Ark of the Covenant বা Ark of the Testimony বা চুক্তির সিন্দুক পৃথিবীর ইতিহাসের অন্যতম রহস্যময় একটি বস্তু। বাইবেলে এর পরিচিতি হিসেবে বলা আছে যে এটি কাঠের বাক্স বা সিন্দুক যা আড়াই হাত লম্বা, দেড় হাত চওড়া এবং দেড় হাত উচ্চতা বিশিষ্ট (21⁄2×11⁄2×11⁄2 royal cubits or 1.31×0.79×0.79 m)। এর উপরিভাগ স্বর্ণের আবরণে আবৃত ছিল। এর সাথে চারটি স্বর্ণের রিং সংযুক্ত ছিল যার দ্বারা আর্কটি বহন করা হতো। আর্কটি প্রথমে চামড়া এবং এর উপর নিল রঙের বিশেষ কাপড় দিয়ে মোড়ানো থাকতো এবং সবসময় এটি একটি কাপড় দিয়ে আচ্ছাদিত থাকতো যাতে এটি বহনকারী পুরোহিতরাও এটি দেখতে না পারে।

বাইবেলের বর্ণনা অনুযায়ী তূর পর্বতে আল্লাহর সাথে মুসা (আঃ) এর সাক্ষাতের সময় আল্লাহর আদেশ এবং নির্দেশনা অনুযায়ী মুসা (আঃ) এটি নির্মাণ করেন। অবশ্য এটি নিয়েও প্রত্নতাত্মিকদের দ্বিমত আছে। ধারনা করা হয় এই আর্কের ভেতর দশটি আদেশ বা আইনের নথি ( Commandments Tablet) সংরক্ষিত ছিল। Book of Exodus এবং Book of Numbers এর সনাতনী ব্যাখ্যা থেকে জানা যায় যে আর্কটিতে হারুন (আঃ) এর যষ্টি, একটি অমৃতের কলস এবং মুসা (আঃ) এর স্বহস্তে লিখিত তাওরাত কিতাব সংরক্ষিত ছিল।

প্রচলিত উপকথা এবং বাইবেলের ভাষ্য অনুযায়ী মিশর থেকে যখন বনী ইসরাইল গোত্র বহিষ্কৃত হলো তখন পুরোহিতরা সৈন্যবাহিনী সহ আর্কটিকে জর্ডান নদীর তীর পর্যন্ত নিয়ে যায়। যখন আর্কটিকে জর্ডান নদীর তীরে আনা হয় তখন নদীর পানি দ্বিখণ্ডিত হয়ে পারাপারের জন্য পথের সৃষ্টি হয়। তখন তারা নদী পার হয়ে আর্কটিকে জেরিকো শহরের কাছে নিয়ে যায়। তারা সাতজন পুরোহিত সহ সাতদিন জেরিকো শহর রক্ষা প্রাচীরের চারিদিকে কুচকাওয়াজ সহকারে পরিভ্রমণ করে। সাতদিন পর আর্কের ঐশ্বরিক ক্ষমতার বলে শহরের প্রাচীর ভেঙ্গে পড়ে এবং জেরিকো শহর তাদের অধিকৃত হয়।

ওল্ড টেস্টামেন্টে আর্কের মধ্যস্থিত ঐশ্বরিক ক্ষমতার কথা বলা হয়েছে। নির্দিষ্ট কিছু লোক ছাড়া কাউকেই এটি স্পর্শ করতে দেয়া হতোনা। যেই এটি অসাবধানবসত স্পর্শ করত সেই মারা পড়ত। জেরিকো শহরে আর্কটিকে ১০০ গজ উচু একটি মিনারের উপর রাখা হয়েছিল যাতে এটি সাধারন মানুষের সংস্পর্শে না আসে। এর সুরুক্ষার জন্য আলাদা বাহিনী নিয়োজিত ছিল। বলা হয়ে থাকে যে মুসা (আঃ) নিজেও এটির সংস্পর্শে আসার সময় একটি বিশেষ ভাবে তৈরি বস্ত্র পরিধান করতেন। প্যালেস্টাইনরা যখন জেরিকো শহর দখল করে তখন তারা এটিকে শহরের বাহীরে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করে কারন এটির প্রভাবে তাদের মধ্যে প্লেগ এবং ক্যান্সার জাতীয় টিউমারের প্রাদুর্ভাব ঘটেছিল। আর্কটির এমন রহস্যময় শক্তির কারনে প্রত্নতাত্মিকদের মধ্যে বিভিন্ন মতামত লক্ষ্য করা যায়। কেউ কেউ ধারণা করেন যে এটি প্রকৃতপক্ষে একটি ছোট নিউক্লিয়ার রিয়েক্টর, যার কারনে মুসা (আঃ) বিশেষ বস্ত্র পরিধান করতেন এটি ব্যবহারের সময় এবং কাউকে এর সংস্পর্শে আসতে দেয়া হতোনা এবং এর প্রতিক্রিয়ার ফলেই প্যালেস্টাইনদের মধ্যে ক্যান্সার এর প্রাদুর্ভাব হয়েছিল।

