একই পরিবারে ওরা ছয়জন শারীরিক প্রতিবন্ধী। বাবা মহরম আলী, একমাত্র ছেলে সুজন এবং চার মেয়ে মর্জিনা, জোহরা, মুক্তা ও পান্না। তাদের মধ্যে সুজন ও মর্জিনা কলেজে পড়ছে। বাদবাকি তিনজন পড়ছে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। তাদের সবার কোমর থেকে পা পর্যন্ত শরীরের বিভিন্ন অংশ অবশ ও বাঁকানো। খেয়ে-পরে বাঁচাই তাদের পক্ষে কঠিন। প্রায় বিনা চিকিৎসায় তাই দিনে দিনে চিরপঙ্গুত্ব বরণ করছে তারা। বাজিতপুর উপজেলার পিরিজপুর ইউনিয়নের বিলপাড় গজারিয়া গ্রামে দরিদ্র এ পরিবারটির বাস।

disability

পরিবারের গৃহকর্তা মহরম আলী ও তাঁর পাঁচ সন্তানই শারীরিক প্রতিবন্ধী। বাজিতপুরের বিলপাড় গজারিয়ায় পরিবারটির বাস।

সরেজমিনে গিয়ে জানা যায়, বাবার মতো সুজন ও তার বোন মর্জিনার কোমর পর্যন্ত অবশ থাকলেও হাতগুলো এত দিন সচল ছিল। হুইল চেয়ারে বসে হাত দিয়ে চাকা ঠেলে ঠেলে তারা স্কুলে যেতে পারত। তাদের অন্য তিন বোন জোহরা, মুক্তা ও পান্নার কেবল পাগুলো অবশ ও বাঁকা। কিছুদিন ধরে সুজন-মর্জিনার হাতও বাবার মতো চিকন হয়ে আসছে। এ নিয়ে দুজনই তাদের শিক্ষাজীবন নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে। সুজন বলে, ‘দুজনেরই হাত দিনে দিনে চিকন হয়ে যাচ্ছে। আগের মতো হাতে জোর পাই না। লিখতে কষ্ট হয়। সামনেই একাদশ শ্রেণির বাৎসরিক পরীক্ষা। পরীক্ষাটা ঠিকঠাকমতো দিতে পারব কি না, এ নিয়ে আমরা এখন শঙ্কিত।’

‘হাত এমন হয়ে গেলে আর লেখাপড়া হবে না’ বলে দীর্ঘশ্বাস ফেলার সময় মার্জিনার চোখের কোণ ভিজে ওঠে। মর্জিনা জানায়, সে লেখাপড়া করে শিক্ষক হতে চেয়েছিল। সুজনেরও একই কথা। মানুষের মর্যাদা পেতে তাকে শিক্ষালাভ করতে হবে। কিন্তু দারিদ্র্য সে স্বপ্ন গুঁড়িয়ে দিচ্ছে। দীর্ঘসময় কথা বললেও ওদের মুখে একবারও হাসির রেখা ফুটে ওঠেনি। সারাক্ষণ মনে হয় মন খারাপ করে আছে তারা। কারণ জানতে চাইলে কোনো উত্তর দেয় না। তার পরও ওরা লেখাপড়া করে বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখে। দুর্বিষহ জীবন অর্থবহ করতে চায়।

উঠোনের এক কোণে হুইলচেয়ারে বসেছিলেন মহরম আলী। তিনি জানান, জন্মের পর থেকে তিনি প্রতিবন্ধী। বড় হতে থাকলে আস্তে আস্তে তার হাত-পা সরু হতে থাকে। তবে এটা কী রোগ, তা তিনি জানেন না। টাকার অভাবে ঠিকমতো চিকিৎসাও করাতে পারেননি। এ অবস্থায়ই বিয়ে করেন। পরে একে একে জন্ম নেওয়া সন্তানদের মধ্যেও একই সমস্যা দেখা দেয়। যথাযথ চিকিৎসার অভাবে ছেলেমেয়েরাও পঙ্গু হতে থাকে।

