সত্তর দশকে উজ্জ্বল এক প্রজন্ম জড়ো হয়েছিলেন দেশের শীর্ষস্থানীয় নাট্যদল ঢাকা থিয়েটারে। নাট্যমঞ্চের এ সংঘ পাদপ্রদীপের আলো পেরিয়ে পেঁৗছে যায় ব্যক্তিগত পর্যায়ে। গড়ে ওঠে বন্ধুত্ব…
ঢাকা থিয়েটারের হয়ে একসঙ্গে একই মঞ্চে আমরা কাজ শুরু করেছিলাম। পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়, রাইসুল ইসলাম আসাদ, হুমায়ুন ফরীদি, সুবর্ণা মুস্তাফা, শিমুল ইউসুফ আর আমি। এখন আমরা প্রত্যেকেই স্বতন্ত্র পরিচয়ে পরিচিত। কিন্তু আমাদের মধ্যে এখনও বন্ধুত্ব আছে।
স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালের ২৯ জুলাই ঢাকা থিয়েটারের জন্ম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন নাট্যচর্চা চলছে অপ্রতিরোধ্য গতিতে। বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক নাট্যচক্রে কাজ করতাম আমরা কয়েকজন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে কাজ করার অনুমতি ছিল না আমাদের। ফলে জন্ম হলো ঢাকা থিয়েটারের। সে সময় সেলিম আল দীন, নাসির উদ্দীন ইউসুফ, ম. হামিদ, আল মনসুর, রাইসুল ইসলাম আসাদ, পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়, হাবিবুল হাসান, সালাউদ্দিন জাকীরা মিলেই তৈরি করেন দলটি। সেলিম আল দীন ছিলেন এই দলের বড় প্রণোদনা। ১৯৭৪ সালে আমি, শিমুল ইউসুফ, জামিল আহমেদ ও মাহবুব আলী যোগ দিই। ‘৭৫ সালে এলো সুবর্ণা, ‘৭৬ সালে জহিরউদ্দিন পিয়ার, ‘৭৭ সালে হুমায়ুন ফরীদি দলে যোগ দেয়। এখন মঞ্চের নাট্যাঙ্গন থেকে আমরা অনেকেই দূরে চলে গেছি, কিন্তু বন্ধুত্বের বন্ধন আজও আমাদের এতটুকু কমেনি।
একসঙ্গে কাজ করার সময়টা আমরা প্রত্যেকেই উপভোগ করেছি। তখন ব্যক্তিস্বার্থ গুরুত্ব পায়নি। মুক্তিযুদ্ধের উত্তেজনা, শক্তি, উদ্যম_ আমরা একসঙ্গে বহন করতাম। কেউ আগে, কেউ পরে দলে এসেছে, কিন্তু প্রত্যেকেরই আলাদা পরিচয় গড়ে উঠেছে। তাদের সবারই মনে হয় ঈশ্বর-প্রদত্ত ক্ষমতা আছে বলেই তারা আজ এ পর্যায়ে আসতে পেরেছে। আমি সৌভাগ্যবান যে তাদের বন্ধু হতে পেরেছি। আসাদকে ঈর্ষা করতাম। স্বাধীনতার পর সবচেয়ে সৌভাগ্যবান অভিনেতা ও। মঞ্চ, টেলিভিশন, চলচ্চিত্র সব ক্ষেত্রেই ভালো সুযোগগুলো পেয়েছে আসাদ। ওর কণ্ঠস্বর চমৎকার। ভালো অভিনেতা। সবচেয়ে বড় কথা, ওর মতো সোজাসাপটা মানুষ খুব কম হয়। পীযূষ গুরুগম্ভীর। ওর মনের কথা কেউ বলতে পারবে না। আজও একই রকম আছে ও। শিমুল মূলত কণ্ঠশিল্পী। তবে সাফল্যের সঙ্গেই অভিনয়শিল্পে নিজের অবস্থান গড়ে তুলেছে। আমরা থিয়েটার করতাম, মঞ্চনাটককে সমৃদ্ধ করতে চেয়েছিলাম। আমাদের সম্পর্কের কোনো নাম দেওয়া যায় না। বন্ধুত্বও বলা যাবে না, ভাই-বোন সম্পর্কও নয় এটা।
বন্ধুত্বের সংজ্ঞা আমি জানি না। সব সম্পর্কের মধ্যেই বন্ধুত্বসুলভ সম্পর্ক থাকে। সেটা বাবা, মা, প্রেমিকা সবার সঙ্গেই। আমরা যখন ঢাকা থিয়েটার করি তখন আমাদের এখনকার মতো এত ব্যস্ততা ছিল না। দল, থিয়েটার, পড়াশোনা, টিভি_ এই ছিল জীবন। প্রতিদিনই আমরা দীর্ঘসময় একসঙ্গে থাকতাম। মহড়া হতো। আড্ডা হতো রমনা রেস্তোরাঁয়। সেলিম আল দীন আর নাসির উদ্দীন ইউসুফ সমবয়সী।
