কটিয়াদীর অবস্থানঃ জেলার একটি থানা কটিয়াদী। এলাকাটির চারদিকে হাওর,কাল বিল ও জলাভূমি।রাস্তাঘাট ও যোগাযোগ ব্যবস্থা অনুন্নত। চলাচলের জন্য নৌকাই প্রধান বাহন।কটিয়াদি শহরে কয়েকটি পাকা বাড়ি ছাড়া কোন স্থাপনা তখনো গড়ে উঠেনি। এলাকাটির দক্ষিন পাশ দিয়ে পূর্ব-পশ্চিমে লম্বালম্বি ভাবে ব্রক্ষপুত্র নদী বয়ে গেছে। মহকুমা শহর কটিয়াদি কিশোরগঞ্জ থেকে ২৫ কিঃমিঃ উত্তরে অবস্থিত।কট্যাদি থেকে ১০/১২ কিঃমিঃ দক্ষিনে কুলিয়ারচর থানা এবং ২৫ কিঃমিঃ দক্ষিন পূর্ব দিকে ভৈরব বাজার অবস্থিত। ভৈরব বাজার থেকে কুলিয়ারচর হয়ে কটিয়াদি পর্যন্ত একটি কাঁচা রাস্তা ছিল।রাস্তাটির অসংখ্য স্থান ছিল বিধ্বস্ত। বর্ষার দিনে এই সড়কের অনেকাংশে পানির নিচে তলিয়ে যেতো।থানা সদরের পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলির মধ্যে চরিরাকোমা, চরপুকিয়া, চড়িপাড়া, ঘগাইর, জালালপুর, মুদগা উল্লেখ্যযোগ্য।

মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে কটিয়াদির গুরুত্বঃ

সড়ক পথে এবং নদী পথে বাজিতপুর ও ভৈরব বাজারে যাতায়াতের পথে একটি বিশেষ স্থান কটিয়াদি।কিশোরগঞ্জ থেকে ভৈরব বাজার ও আশুগঞ্জে চলাচলের জন্য কটিয়াদি ও কুলিয়ারচর ছিল গুরুত্বপূর্ণ। ভৈরব ও কিশোরগঞ্জের মধ্যে যাতায়াত ব্যবস্থা অবিচ্ছিন্ন রাখা এবং এলাকা মুক্তিবাহিনীর দখল মুক্ত রাখার জন্য পাকবাহিনী কটিয়াদি ও তার আশপাশ এলাকায় একাধিক ক্যাম্প স্থাপন করে।এই ক্যাম্প স্থাপনের প্রধান কারন ছিল কিশোরগঞ্জ মহকুমায় দক্ষিন পশ্চিম অঞ্চলের সড়ক,রেলপথ ও নদী পথের উপর পাকবাহিনীর নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠা করা।

পাকিবাহিনীর অবস্থানঃ

কিশোরগঞ্জের কটিয়াদি থানা ছিল ৭০ উইং রেঞ্জার্স এর অপারেশনাল এলাকায়।পাকবাহিনী তাদের সহযোগী রেঞ্জার্স ও রাজাকারদের মাধ্যমে কটিয়াদি,মঠখোলা,কালিয়াচাপড়া,পাকুন্দিয়া,মনোহরদী,বাজিতপুর,কুলিয়ারচর ও গচিহাঁটাতে একাধিক ঘাঁটি স্থাপন করে।ভৈরববাজার ও আশুগঞ্জেও ছিল পাকিবাহিনীর শক্তিশালী অবস্থান।কিশোরগঞ্জের ঘাঁটিতে অবাঙ্গালি রাজাকারদের প্রশিক্ষন দেওয়া হতো।কটিয়াদি থেকে প্রায় ২০ কিঃমিঃ উত্তরে হোসেনপুর থানা সদর এলাকায় অনুরুপ রাজাকারদের একটি প্রশিক্ষন ক্যাম্প ছিল।কটিয়াদিতে স্থানীয়ভাবে নিয়োগকৃত আরও এক কোম্পানি রাজাকারদের অবস্থান ছিল।

