জগদীশচন্দ্র বসুর পর, মেঘনাদ সাহাই (১৮৯৩-১৯৫৬) প্রথম বাঙালি আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পদার্থবিজ্ঞানী, যিনি জ্যোতিঃপদার্থ বিজ্ঞানের স্রষ্টা হিসেবে বিজ্ঞানের ছাত্রদের কাছে অতি পরিচিত। তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন ঢাকার অদূরে শেওড়াতলী গ্রামে ১৮৯৩ সালের ৬ অক্টোবর। বাবা জগন্নাথ সাহা এবং মা ভুবনেশ্বরী দেবীর পঞ্চম সন্তান। কিন্তু যেহেতু তাঁর বাবা আর্থিকভাবে খুব বেশি সচ্ছল ছিলেন না, তাই তাঁর প্রাথমিক শিক্ষাও হয়েছিল ওই গ্রামেরই এক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। বালক মেঘনাদ গ্রামেরই একজন চিকিৎসক অনন্তকুমার দাসের বদান্যতায় ভর্তি হতে পেরেছিলেন সাত মাইল দূরের একটি ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলে, যেখান থেকে ১৯০৫ সালে বৃত্তি পরীক্ষায় প্রথম হয়ে তিনি ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন।

ওই বছরই ব্রিটিশ সরকার বাংলা প্রদেশকে বিভক্ত করে এক বিশাল রাজনৈতিক আন্দোলনের সূত্রপাত করে। যার অবশ্যম্ভাবী ফল হিসেবে শুরু হয় সারা দেশে বিপ্লবী ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড। বিভক্ত পূর্ববাংলার গভর্নর হয়ে এসেছিলেন স্যার ব্যামফিল্ড ফুলার, যিনি একদিন ঢাকার কলেজিয়েট স্কুল পরিদর্শনে এসেছিলেন। ওই স্কুলের অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র মেঘনাদ সাহা অন্য ছাত্রদের সঙ্গে মিলে এই ব্রিটিশ শাসকের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন। ফলে স্কুল থেকে তিনি বহিষ্কার হলেন এবং তাঁর সরকারি মেধাবৃত্তিও বাতিল করে দেওয়া হলো। মেঘনাদ কিশোরীলাল জুবিলি স্কুলে ভর্তি হয়ে ১৯০৯ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশিকা পরীক্ষায় পূর্ববাংলার সব ছাত্রছাত্রীর মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করেন। তিনি ওই পরীক্ষায় ইংরেজি, বাংলা এবং সংস্কৃত_এই তিন ভাষা ও গণিতে সর্বোচ্চ নম্বর পাওয়ার কৃতিত্ব অর্জন করেন। ১৯১১ সালে তিনি একইভাবে অত্যন্ত কৃতিত্বের সঙ্গে আইএসসি পরীক্ষায় মেধা তালিকায় তৃতীয় স্থান অধিকার করেন। উল্লেখ্য, একই পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন অন্য একজন, পরবর্তীকালে ভুবনবিখ্যাত বাঙালি পদার্থবিজ্ঞানী_সত্যেন্দ্রনাথ বসু।

উচ্চশিক্ষার জন্য মেঘনাদ সাহা কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হয়ে গণিতে ১৯১৩ সালে গ্র্যাজুয়েশন ডিগ্রি অর্জন করেন এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাতালিকায় এবারও তাঁর অবস্থান ছিল দ্বিতীয় এবং প্রথম ছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ বসু। দুই বছর পর সত্যেন্দ্রনাথ বসু এবং মেঘনাদ সাহা দুজনই এমএসসি পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন_বসু বিশুদ্ধ গণিতে এবং সাহা ফলিত গণিতে।প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র থাকাকালীনই মেঘনাদ সাহা বিপ্লবী আন্দোলনের গোপন সংগঠন ‘অনুশীলন সমিতির’ সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়েছিলেন এবং এ সময় থেকেই তিনি দেশবরেণ্য সুভাষচন্দ্র বসুর সংস্পর্শে এসেছিলেন। ১৯১৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের প্রচেষ্টায় একটি ইউনিভার্সিটি কলেজ অব সায়েন্স প্রতিষ্ঠিত হয়, যার উদ্দেশ্য ছিল উচ্চতর পর্যায়ে শিক্ষা ও গবেষণার সুযোগ সৃষ্টি করা।

