‘আমরা খাই গাঁজা ওরা ফেনসিডিল’ ‘ফেনসিডিল কিনে খাওয়ার টাকা নেই। তাই আমরা গাঁজা খাই। আর মোটরসাইকেলে চড়ে ওরা প্রতিদিন ফেনসিডিল খেতে আসে।’ কিশোরগঞ্জের বাজিতপুরের উত্তর সরারচর গ্রামের কয়েকজন মাদকসেবী এলাকার মাদক পরিস্থিতি বর্ণনা করতে গিয়ে এ কথা বলেন। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন ছাত্র ও ব্যবসায়ী। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তাঁরা জানান, এলাকার ৭০ থেকে ৮০ ভাগ যুবকই মাদক সেবন করে। মাদক ব্যবসা বন্ধের আবেদন জানিয়ে তাঁরা বলেন, ইচ্ছে হলেই ফেনসিডিল, হেরোইন, গাঁজা বা চোলাই মদ খাওয়া যায়। তাই তাঁরা দিনে দিনে মাদকে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন। উত্তর সরারচরের ইউপি সদস্য মো. ইকবাল জানান, চাইলেই সব ধরনের মাদক পাওয়া যায়। যখন খুশি যে কেউ কিনে খেতে পারে। এলাকার অধিকাংশ মাদকসেবী গরিব। তাই এরা চড়া দামের ফেনসিডিল খেতে না পেরে কম দামে গাঁজা কিনে খায়। আর ফেনসিডিল খেতে আসে অন্য এলাকার যুবকরা। প্রসঙ্গত, ইকবালের বড় ভাই মঞ্জু মিয়া এলাকার সবচেয়ে বড় মাদক ব্যবসায়ী। মাদক ব্যবসায় ভাইয়ের জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে ইকবাল বলেন, মঞ্জুকে পুলিশ কয়েকবার আটক করে কোর্টে চালান দিয়েছিল। কিছুদিন ধরে মঞ্জু এ ব্যবসা থেকে বিরত আছে। ইউনিয়নের উত্তর সরারচরে প্রায় ৬০০ পরিবারের বাস।

 জঙ্গলাকীর্ণ এলাকা বলে বাইরের লোকজন ওই গ্রামে কম যায়। এ সুযোগে গ্রামটিতে নির্বিঘ্নে মাদক ব্যবসা গড়ে উঠেছে। ক্ষমতাসীন দলের এক শ্রেণীর লোক বরাবরই এ ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে আসছে। এলাকাবাসী জানায়, উপজেলা যুবলীগ ও ওয়ার্ড যুবলীগের দুই নেতা বর্তমানে মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করছেন। মাদক ব্যবসায়ীদের অনেকেই অস্ত্রধারী ও সন্ত্রাসী প্রকৃতির। সরেজমিনে জানা যায়, দুপুর থেকেই শুরু হয় গাঁজা বেচাকেনা ও সেবন। সন্ধ্যার পর ফেনসিডিল সেবনকারীরা এলাকায় ঢোকে। বাজিতপুর সদর, কুলিয়ারচর, কটিয়াদী ও নিকলী থেকে যুবকরা মোটরসাইকেলে করে ফেনসিডিল খেতে আসে। স্থানীয় একটি মেডিক্যাল কলেজের কয়েকজন ছাত্রও এখানে ফেনসিডিল খেতে আসেন। সড়ক, রেলপথ ও নৌপথে এখানে ফেনসিডিল আসে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া ও ভৈরবের কালিকাপ্রসাদ, কুলিয়ারচরের গাইলকাটা থেকে ব্যবসায়ীরা ফেনসিডিল ও গাঁজা এনে সরারচরে দিয়ে যান। তাঁদের মধ্যে মহিলাও রয়েছেন। উত্তর সরারচরের গণি মিয়া নিজেই সীমান্ত এলাকা থেকে ফেনসিডিলের চালান আনেন। এ ছাড়া সরারচর রেলস্টেশনে বাবুল নামে আখাউড়ার এক ব্যক্তি স্ত্রীর সহায়তায় ফেনসিডিল ব্যবসা করছেন। দিনে স্বামী-স্ত্রী চা বিক্রি করেন। সন্ধ্যার পর শুরু করেন মাদক ব্যবসা।

 সরারচরে প্রতিদিন কয়েক লাখ টাকার মাদক কেনা-বেচা হয়। গ্রামবাসীর তথ্যমতে, উত্তর সরারচরের সেন্টু মিয়া, মস্তু মিয়া, আঞ্জু মিয়া, মঞ্জু মিয়া, গণি মিয়া, খোকন মিয়া, বাদল মিয়া, সাইফুল ইসলাম, মজলিশপুরের হানিফ মিয়া প্রমুখ এখানকার প্রধান মাদক ব্যবসায়ী। আরো ১০-১২ জন তাঁদের সহায়তা করেন। মাঝেমধ্যে সরারচর বেসরকারি রেজিস্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয়েও গাঁজা রাখা হয়। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নূরুল ইসলাম এ ঘটনার সত্যতা স্বীকার করেছেন। তিনি জানান, ব্যবসায়ীরা প্রভাবশালী বলে এমনটি সম্ভব হয়েছে। জানা যায়, তাঁর দুই ছেলেও মাদকসেবী। তিনি বলেন, ‘শিখ শিখ ধর্ম, দেখ দেখ কর্ম।’ অবাধে মাদক পাওয়া যায় বলেই দুই ছেলে মাদক ধরেছিল। ছয় নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ সভাপতি জীবন বণিক জানান, গ্রামের অর্ধেক যুবকই মাদকে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। কেবল মাদক নয়, এ ব্যবসার পাশাপাশি গোপনে অস্ত্রের ব্যবসা চলছে বলেও অনেকে জানান। মাদক ব্যবসায়ীদের মধ্যে কয়েকজন অস্ত্রধারী রয়েছে বলেও অনেকে জানান। এক শিক্ষক বলেন, ‘চোখের সামনেই কয়েকজন মাদক ব্যবসায়ী অস্ত্র নিয়ে ঘোরে। আমরা নিরীহ মানুষ, প্রতিবাদ দূরের কথা চোখ তুলে তাকানোর সাহসও পাই না।’ সরারচর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আলে মোহাম্মদ আলম বলেন, ‘উত্তর সরারচরে অনেকদিন ধরে মাদক ব্যবসা চলছে। অপরিচিত লোকজন অগণিত মোটরসাইকেলে আসে মাদক সেবন করতে। এলাকাবাসী বিভিন্ন সময় এসব অভিযোগ করলে আমরা বিষয়টি পুলিশকে অবহিত করেছি।’ সহকারী পুলিশ সুপার এন এম নাসিরউদ্দিন জানান, উত্তর সরারচরে মাদকের প্রসার সম্পর্কে নানা অভিযোগ আসছে। এ বিষয়ে খোঁজ-খবর নেওয়া হচ্ছে।