[প্রথম পর্ব] এই বন্দীত্বের খানিকটা বিবরণ মেলে মেজর জেনারেল খলিলুর রহমানের লেখা ‘পূর্বাপর ১৯৭১ : পাকিস্তানী সেনা-গহবর থেকে দেখা’ বইটিতে (কৃতজ্ঞতা : আদিল মাহমুদ)। খলিলুর রহমান তখন ব্রিগেডিয়ার ছিলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর আর সব বাঙালী সামরিক কর্মকর্তাদের মতো প্রাথমিকভাবে গৃহবন্দী থাকতে হয় তাকে। তারপর কোহাট, নওশেরা ও মন্ডি বাহাউদ্দিন বন্দীশিবিরে পরিবার পরিজনসহ তিনটি অসহ্য বছর। লেখনীতে সামরিক বাহিনীর বাঙালী সদস্যদের ওপর পাকিস্তান সরকারের রোষের এবং সেই প্রতিশোধস্পৃহায় তাদের ভোগান্তির বর্ণনা সাধ্যমতো তুলে ধরেছেন তিনি। তবে বেসামরিক বাঙালীদের হদিস তার জানা ছিলো না, স্মৃতিকথায় তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য ঘটনাও পাওয়া যায়নি। আন্তর্জাতিক রেডক্রসের দাপ্তরিক প্রতিবেদন ঘেটে জানা যায়, পাকিস্তানে আটকে পড়া বাঙালী সৈনিক, ব্যবসায়ী ও সরকারী কর্মচারীদের সংখ্যা ছিলো ৪৬ হাজারের মতো। (খলিলুর রহমান বাঙালী অফিসারের সংখ্যা ১ হাজার ১০০ জন ও সৈনিক ৩০ হাজার বলে দাবি করেছেন তার বইয়ে।) আর সাধারণ বাঙালীদের সংখ্যা প্রায় চার লাখ। অবশ্য এদের সবাই বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করেননি। পাকিস্তানী হয়েই রয়ে গেছেন সেদেশে। 

 

Gen. Khalil memoir

পাক-ভারত সমঝোতা ও সিমলা চুক্তি

’৭১ এর ১৭ ডিসেম্বর পশ্চিম রণাঙ্গনেও যুদ্ধবিরতি কার্যকর করে পাকিস্তান ও ভারত। ২০ ডিসেম্বর ইয়াহিয়াকে হটিয়ে ক্ষমতায় আসেন জুলফিকার আলী ভুট্টো। এরপর থেকেই জাতিসংঘ ও প্রধান পৃষ্ঠপোষক যুক্তরাষ্ট্রের মাধ্যমে ভারতের ওপর বন্দী বিনিময়ের জন্য চাপ সৃষ্টি শুরু করে পাকিস্তান। আর এই আলোচনাকে দ্বিপাক্ষিক হতে হবে বলে শর্ত জুড়ে দেয়। অর্থাৎ স্বাধীন বাংলাদেশকে অগ্রাহ্য করা। ভাবতে অবাক লাগে যে পাকিস্তানীদের ভাবখানা ছিলো যে হারলে জাতশত্রু হিন্দুস্থানীদের কাছে হেরেছি, কলেমা জানা বাঙালীদের কাছে নয়! এই ভাব তারা সেই শর্তকে যুক্তিগ্রাহ্য করতে ব্যবহারও করেছিলো। পূর্ব ও পশ্চিম উভয় রণাঙ্গনে তারা ভুখন্ড হারিয়েছে ভারতের কাছে, সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণও করেছে ভারতের কাছে। তাই তাদের আলোচনা হবে ভারতের সঙ্গেই। অন্যদিকে নয়াদিল্লী এতে সংশোধনী দেয় এই বলে যে পূর্ব রণাঙ্গনে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ভারত ও বাংলাদেশের যৌথ কমান্ডের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। তাই ওই রণাঙ্গনের যুদ্ধবন্দী বিষয়ক আলোচনায় বাংলাদেশের উপস্থিত থাকাটা নায্য এবং বাধ্যতামূলক।

