হাজার গরু চড়িয়েছি, ডাংগুলি খেলেছি, গো-বাছুরের জন্য চাইল্লা ঘাস কেটেছি; সেচ-পানি ও কর্ষন যন্ত্রের অভাবে বছরের পর বছর ধরে সে হাওর পতিত বা অনাবাদি থাকতো, সেখানে এখন সবুজ ধানের সমারোহ। সোনালী ধানের ঝিলিকে কৃষকের মুখে হাসি ছড়িয়ে পরছে সর্বত্র । আজ সে মাঠে গরু চড়ানো সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ । সাধীনতাত্তোর সময়ে বংগবন্ধুর উদ্যোগে বিশেষ বিমানে করে জার্মানী হতে হাজার হাজার পাম্প (LLP Pump) এনে হাওরে নাম মাত্র ভাড়ায় বিতরণ করা হয় । বিএডিসির উদ্যোগে এ সব সেচ পাম্প, কর্ষন যন্ত্র, উফশী বীজ, সার ও বিনামূল্যে কীটনাশকের বিতরণের ফলেই বিবর্ণ হাওর আজ ধনে ধানে, সজলা, সুফলায় পরিপূর্ণ । বংগবন্ধুর সবুজ বিপ্লরর ডাকে এক ইঞ্চি জমিও পতিত রাখা যাবে না বংগবন্ধুর। এ আহবানের সফল বাস্তবায়ন হয়েছে হাওরে ।
সারা দেশে ফসলের উৎপাদন (Production) বেড়েছে তিন গুণ । আর হাওরে প্রডাক্টিভিটি (Productivity) যেমন বেড়েছে অনেক। তেমনি ভলিউম অব প্রডাকশান (Volume of production) বেড়েছে ছ’ গুণেরও বেশী । বংগবন্ধু বুঝেছিলেন, অফুরন্ত সম্ভাবনাময়, উর্বর এবং বিশাল হাওরের পতিত জমিকে দ্রুত চাষাধীনের এনে উতপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে খাদ্য ঘাটতির মোকাবেলা করা সম্ভব । তিনি এও বুঝেছিলেন যে, গরীব ও অসহায় হাওরের কৃষকদের পক্ষ্যে এ সব দামী সেচ পাম্প নগদ টাকায় কেনার মত সামর্থ তাদের নাই। তাইতো, তিনি প্রায় বিনামূল্যে, নাম মাত্র ভাড়ায় প্রয়োজনীয় সেচ পাম্প, যাবতীয় খুচরা যন্ত্রাংশসহ সেবা প্রদাণের ব্যবস্থা করেছিলেন । আর এ ব্যবস্থার ফলেই হাওর বিশাল পতিত জমি চাষাধীনে আসে, কৃষকের গোলা সোনালী ধানে ভরে উঠে, ছনের ঘরের জায়গায় রুপালী টিনের ঝলকানি দেখেছি, অনেক কৃষকই সে সময় লাখপতি বনে গিয়েছিলেন। এ বিনিয়োগের রিটার্ণ বা ধারাবাহিকতায় আজ দেশের এক পঞ্চমাংশ ধান হাওরে উতপাদিত হচ্ছে । সারা দেশের মানুষের খাদ্যের যোগান দিচ্ছে হাওর কৃষক ।আজ ও আগামী দিনের খাদ্য ভান্ডারে পরিণত হয়েছে আমার হাওর এলাকা ।
সময়ের বিবর্তনে অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে অনেক । অধিক উতপাদন ব্যয়, ফসলের কম দামে বর্তমানে কৃষকের অবস্থা নাকাল । ধান চাষে কৃষক আগ্রহ হারিয়ে ফেলার উপক্রম । হাজার হাজার শ্রমিক দেশের বিভিন্ন প্রান্ত হতে হাওরে ধান রোপন, পরিচর্যা ও কর্তনের জন্য আসতো । কিন্ত বর্তমানে সর্বত্রই কর্মসংস্থান সৃষ্টি হওয়ায় সেভাবে হাওরে শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না । এ অবস্থায় ধানের উতপাদনশীলতা (Productivity) এবং মোট উতপাদন ( Production) কমে যাবার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে । ভয়াবহ শংকা, আতংকে এবং অনন্যোপায় হয়েই তারা ধান চাষ করে । মান্ধাতার আমলের কৃষি পদ্ধতি দিয়ে ক্রমবর্ধমান উতপাদন ব্যয় এবং পরিবেশ, প্রতিবেশ পরিবর্তনের কারণে কৃষকের অস্থিত্ব বিলীণ হবার উপক্রম । জলবায়ু জনিত পরিবর্তনেও হাওরের কৃষি এখন অনেক জটিল ও ঝুকি পূর্ণ । প্রতি নিয়ত তাদের আগাম বন্যা, খরা, শিলা বৃষ্টি ও রোগবালাই এর মূখোমূখি হতে হয় । এক মুহূর্তের বিলম্বে ঘটে যেতে পারে ভয়াবহ ক্ষতি; তলিয়ে যেতে পারে পাকা ফসল । কৃষকের চোখের লোনা জল আর বানের গোলা জল একাকার হয়ে যায় । বন্যা হতে ফসল রক্ষায় আগাম বীজ তলা করলে ধান চিটা হয় । আবার দেরীতে বপন করলে বন্যায় ডুবে যায়। শাখের করাতের নীচে হাওরের ফসল; এ যেন বেচে থাকার জন্য মৃত্যুর দিকে ধাবিত হওয়া সমশ্রমিকেরও প্রচন্ড অভাব । সঠিক সময়ে কৃষি কার্যাদি সম্পাদনের মাধ্যমে এ সব আপদ-বালাই হতে ফসল রক্ষার জন্য কৃষি যান্ত্রিকীকরণ ছাড়া আর কোন বিকল্প নাই । কৃষি যান্ত্রকীকরণ ব্যতিত প্রতিযোগিতা মূলক উতপাদন বাস্থবতায় ঠিকে থাকাই দায় হবে । সরকার কৃষি ক্ষেত্রে বিভিন্ন রকম প্রণোদনা দিচ্ছে । উতপাদন বৃদ্ধি, উতপাদন খরচ হ্রাস, কর্তনোত্তর ক্ষতি কমানো, ফসলের মান ও গুণ বজায় রাখা ও ফসলের নিবিড়তা বাড়াতে কায়িক শ্রম নির্ভরতা কমিয়ে যন্ত্র ও প্রযুক্তি নির্ভরতা বাড়াতে হবে । এ অতিরিক্ত শ্রম শক্তি আমরা অন্য ক্ষেত্রে নিয়োজিত করতে পারবো ।
এ উপলব্দি থেকে বর্তমান সরকার কৃষি যান্ত্রিকীকরণের উপর অনেক গুরুত্ব দিয়েছে । ব্যক্তি ক্ষতি বা কম উতপাদনে জাতীয় খাদ্য নিরাপ্ততায় বড় রকমের প্রভাব ফেলবে । তাই, সরকার বিভিন্ন রকম প্রণোদনা দিচ্ছে । প্রথম দফায় যন্ত্রের মূল্যের উপর ২৫% হারে ভর্তুকি বাবদ প্রায় ১৬০ কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে । ‘খামার যান্ত্রিকীকরণের মাধ্যমে ফসল উতপাদন বৃদ্ধি-২য় দফা প্রকল্পের আওতায় বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ১৭২ কোটি ১৯ লক্ষ ২৫ হাজার টাকা । বাস্তবায়ন কাল ২০১৩-১৮ সাল । এ প্রকল্পের পরিচালক কৃষি প্রকৌশলী নাজিম উদ্দিন শেখ জানান, এ প্রকল্পের আওতায় ২৫% হারে ২৫ হাজার পাওয়ার টিলার, ৫ হাজার পাওয়ার থ্রেসার, ৭০০ টি কম্বাইন হার্ভেস্টার (বড় ১০০, মাঝারী ৬০০), রাইস ট্রান্সপ্লান্টার ২০০ টি এবং ১,০০০ টি ফুট পাম্পের উপর ভর্তুকি প্রদাণ করা হবে । এর সাথে থাকবে পর্যাপ্ত পরিমানে প্রদর্শণী প্লট ও মাঠ দিবসের (১২৫+১৩,০২০টি) আয়োজন । রাইস