তারকনাথ পালিত এবং রাসবিহারী ঘোষ_এ দুজন আইনবিদের বিপুল আর্থিক অনুদানে এ কলেজ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়েছিল। মেঘনাদ সাহা এবং সত্যেন্দ্রনাথ বসু দুজনই প্রথমে গণিত বিভাগে প্রভাষক নিযুক্ত হয়েছিলেন; কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে পরের বছর দুজনই পদার্থ বিজ্ঞানে চলে আসেন। এ বিভাগে পরে সি ভি রামন পালিত অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেছিলেন।

১৯১৯ সালে পদার্থবিজ্ঞানে যোগ দিয়েছিলেন ড. ডি এম বসু, যিনি প্রথম মহাযুদ্ধের সময় বার্লিনে আটকা পড়েছিলেন। তিনি লিখেছেন_পদার্থ বিভাগে আমার দুজন সহকর্মী ছিলেন_মেঘনাদ সাহা এবং সত্যেন্দ্রনাথ বসু। জার্মানিতে এ সময় পদার্থবিজ্ঞানের যে অগ্রগতি সাধিত হয়েছে, সে বিষয়ে তাঁরা কিছুই জানতেন না। এ সময় বার্লিনে সমবেত হয়েছিলেন প্ল্যাংক, আইনস্টাইন, ভারবুর্গ, ম্যাঙ্ বর্ন, ওয়ান্টার নারনস্টের মতো বিজ্ঞানীরা_যাঁরা যুগান্তকারী কোয়ান্টামতত্ত্ব এবং আপেক্ষিকতত্ত্ব সৃষ্টি করেছিলেন। আমি আমার এ দুজন সহকর্মীর বৈশিষ্ট্য মনে করতে পারি, যা বিজ্ঞান গবেষণায় তাঁদের ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দেয়।

…এস এন বসু অল্পসংখ্যক অনুসিদ্ধান্তের ভিত্তিতে যেভাবে যৌক্তিক পদ্ধতিতে প্ল্যাংক (তাঁর থার্মোডাইনামিঙ্ গ্রন্থে) সমগ্র তাপ বলবিদ্যা নির্ধারণ করেছিলেন, তার প্রশংসা করতেন। …এস এন বসু প্ল্যাংকের কোয়ান্টাম ধারণার উপস্থাপনার অন্তর্নিহিত অসংগতি ধরতে পেরেছিলেন… যেখানে পরিষ্কার যৌক্তিক নির্ধারণের অভাব তিনি লক্ষ করেছিলেন। মেঘনাদ সাহার গবেষণার ধরন ছিল সরাসরি। তিনি আমার কাছে পদার্থবিজ্ঞানের গবেষণার দিগন্তে সর্বশেষ অগ্রগতি জানতে চাইতেন…। কোনো কোনো সময় তিনি আমার কাছে গ্যাসের তাপ আয়নকরণতত্ত্ব এবং তারকার বর্ণালি ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে তার প্রয়োগ নিয়ে আলোচনা করতেন।

১৯১৭ সালে ফিলসফিক্যাল ম্যাগাজিনে সাহার প্রথম মৌলিক গবেষণার প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়, যার শিরোনাম ছিল ‘অন ম্যাঙ্ওয়েল স্ট্রেসেস’ এবং তার দুই বছর পর প্রকাশিত হয় ইলেকট্রনের গতি-সংক্রান্ত একটি প্রবন্ধ_যেখানে তিনি লিনার্ড-ভিসার্ট বিভব নির্ধারণ করেন বিশেষ আপেক্ষিক তত্ত্বের ভিত্তিতে। জ্যোতিঃপদার্থ-বিজ্ঞানে সাহার প্রথম কাজ ছিল নির্বাচিত বিকিরণ চাপের ওপর, যা সৌর আবহমণ্ডলে মৌলিক পদার্থের বণ্টনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই কাজটি প্রকাশিত হয় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের জার্নালে এবং ১৯১৮ সালে এসব কাজের জন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় মেঘনাদ সাহাকে ডিএসসি ডিগ্রি প্রদান করে।

