আলীগড় গ্র্যাজুয়েট পিতামহ ব্রিটিশ পুলিস কর্মকর্তা, অবসর জিবনে বনে ছিলেন আকজন পাক্কা গৃহস্থ (কৃষক) ; নিজ কোদালে জমি তে মাটি কাটা থেকে শুরু করে ধান শুকানো পর্যন্ত কাজ গুলি উনি করতেন। এগুলু দেখে, করে আমি বড় হয়েছি। ছোট বেলা স্কুল ছুটীতে বাড়ীতে থাকলে অন্য দশজন হাওর বালকের মতো ধান কাটা থেকে শুরু করে (ধান) মাড়া খলাতে রাত্রি যাপন, ধান শুকানো থেকে গোলায় উঠানো পর্যন্ত করেছি। এখনো দেশে গেলে নিজে হাতে বীজ তলা থেকে শুরু করে রোপণ বপন সার সেচ কাটা এবং মাড়াই এর কাজ আমি নিজ হাতে করি।

আমাদের হাওরে গৃহস্থ(কৃষি কাজ) কখনোই কুসুমাস্তৃন ছিলো না। যারা আমাদের এলাকার “হিরালীর” কিংবদন্তি জানেন, তাঁরাই আমাদের প্রতিকুল বৈরী কৃষি কাজের কিছুটা হলেও অনুধাবন করে থাকবেন।
কুড়ি বছর আগে পাকা ফসলের বেশী ক্ষতি হতো শিলা বৃষ্টি এবং ঝড়ো হাওতে। ফি বছরে “অকাল বন্যা” তে খুব বেশী নয়। তবে বৈশ্বয়িক উষ্ণতায় সাগর পৃষ্ঠের উচ্চতা, পোলার ভরটেক্স, এলণিনিও সহকারে আধুনিক সব আবহাওয়া ফিনোম্যানন যে আমাদের হাওরের কৃষি কাজে কালক্রমে বিরুপ প্রক্রিয়া ফেলেনি এটা বলা যাবে না। প্রাকৃতিক দুর্যোগ এর চাইতে মনুষ্য সৃষ্ট দুর্যোগ আমদের হাওর কৃষি জিবীদের দূর্ভোগ দুর্দশার জন্য দায়ী সব’চে বেশী।

যারা আমাদের হাওড় এলাকার ঋতু ভেদে আমাদের প্রাকৃতিক পরিবর্তনের কথা জানেন তারা ভালো করেই জেনে থাকবেন আমাদের ছয় মাস নাও (নৌকা) ছয় মাস পাও (পা) ছয় মাসের কৃষি কাজ,অবারিত সবুজ মাঠ আর ছয় মাস পানি আর পানি। এটাই আমাদের স্বাভাবিক জীবন প্রনালী-এটাতেই হাওড় বাসী অভ্যস্ত। হাওড় যেমন বাংলাদেশের বেশী অর্ধেক ধানের যোগান দিয়ে থাকে তেমনি দিয়ে থাকে সিংহ ভাগ মিঠা পানির মৎস্য সম্পদ।   আরও উল্ল্যেখ্য হাওররে বুক চিড়ে প্রবাহিত প্রধান নদ নদী যেমন মেঘনা, সুরমা, কুশিয়ারা এবং এর শাখা প্রশাখা ধনূ, কালনী, ঘোড়াঊত্রা’কে দেশের “হৃদয় ধমনী” তে আখ্যায়িত করলে মোটেও বাড়িয়ে বলা হবে না। যেমন, এই নদ নদী মাধম্যেই সিলেট থেকে শুরু করে ভৈরব-নারায়গঞ্জ-ঢাকা -খুলনা তে নেয়া হয় লাখ লাখ টন পাথর, কয়লা এবং অন্যান্য পন্য সামগ্রী যা জাতিয় কাঠামো উন্নয়নের প্রধান নিয়ামক এবং সহায়ক।

