হাওরবেষ্টিত কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচরে গত বছরের শুরু থেকে চলতি মাস পর্যন্ত ২৬ জন নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ১২টি ঘটনায় থানায় মামলা হয়েছে। বাকিগুলো গ্রাম্য মাতবরেরা বিচার-সালিসের মাধ্যমে নিষ্পত্তি করেছেন। ধর্ষণের ঘটনায় গ্রাম্য সালিসে সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে নগদ অর্থ জরিমানা বা জুতাপেটা করা হয়েছে।

কিশোরগঞ্জের পুলিশ সুপার মীর রেজাউল আলম প্রতিবেদক কে বলেন, ‘ধর্ষণের মতো স্পর্শকাতর বিষয় সামাজিক নিষ্পত্তির কোনো সুযোগ নেই। টাকার বিনিময়ে সবকিছু থেকে পার পাওয়া যায়, এটি প্রতিষ্ঠিত হলে সমাজে সুদূরপ্রসারী নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।’

কুলিয়ারচর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সুব্রত কুমার সাহা জানান, গত বছরের শুরু থেকে চলতি মাস পর্যন্ত ধর্ষণের ১২টি মামলা রেকর্ড হয়েছে। তবে অনুসন্ধানে জানা গেছে, এই সময়ের মধ্যে উপজেলায় ২৬টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। ওই থানার এক উপপরিদর্শক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘ধর্ষণের ঘটনা কানে এলে কিছু মাতবরের ঘুম হারাম হয়ে যায়। এসব ঘটনা নিষ্পত্তি করতে তাঁরা একপায়ে খাড়া হয়ে থাকেন। তাঁদের কারণে ধর্ষণের প্রকৃত হিসাব থানায় রেকর্ড করা যাচ্ছে না।’

গত বছরের ২৬ জুন তারাকান্দি গ্রামে তৃতীয় শ্রেণীর এক ছাত্রী নিজের ঘরে বসে টিভি দেখছিল। শিশুটিকে একা পেয়ে একই এলাকার সুজন মিয়া (২৪) ধর্ষণ করেন। অভিযোগটি থানা পর্যন্ত পৌঁছার আগেই মাতবরেরা এগিয়ে এসে সালিসের মাধ্যমে নিষ্পত্তির চাপ দেন। অবশেষে শাস্তি হিসেবে টাকা পরিশোধ করে শিশুধর্ষণের ঘটনা থেকে দায়মুক্তি মেলে অভিযুক্ত ব্যক্তির। ধর্ষণের শিকার শিশুটির মা বলেন, ‘ইচ্ছা আছিল লম্পটরে জেলের ভাত খাওয়ামু। মাতবরদের লাইগ্গা পারি নাই।’

গত ২১ সেপ্টেম্বর বড়বাইত গ্রামের ষষ্ঠ শ্রেণীর এক ছাত্রী ধর্ষণের শিকার হয়। দাড়িয়াকান্দি গ্রামের অভিযুক্ত আলা উদ্দিনের (৪৫) বিরুদ্ধে মামলা হয়নি। মেয়ের মায়ের অভিযোগ, ‘ঘটনাটি মীমাংসার জন্য মাতবরেরা ৩০ হাজার টাকা দিতে চেয়েছেন। শেষে মান-সম্মানের ভয়ে সব মুখ বুজে সহ্য করে নিয়েছি।’ পরের দিন ২২ সেপ্টেম্বর পীরপুর গ্রামে পঞ্চম শ্রেণীর এক ছাত্রী আলফু মিয়া নামে এক মধ্যবয়সীর হিংস্রতার শিকার হয়। শিশুটির বাবা জানান, মাতবরদের নানা চাপ উপক্ষো করে ১১ দিন পর মামলা করেছেন। এখন মীমাংসার তাগিদে ঘরে থাকতে পারছেন না। চলতি বছরের ১১ ফেব্রুয়ারি চারারবন গ্রামের ১২ বছরের এক শিশু গণধর্ষণের শিকার হয়। এ ঘটনায় তাঁতারকান্দি গ্রামের সাইফুল ইসলাম (২১) ও ওবায়দুল্লাহর (২০) বিরুদ্ধে মামলা হলেও বিরোধ মিটিয়ে ফেলতে মাতবরেরা এখন সক্রিয়।

উপজেলার রামদি গ্রামের মাতবর সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘সত্যি কথা বলতে কি, কুলিয়ারচরে ধর্ষণের ঘটনাগুলো মাতবরদের হাতে বন্দী হয়ে আছে।’

জাতীয় মহিলা সংস্থা ভৈরব শাখার সভানেত্রী উলফত আরা জাহান বলেন, ‘মাতবরেরা শক্তিশালী হয়ে উঠছে। তাদের বিরুদ্ধে গিয়ে মামলা করেও সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। বড় সমস্যা হচ্ছে ভুক্তভোগীরা আইনের প্রতিও আস্থা রাখতে পারছেন না। আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবেই—এমন বিশ্বাস তৈরি হলে মাতবরেরা দুর্বল হতে বাধ্য।’

লিখেছেনঃ সুমন মোল্লা, কুলিয়ারচর