মহরম আলীর স্ত্রী ফুলবানু স্বামী-সন্তানদের সেবা-যত্ন করে করে ক্লান্তপ্রায়। তিনি বলেন, ‘চিকিৎসার অভাবে বাবার মতো সন্তানরাও লুলা (প্রতিবন্ধী) হয়েছে। কোলের তিন বছরের মেয়ে পান্না এত দিন সুস্থ ছিল। চিকিৎসা না পাওয়ায় সেও লুলা হয়ে যাচ্ছে।’ তিনি জানান, তাঁর স্বামী ও অসুস্থ সন্তানরা কেউ নিজের কাজ নিজে করতে পারে না। গোসল, খাওয়া, জামা-কাপড় পরানো থেকে প্রাকৃতিক ক্রিয়াদি সবকিছু করার ভারও তাঁর ওপর।

হুইলচেয়ারে বসে বসে ওরা বাড়ি থেকে সামনের বড় সড়ক পার হয়ে ১০ বছর স্কুলে গেছে। স্থানীয় হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক মোবারক হোসেন বলেন, ‘সুজন ও মর্জিনা দুজনই লেখাপড়ায় ভালো। ওদের জন্য স্কুল কর্তৃপক্ষ এত দিন নানা সুযোগ-সুবিধা দিয়েছে। এখন কেউ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে এগিয়ে না এলে তাদের পক্ষে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করা সম্ভব হবে না।’ প্রতিবন্ধী পরিবারের সদস্যরা জানান, ‘মৃত্তিকা’ নামের স্থানীয় একটি সংস্থা ওদের দেখাশোনা করছে। সংস্থার প্রধান মাহবুবুর রহমান ভুঁইয়ার উদ্যোগে বিভিন্ন সংস্থা তাদের খোঁজখবর নিচ্ছে। নানা ধরনের সাহায্য-সহযোগিতা করছে। সরকারি প্রতিবন্ধী তালিকায়ও তাদের নাম অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। তবে সরকারিভাবে সহযোগিতা অনেক কম। একাধিকবার তারা হুইলচেয়ার পেয়েছে।

কিশোরগঞ্জে ৩৫ হাজার প্রতিবন্ধী:  কিশোরগঞ্জ সদরসহ ১৩ উপজেলায় শারীরিক, মানসিক, দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীসহ নানা ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধী মানুষের সংখ্যা প্রায় ৩৫ হাজার ৫৭৩ জন। এর মধ্যে পুরুষ ১৯ হাজার ৪৪০ এবং নারী প্রতিবন্ধীর সংখ্যা ১৫ হাজার ৯৬১ জন। এ ছাড়া লিঙ্গপ্রতিবন্ধী (হিজড়া) রয়েছে ১৭২ জন। তাদের মধ্যে মাত্র ছয় হাজার ৬৩ জনকে প্রতিবন্ধী সনদ প্রদান করা হয়েছে। জেলা সমাজসেবা অধিদপ্তর সূত্রে এ তথ্য পাওয়া গেছে। ওই সূত্রে আরো জানা গেছে, কটিয়াদী উপজেলায় সবচেয়ে বেশি-তিন হাজার ৯৪৪ জন প্রতিবন্ধী মানুষের বাস। সবচেয়ে কম মিঠামইনে এক হাজার ৩৩৬ জন। বাজিতপুরের একটি ইউনিয়ন পিরিজপুরেই রয়েছে ৫৩১ জন প্রতিবন্ধী। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার ও সুরক্ষা আইন (সংশোধিত), ২০১৩ সংসদে পাস হয়েছে। এর আলোকে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার ও সুরক্ষা বাস্তবায়ন কমিটি গঠন করা হয়েছে। তবে কর্তৃপক্ষের উদাসীনতায় এক বছরেও কমিটিগুলো কার্যকর করা হয়নি বলে অভিযোগ উঠেছে। তাই প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার সুরক্ষা দূরে থাক, প্রতিবন্ধী জরিপ কার্যক্রমও সঠিকভাবে পরিচালিত হচ্ছে না। ফলে প্রতিবন্ধীদের প্রতি সামাজিক সহমর্মিতা তৈরি বা এ সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টির ক্ষেত্রও গতিশীল হচ্ছে না। এদিকে ৩ ডিসেম্বর সারা দেশে প্রতিবন্ধী দিবস উপলক্ষে শোভাযাত্রা ও আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। প্রথম প্রকাশ  দৈনিক কালের কন্ঠ  (2014/12/03/)