আর্কটির ক্ষমতা সম্পর্কে এমন অনেক কথাই শোনা যায়। তবে বিশেষজ্ঞরা ধারণা করেন জেরিকো শহরের প্রাচীর ভেঙ্গে পড়ার ক্ষেত্রে হয়তো আর্কটির কোন সম্পর্ক নেই। হয়তো তা একটি ভুমিকম্পের ফসল মাত্র। কিন্তু আর্কের প্রকৃত শক্তি অন্যখানে, যা এসব ধারণার সাথে সম্পর্কহীন। অনেকেই এটিকে সৃষ্টিকর্তা প্রদানকৃত তাঁর উপস্থিতির পার্থিব নিদর্শন বা প্রমাণ হিসেবে বিশ্বাস করে থাকেন।এই দিক থেকে, হোক এটি সত্য বা কল্পনা, আর্কটি বিশ্বাসের অন্যতম একটি উৎস। পৃথিবী পরিবর্তনকারী চিন্তা ভাবনার একটি আইকন এবং বাস্তবিকই এই শক্তির (বিশ্বাস) চেয়ে বড় কোন শক্তি নেই।

মুসা (আঃ) আর্কটি তৈরি করার পর এটি বনী ইসরাইল গোত্রের কাছেই ছিল। এমনকি মরুভূমিতে তাদের ৪০ বছর বিচরণের সময়ও এটি তাদের সাথেই ছিল বলে বাইবেল থেকে জানা যায়। যখনই তারা কোন স্থানে তাদের ক্যাম্প স্থাপন করতো তখন আর্কটি একটি বিশেষ এবং পবিত্র তাঁবুর মধ্যে সুরুক্ষিত অবস্থায় রাখা হতো।

এই বিশেষ তাঁবুটির নাম ছিল Tabernacle। বাইবেলের মতে যখন বনী ইসরাইল গোত্রের একটি অংশ যখন প্রমিজড ল্যান্ডের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে জর্ডান নদীর তীরে আসে তখন আর্ক বহনকারী প্রিষ্টদের পা নদীর পানি স্পর্শ করা মাত্রই নদীর পানি শুকিয়ে যায় এবং যতক্ষন তারা নদী অতিক্রম না করে ততক্ষন এই অবস্থাতেই থাকে নদীটি। এরপর আর্কটি সহ বনী ইসরাইল গোত্র মিশরে উপস্থিত হয়।

আর্কটির অভিশাপ হতে রক্ষা পাওয়ার জন্য জেরিকো শহর হতে আর্কটিকে গরুর গাড়িতে উঠিয়ে কোন চালক ছাড়াই শহরের বাহীরে ছেড়ে দেয়া হয়। বাইবেলের ভাষ্য অনুযায়ী এর পর আর্কটি kirjath-jearim নামক স্থানে স্থানান্তরিত হয়। সেখানে এটি ২০ বছর ছিল। এরপর রাজা ডেভিড বা দাউদ (আঃ) আর্কটিকে পুনরুদ্ধার করে বনী ইসরাইল দেড় কাছে নিয়ে আসনে।

পবিত্র কোরআন থেকে আর্কটি সম্পর্কে যা জানা যায় তা হচ্ছে “এই সংগে তাদের নবী তাদের একথাও জানিয়ে দিলঃ আল্লাহর পক্ষ থেকে তাকে বাদশাহ নিযুক্ত করার আলামত হচ্ছে এই যে, তার আমলে সেই সিন্ধুকটি তোমরা ফিরিয়ে পাবে, যার মধ্যে রয়েছে তোমাদের রবের পক্ষ থেকে তোমাদের জন্য মানসিক প্রশান্তির সামগ্রী, যার মধ্যে রয়েছে মূসার পরিবারের ও হারুনের পরিবারের পরিত্যক্ত বরকতপূর্ণ জিনিসপত্র এবং যাকে এখন ফেরেশতারা বহন করে ফিরছে ৷যদি তোমরা মু’মিন হয়ে থাকো তাহলে এটি তোমাদের জন্য অনেক বড় নিশানী ৷ “[আল কোরআন ( ২:২৪৮)]

