আমি হাল ছাড়ব না, এত সহজে হেরেও যাব না- প্রতিবার যখন জীবন তাকে এনে হাজির করত কোনো নতুন পরীক্ষার সামনে তখন এটাই হতো স্টিভ জবস-এর জবাব। এমন অনেক মানুষের কাহিনীই আমরা জানি, যারা তাদের জীবনের নানা প্রতিবন্ধকতাকে কাটিয়ে উঠে এসেছেন সাফল্যের শীর্ষে। কিন্তু অ্যাপেল কম্পিউটরসের এর সিইও স্টিভ জবস এদের সবার থেকে একটু আলাদা। প্রতিবন্ধকতাকে কাটিয়ে নয়, তিনি সাফল্য আর খ্যাতির চূড়ায় উঠেছেন তার প্রতিবন্ধকতাকে সঙ্গে নিয়েই। তার একক প্রচেষ্টায় নিছক খালি ভাঁড়ার নিয়ে শুরু হওয়া ‘অ্যাপেল কম্পিউটারস’ আজ মাইক্রোসফট-এর মতো কোম্পানিকে পেছনে ফেলে বিশ্বের এক নম্বর জায়গা দখল করে নিয়েছে। জীবনে বহু প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয়েছেন জবস। কিন্তু তিনি কখনো হাল ছাড়েননি। সমস্যা যত বড়ই হোক নিজেকে বুঝিয়েছেন, ‘আমি হারব না’। সত্যি তিনি হারেননি। কখনো হারেননি। ২০০৪ সালে তার লিভারে এক বিশেষ ধরনের টিউমার ধরা পড়ে। এই টিউমার থেকেই ধরা পড়ে ক্যান্সারের সংক্রমণ। ডাক্তাররা জানান, ‘টিউমার অপারেশন করলে স্টিভ-এর বাঁচার আশা খুবই ক্ষীণ। আবার অপারেশন না করলেও রয়েছে প্রাণসংশয়।’ তখন মুহূর্তের জন্য থেমে গিয়েছিল স্টিভ-এর পৃথিবী। তার নিজের তৈরি করা সাম্রাজ্য একটু একটু করে হারিয়ে যাচ্ছিল চোখের সামনে থেকে। শুধু একটাই কথা মনে হচ্ছিল তার, ‘তাহলে কি সব শেষ? সারা জীবনের পরিশ্রম, সব মেহনত কি নিমেষে শেষ হয়ে যাবে? ‘অ্যাপেল’কে বিশ্বের সর্বোচ্চ স্থানে নিয়ে যাওয়ার যে স্বপ্ন আমি দেখেছি তা কি তাহলে আর কোনোদিন সম্পন্ন হবে না?’ তাকে ঘিরে থাকা মানুষের সবাই যখন ভেঙে পড়েছেন, হারিয়ে ফেলেছেন লড়াই করার ক্ষমতা তখনই স্টিভ উঠে দাঁড়ান। সিদ্ধান্ত নেন, হেরে যাওয়ার আগে শেষ একবার অস্ত্র হাতে তুলে নেবেন। লড়ে নেবেন শেষ লড়াইটা। হার বা জিত যা হওয়ার হবে। তবে এটা ছিল স্টিভ-এর জীবনযুদ্ধের ইতিহাসের একটা অধ্যায়।

সব ডাক্তারই যখন তার বাঁচার আশা প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলেন, তখন স্টিভ বেছে নেন এক বিকল্প চিকিৎসার পথ। ২০০৪ সালে ‘হুইপল প্রোসিডিওর’-এর মাধ্যমে তার টিউমার অপারেশন করেন ডাক্তাররা। কোনো ক্যান্সারনিরোধক প্রয়োগের প্রয়োজনও হয়নি। তবে এতকিছু করেও ক্যান্সারের কামড় আটকানো যায়নি। ততদিনে তার শরীরে থাবা বসিয়ে দিয়েছে ওই মারণ রোগ। এবার একটু একটু করে স্টিভকে ঠেলে নিয়ে যাবে মৃত্যুর দিকে। নিজের জীবনের অন্তিম সত্যিটাকে সঙ্গে নিয়েই স্টিভ এগিয়ে চলা শুরু করেন শীর্ষের পথে। চিকিৎসার জন্য সাময়িক বিরতির পর তিনি ফিরে আসেন অ্যাপেল-এর দুনিয়ায়। নিজের হাতে তুলে