স্তন ক্যানসার বিশ্বব্যাপী মহিলাদের এক নম্বর ক্যানসার সমস্যা। একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ নির্ণয় হলে এ রোগজনিত মৃত্যুর হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমে আসে। প্রাথমিক পর্যায়ে এ রোগ নির্ণয়ের ব্যবস্থার নাম স্তন ক্যানসার স্ক্রিনিং।
যখন স্তন ক্যানসারের কোনো চিহ্ন বা উপসর্গ থাকে না, তখন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে স্তনে ক্যানসারের চিহ্ন খুঁজে দেখা। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে স্তন রেখেই সফল চিকিৎসা সম্ভব হয়।
স্তন ক্যানসার স্ক্রিনিং কোন নারীদের জন্য:
নারী হয়ে জন্মানো স্তন ক্যানসারের একটি ঝুঁকি। তবে সবাই সমান ঝুঁকিপূর্ণ নন। সাধারণত ২০ বছরের নিচে ঝুঁকি থাকে না বললেই চলে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঝুঁকি বাড়তে থাকে। ৫০ বছরের কাছাকাছি এলেই এ রোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়। অন্যান্য আরও ঝুঁকিপূর্ণ বিষয় বিবেচনায় নিয়ে কম ঝুঁকিপূর্ণ ও অতি ঝুঁকিপূর্ণ উভয় গ্রুপের নারীদের স্ক্রিনিং করানো উচিত। তবে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ নারীদের অপেক্ষাকৃত কম বয়স থেকে ও প্রতিবছরই স্তন ক্যানসার স্ক্রিনিং করা উচিত।
কম ঝুঁকিপূর্ণ নারীঃ
যাদের কোনো ধরনের উপসর্গ নেই।
পরিবারের রক্ত সম্পর্কের আত্মীয় (মা, খালা, নানি, দাদি, কন্যা) কারও স্তন ক্যানসার হয়নি।
অথবা পরিবারের অন্য কারও ক্যানসার হওয়ারও ইতিহাস নেই। যেমন ডিম্বাশয় (ওভারি), কোলন ক্যানসার।
ওজন স্বাভাবিক, নিয়মিত ব্যায়াম বা শারীরিক পরিশ্রম করার অভ্যাস।
১৮ মাস বা তারও বেশি দিন শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানো হলে।
অতি ঝুঁকিপূর্ণ নারীঃ
পরিবারের রক্ত সম্পর্কের আত্মীয় (মা, খালা, নানি, দাদি, কন্যা) কেউ স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত হলে, বিশেষ করে একাধিক ব্যক্তি স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার ইতিহাস থাকলে। অন্যান্য ক্যানসার হওয়ার ইতিহাস থাকলে।
আগে স্তন ক্যানসার অথবা ক্যানসার পূর্বাবস্থা শনাক্ত হয়ে থাকলে।
আগে ক্যানসারের জন্য বুকে রেডিওথেরাপি চিকিৎসাপ্রাপ্ত হলে।
স্তনগ্রন্থির পরিমাণ অধিক হলে।
অধিকতর মেদবহুল, অস্বাভাবিক শারীরিক ওজন, শারীরিক পরিশ্রম না করা হলে।
অল্প বয়সে ঋতুস্রাব শুরু হওয়া ও বেশি বয়সে মেনোপজ হলে।
কখনো সন্তান ধারণ না হলে।
শিশুকে বুকের দুধ পান না করানো হলে।
একটানা দীর্ঘদিন জন্ম নিয়ন্ত্রণ বড়ি সেবন অথবা মেনোপজের (মাসিক বন্ধ হয়ে যাওয়া) পর হরমোন থেরাপি নেওয়া হলে।
স্তন ক্যানসার স্ক্রিনিংয়ে কী কী ধরনের পরীক্ষা করানো হয়ঃ
১। ব্রেস্ট সেল্ফ এক্সামিনেশন (বিএসসি)নিজের স্তন নিজে পরীক্ষা করতে শেখা এবং ২০ বছর বয়স থেকে প্রতি মাসে একবার নিজেকে নিজে পরীক্ষা করা। সারা জীবন তা চালিয়ে যাওয়া। এ পরীক্ষার লক্ষ্য নিজের স্তনের স্বাভাবিকতা বুঝতে পারা এবং কোনো অস্বাভাবিকতা দেখা দিলে যাতে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া যায়। যেমন কোনো চাকা অনুভব করা, ত্বক পুরু হয়ে যাওয়া, বৃন্ত থেকে রক্ত ক্ষরণ বা তরল নির্গত হওয়া ইত্যাদি।
