আকাশে পেঁজা পেঁজা সাদা মেঘের ভেলা। শাপলা-শিউলি-কাশফুলে শুচিশুভ্র প্রকৃতি। জগৎ আনন্দময় করে তুলতে দুর্গতিনাশিনী আনন্দময়ীর মর্তে আগমন। ঢাকের বোলে সর্বভূতে শক্তিরূপে সংস্থিতা দেবীর আগমনীবার্তা। শুরু হয়ে গেছে শারদীয় দুর্গোৎসব।দেবী দুর্গার পূজায় অনেক উপচারের মধ্যে অন্যতম হলো ‘অশোক তরু’। অশোক হিন্দু ও বৌদ্ধ উভয়ের কাছেই অত্যন্ত পবিত্র বৃক্ষ। ভগবান বুদ্ধের জন্ম অশোকতলে। আবার হিন্দুদের বহু পৌরাণিক ঘটনার সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য হয়ে আছে অশোক।
পূজা-অর্চনায়, বিশেষ করে শারদীয় দুর্গাপূজায় এর প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। অশোকের ডাল ছাড়া দুর্গাপূজার নবপত্রিকাকে পূর্ণাঙ্গ রূপ দেওয়া যায় না। ষষ্ঠীতে বোধনের সময় বেলগাছের নিচে রাখা ‘নবপত্রিকা’কে অধিবাস করানো হয়। ‘নবপত্রিকা’ হলো অশোকগাছ, ধানগাছ, কলাগাছ, হলুদগাছ, বেলগাছ, জয়ন্তীগাছ, মানকচুগাছ, ডালিমগাছ ও অপরাজিতা গাছের (এই নয়টি) ডাল দিয়ে তৈরি। এই নয়টি বিভিন্ন গাছ নয়টি দেবীর শক্তি বহন করে। এই নয় দেবীর শক্তি নিয়ে নবপত্রিকাবাসিনী ‘দেবীদুর্গা’। অশোকগাছ শোকরহিতা দেবীর শক্তি বহন করে। নবপত্রিকার শক্তিকে এভাবে বর্ণনা করা হয়—
কদলী ব্রহ্মাণী কচুগাছে কালিকা
হরিদ্রে পত্রিকিয়ে দুর্গা জয়ন্তী বৃক্ষে জয়ন্তিকা
বিল্ব বৃক্ষে শিবাণীদেবী ডালিমে রক্তদন্তিকা
অশোক গাছে শোকহারিণী মান্যবৃক্ষে চামুন্ডা
ধান্যে মহালক্ষ্মীদেবী নবদুর্গা পরিবৃতা
অষ্টশক্তি সহিত দেবী নবদুর্গা জগন্মাতা
এরপর দুর্গাপূজার সপ্তমীতে বোধনের বেলগাছের ডাল ছেদন করে অর্ধেকটা ডাল নবপত্রিকায় স্থাপন করে, নবপত্রিকাকে মন্দিরের দ্বারে রেখে বিশেষ স্নান করিয়ে প্রার্থনা করা হয় এই ভেবে যে, ‘মা দুর্গা এই নবপত্রিকার সঙ্গে মন্দিরে প্রবেশ করবেন।’ এভাবে নবপত্রিকাকে গণেশ মূর্তির ডানে স্থাপন করা হয়। একই সঙ্গে বোধনের বাকি অর্ধেক বেলগাছের শাখা ঘটে স্থাপন করা হয়। দশমী পর্যন্ত সেই ঘটে পঞ্চপল্লব থাকে। পঞ্চপল্লব হলো—আম, অশোক, বট, অশ্বত্থ ও যজ্ঞডুমুরগাছ; এই পাঁচটি গাছের শাখা।
