অবশেষে ওয়ার্ল্ড গিনেজ বুকে নাম লেখানোর আশা নিয়েই চির বিদায় নিয়েছেন মাদারীপুরের হাজী খাদেম হোসেন শিকদার। পৃথিবীর সবচেয়ে ‘জীবিত বয়স্ক মানুষ’ হিসেবে বেঁচে থাকার পর ২৮ মার্চ ভোরে ১৫২ বছর ১ মাস ২১ দিন বয়সে পৃথিবী থেকে চির বিদায় নিলেন তিনি। তার জীবনের শেষইচ্ছা ছিল, একজন বাংলাদেশি নাগরিক হিসেবে ‘পৃথিবীর সবচেয়ে জীবিত বয়স্ক মানুষ’ হিসেবে ওয়ার্ল্ড গিনেজ বুকে নাম লিখে মরতে চান।

কিন্তু, তার জীবনের শেষইচ্ছা অপূর্ণ রেখেই অবশেষে তাকে এ পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হলো। জাতীয় পরিচয়পত্রের জন্ম তারিখ অনুযায়ী, হাজী খাদেম হোসেন শিকদারের বয়স হয়েছিল ১৫২ বছর ১ মাস ২১ দিন। তার বাড়ি মাদারীপুর সদর উপজেলার খোয়াজপুর ইউনিয়নের চরগোবিন্দপুর শিকদারকান্দি গ্রামে।বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, ২০০৮ সালের ১৯ আগস্ট ভারতের হাবিব মিয়া (১৩৮) পৃথিবীর ‘সবচেয়ে বয়স্ক মানুষ’ হিসেবে মৃত্যুবরণ করেন, যা পরের দিন বিশ্বের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। সারা বিশ্বের সব মানুষই এতদিন জানতেন, হাবিব মিয়াই ওই সময়ের ‘সবচেয়ে বয়স্ক জীবিত মানুষ’।

কিন্তু প্রকৃতপক্ষে দেখা গেছে, মাদারীপুর সদর উপজেলার খোয়াজপুর ইউনিয়নের চরগোবিন্দপুর শিকদারকান্দি গ্রামের হাজী খাদেম হোসেন শিকদার পৃথিবীর সব চাইতে বেশিদিন বেঁচে থাকা মানুষ।

বাংলাদেশের জাতীয় পরিচয়পত্রে তার জন্ম তারিখ দেওয়া হয়েছে,৭ ফেব্রুয়ারি, ১৮৬০ খৃস্টাব্দ। এ হিসেবে হাজী খাদেম হোসেন শিকদারের বয়স হয়েছিল ১৫২ বছর ১ মাস ২১ দিন (২৮ মার্চ ২০১২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত)।

জীবিত অবস্থায় হাজী খাদেম হোসেন শিকদার সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমার সমবয়সী অত্র অঞ্চলে এখন আর কেউ পৃথিবীতে বেঁচে নেই। আমি আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেছিলাম যে, ৩০০ বার কোরান খতমের পর যেন আল্লাহ আমাকে পৃথিবীতে থেকে নিয়ে যান।’ তিনি বলেন, ‘কিন্তু আমার মনে হচ্ছে, আমার ৩০০ বার কোরান খতম হয়নি। তাই, আল্লাহ আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন।’

তিনি আরও বলেন, ‘এছাড়াও আমার ৫ জন পীর ও জীন আছে। তাদের জন্য আমি এখনও বেঁচে আছি। আমি পৃথিবারী সবচেয়ে বয়োবৃদ্ধ কিনা, তা জানি না, তবে আমার বয়েসী কেউ দুনিয়াতে বেঁচে নেই, এটা আমার বিশ্বাস।’ বিভিন্ন কথার মধ্যে তিনি বিট্রিশ ও জাপানের যুদ্ধের কথা বলতেন। তার চোখের সামনে সবই ভেসে আছে। পড়াশোনার কথা জানতে চাইলে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘গুরুদাস সাহা জমিদার বাড়িতে একটা স্কুল ছিল, সেখানে পড়ালেখা করেছি। কোরান শিখেছি নিজের বাড়িতে হুজুরের কাছে।’

এবিষয়ে খাদেম শিকদারের ৬ষ্ঠ ছেলে মস্তফা শিকদার বলেন, ‘আমার বাবার বয়েসী মানুষ এখন আর পৃথিবীতে কেউ-ই বেঁচে নেই।’ তিনি বলেন, ‘সুদীর্ঘ জীবনে বাবা দুটি বিয়ে করেন। আমরা মোট ৭ ভাই, ৪ চার বোন। সে হিসেবে বর্তমানে বাবার নাতি-নাতনির সংখ্যা হচ্ছে ৪৫ জন। নাতি-নাতনির ঘরে পুতির সংখ্যা ৩৫ জন।’