নেন সংস্থার দায়িত্বভার। একে একে ‘হার্ডল’ পেরিয়ে অ্যাপেল এগোতে থাকে সাফল্যের চূড়ায়। প্রথম লড়াই তাকে লড়তে হয়েছিল শৈশবেই। ২৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৫ সালে সান ফ্র্যান্সিসকো-এ জন্ম হয় স্টিভেন পল জবস-এর। অবিবাহিত বাবা-মায়ের সন্তান স্টিভকে দত্তক নেন পল এবং ক্লারা জবস্। স্টিভ- নামটিও তাদেরই দেওয়া। বাবা-মায়ের অভাবে বেড়ে ওঠাই ছিল স্টিভ-এর প্রথম লড়াই। ক্যালিফোর্নিয়ার হোমস্টেড হাই স্কুল-এ লড়াইয়ের শুরু। ক্যালিফোর্নিয়ার হোমস্টেড হাইস্কুল-এ পড়ার সময় স্টিভ একটি সফ্টওয়্যার সংস্থা হিউলেট-প্যাকার্ড কোম্পানিতে কাজ করার সুযোগ পান। সেখানেই হয় তার কর্মজীবনের সূত্রপাত। এরপর ‘আতারি’ নামে একটি সংস্থার হয়ে তিনি ভিডিও গেম তৈরি করেন। তবে এসবই ছিল শুরুর শুরু। ১৯৭৬ সালে স্টিভ তার দুই বন্ধু স্টিফেন ওজনিক, রোনাল্ড ওয়েনকে নিয়ে ‘অ্যাপেল কম্পিউটারস্’-এর সূচনা করেন। না ছিল কোনো ফান্ড, না কোনো পরিকাঠামো। শুধু ছিল অসীম ইচ্ছা। সফল হওয়ার ইচ্ছা। আর এটাই এগিয়ে নিয়ে যায় স্টিভ বাহিনীকে। ২৪ জানুয়ারি ১৯৮৪ সালে জবস বাজারে আনেন বিশ্বের সবচেয়ে ছোট কম্পিউটার ‘ম্যাকিনটশ’। এর জনপ্রিয়তাই অ্যাপেল-এর বিশ্বাসযোগ্যতাকে অনেকাংশে বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু সব হয়েও কিছুই হলো না। বাড়ানো গেল না অ্যাপেল-এর বাজারদর। বাড়ল না ক্রেতার সংখ্যাও।

অন্যদিকে বিশ্ব-বাজারে ছেয়ে গেল মাইক্রোসফটের নিত্যনতুন পণ্য। বাজার দখলের লড়াইয়ে অ্যাপেলকে পেছনে ফেলে অনেকটাই এগিয়ে যায় মাইক্রোসফট; কিন্তু তখনও হাল ছাড়েননি স্টিভ। চালিয়ে যেতে থাকেন লড়াই। এগিয়ে যেতে থাকেন চূড়ান্ত সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে। তবে সাফল্যের রাস্তা একাকী। সেই রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে মানুষ অনেক সময়ই হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। স্টিভও হয়েছিলেন। তার মনের মুক্তি তিনি খুঁজে পেয়েছিলেন বৌদ্ধধর্মের মধ্যে। সেই টানে তিনি ছুটে এসেছিলেন এই ভারতের মাটিতেও। বৌদ্ধধর্মে দীক্ষা নিয়ে ফিরে গিয়েছিলেন নিজ দেশে। আজীবন নিজের ভাগ্যের সঙ্গে সংগ্রাম করেছেন স্টিভ। কখনো বাবা-মা ছাড়া বাঁচার জন্য, কখনো অ্যাপেলকে পরিচিতি দেওয়ার জন্য, কখনো বা নিজের মৃত্যুকে আটকানোর জন্য- নিরন্তর লড়াই করেছেন। আজও লড়ছেন। যতদিন বেঁচে থাকবেন ততদিন লড়বেন। আর তার এই লড়াই গোটা বিশ্বের মানুষকে জোগাচ্ছে বাঁচার ইচ্ছা। স্টিভ আমাদের দেখিয়েছেন, যারা লড়াই করেন তারা কখনো হারেন না। আর এই পৃথিবী শুধু জয়ীদেরই স্যালুট করে।