মেঘনাদ সাহার সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য মৌলিক বৈজ্ঞানিক গবেষণার অবদান হলো, উচ্চ তাপমাত্রায় আয়নকরণতত্ত্ব এবং সৌর আবহমণ্ডলের বর্ণালি গবেষণায় তার প্রয়োগ। তাঁর বিখ্যাত প্রবন্ধ ‘অন আয়োনাইজেশন ইন দ্য সোলার ক্রোমোস্ফিয়ার’ (সৌর বর্ণ গোলকে আয়নকরণ) প্রকাশিত হয় ফিলসফিক্যাল ম্যাগাজিন জার্নালে ১৯২০ সালের অক্টোবর মাসে।মেঘনাদ সাহা এ প্রবন্ধে বিবেচনা করেছিলেন, ক্যালসিয়াম পরমাণুর আয়নকরণ :

যেখানে Ca হলো ক্যালসিয়াম পরমাণু (গ্যাসীয়), Ca+ হলো ক্যালসিয়াম আয়ন এবং U হলো এই বিক্রিয়ায় নিঃসৃত শক্তির পরিমাণ।সাহা প্রমাণ করেন যে এই বিক্রিয়ার জন্য পাওয়া যায় নিম্নোক্ত সমীকরণ,যেখানে p গ্যাসের চাপ, T হলো তাপমাত্রা এবং X হলো আয়নকরণ ভগ্নাংশ। এই বিখ্যাত সমীকরণটি কিভাবে সাহা পেয়েছিলেন তার ইতিহাস এভাবে বলেছেন,আমি জার্মান জার্নাল নিয়মিত পড়তাম এবং সেভাবেই জে এগার্টের একটি প্রবন্ধের সঙ্গে পরিচিত হই, যেখানে তিনি নারনস্টের তাপ উপপাদ্য প্রয়োগ করে তারকার উচ্চ তাপমাত্রায় আয়নকরণ ব্যাখ্যা করেছিলেন।…

এগার্টের প্রবন্ধটি পড়ার সময় আমি তাঁর সমীকরণে আয়নকরণ বিভব অন্তর্ভুক্ত করার প্রয়োজনীয়তা সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারি, যা দিয়ে যেকোনো পদার্থের, যেকোনো তাপ ও চাপে এক বা একাধিক আয়নকরণ নিখুঁতভাবে গণনা করা যায়।…এভাবেই আমার নামের সঙ্গে যে সমীকরণটি এখন পরিচিত, তা আমি পেয়েছিলাম।

মেঘনাদ সাহার বিভিন্নমুখী অবদান

১৯২১ সালে অধ্যাপক মেঘনাদ সাহা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে খয়রা অধ্যাপক পদে যোগদান করেন এবং দুই বছর পর তিনি এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান হিসেবে যোগদান করেন_যেখানে তিনি ছিলেন ১৫ বছর। ১৯৩৮ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় সাহাকে পালিত অধ্যাপক পদে নিয়োগদান করে, যে পদে একসময় নোবেল পুরস্কার বিজয়ী সি ভি রামন নিযুক্ত ছিলেন।

