পারিবারিক আইন বিষয়ে মতামত – সন্তানের অভিভাবকত্বঃ সামাজিক জীবনে বেচে থাকতে গেলে অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। সেই সমস্যার সমাধান করতে হয় আলোচনার মাধ্যমে। কখনো কখনো দাম্পত্য জীবনে নানামুখী সমস্যার কারনে বিবাহ বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটে। এ ক্ষেত্রে প্রধান যে সমস্যা দেখা যায় তা হলো সন্তানের অভিভাবকত্ব নিয়ে। আমাদের দেশে এ ব্যাপারে যতটুকু আইন আছে তা আসলে কতটা কার্যকরী এবং বাস্তব বান্ধব সেটা ভেবে দেখার সময় এসেছে। বলা হচ্ছে সন্তানের অভিভাবকত্ব মায়ের থাকবে। আবার কারো কারো মতে সন্তানের অভিভাবকত্ব থাকবে বাবার। কেননা বাবাই তার সন্তানের জন্য সবচেয়ে ভাল অভিভাবক। প্রচলিত আইনে বলা হচ্ছে মায়ের অভিভাবকত্বে থাকলেও বাবা তার যাবতীয় খরচ বহন করবে।
সন্তানের অভিভাবকত্ব বাবা বা মা যে কেউ পেতে পারবে কয়েকটা শর্ত পুরণের মাধ্যমে। যুক্তিতে বলে মা সন্তানের সবচেয়ে ভাল বন্ধু এবং ভাল দেখা শুনা করতে পারে তাই মাকে অভিভাবকত্ব দেওয়া উচিৎ। এ কথাটা যুক্তি যুক্ত। তবে দেখতে হবে সন্তানের অন্ন,বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসার যাবতীয় প্রয়োজন মা মিটাতে সক্ষম কিনা। দেখা গেল এ ক্ষেত্রে সন্তানের যাবতয় সুবিধা বাবার কাছে বিদ্যমান তাহলে সন্তানের সুন্দর ভবিষ্যতের কথা বিবেচনা করে তার অভিভাবকত্ব বাবাকে দিতে হবে। আর যদি দেখা যায় মায়ের কাছে এগুলো পাবে তাহলে মায়ের কাছেই সে থাকবে। এর পর দেখতে হবে চারিত্রিক এবং মানবীয় গুনাবলীতে কে ভাল। কার কাছে থাকলে সন্তান সত্যিকার অর্থে ভাল মানুষ হয়ে উঠবে তার কাছেই সন্তান থাকবে। কেননা চারিত্রিক অবক্ষয় সম্পন্ন কারো অভিভাবকত্বে সন্তান থাকলে তার চরিত্র সেরকম হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই এসব বিষয় বিবেচনা করতে হবে। আর হ্যা সন্তান যার কাছেই থাকনা কেন তারা দুজনই যে তার বাবা মা এটা যেন আজীবন তারা অনুভব করতে পারে। নিজেদের ভুলের কারনে সে কেন কষ্ট ভোগ করবে। পৃথিবীতে সেতো একা একা আসেনি। বাবা মায়ের মাধ্যমেই তারা এসেছে। সুতরাং বাবা মা যাকে এই পৃথিবীতে আসতে সাহায্য করেছে তার সব ধরনের কল্যান বাবা মাকেই নিশ্চিত করতে হবে। তাদের মধ্যে স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কটা টেনে এনে তাদের প্রাপ্য সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা যাবেনা।
সন্তান দত্তক নেয়াঃ
আমাদের দেশে এ ব্যাপারে তেমন কোন আইন আছে বলে আমার জানা নেই। আর ইসলাম ধম্যেও এ ব্যাপারে বলা হচ্ছে কোন কিছু বলা নেই। অনেকেই সন্তান ধারনে অক্ষম হওয়ায় অন্যের সন্তান দত্তক নেওয়ার মাধ্যমে মাতৃত্ব বা পিতৃত্বের অভাব কিছুটা লাঘব করতে পারতো কিন্তু ইসলামে কোন বিধান নেই বা দেশে কোন আইনের স্পষ্ট বিধি নিষেধ না থাকায় তাতে জটিলতা দেখা যাচ্ছে।