এখানে এই তথ্যটি মাথায় গেঁথে রাখলে পাঠকের জন্য সুবিধা হবে যে, বাংলাদেশ সরকার আটকে পড়া বাঙালীদের বিনিময়ের জন্য এদেশে আটকে পড়া বিহারী ও অবাঙালীদেরকেই আলোচনায় অগ্রাধিকার দিচ্ছিলো বরাবরই। রেডক্রসের সেই প্রতিবেদনে অবাঙালী পাকিস্তানীদের সংখ্যাটা ছিলো আনুমানিক ১২ থেকে ১৫ হাজার এবং বিহারী ১২ লাখ। বাংলাদেশ বিরোধী আন্তর্জাতিক প্রপোগান্ডায় বিহারী ইস্যুকে পাকিস্তান যতটা আগ্রহের সঙ্গে ব্যবহার করছিলো কার্যত তাদের ফিরিয়ে নেওয়ার প্রশ্নে তা ছিলো একদমই বিপরীত মেরুতে। বস্তুতঃ ’৪৭ সালের দেশভাগের সময়ও বিহারীদের পশ্চিম পাকিস্তানে পূনর্বাসিত করতে নারাজ ছিলো তারা। খলিলুর রহমান তার বইয়ে এই প্রসঙ্গে বেশ চমকপ্রদ পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন। এক বিহারী নৌবাহিনী অফিসারের সঙ্গে কথোপকথনে বলেছেন : পশ্চিম পাকিস্তান পশ্চিম হিন্দুস্থানের কিছু অংশের লোককে বাস্তুহারা হিসেবে গ্রহণ করেছে। কিন্তু দক্ষিণ ভারত ও পূর্ব ভারতীয় মুসলমানদের পশ্চিম পাকিস্তানে ঢুকতে দেয়নি দেশভাগের পরও। ভবিষ্যতেও ঢুকতে দেবে না বলে আমার বিশ্বাস।

ভারত মূলত বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে সমঝোতার লক্ষ্য নিয়েই এই ইস্যুতে অগ্রগামী ভূমিকা নিতে চেয়েছিলো। এ কারণেই এই সমঝোতায় বেসামরিক নাগরিক বিনিময়ের পাশাপাশি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়াটাও প্রাধান্য দিচ্ছিলো ভারত। মার্চে ঢাকায় মুজিব-ইন্দিরা বৈঠকেই ভারত জানিয়ে দেয় পাকিস্তানের সঙ্গে বৈঠকে বাংলাদেশের স্বার্থ অক্ষুন্ন রাখার ব্যাপারে অটল থাকবে তারা । ’৭২ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি জাতিসংঘ মহাসচিব বরাবর একটি চিঠি পাঠায় ইন্দিরা সরকার। এতে যে কোনো সময় যে কোনো জায়গায় পাকিস্তানের সঙ্গে আলোচনায় বিনা শর্তে ভারত রাজী বলে জানানো হয়। চিঠিটির একটি অনুলিপি সুইজারল্যান্ড সরকারের মাধ্যমে পাকিস্তানকেও দেওয়া হয়। পাকিস্তান এটি অগ্রাহ্য করে, বরং ভুট্টো তার প্রকাশ্য বক্তৃতায় বারবার ইন্দিরার সঙ্গে বৈঠকের আগ্রহই তুলে ধরতে থাকেন বারবার।

এই পর্যায়ে এসে ভারত প্রতিনিধি পর্যায়ে একটি দ্বিপাক্ষিক বৈঠকের প্রস্তাব দেয়। এরই ধারাবাহিকতায় ইন্দিরার বিশেষ দুত হিসেবে পাকিস্তানে যান ডি.পি ধর। ২৫ থেকে ২৯ এপ্রিল মারি এবং রাওয়ালপিন্ডিতে ভু্ট্টোর বিশেষ দুত আজিজ আহমদের সঙ্গে বৈঠক হয় তার। ধর ভুট্টোর সঙ্গেও দেখা করেন। সেই আলোচনায়ও একটা অচলাবস্থা সৃষ্টি করে পাকিস্তানের একগুয়েমী। তারা সকল যুদ্ধবন্দীকে ফিরিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি যুদ্ধপরবর্তী সীমানায় দুদেশের সেনাবাহিনীকে অবস্থানের ওপর জোর দেয়। ভারত গুরুত্ব দেয় দীর্ঘ ২৫ বছর ধরে চলা সংঘাতের মৌলিক সমস্যাগুলো সমাধানের যার মধ্যে কাশ্মীর অন্যতম। ভুট্টোর আংশিক নমনীয়তায় অবশেষে একটা ঐক্যমতে পৌছে দুদেশ। ২৯ এপ্রিল প্রাক-বৈঠক এক সমঝোতায় সাক্ষর করে তারা। ফলশ্রুতিতে সিমলায় দুই রাষ্ট্রপ্রধানের মধ্যে বৈঠকের স্থান ঠিক হয়। সেইসঙ্গে প্রস্তাবিত তারিখ ঠিক হয় মে মাসের শেষ অথবা জুনের প্রথম সপ্তাহ।