ট্রান্সপ্লান্টার ব্যবহার করতে ট্রে’তে বিশেষভাবে তেরী উতপাদিত ধানের চারা লাগবে । আবার কম্বাইন হার্ভেস্টারে ধান কাটার সুবিধার জন্য রাস্তার পাশের জমি আগে রোপন করে ভিতরে যেতে হবে। সে লক্ষ্যে প্রশিক্ষণ ও কর্মশালার আয়োজন (৩৯৮টি) যেমন থাকবে, তেমনি যন্ত্রপাতি মেরামতের জন্য থাকবে মেকানিজ (৫০)। এ প্রকল্প হতে একটি কৃষি যন্ত্রপাতি শুমারীও করা হবে । সেই সাথে করা হবে কৃষি যন্ত্রপাতির প্রভাব নিয়ে একটি গবেষণা মূল্যায়ন । আধা-কাচা, ভাংগা রাস্তা; না পানি, না শুকনা নদী/খাল পথে কাটা ধান পরিবহণ, জমি থেকে আইল বা রাস্তায় তোলা কৃষকে আর এক ভয়ংকর ক্ষতি ও ভোগান্তিতে ফেলে । এগুলো বিবেচনায় নিয়ে হাওরের রাস্তায় মালামাল নিয়ে টেকসই চলা ও চালনা উপযোগী পরিবহণ ব্যবস্থার সংযোগ এ প্রকল্পে থাকা উচিত । নদী গুলো মরে যাওয়ার প্রেক্ষিতে হাওরে নিরাপদ ও ইজি ডিজাইনের ছোট নৌ-বাহণের উদ্ভাবণ করা দরকার ।
গত ১২ জুন ১৪ বিএআরসি মিলনায়তনে এ প্রকল্পের জাতীয় কর্মশালা অনুষ্টিত হয় । কৃষি সচিব ড মো নজরুল ইসলাম এতে প্রধান অতথি ছিলেন । কৃষি কর্মকর্তাগণ উপস্থিত ছিলেন । অধিকাংশ বক্তা এ প্রকল্পের কার্যক্রম সবার আগে এবং জরুরীভাবে হাওর এলাকায় বাস্তবায়ন ও সম্প্রসারণের উপর গুরুত্বারোপ করেন । এমনকি এ প্রকল্প পরিচালক এবং কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) মহা পরিচালক এ বছর ধান কর্তন উপলক্ষ্যে হাওর পরিদর্শণ করেন । নিজ চোক্ষে কৃষকের দুরাবস্থা দেখে তারাও হাওরে সবার আগে ধান কর্তন এবং রোপন যন্ত্রের প্রয়োজনীয়তার কথা স্বীকার করেন । কাজেই কদর বাড়ে । তাই মাঠ পর্যায়ে কর্মরত ডিএই এর কয়েক জন কর্মকর্তা হাওরে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ বিষয়টি কর্মশালায় উপস্থাপন করায় বিষয়টি বেশ গুরুত্ব পায় । সারা দেশে ৫০টি জেলার ২০০ উপজেলায় এ প্রকল্পের কার্যক্রম প্রদর্শণ করা হবে । এ তালিকা দেখে আমার চোখ ছানাবড়া । “সারা রাত রামায়ন পড়ে সীতা কার বাপ”? এ অবস্থা হয়েছে । হাওর জেলা হিসাবে পরিচিত কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোণা, সিলেট, মৌলভীবাজার, বি বাড়িয়া ও সুনামগঞ্জ জেলার কয়েকটি উপজেলার নাম এতে আছে । হবিগঞ্জ জেলার নাম নাই। কিন্ত প্রকৃত হাওর উপজেলা হিসাবে পরিচিত একটি উপজেলার নামও আমি এ তালিকায় খুজে পায়নি । মনটা আমার ‘হরষে বিষাদ’ এ পরিণত হলো ।