সন্তান দত্তক নেওয়ার ব্যাপারে স্পষ্ট বিধান বা আইন থাকা জরুরী। উন্নত বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই এ বিষয়ে নির্ধারিত আইন আছে। আমাদের দেশেও এ আইন করার মাধ্যমে যেমন সন্তানহীন দম্পত্তি সন্তানের অভাব মেটাতে সক্ষম হবে তেমনি এমন অনেক পরিবার আছে যেখানে তাদের সন্তান অতি দারিদ্রতার মধ্যে মানুষ হবে কষ্টে ক্লিষ্টে নানা অধিকার বঞ্চিত হবে। অথচ দত্তক নেওয়ার বিধান থাকলে ঐ সন্তানটাই ভাল ভাবে মানুষের মত মানুষ হতে পারবো।
ইসলামে এর বিধান সম্পর্কিত যুক্তিঃ
ইসলামে সন্তান দত্তক নেয়ার ব্যাপারে কোন বিধান নেই বলে যারা বক্তব্য দিয়েছেন তারা হয়তো ঠিকই বলেছেন কিন্তু একটা যুক্তি তারা কোন ভাবেই খন্ডন করতে পারবেননা আর তাহলো স্বয়ং মহানবী হযরত মুহম্মদ সাঃ কেওতো তার পরিবার এক প্রকার দত্তক দিয়েছিলেন। মহানবী সাঃ এর দুধ মাতা ছিলেন হালিমা নাম্মী নামে এক পুতপবিত্র রমনী। তিনি নবী সাঃ কে দুধ পান করিয়েছেন এবং নির্দিষ্ট বয়স পর্যন্ত লালন পালন করেছেন। এটাকেও এক ধরনে দত্তকই বলতে হবে। দত্তকের সংজ্ঞা কি সেটা আমাদের জানা উচিৎ। নিজের ব্যতীত অন্যের সন্তানকে নিজের পরিবারের সাথে নিজের সন্তানের সব সুযোগ সুবিধা দিয়ে লালন পালনের নামই দত্তক। সুতরাং ইসলাম অবশ্যই দত্তক নেয়া সমর্থন করে। যদি সমর্থন না করতো তাহলে নবী সাঃ এ ব্যাপারে মত প্রকাশ করতেন। বলা হয়ে থাকে নবী সাঃ এর কোন বিষয়ে মৌনতাও সম্মতি। এ ব্যতীত নবী সাঃ তার দুধ মাতাকে অত্যন্ত সম্মান করতে এবং কুরআনে যে ১৪ জন মানুষের মাঝে বিবাহ বন্ধন নিষিদ্ধ তার মধ্যে দুধ মাতা এবং তার সন্তানগণ অর্ন্তভুক্ত। তাই ইসলাম কখনোই এটার বিরোধিতা করেনা। এ ব্যাপারে আইন প্রণয়ন করে সন্তানহীন দম্পত্তির ঘরে সন্তানের হাসি ফিরিয়ে দেওয়া আমাদের দায়িত্ব।
বিবাহ বিচ্ছেদঃ
বর্তমান সমাজে বিবাহ বিচ্ছেদ একটা অতি পরিচিত বিষয় হয়ে গেছে। এর মুলে রয়েছে দাম্পত্য কলহ এবং পরস্পরের মাঝে ভুল বুঝাবুঝি। একে অন্যের প্রতি বিশ্বাস না থাকা। ফলে সহজেই ভেঙ্গে যাচ্ছে সুখের কোন সংসার। আর এর কুপ্রভাব আমাদের ছোটদের ওপর বর্তাচ্ছে। বড়দের সমস্যায় ছোটরা কষ্ট ভোগ করবে এটা কারো কাম্য হতে পারেনা। আর হ্যা যদি দাম্পত্য টিকিয়ে রাখা সম্ভব নাই হয় তবে তখন বিবাহ বিচ্ছেদ হতেই পারে । তাই এ ব্যাপারে কিছু বিধি নিষেধ থাকতেই হবে। যার বিনিময়ে সন্তান,স্ত্রী এবং স্বামী সকলেই নিজ নিজ অধিকারটুকু নিশ্চিত হতে পারে।
বিবাহ বিচ্ছেদের ব্যাপারে বলা হচ্ছে নির্দিষ্ট কারণ দর্শানোর মাধ্যমে বিবাহ বিচ্ছেদ হতে পারে। এর পরই আসছে সন্তানের অভিভাবকত্ব নিয়ে যার কথা আগেই বলা হয়েছে। এখন আসি স্ত্রীর প্রাপ্য বিষয় নিয়ে। দেখা যাচ্ছে দেনমহরের অর্থ স্ত্রী পাচ্ছেনা। কিন্তু এটা ঠিক নয়। স্বামী বা স্ত্রী সে যেই বিবাহ বিচ্ছেদের জন্য আবেদন করুকনা কেন দেনমহর হওয়া উচিৎ স্ত্রীর ন্যায্য পাওনা যা স্বামীকে অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে। আর বিবাহ বিচ্ছেদ পরবর্তী একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত স্ত্রীর ভরন