কিন্তু সমঝোতার এক মাসের মাথায় এসে ভুট্টো হঠাৎ ঘোষণা দেন ১৩ দিনের এক রাষ্ট্রীয় সফরের। গন্তব্য মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার কিছু দেশ। উদ্দেশ্য হিসাবে বলেন যুদ্ধের সময় পাকিস্তানের প্রতি তাদের সমর্থনের জন্য ধন্যবাদ জানাতেই এই সফরে বের হচ্ছেন তিনি। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় যুদ্ধবন্দীদের প্রত্যাবর্তনসহ পাকিস্তানের আগের দাবিগুলোয় সমর্থন আদায় এবং ভারতকে তা মেনে নেওয়ার জন্য চাপসৃষ্টি করতেই তার প্লেনে ওঠা। সঙ্গত কারণেই এ সময়টায় স্থগিত করে দেওয়া হয় সিমলা বৈঠকটি। অবশেষে ২৮ জুন থেকে ৩ জুলায় উত্তর ভারতের ওই শৈলশহরে দেখা যায় ভুট্টোকে। এ সময় সচিব ও মন্ত্রী পর্যায়ের অনেকগুলো বৈঠক হয়, ইন্দিরা-ভু্ট্টো আলোচনায় বসেন চার দফা। এর মধ্যে ডি. পি ধর দ্বিতীয় দিনেই অসুস্থ হয়ে পড়ায় তার জায়গা নেন পি এন হাকসার। সিমলাতেও পাকিস্তানীরা আগের দাবিনামা ফিরিয়ে এনে অটল থাকে। আর এতে তাদের প্রধান দাবী হয় যত শিগগির সম্ভব আটক যুদ্ধবন্দীদের ফেরত দেওয়ার।

আবারও ভারত আগের যুক্তি দেখায়। বাংলাদেশের অনুপস্থিতিতে যুদ্ধবন্দী বিনিময়ের ব্যাপারে আলোচনায় তারা অক্ষমতা জানায়। ব্যাপারটা পাকিস্তানীদের যুক্তিগ্রাহ্য করানোর জন্য আত্মসমর্পনের দলিলের শুরুর কথাগুলো উপস্থাপন করতে হয় ভারতকে- নিয়াজী বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথকমান্ডের কাছে আত্মসমর্পন করেছেন। পাকিস্তান তবুও দাবি করে যেহেতু যুদ্ধ শেষ, জেনেভা কনভেনশন মেনে এখন বন্দী বিনিময় হতেই পারে। ভারত পাল্টা জানায়, স্রেফ যুদ্ধ শেষ (সিজেশন অব হোস্টিলিটিস) হওয়াটাই বন্দী বিনিময়ের আদর্শ পরিস্থিতি নয়। এজন্য প্রয়োজন যু্দ্ধ আর না বাধার (টার্মিনেশন অব হোস্টিলিটিস) এবং দীর্ঘমেয়াদী শান্তির পরিবেশ সৃষ্টি করা। আর সেজন্য আগে কাশ্মীরের মতো মূল সমস্যাগুলোর সমাধান প্রয়োজন। আর এই পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে তৃতীয় কোনো শক্তির মধ্যস্থতা ছাড়াই, নিজেদের মধ্যে আপোষমূলক সমঝোতায়।