দুর্গামণ্ডপে নবপত্রিকাকে শাড়ি দিয়ে আবৃত করে মাতৃরূপে পূজা করা হয় গণেশ মূর্তির ডান পাশে রেখে।অশোক একটি চিরহরিৎ মাঝারি আকৃতির বৃক্ষ। উচ্চতা গড়পড়তা ৩০ ফুট। বিস্তৃত ডালপালা ঘনপল্লবময়। গাছের কাণ্ড মুকুটাকৃতি। বাকল মসৃণ ঘনবাদামি ও ধূসর বাদামি রঙের। পাতা ঘনসবুজ, চকচকে। এক ফুট লম্বা পাতায় ১০টি করে পত্রফলক থাকে, প্রতিটি ফুলে চারটি বৃতি থাকে, পুংকেশর ও গর্ভকেশরগুলো লম্বাকৃতির। ফুলের রং কমলা থেকে লাল। মঞ্জরি যত পূর্ণাঙ্গ হবে, ফুলের রং তত লাল হবে। ফুলের বৈজ্ঞানিক নাম Saraca indica. ফুল ফোটা শুরু হয় ফাল্গুনে এবং প্রায় আষাঢ়ের শুরু পর্যন্ত ফুল গাছে ধরে থাকে। প্রতি মঞ্জরি প্রস্ফুটিত হওয়ার পর প্রায় দুই সপ্তাহ সজীব থাকে। ফল শিমজাতীয় মাংসল ও লাল। পাকলে অনেকটা তেঁতুলের মতো। একটি ফলে বেশ কিছু বীজ থাকে। বীজের রং খয়েরি।
কাব্যে-সাহিত্যে অশোকবন্দনা বিস্তর। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন—‘আসত তারা কুঞ্জবনে চৈত্র জ্যোৎস্নারাতে/ অশোক শাখা উঠত ফুটে প্রিয়ার পদাঘাতে’, ‘রক্ত রঙের জাগল প্রলাপ অশোকগাছে’ এমন অনেক পঙিক্তমালা। রামায়ণ-এ আছে, রাবণ সীতাকে হরণ করে রেখেছিলেন অশোকগাছের তলে। কথিত আছে, গৌরী অশোকগাছের তলায় তপস্যা করে শিবের পুণ্যমনোরথ হয়েছিলেন। শোক নাশ করে বলেই এর নাম অশোক। চৈত্র মাসের শুক্লাষষ্ঠীতে পুত্রবতী মায়েরা পুত্রের কল্যাণ কামনা করে অশোক ফুল দিয়ে পূজা করেন, একে অশোকষষ্ঠী বলে। পুত্রবিয়োগের শোক থেকে রক্ষা পেতে ছয়টি অশোক ফুল জলে ভিজিয়ে জলপান করেন হিন্দু নারীরা। এ ছাড়া চৈত্রের শুক্লাঅষ্টমীতে পালিত হয় অশোকাষ্টমী। এই তিথিতে ব্রহ্মপুত্রে স্নান ও আটটি অশোক কলি ভোজানো জলপান করলে শোক নাশ হয়।
কাব্যখ্যাতি ছাড়া অশোকের বনৌষধি হিসেবে খ্যাতিও প্রাচীন। শুকনো ফুল রক্ত আমাশয়ে এবং বীজ মূত্রনালির ব্যাধিতে ব্যবহূত হয়। বাগানে শোভাবর্ধক হিসেবে এই গাছ বেশি লাগানো হয়।বীজ সংগ্রহ করা হয় আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে। বীজ সংরক্ষণের সঙ্গে সঙ্গে বপন করতে হয়। বীজ বপনের ৭-১৫ দিনের মধ্যে অঙ্কুরোদ্গম ঘটে। অঙ্কুরোদ্গমের হার শতকরা ৭০ ভাগ। এক বছরে গাছ তিন ফুট পর্যন্ত বাড়তে পারে। বাগানে ফুলের সৌন্দর্য, বনৌষধি, ধর্মীয় কাজে ব্যবহারের জন্য অশোকগাছ লাগানো যেতে পারে।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক
দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ
Very informative. It was really nice to read it. Well written. Thanks. Hope to see more of your writtings on these issues in near future. Peace. Asif Iqbal Khan