। ই-মেইল করে পাঠিয়ে দিলেন বিশিষ্ট প্রাণীবিদ, দুবাই চিড়িয়াখানার প্রধান রেজা খানের কাছে।

রেজা খান ছবি দেখে জানালেন, এই প্রাণীর গোত্রীয় নাম Chikilidae (চিকিলিডি), বৈজ্ঞানিক নাম Chikila fulleৎi (চিকিলা ফুলেরি)। বাংলাদেশে এটির অস্তিত্ব আবিষ্কারের মানে, এই বদ্বীপ অল্পবয়সী নয়, এর সিলেটের মতো কিছু এলাকা বরং সুপ্রাচীন ভূখণ্ড। ১৪ কোটি বছর আগে পৃথিবীর অখণ্ড স্থলভূমি গন্ডোয়ানার অংশ হিসেবে এটি যুক্ত ছিল আফ্রিকার সঙ্গে। লেজহীন, প্রত্যঙ্গহীন উভচর এ প্রাণী আফ্রিকার আদি উভচর অন্য এক বাসিন্দার দোসর।

রেজা খানের সঙ্গে আমরাও যোগাযোগ করি। তিনি জানান, ছবি দেখে তিনি প্রাথমিকভাবে নিশ্চিত হয়েছেন, প্রাণীটি চিকিলা গণের ফুলেরি প্রজাতির। এটি সিসিলিয়ান পর্বের উভচর প্রাণী। সিসিলিয়ান পর্বের উভচর প্রাণীদের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এদের পা বা অন্য কোনো প্রত্যঙ্গ নেই।মুনির আহমেদ জানান, চিকিলাটি তাঁরা পেয়েছেন মৃত অবস্থায়। এর দৈর্ঘ্য ১১ ইঞ্চি, ব্যাস প্রায় ১ দশমিক ৮ ইঞ্চি, ছোট ছোট দাঁতযুক্ত মুখের দৈর্ঘ্য আধা ইঞ্চির কাছাকাছি। লেজ নেই, পশ্চাদ্ভাগ কেঁচো বা দুমুখো সাপের মতো।

১৯০৪ সালে ব্রিটিশ বিজ্ঞানী আলফ্রেড অ্যালকক চিকিলা ফুলেরিকে Heৎpele গণের fulleৎi (প্রত্যঙ্গহীন) প্রজাতির অন্তর্ভুক্ত হিসেবে বর্ণনা করেন। এটিকে তিনি আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকায় পাওয়া যায়, এমন প্রজাতির প্রত্যঙ্গহীন উভচর প্রাণীর সমগোত্র বলে ধারণা করেছিলেন। ১৯৬০-এর দশকে আমেরিকান বিজ্ঞানী ই এইচ টেইলর এটিকে Caecilidae পরিবারের Gegeneophis গণের অন্তর্ভুক্ত করেন। কিন্তু এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে ভারতীয় বিজ্ঞানীরা কিছু ব্রিটিশ ও বেলজিয়ান বিজ্ঞানীর সহযোগিতায় ডিএনএ বিশ্লেষণের মাধ্যমে প্রমাণ করেন, এটি আসলে Heৎpele বা Gegeneophis নয়, সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি গণের প্রজাতি। তাঁরা এর নাম দেন Chikila।

ভারতীয় দৈনিক দ্য হিন্দুতে গত ২২ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সত্যভামা দাস বিজুর (এসডি বিজু) নেতৃত্বে ভারতীয় ও ইউরোপীয় একদল গবেষক প্রায় পাঁচ বছর গবেষণার পর উত্তর ভারতের ২৫০টির মতো স্থানে গবেষণাজরিপ চালিয়ে পা ও লেজহীন উভচর প্রাণীর এক প্রজাতির সন্ধান পান। মেঘালয়ের গারো অঞ্চলের মানুষ প্রাণীটিকে গারো ভাষায় চিকিলা বলে। তাদের ধারণা, এটি একধরনের বিষাক্ত সাপ।অধ্যাপক বিজুর গবেষক দলের সদস্যরা প্রাণীটির অঙ্গসংস্থান ও ডিএনএ বিশ্লেষণ করে দেখতে পান, এটি Heৎpele ও Gegeneophis থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র একটি গণের প্রত্যঙ্গহীন প্রজাতি। তাঁরা এর নামকরণ করেন গারো শব্দ ‘চিকিলা’ দিয়ে। তাঁদের রচিত গবেষণা সন্দর্ভটি ব্রিটিশ রয়েল সোসাইটির জার্নালে প্রকাশিত হয়। তাঁরা দাবি করেন, এই প্রজাতির উদ্ভব ডাইনোসরের যুগে, এর নিকটতম আত্মীয়রা এখনো আফ্রিকায় বাস করে।

চিকিলা বাস করে মাটির নিচে। মা চিকিলা মাটির নিচে বাসা বাঁধে ও ডিম দেয়। ডিমগুলো জড়িয়ে কুণ্ডলী পাকিয়ে থাকে। দুই-তিন মাসের মধ্যে ডিম ফুটে বাচ্চা বেরোয়। অন্যান্য উভচরের মতো এদের কোনো শুককীট পর্যায় নেই। সরাসরি বেরিয়ে আসে আকারে ছোট কিন্তু দেখতে পূর্ণবয়স্ক চিকিলার মতোই। অধ্যাপক বিজু দ্য হিন্দু পত্রিকাকে জানান, ভারতের আসাম, অরুণাচল প্রদেশ, মণিপুর, মেঘালয়, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড, ত্রিপুরা, সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন স্থানে মাটি খুঁড়ে তাঁরা চিকিলার সন্ধান পেয়েছেন।

রেজা খান মনে করেন, লাউয়াছড়া অঞ্চলে পাওয়া চিকিলা ফুলেরি বাংলাদেশে এই প্রজাতির প্রাণীর অস্তিত্ব প্রমাণ করল। তিনি বলেন, ‘আমাদের লাউয়াছড়া প্রাণবৈচিত্র্যের এক সোনার খনিবিশেষ। এতে এ প্রমাণও মিলল যে, ১৪ কোটি বছর আগের প্রাগৈতিহাসিক যুগে আফ্রিকা মহাদেশের সঙ্গে এ ভূখণ্ড যুক্ত ছিল।’

-মশিউল আলম