সাহাকে আরো একটি প্রতিষ্ঠানে সময় দিতে হতো_সেটি ছিল ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর কাল্টিভিশন অব সায়েন্স। ১৯২৮ সালে এই প্রতিষ্ঠান থেকেই সিভি রামন তাঁর অত্যন্ত সুযোগ্য ছাত্র কে এস কৃষ্ণানের সহায়তায় রামনপ্রক্রিয়া আবিষ্কার করেন; যে প্রক্রিয়াকে অনেকে রামন-কৃষ্ণানপ্রক্রিয়া বলেও অভিহিত করেন। এই কৃষ্ণান ১৯৩৫ সাল পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে অধ্যাপনা করেছিলেন। ১৯৩৪ সালে মুম্বাই শহরে অনুষ্ঠিত বিজ্ঞান কংগ্রেসের মূল সভাপতি ছিলেন অধ্যাপক মেঘনাদ সাহা। তাঁর ভাষণের প্রথমাংশে ছিল জ্যোতিঃপদার্থ-বিজ্ঞান বা Astrophysics নিয়ে আলোচনা এবং এ বিষয়ে তাঁর বিভিন্ন গবেষণার বিবরণ। ভাষণের দ্বিতীয়াংশে ছিল একটি সর্বভারতীয় একাডেমী অব সায়েন্স গঠনের জন্য তাঁর সুচিন্তিত প্রস্তাব। এ ভাষণেই সাহা বাংলার বন্যা সমস্যা নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা করেছিলেন এবং একটি নদী গবেষণাগার স্থাপনের প্রস্তাব করেছিলেন।

১৯৩৪ সালে সাহা ‘সায়েন্স অ্যান্ড কালচার (Science and Culture) নামে একটি বৈজ্ঞানিক মাসিক প্রকাশ করার ব্যবস্থা করেন, যা আজ পর্যন্ত অবিচ্ছিন্নভাবে প্রকাশিত হয়ে একটি রেকর্ড সৃষ্টি করেছে বলা যায়। এ পত্রিকায় সাহা অসংখ্য প্রবন্ধ এবং সম্পাদকীয় লিখেছেন, যা শুধু তাঁর বহুমুখী প্রতিভার স্বাক্ষর বহন করে তা-ই নয়, তিনি যে ভারতীয় জনগণের আর্থসামাজিক উন্নয়নের জন্য কী গভীরভাবে চিন্তা করতেন তার পরিচয়ও পাওয়া যায়। ১৯৩৮ সালে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস যে জাতীয় পরিকল্পনা কমিশন স্থাপন করে তা সাহারই চিন্তাধারার প্রত্যক্ষ ফল, সাহা তার সক্রিয় সদস্য ছিলেন আজীবন। জীবনের শেষ দিনটিতে তিনি এই পরিকল্পনা কমিশনের অফিসে যাওয়ার সময় হঠাৎ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে রাস্তায় পড়ে যান এবং এভাবেই তাঁর জীবনাবসান ঘটে।

সাহা পরিকল্পনা কমিশনের শক্তি ও জ্বালানি উপকমিটি এবং নদী প্রশিক্ষণ ও জলসেচ উপকমিটির সদস্য ছিলেন। তিনি ভারতীয় নদীগুলোর প্রায় চিরস্থায়ী বন্যা সমস্যা নিয়ে সারা জীবনই গভীরভাবে চিন্তা করেছেন। সেই ১৯২৩ সালে মেঘনাদ সাহা উত্তর বাংলার প্রলয়ঙ্করী বন্যার সময় আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের অধীনে গঠিত জাতীয় বন্যা কমিটিরও সক্রিয় সদস্য ছিলেন। ১৯৩৪ সালে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতির ভাষণে তিনি বন্যার এই সর্ববিধ্বংসী চরিত্রের প্রতি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন, যার জন্যই ১৯৪৩ সালে দামোদর উপত্যকা অনুসন্ধান কমিটি গঠিত হয়েছিল। তাঁর সক্রিয় পরামর্শ এবং উৎসাহের জন্যই পরবর্তী সময়ে দামোদর উপত্যকা অথরিটি স্থাপিত হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের টেনেসি-উপত্যকা অথরিটির আদলে, যা বলা যায় উপমহাদেশে বন্যা নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে একটি প্রধান মাইলফলক হিসেবে কাজ করেছে।

