কিশোরগঞ্জের বৃহত্তম গনহত্যার স্মৃতি বহন করে আছে বড়ইতলা স্মৃতি সৌধ,সাড়ে তিন শতাধিক নিরীহ গ্রামবাসীকে যেখানে হত্যা করা হয় নৃশংসভাবে ।

কিশোরগঞ্জের বৃহত্তম গনহত্যার স্মৃতি বহন করে আছে বড়ইতলা স্মৃতি সৌধ, সাড়ে তিন শতাধিক নিরীহ গ্রামবাসীকে যেখানে হত্যা করা হয় নৃশংসভাবে। ১৯৭১ সনের ১৩ই অক্টোবর  এই দিনে কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার বড়ইতলা নামক স্থানে রেললাইনের পাশে জড়ো করে কয়েকটি গ্রামের সাড়ে তিন শতাধিক গ্রামবাসীকে নৃশংসভাবে হত্যা করে পাকিস্তানি মিলিশিয়া ও এদেশের রাজাকাররা। সেদিনের এ বর্বরোচিত হত্যাযজ্ঞের ঘটনায় সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে গেছেন অনেকে অনেকে আজো বয়ে বেড়াচ্ছেন নৃশংস নির্যাতনের চিহ্ন। কিশোরগঞ্জবাসীর জন্য সেই ভয়াল দুঃস্বপ্নের কাহিনী ।

১৯৭১ সনের উত্তাল অক্টোবর। দেশ মাতৃকার স্বাধীনতার জন্য বাঙালি দামাল ছেলেরা শত্রুর বিরুদ্ধে লড়ছে জীবন বাজি রেখে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও এ দেশের স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকার-আল বদররা চালাচ্ছে নির্বিচারে হত্যা, লুণ্ঠন ধর্ষণ-অগ্নিসংযোগ। ১৩ অক্টোবর দুপুর ১২ টার দিকে ট্রেনে করে একদল মিলিশিয়া ও রাজাকার এসে নামে বড়ইতলা নামক স্থানে। তাদের একটি দল পার্শ্ববর্তী কর্শাকড়িয়াইল দামপাড়া গ্রামে প্রবেশ করে কয়েকজন গ্রামবাসীকে হত্যা করে। এক পর্যায়ে বিনা উস্কানিতে হানাদার ও রাজাকাররা দামপাড়া, কড়িয়াইল, তিলকনাথপুর, গোবিন্দপুর, চিকনিরচর, কালিকাবাড়ি ও ভুবিরচর গ্রামের চার শতাধিক মানুষকে ধরে আনে। তাদেরকে হাত বেধে জড়ো করা হয় বড়ইতলায়। এ সময় খবর আসে যে, গ্রামবাসী দুইজন মিলিশিয়াকে হত্যা করেছে। এ গুজবের সত্যতা যাচাই না করেই শত শত মানুষকে রেললাইনের পাশে দাঁড় করিয়ে বেয়নেট দিয়ে খুচিয়ে খুচিয়ে, পিটিয়ে ও গুলি করে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। যেনো হঠাৎ কেয়ামত নেমে আসে তাদের ওপর।

শত শত গ্রামবাসীর আর্তচিৎকারে সেদিন ভারী হয়ে উঠে আকাশ-বাতাস। অনেকে সেদিন হত্যাযজ্ঞ থেকে সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যায়। এদের অনেকে এখনও বেঁচে আছেন পঙ্গু জীবন নিয়ে-কেউবা বেয়নেটের আঘাতের চিহ্ন শরীরে ধারন করে, যাদের অনেকে হারিয়েছেন বাবা, ভাইসহ স্বজনদের।

বড়ইতলা হত্যাকাণ্ডে ৩শ’ ৬৫ জন গ্রামবাসী প্রাণ হারায়। ফলে ওই সময় প্রায় পুরুষশূন্য হয়ে পড়ে কয়েকটি গ্রাম। চিকনীরচর গ্রাম থেকেই হত্যা করা হয় দেড় শতাধিক মানুষকে। এ গ্রামে অনেক পরিবার রয়েছে যারা ১০ থেকে ১৫ জন স্বজনকে হারিয়েছেন।

সিরাজুলের মতো সৌভাগ্যক্রমে প্রাণে রক্ষা পেয়েছেন নির্যাতনের শিকার অনেকেই। আহত অবস্থায় এখনও বেঁচে আছেন তাদের কেউ।

স্বাধীনতার পর এলাকাবাসী বড়ইতলার নাম করে শহীদনগর। স্থানীয়দের উদ্যোগে এখানে নির্মিত হয় স্মৃতিফলক। পরবর্তীতে ২০০০ সনে ৩ লাখ টাকা ব্যয়ে এখানে ৬শ’ ৬৭ বর্গফুট এলাকায় স্মৃতি সৌধ নির্মাণ কাজ শুরু হলেও এখনও অসমাপ্ত অবস্থায় পড়ে আছে সেটি।

প্রতি বছর ডিসেম্বরে বিজয় দিবস এলেই বড়ইতলা স্মৃতি সৌধের শুকনো ইট ভিজে যায় স্বজন হারানো মানুষের চোখের জলে। শহীদের আত্মীয়স্বজন ও এলাকাবাসী এখানে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানায় শহীদদের প্রতি। এলাকাবাসীর দাবি শহীদনগর স্মৃতি সৌধের নির্মাণ কাজ শেষ করে স্মৃতিফলকে সকল শহীদদের নাম ঠিকানা লিপিবদ্ধ করা হোক। তবেই শান্তি পাবে বড়ইতলায় প্রাণ বিসর্জনকারীদের আত্মা।