মুক্তিবাহিনীর অবস্থানঃ

কিশোরগঞ্জ কটিইয়াদি এলাকায় রেঞ্জার্স ও রাজাকারদের ব্যাপক চলাচল থাকায় মুক্তিবাহিনীর এই এলাকায় কোন স্থায়ী ঘাঁটি গড়ে উঠেনি।মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডরগণ সীমান্ত অবস্থান থেকে এলাকায় আক্রমন পরিচালনা করতো।জুন মাস নাগাদ এই এলাকায় মুক্তিবাহিনীর ততপরতা বৃদ্ধি পায় এবং আশপাশের এলাকায় অবস্থান নিতে চেষ্টা করে।এই সময় স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা দলের নেতা হারুন-অর-রশিদ পাকিবাহিনীর বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি আক্রমন পরিচালনা করে।কটিয়াদির আমবুশ এই যুদ্ধ গুলির মধ্যে একটি উল্লেখ্যযোগ্য যুদ্ধ।

যুদ্ধের বিবরণঃ

১৪ জুলাই ১৯৭১ কটিয়াদি এলাকায় অবস্থানকারী মুক্তিবাহিনীর দলনায়ক হারুন-অর-রশিদের নিকট পাকবাহিনীর চলাচলের একটি সংবাদ আসে।তথ্য সংগ্রহএ জানা যায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ৫ টি সৈন্যবাহী লঞ্চ বেলাবো থেকে এসে কটিয়াদিতে অপেক্ষা করছে ।১৫ জুলাই লঞ্চ গুলি যুদ্ধাস্ত্র, রসদ ও খাদ্য সামগ্রী নিয়ে পরবর্তীতে ঢাকা অথবা ময়মনসিংহের উদ্দেশ্যে যাত্রা করার উদ্যোগ নিচ্ছে।

কমান্ডার হারুন-অর-রসিদ এই খবরের উপর ভিত্তি করে কটিয়াদী এলাকায় অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে কটিয়াদী থেকে কিছুদুরে সাগরদী বাজারের নিকট অবস্থানের গ্রহনের মাধ্যমে সুবিধাজনক স্থানে লঞ্চের উপর আক্রমনের পরিকল্পনা গ্রহন করে । একই সময়ে গ্রুপ কমান্ডার মোশারফ হোসেন কিরণের নেতৃত্বে ২০ জন মুক্তিযোদ্ধার একটি দল খিদিরপুর গ্রাম থেকে অগ্রসর হয়ে সাগরদী বাজারে এসে কমান্ডার হারুন-অর-রসিদ এর দলের সাথে যোগ দেয় । কমান্ডার হারুন-অর-রসিদ সাগরদী বাজারের কাছে রামপুরা গ্রামের উত্তর প্রান্তে ব্রহ্মপুত্র নদী বাঁক নিয়েছে সেখানে অ্যামবুশ করার সিদ্ধান্ত গ্রহন করেন । তিনি মুক্তিযোদ্ধা দলটিকে তিনটি ভিন্ন ভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত করে তিনটি সুবিধাজনক স্থানে অবস্থানের নির্দেশ দেন । তিনি আরোও নির্দেশ দেন প্রথম লঞ্চ মুক্তিবাহিনীর তৃতীয় এবং শেষ অবস্থানে না পৌছানো পর্যন্ত কেউ যেন গুলি না চালায় । এই তৃতীয় অবস্থানে ছিলেন শেখ হারুন-অর-রশিদের নের্তত্বাধীন মূল দল ।

১৫ জুলাই পাকিস্থানি সৈন্যবাহী লঞ্চগুলি যাত্রা না করায় অনেকেই হতাশাগ্রস্থ হয়ে পড়ে । তবুও কমান্ডারের নির্দেশে সকলেই শত্রুর অপেক্ষায় থাকে । ১৬ জুলাই সকালে সংবাদ আসে লঞ্চ পাঁচটি কটিয়াদি থেকে রওনা করেছে । যে কোন সময় রামপুরা বাক অতিক্রম করবে । এই সংবাদে শেখ হারুন-অর-রশিদ তার দলকে পুনরায় নদীর তীরে তিনটি স্থানে অবস্থান গ্রহনে নির্দেশ দেন ।

১৬ জুলাই সকাল ৮ টায় পাকবাহিনীর প্রথম দুটি লঞ্চ মুক্তিবাহিনীর অবস্থানে প্রবেশ করে । দুটি করে  লঞ্চ একসাথে বাধা । সকলে দলনেতার নির্দেশের জন্য অপেক্ষায় থাকে । দ্বিতীয় জোড়া লঞ্চ দুনম্বর উপদলের সম্মুখে উপস্থি হলে হঠাৎ করে এই দলের মুক্তিযোদ্ধা আফতাব উত্তেজিত হয়ে ‘জয় বাংলা’ ধবনি দিয়ে লঞ্চের উপর গুলিবর্ষন শুরু করে ।

