প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা আলাউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে পরিবর্তিত এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তালিকা নিয়ে কোনো আপত্তি করেনি শিক্ষা মন্ত্রণালয়। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ ওই তালিকা পড়েও দেখেননি। তিনি তালিকাটি হাতে পেয়েই ওয়েবসাইটে দিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেন।
তালিকা বিশ্লেষণে দেখা যায়, নতুন তালিকায়ও বেশ কিছু অসংগতি রয়েছে। আগের তালিকা সম্পর্কে প্রধান অভিযোগ ছিল, বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কিছু প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত হয়েছে। সেই অভিযোগ আছে পরিবর্তিত তালিকা নিয়েও। দেশের বিভিন্ন এলাকার কয়েকজন সাংসদ গতকাল শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে গিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
গতকাল দেশের কয়েকটি স্থানে বিক্ষোভও করেছে এমপিও-বঞ্চিতরা। আগের তালিকা থেকে বাদ পড়া কয়েকটি প্রতিষ্ঠান মামলার হুমকি দিয়েছে।
এ প্রসঙ্গে শিক্ষামন্ত্রী প্রথম আলোকে বলেন, উপদেষ্টাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল, তিনি সেই দায়িত্ব পালন করেছেন। এ বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রী কিছুই বলতে চান না।
এদিকে শিক্ষামন্ত্রীর কাছে তালিকা দেওয়ার পর উপদেষ্টা আলাউদ্দিন আহমেদ গত সোমবার রাতে অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাঁকে রাজধানীর একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, তাঁর মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়েছে।
উপদেষ্টা আলাউদ্দিন গত সোমবার শিক্ষামন্ত্রীকে একটি চিঠি ও এক হাজার ৪৮৩টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তালিকা হস্তান্তর করেন। চিঠিতে এমপিওভুক্তির ক্ষেত্রে জনসংখ্যার বিষয়টি বাদ দেওয়ার কথা বলেন তিনি। এর বদলে তিনি জাতীয় সংসদের নির্বাচনী এলাকা অথবা উপজেলার ভিত্তিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করা হয়েছে বলে উল্লেখ করেন।
শিমুল বিশ্বাসের দাদার নামের কলেজ যুক্ত, আসাদুল হাবিবেব বাবার নামের কলেজ বাদ: নতুন তালিকায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত সহকারী শিমুল বিশ্বাসের দাদার নামে প্রতিষ্ঠিত আলহাজ অহেদ আলী কলেজের নাম এমপিওভুক্ত হয়েছে। শিক্ষামন্ত্রীর কাছে পাবনা সদরের এই প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে গতকাল অভিযোগ এসেছে।
এদিকে সাবেক উপমন্ত্রী আসাদুল হাবিবের বাবার নামে প্রতিষ্ঠিত লালমনিরহাট সদর উপজেলার বড়বাড়ী ইউনিয়নে অবস্থিত শহীদ আবুল কাশেম মহাবিদ্যালয়টি আগের তালিকায় স্থান পেলেও তা বাদ দেওয়া হয়েছে। মন্ত্রিসভার বৈঠকে বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক ওঠায় গত ১৬ মে শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠানটির এমপিও বাতিল করে দেয়। এর প্রতিবাদে গত সোমবার আবুল কাশেম মহাবিদ্যালয়ের সামনে কুড়িগ্রাম-রংপুর-ঢাকা মহাসড়কে মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়।
বাদ পড়েছে গভর্নরের প্রতিষ্ঠান: বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আতিউর রহমানের প্রতিষ্ঠিত জামালপুর সদরের হাসনা মফিজ নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের নাম বাদ পড়েছে। এ প্রসঙ্গে ওই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ ফজলুল হক জানান, ‘প্রতিষ্ঠানটি সুন্দরভাবে চলছিল। এমপিওভুক্ত হওয়ায় প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে নতুনভাবে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা সৃষ্টি হয়। কিন্তু হুট করে এমন একটি হঠকারী সিদ্ধান্তে সবাই মুষড়ে পড়েছেন।’