পোষণ দিতে হবে। যদি কেউ সেই সময়টা স্ত্রীর পুনরায় বিবাহ পর্যন্ত ধার্য করে সেটা হবে অন্যায়। কেননা স্বামী তার কাছ থেকে কোন রুপ সুযোগ সুবিধা না নিয়ে কেন তাকে দীর্ঘ সময় ভরন পোষন দিবে। এটা কখনোই যুক্তি সংগত হতে পারেনা। তাই এ ব্যাপারে ধর্মীয় আইন এবং প্রচলিত আইন বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ধরা যাক বিবাহ না হওয়া পর্যন্ত স্ত্রীর ভরন পোষণ দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে বড় সমস্যা হলো স্ত্রী যদি দীর্ঘ দিন বিবাহ না করে। তাহলে কেন সেই অনির্দিষ্ট কাল ব্যাপী স্বামী তাকে ভরণ পোষণ দিবে। কারণ সেতো আর তার স্বামী নেই। এ সব কারনেই দেনমহর হচ্ছে নারীর প্রাপ্য অধিকার যেন স্বামীর সাথে বিচ্ছেদ হলেও সে নির্দিষ্ট একটা সময় পর্যন্ত তার প্রাপ্ত দেনমহরের অর্থে সে চলতে পারে।
বহু বিবাহঃ
পৃথিবীর নানা দেশেই বহু বিবাহ প্রচলিত আছে। কোন কোন দেশে এ ব্যাপারে আইন রয়েছে আবার কোন কোন দেশে আইন নেই। আমাদের দেশে তেমন কোন আইন নেই বললেই চলে। আর তাছাড়া আমাদের দেশে বহু বিবাহ রীতিও তেমন প্রচলিত নয়। উন্নয়নশীল অতি জনবহুল একটা দেশে বহু বিবাহ কখনোই সুফল বয়ে আনতে পারেনা। তাই এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা থাকা উচিৎ।
বলা হয়ে থাকে নারী সব কিছু ছেড়ে দিতে পারে শুধু স্বামীর অধিকার ছাড়তে পারেনা। সে কাউকেউ তার স্বামীর অধিকার দিতে রাজি নয়। এ ক্ষেত্রে আমি অনেক নারীর সাথে কথা বলেছি যারা মনে করে স্বামীর দ্বিতীয় বিবাহ বা বহু বিবাহ হচ্ছে নারীর জন্য সবচেয়ে বেদনা দায়ক। এর স্বামীকে তার অন্য স্ত্রীর সাথে দেখার চেয়ে তাদের কাছে বিবাহ বিচ্ছেদের কষ্ট অনেক কম। ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে সামর্থবান পুরুষ চারজন নারীকে একসাথে বিয়ে করতে পারলেও ইসলাম হচ্ছে চিরন্তন ধর্ম যা মানুষকে শিখিয়েছে পরিস্থিতি অনুযায়ী চলতে। আমাদের সমাজ ব্যাবস্থায় কি অবস্থানে আছে সেটাও দেখা উচিৎ। একটা সময় ছিল যখন নারীদের সংখ্যা আনুপাতিক হাবে এতটাই বেশি ছিল যে তিন চারটে বিয়ে করা ব্যাতীত কোন উপায় ছিলনা। এখন তা নেই। এখন মানুষের যে পরিবর্তন এসেছে তা বিবেচনা করে বহুবিবাহ ব্যবস্থার জন্য নির্দিষ্ট আইন করা উচিত। দেখা যাচ্ছে বলা হয়েছে প্রথম স্ত্রীর অনুমতি ব্যতীত দ্বিতীয় বিবাহ করা যাবেনা। কিন্তু এ কথা কজন স্বামী মানেন আর কজন স্ত্রীইবা আছেন যারা স্বামীকে দ্বিতীয় বিয়েতে অনুমতি দেবেন। সুতরাং ওলামায়ে কিরাম এবং বিজ্ঞ বিচারক মন্ডলীর একটা সমন্বিত পরিষদ এ ব্যাপারে দীর্ঘ আলোচনার মাধ্যমে ঠিক করবেন আমাদের দেশে বহুবিবাহ নীতিমালার নির্ধারনি বিষয়। তবে পারিবারিক আলোচনা এবং একে অন্যের ওপর বিশ্বাস স্থাপনের মাধ্যমে দাম্পত্য জীবনে সুখ আনা সম্ভব বলে মনে করেন অনেক সুখী দম্পত্তি যারা মনে করেন এর মাধ্যমে বহুবিবাহ রীতি রোধ করা যায়। আর একান্তুই যদি দাম্পত্য সুখ না থাকে সে ক্ষেত্রেও বিকল্প আইন প্রনয়ন জরুরী।