ধানের মাঠের কলমি শাক তুলবেন বৃদ্ধা, হাঁটুজল ঠেলে তাই এগোচ্ছেন সামনের দিকে। যেখানে পানি প্রায় বুকসমান, সেখানেই কলমি, শাপলা ও রক্তশাপলার অবাধ বিস্তার।হালটের মতো লম্বা এক টুকরো জায়গা, উঁচু, কাশ-ঘাস ও উলুবনের রাজত্ব ওখানটায়। ওই জায়গাটুকু যখন অতিক্রম করছেন বৃদ্ধা, তখন কানে এল বড় কোনো পাখির একটানা ডানা ঝাপটানোর শব্দ। পাশাপাশি হিসহিসজাতীয় শব্দ। বৃদ্ধার হাতে মাছ ধরা কোচ, অতএব নির্ভয়ে এগোলেন তিনি। ভাবছিলেন, নির্ঘাত বিষধর সাপ আর পাখির মধ্যে জীবনবাজি লড়াই চলছে!

এগিয়ে গিয়ে দেখেন, একটি হাঁস মাটিতে দাঁড়িয়ে তার গলাটা লম্বা করে বাড়িয়ে ঠোঁট দিয়ে আক্রমণ করতে চাইছে একটি প্রকাণ্ড গুইসাপকে। দুই ডানা মেলে বারবার আঘাত করতে চাইছে গুইসাপকে। গুইসাপে হাঁস খাবে, তা তো হয় না! বৃদ্ধা দ্রুত এগোলেন। গুইসাপটি ভয়ে দৌড়ে গিয়ে নামল ওপাশের ধানখেতটিতে। ও মা! হাঁসটি উড়াল দিল বৃদ্ধার পক্বকেশে দুই ডানার নরম বাতাস ঢেলে। আরে! ডিম! এগোলেন তিনি। বুঝতে দেরি হলো না মোটেও বুনো হাঁসের ডিম এগুলো। হাঁসটি বাসাও বেঁধেছে!

বৃদ্ধা বসলেন। মোট নয়টি ডিম কাপড়ের আঁচলে বেঁধে ফিরতি পথ ধরলেন। মাথার ওপরে চক্কর দিচ্ছে এক জোড়া বুনো হাঁস।বৃদ্ধার বাড়িতে ডিমে তা দিচ্ছে দুটি মুরগি। তিনি একটির তায়ে দিলেন পাঁচটি ডিম, অন্যটির তায়ে চারটি ডিম। খুব খুশি তিনি।খবরটা চাউর হতে দেরি হলো না মোটেও। বহু মানুষ এল বুনো হাঁসের ডিম দেখতে।

সেলফোনে খবর এল আমার কাছে। আমিও রোমাঞ্চিত হলাম। স্মৃতিকাতরতায় আক্রান্ত হলাম প্রবলভাবে। ৩৮ বছর পরে শুনলাম এ রকম খবর। আমি সর্বশেষ বালিহাঁসের (Pygmy Cotton Goose) ১০টি ডিম মুরগির তা-এ বসিয়ে ছানা ফুটিয়েছিলাম ১৯৭৩ সালে। শৈশব-কৈশোরে প্রায় প্রতিবছরই বালিহাঁস, সরালি হাঁস (Lesser whistling duck) ও ক্বচি ৎ মেটে হাঁসের (Spot-billed Duck) ডিম এভাবেই পাওয়া যেত। মা-দাদি-নানি মুরগির তায়ে ছানা ফোটাতেন। তখন বৃহত্তর খুলনা জেলায় এই তিন প্রজাতির হাঁসই যথেষ্ট ছিল—ছিল তাদের সুরক্ষিত-নিভৃত ও নিরাপদ আবাসভূমি। আহা রে, পিচ্চি-পিচ্চি দুষ্টু-মিষ্টি চেহারার তুলতুলে ছানারা! বালিহাঁসের ছানারা ছিল সবচেয়ে সুন্দর। গত ৩৮ বছরে তিন রকম হাঁসের বসবাস-উপযোগী পরিবেশ একেবারে গোল্লায় গেছে বলা যায়। ওরা বৃহত্তর খুলনা থেকে বসবাস গুটিয়ে নিয়েছে সেই কতকাল আগে! তার ভেতরে হঠা ৎ এই খবরে আমি উল্লসিত-উদ্দীপিত হই।

ডিম পাওয়া এই ঘটনা এ বছরেরই গত সেপ্টেম্বরের ২৪ তারিখে বাগেরহাটের ফকিরহাট গ্রামে। আর মাত্র পাঁচটি দিন তা দিতে পারলে বুনো হাঁস-দম্পতি ছানাদের নিয়ে জলে নামতে পারত। তখন আর ছানাদের পায় কে! বুনো হাঁসের ছানাদের ধরা চাট্টিখানি কথা নয়।খোঁজ নিয়ে জেনেছি, মুরগির তায়ে বসানোর মাত্র পাঁচ দিনের মাথায় প্রথম ডিমটি ফোটে। পরবর্তী ৩০ ঘণ্টায় মোট পাঁচটি ছানা ফোটে। বাকি চারটি ডিম নষ্ট হয়ে যায়। গিয়ে পর্যবেক্ষণ করেছি, প্রতিটি ছানার প্রথম দিনের ওজন গড়ে ১০-১২ গ্রাম। ঠোঁট লম্বায় আধা ইঞ্চি, চওড়া তিন সুতো। পা ও পায়ের পাতা কালো। চোখের মণিও কালো। ওপরের ঠোঁট কালো। শরীরের মাপ চার-পাঁচ ইঞ্চি।

মুরগি-মায়ের সঙ্গে মুরগি-ভাইবোনদের সঙ্গে বুনো হাঁসের পাঁচটি ছানা মহা সুখেই আছে। ওরা জলে নামে। মুরগি-মা পাড়ে দাঁড়িয়ে খবরদারি করে। এরা হলো ছোট সরালির ছানা। বৈজ্ঞানিক নাম D. javanica। ছানাগুলো এখন বেশ বড় হয়েছে। উড়তে শিখবে সপ্তাহ খানেকের মধ্যেই। বৃদ্ধাকে বুঝিয়ে রাজি করানো হয়েছে জবাই করে না খেতে। উড়তে শিখলে হাঁসের ছানারা যেন উড়ে যেতে পারে, তিনিও এখন সেই প্রতীক্ষায় আছেন।

লিখেছেনঃ শরীফ খান | তারিখ: ৩০-১১-২০১১ | প্রথম আলো থেকে সংগ্রহিত