পশুর যেমন রাজা আছে, পাখিরও তেমনি আছে রাজা। এই পাখিটি রাজা হলেও আকারে বা সৌন্দর্যে একে হার মানানোর মতো বহু প্রজাতির পাখিই এ দেশে রয়েছে। কিন্তু তা হলে কী হবে, সাহসে, চতুরতায়, বিচক্ষণতায় বা মাতব্বরিতে কেউ একে হার মানাতে পারবে না। তাই তো সে রাজা। বাংলাদেশের পাখিরাজ ‘ফিঙে’। এ দেশে পাখিরাজকে নিয়ে বহু পৌরাণিক কথা বা মিথ প্রচলিত আছে। ময়মনসিংহ অঞ্চলের তেমনই একটি মিথ হলো: ‘একদিন সব পাখি সভা করে স্থির করল, অন্যান্য পশু-প্রাণীর মতো তাদেরও চাই রাজা। কাকে রাজা করা হবে, তা নিয়ে চলে নানা আলোচনা। শেষে ঠিক হলো, যে পাখি পরদিন সকালে সেজেগুজে সবার আগে আসতে পারবে, সে-ই হবে রাজা।

সবাই রাজা হতে চায়, এ জন্য সেদিন সবাই খুব ভালো করে সাজতে লাগল। কিছুতেই আর কারও সাজা শেষ হয় না! এই ফাঁকে ফিঙে নির্দিষ্ট জায়গায় চলে এল সবার আগে। আর সে হলো পাখির রাজা।’ ফিঙের এই গতিময় ভঙ্গির তালে তালে ময়মনসিংহ জেলার বালকেরা তাই ছড়া কাটে, ‘ফেচুয়া রাজা-ফেচ্কুচ, ফেচুয়া রাজা-ফেচ্কুচ’। অন্য সব পাখির সাজতেগুজতে বিলম্ব হওয়ার জন্যই ফিঙে রাজা হয়ে গেছে। তাই বলা হয়, ‘সাজতেগুজতে ফেচুয়া রাজা!’ফিঙে আকারে খুব বড় বা শক্তিশালী না হলেও দরকারের সময় যেকোনো বড় পাখিকেও আক্রমণ করতে ছাড়ে না, এমনকি বিরাটকায় শকুনকেও।

ইগল-বাজপাখিদেরও সে ধাওয়া করে। কাক-চিল-হাঁড়িচাঁচারাও একে সমীহ করে চলে। এ ছাড়া শিয়াল, বনবিড়াল, খাটাশ-গুইসাপসহ বাড়ির পোষা কুকুর-বিড়ালও তাদের আক্রমণে ভড়কে যায় এবং শেষমেশ লেজ গুটিয়ে পালায়। তার বাসার ত্রিসীমানায় কাউকে ঘেঁষতে দেয় না সে। তা ছাড়া পাখিদের ঝগড়াঝাঁটিতে মাতব্বরি করার স্বভাবও এর রয়েছে। এ দেশে ফিঙের সংখ্যা অগণিত। যেমন আছে গ্রামে, তেমনি শহরে। খেতখামারে, গাছের ডালে মাঠে চড়ে বেড়ানো গরু-মোষ-ছাগলের পিঠে, মাঠ-খাল-বিলে পোঁতা কাঠিতে, টেলিগ্রাফ-বিদ্যুতের তারে সার সার ফিঙে দেখা যায়। ফিঙে চমৎকার শিস দেয়। শিস বেশ মিষ্টি। এরা বিভিন্ন স্বরে ডাকে। কখনো সেতারের ঝংকার দেওয়ার মতো, কখনো মেকিকি, মেকিকি স্বরে।