মেঘনাদ সাহার অন্য একটি উল্লেখযোগ্য অবদান ছিল ভারতীয় বর্ষপঞ্জির সংস্কার। ১৯৫২ সালে ভারতীয় সরকার এই বর্ষপঞ্জি সংস্কারের জন্য একটি কমিটি গঠন করে এবং বলাই বাহুল্য, এ বর্ষপঞ্জি সংস্কার একটা বিশাল কাজ; কেননা বিশাল ভারতে ৩০টি ভিন্ন ভিন্ন বর্ষপঞ্জি চালু ছিল বা এখনো আছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরুর কথামতো এই বর্ষপঞ্জিগুলো ‘অতীত রাজনৈতিক বিভাগেরই সাক্ষী_কিন্তু স্বাধীনতার পর স্পষ্টতই একটা সুষমতার প্রয়োজন আমাদের সামাজিক, রাষ্ট্রীয় এবং অন্যান্য প্রয়োজনের তাগিদে।’এই বর্ষপঞ্জি সংস্কার কমিটিতে মেঘনাদ সাহা ছিলেন বোধ হয় একমাত্র বৈজ্ঞানিক মানুষ এবং এ কমিটির সুপারিশমালার অন্যতম ছিল বছরের শুরু হবে চৈত্র মাস থেকে, চৈত্র থেকে ভাদ্র প্রতিটি মাস হবে ৩১ দিনের এবং অন্য মাসগুলো ৩০ দিনের। ৩৬৫ দিনের প্রতিটি বছরের দিনসংখ্যা যদি চার দিয়ে বিভাজ্য হয়, তবে সেটি হবে অধিবর্ষ।

ধর্মীয় পঞ্জিকা আকীর্ণ ভারতবর্ষে সাহা কমিটির এসব সুপারিশ কতটা গৃহীত হয়েছে, তা আমার জানা নেই। তবে বাংলাদেশে একই ধরনের ড. শহীদুল্লাহ কমিটির সুপারিশ বাংলা একাডেমীর উদ্যোগে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক গৃহীত হয়েছে এবং তার প্রচলন করা হয়েছে। বাংলাদেশ ও পশ্চিম বাংলায় একই ধরনের বর্ষপঞ্জি অনুসরণ করা হলে বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা এবং সুসাহিত্যিক ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর প্রতি আমরা যথাযথ সম্মান দেখাতে পারতাম বলে সব সময় মনে হয়েছে।

সাহার ‘A Treatise on Heat’ এবং ‘A Treatise of Modern Phyiscs’ দুটি অত্যন্ত জনপ্রিয় গ্রন্থ, আমরা অনেকেই ছাত্রাবস্থায় ব্যবহার করার সুযোগ পেয়েছিলাম। আমার গবেষণা জীবনের শেষের দিকে সাহার আরেকটি কাজ দেখে আমি চমৎকৃত হয়ে গিয়েছিলাম। সেটা হলো, চৌম্বক একমেরুর ওপর একটি অত্যন্ত সুন্দর প্রবন্ধ; যেখানে সাহা চৌম্বক একমেরু (magnetic monopole)-এর চুম্বকত্বের তীব্রতার জন্য একটি সমীকরণ নির্ধারণ করেছিলেন। ১৯৩২ সালে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী ডিরাক চৌম্বক একমেরুর অস্তিত্ব সম্পর্কে কিছু অনুমান প্রকাশ করেছিলেন; কিন্তু বর্তমানকালে পরম একীভূততত্ত্বে এ ধারণা আবার ফিরে এসেছে, যেখানে কোয়ান্টায়িত বৈদ্যুতিক আধান এবং চৌম্বক আধানের ধারণা খুবই স্বাভাবিক। চুম্বক একমেরুর ভর হবে একীভূত ভর স্কেলের মতো এবং তা তত্ত্ব অনুসারে আদি বিশ্বে ফোটনের ঘনত্বেই তৈরি হয়েছিল। এই চৌম্বক একমেরু খোঁজা হয়েছিল, কিন্তু পাওয়া যায়নি মোটেই।