আমাদের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অদুরদর্শিতার সুযোগে পাশের দেশের নদ নদী “উন্নয়ন” এর জোয়ারে আমাদের হাওর নদ নদী গুলুর হৃদয় ধমনী তে কোলষ্টেরল বা গাদ জমতে শুরু করে সেই আশির দশকের শুরুতেই , নদীগুলু তে কার্গো জাহাজ আটকে যেতে থাকে । নদ নদী দ্রুত হারাতে থাকে নাব্যতা গভীর’তা। তৎকালীন সরকার নদ নদীর “বাইপাস সার্জারী” শুরু করে “নদী বাঁক সোজা করন ” প্রকল্পের মাধ্যমে- দেশে তখন আন্তঃর্জাতিক মানের ড্রেজারে প্রকল্পটি আমাদের হাওরে দুটো ব্যাপারে কিছুটা হলেও সহায়ক হয়, যেমন একটি, নৌ পথে যাতায়াত সময় কমে যাওয়া আরেকটি বাঁক কেটে সোজা করনে জমিতে সেচ প্রকল্পে পানির স্বল্প দুরত্বতা । নদীর বাক সোজা করনঃ অথচ নদী পূনঃর্খনন অবহেলায় মূল সমস্যাটা রয়ে যায় – নদ নদীর দ্রুত পলি ভড়াটে অগভীরতার সৃষ্টি হতে থাকলো। অবশ্যয়ই নিঃসন্দেহে নদ নদী পানি ধারন ক্ষমতা হারিয়েছে অনেকাংশে । আমাদের বিশেষজ্ঞ জনেরা বলে থাকেন- নদীর পাড় উপচিয়ে পানি হাওরে প্রবেশ করে তলিয়ে দিচ্ছে ধানের মাঠ!

কিন্তু মজার ব্যাপারটী হলো, নদীর পাড় ডুবে যাওয়ার আগেই হাওর মাঝে ধানের মাঠ পানিতে সাদা হয়ে যাচ্ছে অর্থাৎ পাড় না ডুবেই পানির অনুপ্রবেশ ঘটছে হাওরে ! লক্ষনীয়, ঢাকা’র মত উচু জায়গাতে যখন বন্যা হয় তখন কিন্তু আমাদের নীচু এলাকার হাওরে বন্যা পরিলক্ষিত হয় না কারন, হাওরে বন্যার প্রভাব শুধুই ঊত্তরে’র পাহাড়ী ঢলের প্রভাবে প্রভাবিত হয়। এজন্যই চৈত- বৈশাখে আমাদের আমাদের কৃষক কুলের দৃষ্টি নিবন্ধিত থাকে ঊত্তরের দিগন্তে। ঊত্তরীয় ঢলের ঘোলা পানি খড় ধারাতে প্রবাহিত হতে থাকে হাওরের নদ নদীতে, পাড় ভাংতে শুরু হয় । সবচে সর্বনাশা কাজ যেটি লক্ষণীয় সেটা হলো, নদী থেকে পাওয়ার পাম্প বা সেচে প্রকল্পের পরিত্যাক্ত ড্রেন দিয়ে হাওরে পানি ঢুকতে শুরু করে, পানির প্রবল তোড়ে ড্রেনের প্রস্থতা বৃদ্ধি পায়। পরের বছরে পাম্প প্রকল্পের লোকজন, আবার নতুন জায়গায় পাম্প বসায় নতুন ড্রেন সৃষ্টি হয়। পানি সেচ কর্ম শেষে ড্রেনগুলু বন্ধের ব্যবস্থা থাকলে হাওড়ে দ্রুত পানি অনুপ্রবেশ বন্ধ হতো বলে আমার ধারনা।

আমাদের হাওড় এলাকায় স্লুইসগেট প্রযুক্তি বেশি দিনের নয়। হাতে গোনা স্লুইস গেট তাও আবার ঊজান ইউনিয়ন ভুক্ত হাওড়েই বেশী দেখা যায়। যুগের পর যুগ অনেক জায়গাতেই স্লুইস গেট নির্মানের কথা থাকলেও কেনো জানি হয়নি।  এখন আসা যাক আমাদের এলাকার সদরের কিছু নামকরা বাধের কথায়, উল্লেখ্যোগ্য হলো -জিওয়েলের বাঁধ, হালালের বাঁধ, শনিয়ার জানের বাঁধ প্রভৃতি। এই বাঁধ গুলু হাওড় রক্ষার্থে সিংহ দূয়ার এর ভুমিকা রাখে। ঢলের পানির চাপে বাঁধ ভেঙ্গে হু হু করে পানি ঢুকতে থাকে আধা কাচা/পাকা ধানের জমিতে ভাসিয়ে নেয়ার উপক্রম ঘটে এবং তলিয়ে দেয় হাজার হাজার হেকটর ধানি জমি। অমোঘ চক্রে , এই গুরুত্ব পূর্ন বাঁধ গুলোর যুগের পর যুগ সমস্যা নিরসনে স্থায়ী কোন ব্যাবস্থা নেয়া হয়নি। সেই বাঁশের ফাঁকে চাঁটাই এর প্রতিরোধ দেয়ালে কিছু মাটি । দূর্যোগপুর্ন রাতে মসজিদের মাইকে ভেসে আসে “কোদাল, ওরা” এর সাহায্যের করুন আর্তি। কত বছর যে নিকশ কালো রাতে বাঁধ ঠেকাতে ছুটেছি ইয়ত্তা নেই।