ফিঙে ‘রাজকাক’ (King crow) নামেও পরিচিত। এ দেশে ফিঙের নামের যেন শেষ নেই। একেক অঞ্চলে সে একেক নামে পরিচিত। কেইচকা, ঘেচেঘচিয়া, প্যাঁচকুলা, ফেউচ্যা, ফেচুয়া, ফেঁচু, ফেকা, ফেঁচকি, ফ্যাঁইচকা, ফ্যাচসা, ফ্যাচকুনা, হ্যাচ্চা, হেউচ্চা, ধেচুয়া, ধেচ্ছজা, কেঁচু কেঁসু, ঢেবচু, ফিঙা, কালিফেঁচা—এ সবই একেকটি আঞ্চলিক নাম। ফিঙেকে হিন্দিতে বলে কোতোয়াল। ইংরেজিতে ব্যাক ড্রোঙ্গো (Black drongo)। বৈজ্ঞানিক নাম ডাইক্ররাস অ্যাডসিমিলিস (Dicrurus adsimilis)। ফিঙে ছাড়াও এই পরিবারের আরও ছয়টি সদস্যের বাস এ দেশে। এগুলো হলো—ছোট বা বামন ফিঙে, ধূসর ফিঙে, কাকঠুঁটো ফিঙে, কেশরাজ এবং বড় ভিমরাজ। ফিঙে বা কালিফেঁচা এ দেশের সর্বত্রই আছে। তবে বনে নেই।

ফিঙে বা কালিফেঁচা কুচকুচে কালো পাখি। কালোর ওপর নীলচে আভা। লম্বা লেজটি দ্বিধাবিভক্ত। দেহের গড়ন ছিপছিপে। ঠোঁটের আগা থেকে লেজের ডগা পর্যন্ত লম্বায় প্রায় ২৮ সেন্টিমিটার। চোখ টকটকে লাল। ডানার আগা ব্রোঞ্জ রঙা, ঠোঁট কালো। ঠোঁটের গোড়ার দুই পাশে সাদা ফোঁটা। পা কালো। ফিঙে সাধারণত জোড়ায় জোড়ায় বা দলে বাস করে। এরা বেশ চটপটে ও চঞ্চল প্রকৃতির। সারা বছরই কমবেশি ছোটাছুটি করে। দৃষ্টিশক্তি প্রখর। মথ, প্রজাপতি, ডানাওয়ালা উইপোকা, গঙ্গাফড়িং ইত্যাদি এদের প্রিয় খাদ্য। উড়ন্ত অবস্থায় ফসলের কীটপতঙ্গ ধরে খায়। গরু-মোষ-ছাগলের পায়ের নিচে পড়ে মারা যাওয়া কীটপতঙ্গও খায়। ফসল অনিষ্টকারী কীটপতঙ্গ খেয়ে এরা আমাদের খুব উপকার করে। এরা গরু-মোষ-ছাগলের বন্ধু।

গবাদিপশুর পিঠ, কান, শিঙে বসে উকুন, আটালি, কীটপতঙ্গ খেয়ে তাদেরও উপকার করে। ফিঙে কীটপতঙ্গ ছাড়াও খেজুরের রস ও ফুলের মধু খেতে পছন্দ করে। গ্রীষ্ম তাদের প্রজনন ঋতু। তবে বর্ষাতেও প্রজনন করে। এ সময় এরা বেশ ঝগড়াটে স্বভাবের হয়ে যায়। নিজের ত্রিসীমানায় অন্য কাউকে বরদাশত করেনা।এ সময় এরা জোড় বেঁধে অত্যন্ত ছন্দোময় গতিতে ছোটাছুটি করে। দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়।

এরা সাধারণত ইংরেজি ওয়াই (Y) আকৃতির কোনো ডালে বাসা বাঁধে। বৈদ্যুতিক বা টেলিগ্রাফের তারের সংযোগস্থলেও বাসা বাঁধতে দেখা গেছে। বাসা ছোট একটি বাটির মতো। বাসাতে কোনোমতে পেটটা আটাতে পারলেই খুশি। বাসা তৈরিতে ছোট কাঠি, ঘাস, গাছের নরম শেকড়, খড়কুটো, মাকড়সার জাল প্রভৃতি ব্যবহার করে। বাসা তৈরি হয়ে গেলে স্ত্রী ফিঙে তাতে তিন থেকে পাঁচটি সাদাটে ডিম পাড়ে। ডিমে লালচে বাদামি ফোঁটা থাকে। স্ত্রী-পুরুষ দুজনেই বাচ্চার যত্ন নেয়। ছানারা একদিন উড়তে শেখে। তরঙ্গায়িত ভঙ্গিতে উড়তে উড়তে ‘পাখির রাজা ফিঙে’ শিস দিতে দিতে আকাশ-বাতাস মাতাল করে তোলে