সাহার গবেষণার মূল্যায়ন

মেঘনাদ সাহার গবেষণার মূল্যায়ন সবচেয়ে ভালোভাবে করেছিলেন নোবেল পুরস্কার বিজয়ী সি এন ইয়ং (C N Yang)- (লি এবং ইয়ং-এর বিখ্যাত ইয়ং)-এর শিক্ষক। ইয়ং যখন চীন দেশ থেকে পিএইচডি গবেষণা করার জন্য আমেরিকা যাত্রা করছেন, তখন তাঁর শিক্ষক উপদেশ দিয়েছিলেন, সে যেন যাওয়ার পথে কলকাতায় মেঘনাদ সাহার সঙ্গে দেখা করে যায়। ইয়ং তাই করেছিলেন। ১৯৩৬ সালে এস রোসলান্ড তাঁর অতি-পরিচিত ‘থিওরেটিক্যাল অ্যাস্টোফিজিঙ্’ গ্রন্থের ভূমিকায় লিখেছিলেন_

যদিও এ বিষয়ে (অর্থাৎ আণবিক তত্ত্ব বিষয়ে) নিলস্ বোরকে অবশ্যই পথিকৃৎ হিসেবে মেনে নিতে হবে, তবু এই ভারতীয় পদার্থবিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা (১৯২০) সর্বপ্রথম চেষ্টা করেছিলেন আণবিক তত্ত্ব থেকে নক্ষত্রের বর্ণালি অনুক্রমের একটা সুসংগত তত্ত্ব তৈরি করতে।…সাহার এই কাজ জ্যোতিঃপদার্থ-বিজ্ঞানকে যে প্রণোদনা দিয়েছিল, সে সম্পর্কে অতিশয়োক্তি করা যায় না। কেননা, এর পরের সব অগ্রগতি এই কাজটি দিয়েই প্রভাবিত হয়েছে এবং পরবর্তী বেশির ভাগ কাজই সাহার চিন্তাধারার এক পরিমার্জনার চরিত্র গ্রহণ করেছে।সাহার প্রবন্ধের একটি সারসংক্ষেপ পাওয়া যাবে এবং বাংলা একাডেমী কর্তৃক প্রকাশিত বিজ্ঞান বিশ্বকোষের ৩৭১-৩৭৩ পৃষ্ঠায়। এই বিশ্বকোষের কিছুটা উদ্ধৃতি এখানে দেওয়া যায়। সাহার বিখ্যাত সমীকরণ পরিষ্কারভাবে দেখায় যে আয়নকরণের পরিমাণ শুধু তাপমাত্রার ওপর যে নির্ভর করে তা নয়, বরং তা চাপের ওপরও নির্ভর করে।

তারকার ক্ষেত্রে বোরের আণবিক তত্ত্বের এটাই প্রথম সার্থক প্রয়োগ এবং এই তত্ত্ব সৌর আবহমণ্ডলের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করে। এ তত্ত্ব থেকেই তারকার তাপমাত্রা, চাপ এবং মৌলিক পদার্থের বণ্টন সম্পর্কে যথাযথ জ্ঞান অর্জন করা সম্ভব হয়।মেঘনাধ সাহার দ্বিতীয় মৌলিক প্রবন্ধ ‘সূর্যে মৌলিক পদার্থ’ কলকাতা থেকে ১৯২০ সালে ২২ মার্চ পাঠানো হয় এবং তা ‘ফিল ম্যাগ’ জার্নালে ডিসেম্বরে প্রকাশিত হয় (ফিল ম্যাগ ৪০ (১৯২০) ৪০)। দৃশ্যমান বর্ণালি রেখার (ফ্রনহফার লাইন) সাক্ষ্য থেকে ৩২টি মৌলিক পদার্থের সূর্যে উপস্থিতি নিশ্চিত করা হয়েছিল। ফ্রনহফার বর্ণালিতে রুবিডিয়াম ও সিজিয়ামের অনুপস্থিতি সাহা ব্যাখ্যা করেছিলেন তাদের অতি স্বল্প আয়নাইজেশন বিভব থেকে।কিন্তু সৌর কলঙ্ক (sun spot) হলো সৌর আবহমণ্ডলে স্থানীয় শীতলীকৃত জায়গা এবং এখানে এসব মৌলিক পদার্থ তাদের আধানহীন (neutral) অবস্থায় ফিরে আসবে, ফলে সৌর কলঙ্কে এসব মৌলিক পদার্থের অস্তিত্ব দেখা যাবে।