২। ক্লিনিক্যাল ব্রেস্ট এক্সামিনেশন (সিবিসি) প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চিকিৎসক দ্বারা শারীরিক পরীক্ষা করানো। ২০ থেকে ৩৯ বছর বয়স পর্যন্ত তিন বছরে একবার এবং ৪০ বছর পার হলে প্রতিবছর একবার। এ পরীক্ষার পাশাপাশি চিকিৎসক প্রয়োজনে অন্যান্য পরীক্ষা করানোর উপদেশ দিয়ে থাকেন।
৩। ম্যামোগ্রাফি ও অন্যান্য রেডিওলজি এবং ইমেজিং পরীক্ষা। যেমন আলট্রাসনোগ্রাফি, এমআরআই। পরবর্তী সময়ে প্রয়োজন হলে অন্যান্য পরীক্ষা যেমন এফএনএসি (ফাইন নিডল এসপিরেশন) অর্থাৎ সূক্ষ্ম সুঁই ফুটিয়ে রস বের করে মাইক্রোস্কোপিক্যাল পরীক্ষা করে রোগ শনাক্ত করা।
ম্যামোগ্রাফি কী:
ম্যামোগ্রাফি হলো স্তনের এক্স-রে। ম্যামোগ্রাফি মেশিন (বিশেষ ধরনের এক্স-রে মেশিন) দিয়ে এ পরীক্ষা করা হয়। এক্স-রে করতে ব্যবহার হয় তেজস্ক্রিয় রশ্মি। এটি স্তন ক্যানসার ঘটানোর জন্য একটি ক্ষতিকর উপাদান। তবে ম্যামোগ্রাফিতে খুব সামান্যই তেজস্ক্রিয় রশ্মি ব্যবহূত হয়। পঞ্চাশোর্ধ্ব ব্যক্তিদের যদি দুই-তিন বছর অন্তর স্ক্রিনিং ম্যামোগ্রাফি করানো হয় এবং প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ নির্ণয় হয়, তবে ক্ষতির চেয়ে লাভ বেশি হয় বলে বিভিন্ন গবেষণায় প্রমাণিত। তাই আন্তর্জাতিকভাবে ম্যামোগ্রাফি স্তন ক্যানসার স্ক্রিনিংয়ের একটি শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবে বিবেচিত। রেডিওলজিস্টের তত্ত্বাবধানে মহিলা রেডিওলজি টেকনোলজিস্ট (ম্যামোগ্রাফিতে বিশেষভাবে ট্রেনিংপ্রাপ্ত) ম্যামোগ্রাফি মেশিন পরিচালনা করেন এবং রেডিওলজিস্ট ম্যামোগ্রাফি ফিল্মের রিপোর্ট প্রদান করেন। ম্যামোগ্রাফির সুফল পেতে হলে প্রয়োজন ভালো মেশিন, দক্ষ টেকনোলজিস্ট এবং ম্যামো-রিপোর্টিংয়ে বিশেষভাবে পারদর্শী রেডিওলজিস্ট।
সাধারণভাবে ৫০ বছর হওয়ামাত্রই ম্যামোগ্রাফি শুরু করা এবং সুস্থ-সবল দেহ বজায় থাকলে তিন বছর অন্তর তা ৭০ বছর বয়স পর্যন্ত চালিয়ে যাওয়া। উন্নত দেশের বিভিন্ন ক্যানসার সংগঠন লাখ লাখ নারীর ওপর দীর্ঘদিন ধরে এ ধরনের প্রোগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। তবে কোনো কোনো সংগঠন ৪৭ থেকে ৭৩ বছর পর্যন্ত স্ক্রিনিং ম্যামোগ্রাফির জন্য পরামর্শ দিয়ে থাকে।
অতি ঝুঁকিপূর্ণ নারীদের ক্ষেত্রে ৪০ বছর পার হলেই স্ক্রিনিং ম্যামোগ্রাফি শুরু করা এবং প্রতিবছর একবার পরীক্ষা করা উচিত। তবে ৪০ বছরের কম বয়সীদের সাধারণত স্ক্রিনিং ম্যামোগ্রাফির পরামর্শ দেওয়া হয় না। সে ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ বা ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে অংশ নিয়ে স্ক্রিনিং ম্যামোগ্রাফি করা যেতে পারে। ৩০ বছরের নিচে স্ক্রিনিং ম্যামোগ্রাফি অনুমোদনযোগ্য নয়। অল্প বয়সী নারীর স্তনগ্রন্থি অত্যন্ত ঘন হয়ে থাকে। ম্যামোগ্রাফিতে কোনো ইমেজ বা ছবি থাকলে তা ঘন গ্রন্থির আড়ালে ঢাকা পড়ে যায়। রোগ শনাক্ত হয় না। অল্প বয়সী নারীদের অহেতুক ম্যামোগ্রাফি করা হলে স্তন ক্যানসারের ঝুঁকিও বেড়ে যায়। কারণ, ম্যামোগ্রাফি এক ধরনের তেজস্ক্রিয় রশ্মি। ঝুঁকিপূর্ণ অল্প বয়সী নারীদের জন্য আলট্রাসনোগ্রাফি, এমআরআই ম্যামোগ্রাফি করার জন্য পরামর্শ হতে পারে।
-লিখেছেনঃ পারভীন শাহিদা আখতার