৭ জানুয়ারি। হেমেন্দ্রনাথের জন্মদিন। তার ১১৫তম জন্মদিনে জানাই সশ্রদ্ধ সম্মান ও ভালোবাসা। ভারতীয় চিত্রশিল্পী তথা বর্তমান বাংলাদেশের আধুনিক চিত্রশিল্পের সঙ্গে যে জেলা শহরটির নাম ওতপ্রোতভাবে জড়িত; তা ময়মনসিংহ শহর।
মৈমনসিংহ গীতিকা; দেওয়ানা মদিনার দেশ; বীরাঙ্গনা সখিনার দেশ ময়মনসিংহ। এই ময়মনসিংহ জেলার কিশোরগঞ্জেজেলার সাচহাটা গ্রামে ১৮৯৪ সালে চিত্রশিল্প হেমেন্দ্রনাথ মজুমদারের জন্ম। তার বাবা দুর্গানাথ মজুমদার ময়মনসিংহের আঠারবাড়ি এস্টেটে চাকরি করতেন। ময়মনসিংহের সিটি কলেজিয়েট স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন ক্লাসের ছাত্র হেমেন্দ্রনাথ কাউকে না বলে বাড়ি থেকে পালিয়ে যান কলকাতায় এবং সরকারি আর্ট স্কুলে ভর্তি হন। ছোটবেলা থেকেই তাকে ছবি আঁকার নেশা পেয়ে বসে। কিন্তু তখনকার দিনে মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে লেখাপড়া না করে গান গাইবে বা ছবি আঁকবে এ কথা কোনো বাবা-মা ভাবতে পারেন না। হেমেন্দ্রনাথের বেলায়ও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। কাজেই শিল্প সৃষ্টির তাড়নায় গৃহত্যাগ।
গভর্নমেন্ট আর্ট স্কুলে হেমেন্দ্রনাথ ভর্তি হলেন বটে; কিন্তু বাধা রুটিনে শিল্পচর্চায় তার মন ভরেনি। তাই তিনি স্কুল ছাড়লেন। সরকারি আর্ট স্কুল ছেড়ে হেমেন্দ্রনাথ অধুনালুপ্ত জুবিলী আর্ট স্কুলে ভর্তি হন এবং তিন বছর ছবি আঁকার চর্চা করেন।
হেমেন্দ্রনাথ ১৯২১ সালে বোম্বে আর্ট এক্সিবিশনে কয়েকখানি ছবি পাঠান এবং ‘স্মৃতি’ ছবিখানির জন্য প্রথম পুরস্কার স্বর্ণপদক লাভ করেন। ওই বছরই কলকাতার সোসাইটি অফ ফাইন আর্টসের প্রথম প্রদর্শনীতে তার পল্লী প্রাণ ছবিটি পুরস্কৃত হয়। ১৯২২ সালে মাদ্রাজ প্রদর্শনীতে ‘বর্ণঝঙ্কার ও ১৯২৩ সালে ‘কর্দমে কমল’ দুটি ছবিই পুরস্কৃত হয় এবং ময়মনসিংহের ছেলে হেমেন্দ্রনাথের নাম ছড়িয়ে পড়ে পুরো ভারতবর্ষসহ সারাবিশ্বে।
এ সময়েই নানা বাংলা মাসিক পত্রিকায় তার ছবি প্রকাশিত হতে থাকে এবং কলকাতা, বম্বে, মাদ্রাজ, সিমলা, দিল্লি ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় তার ছবি গৃহীত ও পুরস্কৃত হয়। ছবি আঁকা এবং ছবি সম্পর্কে আলোচনার ক্ষেত্রেও হেমেন্দ্রনাথের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। ১৯১৯ সালে তার তৎকালীন বাসস্থান ২৪ বিডন স্ট্রিটের বাড়িতে ‘ইন্ডিয়ান একাডেমি অফ আর্ট’ নামে একটি চারুকলার প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন।
ভারতীয় শিল্পের জাগরণে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দানের তো তুলনা নেই। কিন্তু অবনীন্দ্রনাথের এতো কাছে থেকেও হেমেন্দ্রনাথ প্রায় অবনীন্দ্র প্রভাবমুক্তই ছিলেন না, রঙের ব্যবহার ও সূক্ষ্ম রেখার বিন্যাস তার নিজস্বতা সৃষ্টিতেও সক্ষম ছিলেন।
হেমেন্দ্রনাথের বিখ্যাত ছবিগুলো হচ্ছে সিক্ত বসনা নারী, প্রেম-মদিরা, পরিত্যক্তা, রবীন্দ্রনাথ ইত্যাদি। তার শেষ জীবনের ছবি হচ্ছে দুই চাষীর তামাক খাওয়া, ফসল কাটা, মাছ ধরা ইত্যাদি। অক্লান্ত পরিশ্রম ও অনিদ্রার ফলে ১৯৪৮ সালের ২২ জুলাই মহান শিল্পী মৃত্যুবরণ করেন।
হেমেন্দ্রনাথ প্রায়ই বলতেন, ‘কলাবিদ্যার পরীক্ষায় চাই অসাধারণ দৃষ্টিশক্তি।’ তাই তিনি দৃষ্টিহীনতার যে চশমা ব্যবহার হয় সেই চশমার জন্যই ছবি আঁকা বিষয়ক বই লিখেন ‘ছবির চশমা’। আজ তিনি নেই, কিন্তু তার সৃষ্টকর্ম আছে। ব্রহ্মপুত্রের ধ্বনি, ময়মনসিংহের প্রকৃতি বারবার মনে করিয়ে দেয় শিল্পী হেমেন্দ্রনাথের কথা। তার জন্মবার্ষিকীতে ময়মনসিংহ চারুকলাসহ অন্যান্য চারুকলাও বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। সার্থক হোক শিল্পী হেমেন্দ্রনাথের জন্মবার্ষিকী।