প্রফেসর এইচ এন রাসেল কর্তৃক এই ভবিষ্যদ্বাণীর যাচাইকরণ ঘটে যখন তিনি Rb-এর অবলোহিত জোড়া 7911 ও 7800 আবিষ্কার করেন। এটাই ছিল আয়নাইজেশন-তত্ত্বের প্রাথমিক অন্যতম বিশাল বিজয়। কিন্তু ঈং মৌলিক পদার্থের উপস্থিতি সৌর কলঙ্কের বর্ণালিতে দেখা যায়নি, কেননা তার আয়নাইজেশন বিভব এতই কম যে এটা সৌর কলঙ্কেও আয়নায়িত অবস্থাতেই থাকে।এই তত্ত্ব সৌর ক্রোমোস্ফিয়ার বিভিন্ন তাপমাত্রার চালচিত্র অঙ্কনের সম্ভাবনার দ্বার খুলে দেয়। মেঘনাথ সাহা তাঁর ‘অন এ ফিজিক্যাল থিওরি অব স্টেলার স্পেকট্রা’ প্রবন্ধে [প্রসি. রয়া. সোসা. লন্ডন, ৯৯ (১৯১১) ১৬৫] দেখান, কেমন করে তত্ত্ব তাপমাত্রার ওপর ভিত্তি করে তারকাদের শ্রেণীকরণের কাজে সাহায্য করবে।হার্ভার্ড কলেজ মানমন্দিরের ই সি পিকেরিং এবং এ জে ক্যানন চার লাখ তারকার বর্ণালি জরিপ করে দেখান যে এদের সব বর্ণালি কতগুলো বিশেষ দলে বিভক্ত করা যায় যাদের নাম হলো, P…O…B…A…F…G…M…N…R…S

যেখানে ই চিহ্নিত তারকাগুলো হিলিয়াম তারকা এবং অ তারকাগুলো হাইড্রোজেন তারকা। মেঘনাদ সাহা প্রমাণ করেন যে এই হার্ভার্ড তারকা শ্রেণীকরণ আসলে তাপমাত্রা অনুসারে শ্রেণীকরণ ছাড়া আর কিছুই নয়।আয়নাইজেশন-তত্ত্ব আরো অনেক ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়েছে যেমন অগি্নশিখার পরিবাহিতা, আর্ক বর্ণালি সৃষ্টি, তারকার অবস্থার গবেষণা, বিস্ফোরণের গবেষণা ইত্যাদি।হার্ভার্ড মানমন্দিরের গবেষক সেসিলিয়া এইচ পায়েন (Cecilia H Payne) সাহা তত্ত্বের ওপর বিস্তৃত গবেষণা করে তাঁর গ্রন্থ ‘স্টেলার অ্যাটমসফিয়ার’ রচনা করেছেন, যাকে বলা হয়েছিল জ্যোতিঃপদার্থবিদ্যার ওপর সর্বোৎকৃষ্ট পিএইচডি থিসিস। এই থিসিসে তিনি লিখেছেন_’নাক্ষত্রিক বস্তুর আয়নাইজেশনের ধারণা আধুনিক জ্যোতিঃপদার্থ-বিজ্ঞান সৃষ্টি করেছে।’

-কালের কণ্ঠ