সাথে সাথে সকল মুক্তিযোদ্ধা লঞ্চের উপর গুলি চালাত থাকে । ততক্ষনে প্রথম দিকের চারটি লঞ্চ অর্থাৎ দুজোড়া লঞ্চ মুক্তি যোদ্ধাদের অ্যামবুশ সীমানার মধ্যে ঢুকে পড়েছে । এবং এই চারটি লঞ্চই আক্রান্ত হয়েছে ।
পিছনের লঞ্চটি সামনের লঞ্চগুলি আক্রান্ত হতে দেখে আর সম্মুখে না এগিয়ে কিছুটা পিছনে যেয়ে রামপুরা বাজারের নিকট নদীর পশ্চিম তীরে সৈনিকদের নামিয়ে দেয় ।

পাকিস্থানী বাহিনী লঞ্চের ছাদে বালুর বস্তা দিয়ে পূর্বেই মজবুত ভাবে একাদিক বাংকার তৈরী করে রেখেছিল ।
সেই অবস্থান থেকেই পাকবাহিনী এল,এম,জি দিয়ে প্রচন্ড গুলি বর্ষন শুরু করে । একই সাথে পিছনে স্থলপথে নেমে আসা সৈনিকরাও মরিয়া হয়ে গুলি চালাতে চালাতে অগ্রসর হতে থাকে ।  দলনেতা হারুন বুঝতে পারেন

এই অবস্থায় পাকবাহিনীর সামনে টিকে থাকা সম্ভব নয় ।  তিনি নিজ দলের এল এম জি ফায়ারিং কভারে তিনটি দলকেই প্রত্যাহার করে নিয়ে আস্তে সমর্থ হন । কমান্ডার হারুন কটিয়াদী যুদ্ধ ক্ষেত্র ছেড়ে  নিজ দল সহ সাগরদী বাজার পাড় হয়ে চালাকেরচরে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে আসেন ।

অল্প সময়ের ব্যবধানে পাকিস্থানী সামরিক বাহিনীর একটি হেলিকপ্টার আড়ালিয়া বাজারের পার্শবর্তী মাঠে অবতরন করে। এ অবস্থায় মুক্তিবাহিনীর দলটি প্রথমে ভেবেছিল পাকবাহিনী তাদের তাদের শক্তি বৃদ্ধির জন্য নতুন সৈন্যের সমাবেশ ঘটাচ্ছে ।  পরে এলাকার জনগনের কাছ থেকে জানা যায় যে এই হেলিকপ্টারটি এসেছিল পাকবাহিনীর আহত সৈ্নিকদের সরিয়ে নেয়ার জন্য ।  পাকবাহিনীর হেলিকপ্টারটি তিনবার এই এলাকায় আসা যাওয়া করে । প্রত্যক্ষদর্শীর মতে, কটিয়াদী লঞ্চ আক্রমনে  ১৫/১৬ জন আহত কিংবা নিহত সৈ্নিকদের পাকবাহিনী হেলিকপ্টারে করে নিয়ে যায় ।

কটিয়াদি অ্যামবুশ অংশগ্রহনকারী মুক্তিযোদ্ধাঃ
শেখ হারুন অর রশিদ, ছানোয়ার আলী, মোশারফ হোসেন, আব্দুর রশিদ, হায়দার আলী নান্নু, আতাউর রহমান, কাজী মস্তোফা, আব্দুল আউয়াল, আব্দুল কুদ্দুস, কাজী সাইদুর রহমান, জয়নাল আবেদিন, মতিঊর রহমান, জয়নাল, মস্তোফা, তমিজ উদ্দিন, আমিনুল ইসলাম, মোঃ শামসুদ্দিন, মুজিবর রহমান, আবু তাহের, রফিকুল ইসলাম, আহম্মদ হোসেন খান, আব্দুল জব্বার, আফতাব উদ্দিন, আব্দুর রশীদ, আব্দুল মালেক, আব্দুল হাকিম ।

সামগ্রীক মূল্যায়নঃ
কটিয়াদি এলাকায় পাকবাহিনীর লঞ্চ আক্রমনে মুক্তিবাহিনী সমন্বিত কার্যক্রম গ্রহন করে । কিন্তু লঞ্চে পাকবাহিনীর শক্তিশালী অবস্থা সম্পর্কে অনভিজ্ঞতার কারনে মুক্তিবাহিনী পাকবাহিনীর পাল্টা আক্রমনের শিকার হয় এবং কটিয়াদি এলাকা থেকে পিছু হটতে বাধ্য হয় ।