ভাটি বাংলার হাওর- হয়তোবা সমুদ্র নয়, তবে তারচেয়ে কোনো অংশে কম কি। হাওর মানে দিগন্ত বিস্তৃত ভুমি। বর্ষায় পানি আর পানি। শুকনোকালে মাঠের পরে মাঠ। সবুজ ধানের ক্ষেতে ফসলের হাসি। ঘাসের চট্টন আর মাছের জলাধার। হাওরাঞ্চলের বৈশিষ্ট্য ছয় মাস পানি আর ছয় মাস ফসল উৎপাদনের ব্যস্থতা। এই হাওরাঞ্চলের মানুষের অজানা জীবনযুদ্ধের অবর্ণনীয় বর্ণনায় লেখিকা শিরিন আক্তার তার প্রথম উপন্যাস ‘আফাল’ গ্রন্থে তুলে ধরেছেন হাওরের মানুষ, জীবন, ধর্ম, লোকাচার ও সংস্কৃতির অনন্য আলেখ্য। আফাল মানে ঢেউ- হাওরের উতলা ঢেউ।
হাওরের আফালের সাথে হাওরের মানুষের জীবন কীভাবে কাটে, কিভাবে ঘুমায় আর চিন্তার অতলে কিভাবে স্বপ্নের জাল বুনে সেইসব অজানা কথামালাকে নিজের জীবনবোধ আর দর্শনের মালঞ্চে গেঁথেছেন একটি অনবদ্য কাহিনী। হাওর এলাকার বড়কর্তা, একান্তবর্তী পরিবার, সামাজিক সংস্কারের দাসত্ব, দুর্যোগ-দুর্ভাবনা, হাহাকার ভরা দীর্ঘশ্বাস, অনেকের মাঝেও একাকীত্ব এমনকি হতাশার মাঝেও আশা নিয়ে নতুনভাবে ঘুরে দাঁড়াবার অর্ণিবাণ প্রত্যয় হাওরের মানুষেরা কিভাবে জীবন কাটায়, কিভাবে মানুষ গড়ে, কিভাবে তাদের স্বপ্ন ভাঙ্গে-গড়ে লেখিকা খুব আদুরে আঞ্চলিক ভাষায় উপস্থাপন করেছেন ভিন্নমাত্রার জীবনচিত্রকথা- ‘আফাল’।
এই আফাল যার অর্থ ঢেউ। ঢেউয়ের দোল খাওয়া নৌকার মতোই আফালের কাহিনী পাঠকের হৃদয় দোলাতে দোলাতে নিয়ে যাবে হাওরে ভাসা কোনো এক অচিন দ্বীপে। যেখানে স্বপ্নরা বাস করে সদূর সবুজ পাহাড়ের উপর ভর করে অনন্য উচ্চতায় দাঁড়িয়ে থাকা সুনীল আকাশের মেঘালয়ে। যে মেঘালয় থেকে হয়ত ক্ষাণিক পরেই রিমঝিম বারি ধারায় কোনো এক নতুন গানের সুর তুলবে হাওরের জলে, ঢেউয়ের গর্জনে, জলের অতলে অথবা নীরব নিথর রোদেলা দুপুরের নিঃষ্প্রাণ বাতাসের বোবাকান্নায়। লেখিকা শিরিন আক্তারের হাওরে বিভোর স্বপ্নে-জাগরণে, অনুভবে আলিঙ্গনে কাটানো শৈশব, যৌবন আর বিদগ্ধ জীবনবোধের পূর্ণতায় দেখা-অদেখা, চেনা-অচেনা মানুষগুলোর ভেতরের নির্যাসটুকু খন্ডিত করেছেন উপন্যাসের শব্দে, বর্ণে, বাক্যে, প্যারায় প্যারায়।
গল্পের কাহিনীর চেয়ে পাঠকের কাছে মাঝে মাঝে মনে হবে হাওরের মানুষের ভাষার শৈল্পিকতার কতো মুগ্ধতা- না আধুনিক, না অ-প্রাচীন। আগামি দিনে যে প্রজন্ম হাওরের ইতিহাস ঘেটে ঘেটে সাগরের জল সিচতে চাইবে ঝিনুকের খোলস দিয়ে- তাদের জন্য অনবদ্য সহায়িকা হবে এই উপন্যাস- আফাল।