আমাদের প্রত্যেকেরই আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট ছিল। সেজন্য আমাদের মধ্যে কোনো রকম দম্ভ কাজ করত না। নিজেদের নিয়ে সত্য কথা বলার সাহস ছিল সবার মধ্যেই। যেমন আমি কোনো খারাপ কাজ করলে ফরীদি বলে দিয়েছে, ‘তুই এটা কেন করেছিস?’ স্বভাব চরিত্রের দিক থেকে পীযূষ ধীরস্থির। কিন্তু অন্যদিকে অসম্ভব এলোমেলো ফরীদি। ওর মধ্যে সারাক্ষণ চঞ্চলতা বিরাজমান। অন্যদিকে আসাদ ছিল কখনও চঞ্চল, আবার কখনও স্থির প্রকৃতির। আমি মনে করি, আমাদের সময়ে যে কয়েকজন অভিনয়শিল্পী অভিনয় করেছে তাদের মধ্যে সবচেয়ে প্রতিভাধর অভিনেতা বলব ফরীদিকে। এমন মানের অভিনয়শিল্পী আর জন্মাবে না। সেই সুযোগও এখন আমাদের দেশে নেই। ফরীদি বলত_ ‘জানালাটা বড় ও খোলা রাখবে, সেখানে ধুলোবালি ঢুকবে, তবে আলো-বাতাসও আসবে।’ ফরীদিও ওই রকম। সব খুলে দাও। ধুলো-বাতাস ঢুকুক। কিন্তু সব খুলে দিতে গিয়ে নিজেকে অনেক কষ্ট দিয়ে ফেলেছে ও। ফরীদি স্বভাবশিল্পী। ও যদি ঢাকা থিয়েটারে না-ও আসত, যে প্রতিভা, তা দিয়ে অন্য ক্ষেত্রেও পারদর্শী হতে পারত। ওর শিল্পবোধের জায়গাটা খুব স্বচ্ছ। নান্দনিকতার জায়গাও খুব ভালো বোঝে। শৈশব থেকেই জীবনকে খোলা চোখে দেখেছে। মঞ্চে অভিনয়ের পাশাপাশি তখন আমরা প্রায় সবাই টিভিতে অভিনয় করি। তখন টিভিতে একজন অভিনয়শিল্পীর মাসে দুই-একটি নাটকে অভিনয় করা যেত। সে অন্যকথা। ফরীদির অভিনয়ের প্রতি আকাঙ্ক্ষা ছিল প্রবল। সেজন্যই কি-না সে তখন চলচ্চিত্রে অভিনয় শুরু করে। তখন পাশের দেশ ভারতের দিকে তাকালেই দেখা যেত নাসিরুদ্দিন শাহ, নানা পাটেকর, ওমপুরির মতো অভিনয়শিল্পীরা তাদের চলচ্চিত্রকে পাল্টে দিয়েছে। ফরীদি ভেবেছিল আমাদের দেশের চলচ্চিত্রও বুঝি পাল্টে যাবে। কিন্তু দুঃখের বিষয় যে আমাদের দেশীয় চলচ্চিত্রের পরিবেশ পাল্টে যায়নি। উল্টো ফরীদিকে পাল্টাতে হয়েছিল।
সুবর্ণা যখন মঞ্চনাটকে আসে, তখন অষ্টম শ্রেণীতে পড়ে সে। ঢাকার মগবাজারে কাজী অফিসের গলিতে থাকে। পীযূষের দায়িত্ব ছিল ওকে মহড়ায় নিয়ে আসা এবং মহড়া শেষে বাড়িতে দিয়ে আসা। ও জন্মগতভাবে অভিনয়শিল্পী। টেলিভিশনের অনেক জনপ্রিয় চরিত্রে তাকে দেখা গেছে। এজন্য এখনও সুবর্ণাকে দর্শকরা মনে রেখেছে বলতে হয়। সে এখনও অভিনয় করছে। কিন্তু আগের মতো নেই। এর কারণ একটাই অভিনয়কে পেশা হিসেবে নিয়ে অভিনয়শিল্পীর করার কিছু থাকে না।
আমাদের সময়টা স্বর্ণযুগ ছিল বলা যেতে পারে। আমাদের মধ্যে দারুণ বন্ধুত্ব ছিল। হ্যাঁ, এটাও ঠিক যে আমাদের মধ্যে কখনও ছোটখাটো ভুল যে হতো না তা কিন্তু নয়। আমাদেরও নানা বিষয় নিয়ে মন খারাপ হয়েছে, কিন্তু সেটা ক্ষণিকের জন্য। নিজেরাই সে ভুলগুলোকে শুধরে নিয়েছি। আমাদের মধ্যে যদি একাত্মতা না থাকত তাহলে কিন্তু দলটা ভেঙে অন্য কোনো দল হতো।
আমরা প্রত্যেকের ওপর শ্রদ্ধাশীল ছিলাম। বন্ধুদের মূল্যায়ন করি এভাবেই, ফরীদির মতো অসাধারণ অভিনেতা আর একজনও আসবে কি-না সন্দেহ। আসাদের মতো প্রভাববিস্তারী অভিনেতাও কি পাওয়া যাবে? পীযূষের এই মাপের কণ্ঠ কি আর আছে? সুবর্ণার মতো লেখাপড়া জানা অভিনেত্রীও কি পাওয়া যাবে?’
এখন আমাদের প্রত্যেকেরই আলাদা জীবন হয়েছে। অনেকদিন পরপর দেখা হয় আমাদের। তাহলে আমরা সবাই জানি, যদি প্রয়োজন হয়, তাহলে একজন অন্যজনের পাশে এগিয়ে যাবে। পীযূষ, সুবর্ণা, ফরীদি, আসাদ, শিমূল, বাচ্চু ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ আছে। তাদের কেউই এখনও এতটুকুও দূরে নয়। আসলে বন্ধুত্ব মরে না।