আলোচনার এক পর্যায়ে অবশেষে চুক্তির একটি করে খসড়া তৈরীতে রাজী হয় দুপক্ষ। বলাবাহুল্য দুপক্ষই পরষ্পরের স্বার্থ বিরোধী ও মূল এজেন্ডার বিরুদ্ধে যায় বলে একে অন্যের খসড়া বাতিল করে তাতে সংশোধনী আনতে জোর দেয়। চমকপ্রদ ব্যাপার হচ্ছে মোট ৭টি সংশোধিত খসড়া নিয়ে আলোচনা চলে বৈঠকে যার মধ্যে চারটি পাকিস্তানীরা উপস্থাপন করে। নানা মতদ্বৈততাকে অতিক্রম করে অবশেষে ১২ জুলাই ইন্দিরা ও ভুট্টো একটি সমঝোতা চুক্তিতে সই করেন যার নাম হয়ে যায় ‘সিমলা চু্ক্তি।’ মূলত দু ধরণের ইস্যুকে প্রাধান্য দেওয়া হয় এই চুক্তিতে। প্রথমটি ১৯৭১ সালের যুদ্ধের উপজাত সমস্যা এবং অন্যটি হচ্ছে দু’দেশের মধ্যে দীর্ঘদিনের সংঘাতের মৌলিক কারণগুলো। মোট ছয়টি অনুচ্ছেদ নিয়ে এই চুক্তিটি গঠিত হয়েছে যার তিনটি দুই দেশের সম্পর্ক উন্নয়নে আবশ্যকীয় শর্তাবলী, দুটি ১৯৭১ সালের যুদ্ধপরবর্তী সমস্যা এবং একটি এই চুক্তি কার্যকর রাখার নির্দেশাবলী নিয়ে।

 

Sim La Agreement

 পাঠকের সুবিধার জন্য অল্প কথায় তুলে ধরা যেতে পারে অনুচ্ছেদগুলোর বক্তব্য। প্রথম অনুচ্ছেদে দুদেশ বৈরিতা শেষ করে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলার পাশাপাশি উপমহাদেশে শান্তি বজায় রাখার ব্যাপারে একমত হয়েছে। সে লক্ষ্য অর্জনে দুদেশই জাতিসংঘের সংবিধান মেনে সংঘর্ষের বদল দ্বিপাক্ষিক সমঝোতার মাধ্যমে যে কোনো সমস্যার সমাধানে আন্তরিক থাকবে। পরস্পরের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমতাকে সম্মাণ জানিয়ে কেউ কারো আভ্যন্তরীন সমস্যায় নাক গলাবে না এবং শক্তি ব্যবহার করবে না। দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে পরষ্পরবিরোধী অপপ্রচার ও বিরোধিতামূলক তথ্য ও তত্ত্ব সম্প্রচার থেকে বিরত থাকার ব্যাপারে ঐকমত্য হয়। তৃতীয় অনুচ্ছেদে পরষ্পরের সম্পর্ক স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে ধাপে ধাপে এগুনোর কথা বলা হয়েছে। আর এজন্য বিভিন্ন খাতে পারষ্পরিক সহযোগিতার হাত বাড়াতে একমত হয়েছে দুদেশ। খাতগুলোর মধ্যে রয়েছে যোগাযোগ, পর্যটন, অর্থনৈতিক-বৈজ্ঞানিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নে সহযোগ।

চতুর্থ অনুচ্ছেদে ১৯৭১ সালের যুদ্ধপরবর্তী সমস্যা নিয়ে সমঝোতা হয়। সুবাদে দুই দেশই দখলকৃত ভুখন্ড থেকে নিজেদের সেনাবাহিনী সরিয়ে নিয়ে আসতে রাজী হয় আন্তর্জাতিক সীমানা বরাবর। এখানে পশ্চিম রণাঙ্গন ও জম্মু ও কাশ্মীরের সীমারেখার কথা বলা হয়েছে। বাংলাদেশ নয়। কারণ বাংলাদেশ ভারত দখল করেনি, স্বাধীনতায় সাহায্য করেছে মাত্র। পঞ্চম অনুচ্ছেদে চুক্তি কার্যকর রাখার নিয়মাবলী বা শর্তাদির ব্যাপারে জোর দেওয়া হয়। শেষ অনুচ্ছেদে দীর্ঘমেয়াদী শান্তি বজায়ের জন্য দুই দেশের প্রতিনিধিদের মধ্যে পর্যায়ক্রমিক আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার কথা বলা হয়েছে। এসব আলোচনার মূল অনুষঙ্গ হবে সম্পর্কো্ন্নয়ন, সামরিক ও বেসমারিক যুদ্ধবন্দী বিনিময়, কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনঃস্থাপন এবং জম্মু-কাশ্মীরের ব্যাপারে চূড়ান্ত সমঝোতা। স্বাধীনতা বিরোধী পক্ষ বরাবরই সিমলা চুক্তির ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে আসছে, আশা করছি এটুকু পড়ার পর পাঠকরা সেই বিভ্রান্তি কাটিয়ে উঠবেন। বরং সিমলা চুক্তির মাধ্যমেই আটকেপড়া বাঙালী-বিহারী ও পাকিস্তানীদের বিনিময়ে একটা পক্ষ হিসেবে বাংলাদেশের আলোচনায় অধিকার প্রতিষ্ঠা হয়, পরোক্ষভাবে হলেও বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে মেনে নেওয়ার তিক্ত স্বাদটি পেতে হয় পাকিস্তানকে।

