একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর সমগ্র বাঙ্গালী জাতি যখন বিজয়ের আনন্দে উল্লাস মুখর, ‘জয় বাংলা’ ধ্বনিতে যখন সারা দেশের আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত সেদিনও কিশোরগঞ্জ শহরবাসীরা ছিল পাক হানাদার বাহিনীর দোসর রাজাকার, আলবদর আর আল শামস বাহিনী দ্বারা অবরুদ্ধ। ভয়ে সেদিনও তারা ঘর থেকে বের হতে পারেনি, পারেনি লাল-সবুজের পতাকা আকাশে ওড়াতে। ১৬ ডিসেম্বর সারা দেশবাসী মুক্তির স্বাদ অনুভব করলেও কিশোরগঞ্জ শহরবাসীরা সেদিন বিজয় দেখেনি। সেদিনও তাদের প্রতিটি প্রহর কেটেছে মৃত্যুভয় আর আতঙ্কে। মুক্তির আনন্দ তাদের বুকে চেপে রাখতে হয়েছিল সেদিনও।
পাকবাহিনী কিশোরগঞ্জ শহরে প্রবেশ করেছিল একাত্তরের ১৯ এপ্রিল, আর শহর ছেড়ে চলে যায় ৪ ডিসেম্বর। এই আট মাসে তারা চালিয়েছিল ধ্বংসযজ্ঞ, হত্যা করেছিল বহু নিরীহ মানুষ। পাক বাহিনীর সহযোগিতা করে স্থানীয় রাজাকার, আল বদর ও আল শামস বাহিনীর সদস্যরা। পাকবাহিনী চলে গেলেও শহরের জামিয়া বিল্ডিংকে প্রধান ঘাঁটি করে কয়েকশ’ সশস্ত্র স্বাধীনতা বিরোধী কিশোরগঞ্জ শহরকে নিয়ন্ত্রণে রেখেছিল। তবে মুক্তিবাহিনীও কিশোরগঞ্জ শহরকে চারিদিক থেকে ঘিরে রাখে। কিন্তু নিরীহ মানুষের প্রাণহানি এড়াতে মুক্তিযোদ্ধারা সেদিন শত্রুর ওপর আক্রমণ চালায়নি।
অবশেষে অবস্থা বেগতিক দেখে ১৬ ডিসেম্বর গভীর রাতে রাজাকার, আলবদরসহ সকল স্বাধীনতা বিরোধীরা মাইকে আত্মসমর্পণ ও অস্ত্র জমা দেয়ার ঘোষণা হয়। ১৭ ডিসেম্বর শুক্রবার সকাল সাতটায় কবিরউদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর প্রথম দলটি কিশোরগঞ্জ শহরে প্রবেশ করে। এরপর মুক্তিবাহিনীর অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দল বিভিন্ন দিক থেকে শহরে প্রবেশ করতে থাকে। সব দলের নেতৃত্বে ছিলেন মাহবুবুল আলম, আবদুল বারী খান, নাজিমউদ্দিন কবীর, ক্যাপ্টেন হামিদ, নূরুল ইসলাম খান পাঠান বীরপ্রতীক, হান্নান মোল্লা, অধ্যাপক আবদুল গণি, সাব্বির আহমদ মানিক, আক্কাস আল মাঝি প্রমুখ। একাত্তরের ১৭ ডিসেম্বর সবুজ জমিনে লাল সূর্য খচিত স্বাধীন বাংলার পতাকা কিশোরগঞ্জ শহরের ঘরে ঘরে উত্তোলিত হয়।