সর্বশেষ ২০১০ এ অকাল বন্যার দুর্যোগ দেখা দিল। সারা রাত জিওয়েলের বাধে। উত্তরে নিকশ কালো অন্ধকার। দা’ওয়ালা (ধান কাটীয়ে) পাওয়া দুস্কর, স্থানীয় দা ওয়ালা’রা সুযোগে (ইউনিয়ন বদ্ধ) ঊচ্চ পারিশ্রমিকে জোট বেঁধেছে। অপেক্ষাতে “নয়ন ভাগা”, অর্থাৎ গৃহস্তের নয়ন সম্মুখে বুক পানিতে ধান কেটে লুটে পুটে নিয়ে যাওয়া , চোখের জলে কপাল থাপরায় কৃষক । এই ব্যাপারটি বেদনাদায়ক এবং সর্বর্স্বীকৃত বিষয় হলেও আমার ব্যক্তিগত ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম, যারা আমাকে ব্যক্তিগত ভাবে চেনেন তারা জানেন পোকা মাকরের কামড় খেয়ে রাত দুপুরে লোকজন নিয়ে বুক পানিতে নিজে ধান কেটে নিয়ে আসার রেকর্ড আমার আছে।

যাক, এই বাঁধ গুলু হটাত করেই ভেঙ্গে যায় না, কিন্তু মজার বিষয় হলো অকাল বন্যার আলামত দেখা দেয়া মাত্র উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের কিছু সংখ্যক “জন প্রতিনিধি” প্রশাসনে অতি দ্রুত ধর্না দেয়া আরম্ভ করে এবং ফসল রক্ষা নিমিত্তে বাঁধ রক্ষার্থে জরুরি তহবিলের জন্য অযথাই আতঙ্কের সৃষ্টি করে। গরীব কৃষকের যখন বুক ফাটা আহাজারি ঠিক তখনি , পোয়া বারো হয় কিছু স্বার্থান্বেসী মহলের।

ঠিক এমনি অবস্থার অবতারনা হয় ২০১০ এ। এহেন দূর্যোগে এলাকার সুধীমহল এবং কৃষক কুলের নেত্রীবৃন্দ দের নিয়ে জরূরী সভায় বসলেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। “প্রতিনিধি” দল সামনের চেয়ারগুলুতে – শুধু বলছে – “স্যার আর দুইডা(দুই) দিন দেরী করলে আর ঊফায় (উপায়) নাই, পানি যেইভাবে আইতেছে আগামী সাত দিনে বেক্তা (সবই) খায়ালবো (নিয়ে যাবে) তারতারি থুক বরাদ্দ থেইকা দেইন কিছু” নির্বাহী সাহেব আমার দিকে তাকালেন কয়েকবার। আমি বললাম কিভাবে সাতদিনে সব নিয়ে যাবে এটা জানতে পারলেন চেয়ারম্যান সাহেব? উত্তরে চেয়ারম্যান সাহেব পান চিবুতে চিবুতে আমাকে বললেন- বাবাজী তো এম্রিকান মানুষ বন্দের (হাওড়ের) খবর কি কইরা জানবাইন? সাথে সাথে নির্বাহী উনার মুখ থেকে কথা নিয়ে বললেন আপনার বাবাজী যে আপনার চেয়ে বড় কৃষক এইটা কি আপনি জানেন? যাক , চেয়ারম্যান সাহেব ভিন্ন ইউনিয়নের, জানতেন না।