কলেজ বন্ধ করে দেবেন ড. খলীকুজ্জমান: মৌলভীবাজারের পাঁচগাঁও মাওলানা মোফাজ্জেল হোসেন মহিলা কলেজের নাম আগের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। নতুন তালিকায় কলেজটির নাম বাদ দেওয়া হয়েছে। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ খলীকুজ্জমান আহমদ তাঁর বাবার নামে কলেজটি প্রতিষ্ঠা করেন।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে খলীকুজ্জমান আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার যা অর্থসম্পদ ছিল, তা বিনিয়োগ করে প্রতিষ্ঠানটি এত দিন টিকিয়ে রেখেছি। কয়েক বছর ধরে আমি আর প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের ঠিকমতো বেতন-ভাতা দিতে পারছিলাম না। সম্প্রতি প্রতিষ্ঠানটি এমপিওভুক্ত করায় আনন্দের সঙ্গে ভেবেছিলাম, কলেজটি এগিয়ে নেব। কিন্তু এমপিও তালিকা থেকে বাদ দেওয়ায় এখন প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ করা ছাড়া সামনে আর কোনো পথ নেই।’
গলাচিপায় দুটি প্রতিষ্ঠান বিএনপি-জামায়াত নেতাদের: নতুন তালিকায় স্থান পাওয়া গলাচিপার দুটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতারা বিএনপি-জামায়াতের সক্রিয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। গলাচিপা আইডিয়াল স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা হলেন জামায়াতে ইসলামীর জেলা আমির শাহ আলম। গত দুটি নির্বাচনে বিএনপি থেকে সংসদ নির্বাচনে মনোনয়নপ্রত্যাশী গোলাম মোস্তফার প্রতিষ্ঠা করা কে আলী কলেজ এমপিওভুক্ত হয়েছে। আওয়ামী লীগের স্থানীয় সাংসদ গোলাম মাওলা রনির এলাকায় এই প্রতিষ্ঠান দুটি অবস্থিত।
বানিয়াচংয়ে সড়ক অবরোধ: বানিয়াচং উপজেলার রত্না উচ্চবিদ্যালয়ের নাম আগের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত ছিল। এটা বাদ পড়ায় স্থানীয় এলাকাবাসী ও শিক্ষার্থীরা গতকাল বিক্ষোভ ও হবিগঞ্জ-বানিয়াচং সড়ক অবরোধ করে যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেয়।
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক এম এ তাহের জানান, অনগ্রসর হাওরাঞ্চলের শিক্ষার্থীদের সুবিধার জন্য ১৩ বছর আগে এলাকাবাসী বিদ্যালয়টি চালু করেছিল। নীতিমালার ভিত্তিতে কিছুদিন আগে তৈরি করা এমপিও তালিকায় প্রতিষ্ঠানটির নাম ছিল। নতুন তালিকায় নাম না থাকায় শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করেছে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে সাংসদেরা: গতকাল বেশ কয়েকজন সাংসদ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে গিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। শেরপুর-১ আসনের সাংসদ আতাউর রহমান আতিক জানান, তিনি যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নাম সুপারিশ করেছিলেন, সেগুলো তালিকাভুক্ত হয়নি। স্থানীয় পর্যায়ে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সাপমারি দাখিল মাদ্রাসার নাম তিনি সুপারিশ না করলেও তালিকাভুক্ত হয়েছে। ওই মাদ্রাসার উদ্যোক্তা ও শিক্ষকদের কয়েকজন জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। তবে মাদ্রাসা সুপার আবদুল আজিজ বলেন, মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নয়।
কুড়িগ্রামের সাংসদ মোহাম্মদ জাফর আলীও মন্ত্রণালয়ে গিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, শিক্ষায় অনগ্রসর ও দরিদ্র এই জেলায় প্রয়োজনীয়সংখ্যক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করা হয়নি।
জয়পুরহাট জেলার প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণের অভিযোগ উঠেছে। এর আগে প্রথম দফায় জয়পুরহাটের কোনো প্রতিষ্ঠানকে তালিকাভুক্ত করা হয়নি। এ নিয়ে সমালোচনা হওয়ায় জয়পুরহাটের তিনটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করা হয়। কিন্তু পরিবর্তিত তালিকায় আবারও দুটি প্রতিষ্ঠানকে বাদ দিয়ে নতুন একটি প্রতিষ্ঠান যুক্ত করা হয়েছে।
বৈষম্যমূলক আচরণের অভিযোগে কালাই উপজেলার এমপিও-বঞ্চিত শিক্ষক-কর্মচারীরা প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চেয়ে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে স্মারকলিপি দিয়েছেন। এমপিও-বঞ্চিত কালাই উপজেলার আওড়া উচ্চবিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক শাহারুল আলম বলেন, ‘১৩ বছর ধরে বিনা বেতনে চাকরি করছি। সব শর্ত পূরণ করার পরও বৈষম্যমূলক আচরণের কারণে বিদ্যালয়টি এমপিওভুক্ত হয়নি।’
জয়পুরহাট-২ আসনের সাংসদ গোলাম মোস্তফা বলেন, ‘এটা সরকারের রাজনৈতিক প্রতিহিংসার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওর ক্ষেত্রে জয়পুরহাট জেলাকে চরম বৈষম্য ও বঞ্চিত করার কারণ, জেলার দুটি আসনেই বিএনপির প্রার্থী জয়লাভ করেছেন।