তিনি জানান, তার বাবা বেঁচে থাকা পর্যন্ত খালি চোখে কোরান শরীফ পড়তে পারতেন। আগে একা একা হেঁটে হাটবাজারে যেতে পারলেও প্রায় ১ বছর ধরে খুব একটা হাঁটাচলা করতে পারতেন না। কানে একটু কম শুনতেন।  তিনি বলেন, ‘ভারতের হাবিব মিয়া যে পৃথিবীর সবচেয়ে বয়স্ক জীবিত মানুষ ছিলেন, এটা ভুল ধারণা।’

তিনি তার বাবা পৃথিবীর সবচাইতে বেশিদিন বেঁচেছিলেন দাবি করে বলেন, ‘পৃথিবীর সবচেয়ে বয়স্ক জীবিত মানুষ হিসেবে এবং বাংলাদেশের ইতিহাসের পাতায় বাবার নাম উঠে আসা উচিৎ। আর সেটা হবে, বাংলাদেশের জন্য একটা গর্বের বিষয়। সরকারসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় আমার বাবার নাম ওয়ার্ল্ড গিনেজ বুকে লেখানো সম্ভব।’

এবিষয়ে একই এলাকার তরুণ মনজুর হোসেন (২৬) বলেন, ‘আমি ছোট বেলায় আমার দাদার কাছ থেকে শুনেছি, খাদেম শিকদারের কথা। তিনি ১৫২ বছর ১ মাস ২১ দিন বেঁচে ছিলেন এটা গর্বের কথা। সরকারের উচিত গিনেস বুকে তার নাম লেখানো।’ কামাল হোসেন একই দাবি করে প্রতিবেদক কে জানান, খাদেম শিকদারের বয়স ১৫০ বছরের বেশি হবে।

৭০ বয়স বয়েসী বৃদ্ধা গোলজান বেগমের ভাষায়, ‘আমি সেই ছোট বেলা থেকে তাকে এমনই বুড়া দেখতাছি।’

খোয়াপুরের ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলী মুন্সী বলেন, ‘খাদেম শিকদারের বয়স ১৫২ বছর না হলেও ১৫০ বছর হবে বলে আমার ধারণা। তবে জাতীয় পরিচয়পত্র অনুযায়ী, তার বয়স ১৫২ বছরের ঊর্ধ্বে। গিনেস বুকে অনেকের নাম উঠলেও প্রকৃতপক্ষে খাদেম শিকদারই পৃথিবীর সবচেয়ে জীবিত বয়স্ক মানুষ ছিলেন।’

এদিকে, মাদারীপুর জেলার ভোটার তালিকা তৈরি করার সময়কার জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মোহাম্মদ আলাউদ্দিন বলেন, ‘খোয়াজপুর এলাকার খাদেম শিকদারের জাতীয় পরিচয়পত্রের জন্ম তারিখ সঠিক। জন্ম তারিখ অনুযায়ী, তার বেঁচে থাকা সময় পর্যন্ত বয়স হয়েছিল ১৫২ বছরের ১ মাস ২১ দিন। আমরা যখন ভোটার তালিকা তৈরি করেছি, তখন তার বয়স সঠিকভাবে জেনে-শুনেই করেছি।’

তিনি আরও বলেন, ‘ভারতের হাবিব মিয়া ১৩৮ বছর বয়স নিয়ে পৃথিবীর সবচেয়ে বয়স্ক মানুষ হিসেবে মৃত্যুবরণ করলে সারা বিশ্বের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ২০ আগস্ট সংবাদটি প্রকাশিত হয়। সারা বিশ্বের কাছে হাবিব মিয়া পরিচিত হয়ে ভারতের নাম উজ্জ্বল করেন। সে হিসেবে মাদারীপুরের আলহাজ্ব খাদেম হোসেন সিকদারের ১৫২ বছর ১ মাস ২১ দিন বয়স নিয়ে ওয়ার্ল্ড গিনেস বুকে নাম লেখানো কোনো অসম্ভব বিষয় নয়। সে ক্ষেত্রে সরকারসহ সংশ্লিষ্টদের এগিয়ে আসতে হবে। এতে বাংলাদেশের সম্মান উজ্জ্বল হবে বলে মাদারীপুরবাসীর ধারণা।’

সুত্রঃ বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম