anandamohon_boshoময়মনসিংহ আনন্দমোহন কলেজের প্রতিষ্ঠাতা উপমহাদেশের প্রথম এবং একমাত্র র‌্যাংলার আনন্দমোহন বসুর পৈত্রিক ভিটার এখন বেহাল দশা।  বাঙালি রেনেসাঁর অন্যতম স্থপতি বিখ্যাত এই সমাজ সংস্কারকের স্মৃতিবিজড়িত বাড়িটি অবৈধ দখলদারদের কবলে। রাজনৈতিক নেতৃত্বের পৃষ্ঠপোষকতা আর ভূমি বিভাগের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীর সহযোগিতায় লিজের নামে বাড়িটি নিজের দখলে রেখেছেন এক প্রভাবশালী ব্যক্তির পরিবার।

কিশোরগঞ্জের ইটনা উপজেলার জয়সিদ্ধি গ্রামে আনন্দমোহন বসুর এই পৈত্রিক ভিটাটি সংরক্ষণের জন্য এলাকাবাসী ও সুধীজনদের দীর্ঘদিনের দাবি থাকলেও এ ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ নেই। ফলে অরক্ষিত ভিটায় অযত্ন-আর অবহেলায় ধ্বংস হতে চলেছে সপ্তদশ শতাব্দীর স্থাপত্য শৈলীর অনুপম নিদর্শন এ বাড়িটি। কয়েক একর আয়তনের বাড়িটিতে রয়েছে কয়েকটি বিশাল ভবন, খোলা মাঠ ও একাধিক পুকুর। বিশাল বসতবাড়িটি পরিণত হয়েছে পরগাছা উদ্ভিদের বাসস্থানে। চারদিকে নির্মিত প্রতিরক্ষা দেয়ালের অনেক জায়গায় ফাটল দেখা দিয়েছে। দেয়ালের অনেক জায়গার ইট-পাথর দুর্বৃত্তরা লুট করে নিয়ে গেছে। আনন্দমোহন বসুর আতুড়ঘরটিকে বানানো হয়েছে গোবরের গর্ত। এ অবস্থায় ঐতিহ্যের নিদর্শন এসব স্থাপনা বিলীন হওয়ার উপক্রম হয়েছে।

ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও উপমহাদেশে ছাত্ররাজনীতির গোড়াপত্তনকারী আনন্দমোহন বসুর জন্মস্থান ও বসতবাড়ি দেখার জন্য দেশের নানা প্রান্ত থেকে প্রায়ই দর্শনার্থীরা আসেন। কিন্তু বসতবাড়িটি বেদখল হয়ে থাকায় বাড়িটিতে দর্শনার্থীদের প্রবেশাধিকারও সংরক্ষিত পর্যায়ে চলে গেছে। এরপরও বসতবাড়িটি উদ্ধার কিংবা সংরক্ষণে কোনো উদ্যোগ বা আগ্রহ নেই প্রশাসন কিংবা প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের

Kishoreganj-Ananda-Mohan-Bose-Photপ্রত্যন্ত গ্রাম জয়সিদ্ধিতে ১৮৪৭ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর জন্মগ্রহণ করেন আনন্দমোহন বসু।  ১৯০৬ সালের ২০ আগস্ট মাত্র ৫৯ বছর বয়সে পক্ষাঘাত রোগে ভুগে কোলকাতায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন। একজন নিবেদিত প্রাণ শিক্ষানুরাগী, বিচক্ষণ রাজনীতিবিদ হিসেবে বাঙলার রেনেসাঁর উত্তরণে তিনি অবিষ্মরণীয় অবদান রেখেছেন।

‘ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস’র অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা, ভারতীয় উমহাদেশে ছাত্র রাজনীতির গোড়াপত্তনকারী, উনিশ শতকের নারী জাগরণের অগ্রদূত এবং উপমহাদেশের প্রথম ও একমাত্র ‘র‌্যাংলার’ কীর্তিমান এ মানুষটির শারীরিক মৃত্যু ঘটলেও তিনি অনন্য এক মৃত্যুঞ্জয়ী।

আনন্দমোহন বসুর বাবার নাম পদ্মলোচন বসু এবং মাতার নাম উমা কিশোরী দেবী। আন্দমোহন বসুর পিতা পদ্মলোচন বসু শিক্ষা জীবন শেষে ময়মনসিংহ সিটি কালেক্টরেটে চাকরি নেন। ময়মনসিংহ শহরের রামবাবু রোড এলাকায় অবস্থিত বর্তমান ময়মনসিংহ সিটি কলেজিয়েট স্কুলটি ছিল আনন্দমোহন বসুর ময়মনসিংহের পৈত্রিক নিবাস।  মেধাবী আনন্দমোহন বসু ১৯৬২ সালে হার্ডিঞ্জ স্কুল (বর্তমান ময়মনসিংহ জিলা স্কুল) থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় নবম স্থান অধিকার করেন। পরে কোলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে এফএ এবং বিএ উভয় পরীক্ষায় প্রথম স্থান লাভ করে উত্তীর্ণ হন। এই অসাধারণ কৃতিত্বের জন্য তিনি ‘প্রেমচাঁদ-রায়চাঁদ’ বৃত্তি লাভ করেন। এই বৃত্তি পাওয়ার সুবাদে তিনি উচ্চতর লেখাপড়ার জন্য ইংল্যান্ডে যাওয়ার সুযোগ পাওয়ার পাশাপাশি দশ হাজার টাকা বৃত্তি লাভ করেন। ইংল্যান্ডে ক্যাম্ব্রিজ এর ক্রাইস্ট চার্চ কলেজে তিনি উচ্চতর গণিত বিষয়ে লেখাপড়া করেন। ১৮৭৪ সালে সেখানে গণিত বিষয়ক সর্বোচ্চ পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে তিনটি বিষয়ে প্রথম শ্রেণি অর্থাৎ সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে ‘র‌্যাংলার’ উপাধি লাভ করেন আনন্দমোহন বসু।photo-1

ওই বছরই বার-এট-ল ডিগ্রি লাভ করে দেশে ফিরে আসেন এবং আইন ব্যবসা শুরু করেন। এর পূর্বে ছাত্রাবস্থায় তিনি ময়মনসিংহ জিলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক ভগবান চন্দ্র বসুর কন্যা অর্থাৎ বিজ্ঞানাচার্য জগদীশ চন্দ্র বসুর বোন স্বর্ণপ্রভা দেবীকে বিয়ে করেন।
photo-3

রাজনীতিতে আনন্দমোহন বসু ছিলেন স্বপ্নদ্রষ্টা ও অগ্রদূত। ছাত্রদের মধ্যে স্বদেশপ্রীতি জাগানোর উদ্দেশ্যে ১৮৭৫ সালে গঠন করেন স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন। ১৮৭৬ সালে তিনি গঠন করেন ভারতবর্ষের জাতীয় কংগ্রেস এর পূর্বসূরী সংগঠন ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন। ১৮৭৮ সালের ১৫ই মে তিনি ‘সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজ’ প্রতিষ্ঠা করেন। ‘সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজ’ এর তিনি ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। এর পূর্বে আনন্দমোহন বসু সস্ত্রীক ব্রহ্মানন্দ কেশব চন্দ্র সেনের কাছে ব্রাহ্ম ধর্মে দীক্ষা নেন। ১৮৮৫ সালে ‘ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস’র প্রতিষ্ঠাকালে সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জীর সঙ্গে তিনি অসামান্য অবদান রাখেন। তিনি দু-দুবার ‘ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস’র সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।

photo-2

সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজ-এর নিজস্ব ভবন নির্মাণ এবং সমাজ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত সিটি কলেজ ও সিটি স্কুল স্থাপনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। নিজ এলাকায় শিক্ষা বিস্তারের লক্ষ্যে তিনি ময়মনসিংহের পৈত্রিক বাড়িটি দান করে ১৮৮৩ সালে সিটি কলেজিয়েট স্কুল এর কার্যক্রম শুরু করেন। তখন এটির নাম ছিল ময়মনসিংহ ইন্সটিটিউশন উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়। প্রতিষ্ঠাকালে এ বিদ্যালয়ে শহরের সর্বাধিক ছয়শত নয়জন ছাত্র ছিল। তিনি কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেলো, সিনেট সদস্য এবং শিক্ষা কমিশনের সদস্য ছিলেন। ময়মনসিংহে কোনো কলেজ না থাকায় ১৮৯৯ সালে ‘ময়মনসিংহ সভা ও আঞ্জুমানিয়া ইসলামিয়া আনন্দমোহন বসুর কাছে একটি কলেজ প্রতিষ্ঠার দাবি জানায়। ১৯০১ সালে তিনি সিটি স্কুলটিকে দ্বিতীয় শ্রেণির কলেজে উন্নীত করেন এবং ১৯০৮ সালে এর নামকরণ করা হয় আনন্দমোহন কলেজ।photo-4

পশ্চাদপদ নারীদের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে কয়েকজন শিক্ষানুরাগীর সহযোগিতায় ১৮৭৬ সালে স্থাপন করেন ‘বঙ্গমহিলা মহাবিদ্যালয়। যা পরে বেথুন স্কুলের সঙ্গে একীভুত হয়। আনন্দমোহন বসু ও দুর্গামোহন দাসের ঐকান্তিক চেষ্টায় বেথুন স্কুলের সর্বোচ্চ শ্রেণীর দু’ছাত্রী কাদম্বিনী বসু ও সরলা দাস কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ টেস্ট পরীক্ষায় অংশ নিয়ে এন্ট্রান্স পরীক্ষা দেবার উপযুক্ত বিবেচিত হন। ১৮৭৮ সালে কাদম্বিনী বসু প্রথম এন্ট্রান্স পাস মহিলা হবার গৌরব অর্জন করেন। এর ফলে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে নারী শিক্ষার দ্বার উন্মোচিত হয়।

কেবল তাই নয়, আনন্দমোহন বসু, দ্বারকানাথ গাঙ্গুলী, দুর্গামোহন দাস, শিবনাথ শাস্ত্রী প্রমুখের আন্দোলনে ১৮৭৮ সালের ২৭ এপ্রিল কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট নারীর জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি লাভের দাবি মেনে নেয় এবং ১৮৮২ সালে কাদম্বিনী বসু ও চন্দ্রমুখী বসু প্রথম মহিলা স্নাতক হবার সম্মান অর্জন করেন। এছাড়াও তিনি ‘বেঙ্গল প্রভিনসিয়াল কমিটির মাধ্যমে ১৮৮১-৮২ সালে ছাত্রীদের জন্য হোস্টেলের ব্যবস্থা করেন।

র‌্যাংলার আনন্দমোহন বসুর ১১০তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ ২০শে আগস্ট। কিন্তু তাঁর পৈত্রিক ভিটায় থাকছে না কোনো আয়োজন।  উল্টো অযত্ন ও অবহেলায় ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে তাঁর পূর্বসুরীদের বসতবাড়ি।  এছাড়া বিখ্যাত এই মনিষীর জন্মস্থানটিকে দখলমুক্ত করে সংরক্ষণের জন্য দাবি জানিয়েছেন এলাকাবাসী।  সম্প্রতি কিংবদন্তি অভিনেত্রী সুচিত্রা সেনের বাড়িটি উচ্চ আদালতের আদেশের পর উদ্ধার হওয়ায় আবারও আশায় বুক বাঁধছেন তারা। তাদের প্রত্যাশা, আনন্দমোহন বসুর পৈত্রিক ভিটাটিকে উদ্ধার করে এটি সংরক্ষণ করতে সরকার শিগগিরই যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করবে।