ভুট্টোর নতুন চাল : চীনা ভেটো

ছলে-বলে-কৌশলে যেভাবেই হোক পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধীদের ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে ভুট্টোর একাগ্রতার একটা রাজনৈতিক ব্যাখ্যাও আছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা এক অর্থে তার উপকারেই এসেছিলো। দীর্ঘ সেনাশাসন থেকে মুক্ত হযে বেসামরিক নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা পেয়েছিলো পাকিস্তানে। এটি সংহত করতেই শুধু নয়, পূর্ব পাকিস্তান বিপর্যয়ে তার সংশ্লেষ মুছে ফেলে বীরের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার জন্য এটি ভুট্টোর জন্য জরুরী ছিলো। পাবলিক সেন্টিমেন্ট পক্ষে টানতে তাই শুরু থেকেই এটিকে তার প্রধান এজেন্ডা হিসেবে তুলে ধরেন ভুট্টো। অবমুক্ত মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির গোপন দলিল পর্যালোচনায় দেখা যায় এই বিনিময়ে শেখ মুজিবকেই প্রধান পণবন্দী হিসেবে ব্যবহার করার ইচ্ছে ছিলো তার। কিন্তু সেটা ব্যর্থ হয়। মুজিব এবং ইয়াহিয়া দুজনের ওপরই কোনো ধরণের ব্যবস্থা নেওয়ার ব্যাপারে মার্কিন চোখরাঙা্নীতে সংযত হতে বাধ্য হন ভুট্টো। মুজিবকে ফিরিয়ে দেওয়ায় ভূমিকা রাখার মাধ্যমে উপমহাদেশে খোয়ানো ভাবমূর্তি উদ্ধারে ব্রতী ছিলো যুক্তরাষ্ট্র। আর দীর্ঘ মিত্র ইয়াহিয়ার গায়ে আচড় পড়াটা মেনে নিতে রাজী ছিলেন না প্রেসিডেন্ট নিক্সন- এক বার্তায় স্পষ্টই এই হুমকিটা দেওয়া হয়েছে ভুট্টোকে। তবে এটাকে নিজের পক্ষে কাজে লাগানোর উপায়টা ঠিকই বের করে রেখেছিলেন তিনি। যুদ্ধবন্দীদের ফিরিয়ে আনার কাজে মার্কিন সহযোগিতার আশ্বাসটি আদায় করে নেওয়ার পাশাপাশি জাতিসংঘে প্রধান মিত্র চীনকে ব্যবহার করার কাজটি সূচারুরূপেই সারেন ভুট্টো।

১৯৭২ সালের ১০ আগস্ট এক সংবাদ সম্মেলনে শুরু হয় ভুট্টোর কূটচালের নতুন পর্যায়। সেখানে ভুট্টো বলেন : ‌বাংলাদেশ মনে করে আমাদের যুদ্ধবন্দীদের ফিরিয়ে দেওয়ার ওপর ভেটো দেওয়ার ক্ষমতা তাদের আছে, এই ভেটো ক্ষমতা কিন্তু আমরাও রাখি।’ পরে এই বক্তব্যের ব্যাখ্যায় বলেন জাতিসংঘের সদস্যপদ পাওয়ার জন্য বাংলাদেশের আবেদনে ভেটো দিতে চীনকে তিনি অনুরোধ করেছেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের জন্য জাতিসংঘের সদস্য হ্ওয়াটা কতখানি জরুরি ছিলো ভুট্টো তা বুঝেছিলেন বলেই চেলেছিলেন চালটা। আর সেটা যে মিথ্যে হুমকি ছিলো না তার প্রমাণ দেয় চীন ২৫ আগস্ট তাদের প্রথম ভেটোটি প্রয়োগ করে। বাংলাদেশের অপরাধ তারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে চায়। বলা চলে পরাক্রম দুই পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মনোভাব অত্যন্ত অসহায় অবস্থায় ফেলে দিয়েছিলো বাংলাদেশ সরকারকে যার প্রমাণ মিলেছে পরের দু’বছরে। (চলবে) [প্রথম পর্ব]

লিখেছেন : অমি রহমান পিয়াল