একটি কম্বাইন্ড হার্ভেস্টার বা একটা রাইস ট্রান্সপ্লান্টারের দাম পরবে যথাক্রমে প্রায় ১০- ২৭ লক্ষ টাকা ও সাড়ে ৩ লক্ষ টাকা । আমাদের অধিকাংশ কৃষক ক্ষুদ্র কৃষক, জমিগুলো খন্ড বিখন্ড । যৌথ ও বড় কৃষক পরিবারগুলো ভেংগে যাওয়ায় আর্থিক অবস্থাও দুর্বল । সে ভর্তুকি মূল্যেই হোক বা বাকীতেই হোক ! ক’ জনের সামর্থ আছে এ যন্ত্র গুলো কেনার ? হাওরে বছরে মাত্র একটি ফসল উতপাদন হয় । তাই একটি কম্বাইন্ড হার্ভেস্টার বা রাইস ট্রান্সপ্লান্টার মাত্র স্বল্প কদিন কাজে নিয়োজিত থাকবে । অধিক বিনিয়োগের মূল্যবান এ যন্ত্রগুলো বাকী সময় অলস ভাবে পরে থেকে নষ্ট হবার আশংকার পাশাপাশি বিনিয়োগ উঠে না আসার সম্ভাবনা থেকেই যাবে । যন্ত্রের কার্যকারিতা বা গোলযোগের মতো বড় বিষয়টির দায়বত্বতা কি কৃষক বহণ করতে পারবে? ব্যাংক লোন পাওয়ার কোন নিশ্চয়তা নাই । কয়েক জনে মিলে কিনে নিজেরা ব্যবহার বা ভাড়া খাটাবে, সেটাও জটিল কাজ । সমবায় কালচার এখনো আমাদের মাঝে সেভাবে গড়ে উঠেনি । ব্যক্তি উদ্যোগে অন্যত্র নিয়ে গিয়ে ব্যবহার করাও সম্ভব নয়।
তদারককারি কৃষি প্রকৌশলীদের চাকুরি প্রকল্প ভিত্তিক । প্রকল্প শেষ হলে কে দেখবাল করবেন ? তাই বলে কি হাওরের কৃষক সরকারের এ সত ইচ্ছার সুফল হতে বঞ্চিত হবে ? তাদেরই তো সবার আগে এ যন্ত্রগুলো বেশী প্রয়োজন । বংগবন্ধু জার্মানী হতে বিশেষ বিমানে করে জরুরীভাবে এনে অধিক দামের সেচ পাম্প হাওর কৃষকদের মাঝে নাম মাত্র ভাড়ায় বিতরণ করেছিল বলেই হাওর আজ ও আগামী দিনের খাদ্য ভান্ডার’ এ পরিণত হয়েছে। এ উদাহরণ তো আমাদের সামনে রয়েছেই । তাছাড়া বিআরটিসির কোটি টাকা দামের বাস ভাড়ায় নিয়ে কিছু লোক নিজেরা লাভবান হয়ে জনগণকে সেবা দিচ্ছে ! সেক্ষে্ত্রে কৃষকের পক্ষ্যে সরকারের টাকায় কেনা কম্বাইন্ড হার্ভেস্টার এবং রাইস ট্রান্সপ্লান্টার ভাড়ায় ব্যবহারের সুযোগ দাবী করা অযৌক্তিক হবে না । এটা বরং অধিক যুক্তিযুক্ত এবং জন গুরু্ত্বপূর্ণ । এ ব্যবস্থা থাকা উচিত । বংগবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা, তার সরকারের অর্জন- খাদ্য নিরাপত্তার নিশ্চয়তা বিধানের স্বার্থে হাওর অঞ্চলে সর্বাগ্রে এবং অধিক প্রয়োজনীয় কম্বাইন্ড হার্ভেস্টার এবং রাইস ট্রান্সপ্লান্টার বেশি পরিমাণে বরাদ্দের দাবী জানাছি । সে-টা ভর্তুকি মূল্যে কিনে নয়, ন্যায্য ভাড়ায় সেবা প্রাপ্তির ।
খামার যান্ত্রিকীকরণের মাধ্যমে ফসল উতপাদন বৃদ্ধি প্রকল্প’-২য় পর্যায়ের প্রদর্শণী ও মাঠ দিবসসহ সকল কার্যক্রমে হাওর উপজেলা সমূহ অর্ন্তভূক্ত থাকবে এ আশাবাদ আমরা করতেই পারি । কারণ, ‘মাছে ভাতে বাংগালীর যোগানদাতা হাওরবাসি ।
ড নিয়াজ পাশা, কৃষি প্রকৌশলী ও হাওর ভূমিপুত্র ।
সাবেক ভিপি, ফজলুল হক হল ছাত্র সংসদ, বাকৃবি, ময়মনসিংহ ।
সার্ক এগ্রিকালচার সেন্টার, ঢাকা ।
ফোন- ০১৭২৭ ০৭৪ ৫৮৪