এ প্রসংগে বাইবেলের বর্ণনা কুরআন থেকে বেশ কিছুটা ভিন্ন । তবুও এ থেকে আসল ঘটনার যথেষ্ট বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায়।এক যুদ্ধে ফিলিস্তিনীরা বনী ইসরাঈলদের থেকে এটি ছিনিয়ে নিয়েছিল। কিন্তু তাদের যে শহর ও যে জনপদে এটি রাখা হতো সেখানেই মহামারীর প্রাদুর্ভার হতে থাকতো ব্যাপকভাবে। অবশেষে তারা সিন্দুকটি একটি গরুর গাড়ির ওপর রেখে হাঁকিয়ে দিয়েছিল। সম্ভবত এ বিষয়টিকে কুরআন এভাবে বর্ণনা করেছে যে,সেটি তখন ফেরেশতাদের রক্ষণাধীনে ছিল কারণ সেই গাড়িটিতে কোন চালক না বসিয়ে তাকে হাঁকিয়ে দেয়া হয়েছিল। আর আল্লাহর হুকুমে এটিকে বনী ইসরাঈলদের দিকে নিয়ে আসা ছিল ফেরেশতাদের কাজ। আর এই সিন্দুকের ”মধ্যে রয়েছে তোমাদের রবের পক্ষ থেকে তোমাদের জন্য মানসিক প্রশান্তির সামগ্রী”- একথার অর্থ বাইবেলের বর্ণনা থেকে যা পাওয়া যায় তা হচ্ছে এই যে,বনী ইসরাঈল এই সিন্দুকটিকে অত্যন্ত বরকতপূর্ণ এবং নিজেদের বিজয় ও সাফল্যের প্রতীক মনে করতো।

এটি তাদের হাতছাড়া হবার পর সমগ্র জাতির মনোবল ভেঙে পড়ে। প্রত্যেক ইসরাঈলী মনে করতে থাকে, আমাদের ওপর থেকে আল্লাহর রহমত উঠে গেছে এবং আমাদের দুর্ভাগ্যের দিন শুরু হয়ে গেছে। কাজেই সিন্দুকটি ফিরে আসায় সমগ্র জাতির মনোবল ব্যাপকহারে বেড়ে যায়। তাদের ভাঙা মনোবল আবার জোড়া লেগে যায়। এভাবে এটি তাদের মানসিক প্রশান্তির কারণে পরিণত হয়। ”মূসা ও হারুণের পরিবারের পরিত্যক্ত বরকতপূর্ণ জিনিসপত্র” এই সিন্দুকে রক্ষিত ছিল। এর অর্থ হচ্ছে, ‘তূর-ই-সিনাই’-এ (সিনাই পাহাড়) মহান আল্লাহ হযরত মূসাকে পাথরের যে তখতিগুলো দিয়েছিলেন। এ ছাড়াও হযরত মূসা নিজের লিখিয়ে তাওরাতের যে কপিটি বনী লাভীকে দিয়েছিলেন সেই মূল পাণ্ডুলিপিটিও এর মধ্যে ছিল। একটি বোতলে কিছুটা ”মান্না’ও এর মধ্যে রক্ষিত ছিল, যাতে পরবর্তী বংশধররা আল্লাহর সেই মহা অনুগ্রহের কথা স্মরণ করতে পারে, যা মহান আল্লাহ ঊষর মরুর বুকে তাদের বাপ-দাদাদে ওপর বর্ষণ করেছিলেন। আর সম্ভবত অসাধারণ মু’জিয়া তথা মহা অলৌকিক কার্যক্রমের কেন্দ্রবিন্দু হযরত মূসার সেই বিখ্যাত ‘আসা’ বা লাঠিও এর মধ্যে ছিল।

সোলেমান (আঃ) আল্লাহর নির্দেশে তাঁর উপাসনালয় (Solomon’s Temple) নির্মাণের সময় তাতে আর্কটি স্থাপন এবং সুরুক্ষার জন্য একটি বিশেষ স্থান তৈরি করেন। তাঁর মৃত্যুর অনেক বছর পর ব্যাবলনিয়রা জেরুজালেম দখল করে নেয় এবং Solomon’s Temple ধ্বংস করে দেয়। এরপর আর্কটির সঠিক অবস্থান জানা যায়নি। বাইবেলের Book of Ezra এর ভাষ্য অনুযায়ী ব্যাবলিনিয়রা জেরুজালেমের অন্যান্য সম্পদের সাথে আর্কটিও নিয়ে যায়। আবার Book of Revelation এর তথ্য অনুযায়ী ঐ সময় আল্লাহর আদেশে আর্কটি স্বর্গে স্থানান্তরিত করা হয়।

এরপর আর্কটির অবস্থান সম্পর্কে অনেক গুজব শোনা যায়। শোনা যায় এটি ইউথোপিয়ার অর্থোডক্স চার্চে সুরক্ষিত আছে। আবার কেউ কেউ মত দেন এটি Knight Templers রা পুনরুদ্ধার করে আয়ারল্যান্ডে নিয়ে যায়। কারো কারো মতে এটি ভ্যাটিকান চার্চে সুরক্ষিত আছে। কিন্তু এসবই গুজব যার কোন প্রমাণ আজ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। আর আর্কটিও পৃথিবীর ইতিহাসের অন্যতম রহস্যময় বস্তু হিসেবে মানুষের মাঝেই রয়ে গেছে।

লিখেছেনঃ মেহেদী আনোয়ার উইকিপিডিয়া অবলম্বনে