বিশ্বের দীর্ঘতম নদী মাইটী মিসৌরী/মিসিসিপির পারে আমার দীর্ঘদিনের বসবাসে এখানের অকাল বন্যায় “ল্যাভি” ভেঙ্গে গিয়ে কি যে মানবেতর জীবন তৈরি হয় এবং সর্বস্তরের মানুষ কিভাবে বাঁধ রক্ষা করেন এটা কাছ থেকে দেখেছি এবং অংশ গ্রহণ করেছি অনেক বার। নিজ চক্ষে না দেখলে বর্ননা করা দুষ্কর যারা দেখেছেন তারাই ভালো জানবেন। সেই সুবাদে আমার অনেক বন্ধু বান্ধব আছে যারা মার্কিন আবহাওয়া দফতরের আবহাওয়াবিদ, দেশে থাকলে সময়ে অসময়ে আমাকে দেশের কিছু আগাম আবহাওয়া বার্তা দিয়ে থাকে, এমন একজন কে মেসেজ দিয়ে জানতে চাইলাম আমাদের ভাটি এলাকার আগাম দশ দিনের বৃষ্টি পরিমান, ইতিমধ্যে আমি উপজেলা নির্বাহী কর্মকতার মিটিং থাকাকালীন সময়েই ওখান থেকে বসেই চুপিসারে সামনে বসা নির্বাহীর ফোনে এস এম এস দিলাম, আপনি দয়া করে “জনপ্রতি নিধিদের” বলুন সরেজমিন অবস্থা প্রতিবেদনে আপনি কাল থেকে এলাকা সফরে বেরুবেন, তারপর তহবিল সিদ্ধান্ত। নির্বাহী কর্মকর্তার ঘোষণা তে “জনপ্রতি নিধিদের” চেহারা চুপসে গেলো নিমিষেই। পরদিন যথারিতী লোকজন নিয়ে এলাকার “সুবিধা বাঁধ” এবং এলাকা পরিদর্শনে বেরুলাম। নৌকাতে ঊঠা মাত্র আমার মার্কিনী আবহাওয়াবিদ বন্ধুটি জানালো –আমাদের এলাকায় আগামী ২০ দিনের মেঘালয়/আসাম অঞ্চলের ঢল বৃষ্টি বন্ধ থাকবে। খবরটা জেনে নৌকার সবাই হাত তালি তে ফেটে পরলো। আমরা এলাকা এবং বাঁধ গুলু পরিদর্শন করে সবাই কে নিশ্চিত এবং আশ্বস্ত করলাম।

অকাল বন্যা উন্নয়ন পরবর্তী পরিস্থিতি আলোচনা তে স্থানীয়দের নিয়ে নির্বাহী কর্মকর্তার ফলোআপ মিটিং এ আমাকে ডাকলেন, এসময়ে “জনপ্রতিনিধি” দের অনেকেরই দেখা পাওয়া গেলো না। মিটিং এ উনি আমাকে কিছু বলার জন্য বললেন- আমি বলেছিলাম, উন্নত বিশ্বেও অকাল বন্যা হয় কিন্তু সহায় সম্পদ শস্য মাঠ রক্ষায় ওদের আগাম প্রতিরোধ ব্যাবস্থা অনেক ভালো। যেমন বাঁধ গুলুর কাছে ওরা ব্যাগ ভর্তী বালু, পাথর আগাম গুদাম জাত করে রাখে। সারা বছর একটি লোক পানির উচ্চতা মনিটর করে। অবস্থা বেগতিক দেখলে জনগণ কে জানান দেয় , লাইন ধরে হাতাহাতিতে সর্বস্তরের জনগণ দাঁড়িয়ে যায় পূর্বপ্রস্তুতিকৃত বালুর বস্তা ফেলতে থাকে বাঁধে-সুরক্ষিত হয়ে যায় জনজীবন।

যুগের পর যুগ আমাদের ঝুঁকি পুর্ন বাঁধ গুলুর সংস্কার না হওয়া পর্যন্ত আমরা কি পারিনা অন্ততঃ বছরের ছয়মাস ঝুঁকি পূর্ন বাঁধের আওতাধীন কৃষকেরা মিলে বাঁধের প্বার্শে গুদামজাত করতে আগাম, বালু পাথরের বস্তা, পালা করে একেক জন শুধু দেখা শুনা করাবে নদ নদীর মতিগতি। বন্ধ হবে চোখের পানি। থাকবে গৃহস্থ হাসিখুশি।

পানিতে ধানকাটা ছবি সূত্রঃ- আমার জনৈক ফেসবুক বন্ধু (ইটনা)