কিশোরগঞ্জে চিকিৎসার নামে তিয়ানশি কোম্পানীর লাগামহীন প্রতারণার শিকার হচ্ছে সাধারণ মানুষ। সকল প্রকার রোগ নিরাময়ের মিথ্যা প্রলোভনের জালে আটকা পড়ে চীন ভিত্তিক তিয়ানশি কোম্পানীর ঔষধ ও অন্যান্য সামগ্রী ব্যবহার করে নিরীহ মানুষ একদিকে যেমন মারাত্মক শারীরিক জটিলতার মুখে পড়ছে তেমনি আর্থিকভাবে হয়ে পড়ছে সর্বস্বান্ত। অথচ ফুড সাপ্লিমেন্টারীর নামে চিকিৎসায় ব্যবহৃত এসব সামগ্রীর নেই সরকারের ঔষধ প্রশাসন, খাদ্য বিভাগ কিংবা বিএসটিআইয়ের কোন প্রকার অনুমোদন। চিকিৎসা ক্ষেত্রে ঔষধ ও ফুড সাপ্লিমেন্টারী ব্যবহারে বাংলাদেশ মেডিকেল এন্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের (বিএমডিসি) অনুমোদিত চিকিৎসক কর্তৃক ব্যবস্থাপত্র প্রদানের আইন রয়েছে। অথচ স্বাস্থ্য ঝুঁকির চিন্তা না করে মনগড়া ব্যবস্থাপত্র দিচ্ছেন তিয়ানশির সাথে সংশ্লিষ্ট এমন সব অর্ধশিক্ষিত ব্যাক্তি যাদের চিকিৎসা সংক্রান্ত কোন ধারণাই নেই। এভাবে দিনের পর দিন ভূয়া চিকিৎসক কর্তৃক প্রদত্ত বেআইনী ফুড সাপ্লিমেন্টারী চড়া দামে কিনে ব্যবহার করে শত শত মানুষ প্রতিনিয়ত ক্ষতির মুখে পড়লেও প্রশাসনের নির্বিকার ভূমিকায় চরম ক্ষুদ্ধ সাধারণ জনগণ।

জেলা শহরের চর শোলাকিয়া এলাকার বিশিষ্ট ব্যবসায়ী আব্দুল আলী কয়েক মাস পূর্বে ছোটখাট শারীরিক অসুস্থতার জন্য তিয়ানসি থেকে তাদের ব্যবস্থাপত্র মোতাবেক কিছু ঔষধ খেয়ে বুকে প্রচন্ড ব্যাথাসহ জটিল হৃদরোগের সৃষ্টি হয়। এক পর্যায়ে অবস্থার অবনতি ঘটলে তাকে ঢাকা হার্ট ফাউন্ডেশনে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিতে হয়। এর ফলে তার তিন লক্ষাধিক টাকা খরচ হয়। আব্দুল আলী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন তিয়ানশির ঔষধ খাওয়ার ফলেই তিনি হৃদরোগের সমস্যায় পড়েন। তিনি চিকিৎসার নামে এধরনের প্রতারনা বন্ধ ও জড়িতদের শাস্তি দাবী করেন।

কিশোরগঞ্জের ঐতিহাসিক শহীদি মসজিদের ইমাম ও জামিয়া ইমদাদীয়া মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সর্বজন শ্রদ্ধেয় আলেম মাওলানা আনোয়ার শাহ তিয়ানশি থেকে ৬৬ হাজার টাকা ব্যায়ে একটি ম্যাজিক বিছানা ক্রয় করেন। কয়েক শত উপকারী পাথর বসানো উক্ত চাদর ব্যবহারে বিষ ব্যাথাসহ শরীরের আরো বহু রোগ থেকে মুক্ত থাকা যায় বলে তিয়ানশি থেকে বলা হয়। এ ছাড়া আট হাজার টাকা ব্যায়ে রক্তের উচ্চ চাপ রোধক চিরুনী ক্রয় করেন। কিন্ত পণ্য দুটি ক্রয় করে কোন উপকারই পাননি অভিযোগ করে তিনি প্রতারনার শিকার হয়েছেন বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। একইভাবে উক্ত চাঁদর কিনে পরে তা ফেরত দেয়ার কথা বলেছেন কিশোরগঞ্জ পৌরসভার মেয়র মাজহারুল ইসলাম ভূইঁয়া কাঞ্চন। সদর উপজেলার মহিষাকান্দি গ্রামের রুকসানা আক্তার গর্ভাবস্থায় নিরাপদ প্রসবের জন্য তিয়ানশির ঔষধ খান। কিন্তু পরবর্তীতে শারীরিক অবস্থার অবনতি হয় এবং মৃত শিশু প্রসব করেন বলে অভিযোগ করেছেন।

একইভাবে কিশোরগঞ্জ পৌরসভার দুই নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর জালাল উদ্দিন, কৃষি কর্মকর্তা খোরশেদ আলম, বিশিষ্ট ব্যবসায়ী বাদল রহমান, আইনজীবী সাইফুল হক, গৃহিনী মাহফুজা হক,শোলাকিয়া এলাকার বৃদ্ধা নীলুফা আক্তার,কাদিরজঙ্গল গ্রামের মিয়া বকস্, পুমদি গ্রামের সঞ্জিত চন্দ্র শীল এবং নীলগঞ্জ গ্রামের কিতাব আলী এরা প্রত্যেকেই ডায়াবেটিস, কিডনী, হৃদরোগসহ অন্যান্য জটিল রোগে চড়া দামে তিয়ানশির ঔষধ সেবন করে ও অন্যান্য সামগ্রী ক্রয় করে প্রতারণার শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন। তাদের সবার অভিযোগ তিয়ানশির ঔষধ সেবন ও সামগ্রী ব্যবহার করে কোন উপকার পাননি উল্টো নতুন নতুন শারীরিক সমস্যায় পড়েছেন।

সরজমিন অনুসন্ধানে জানা যায় অনেকটা এমএলএম পদ্ধতিতে সদস্য সংগ্রহ করে ক্রম বর্ধমান মুনাফা ও লোভনীয় পুরস্কারের লোভ দেখিয়ে সহজ সরল মানুষকে তিয়ানশির বিপনন কার্যক্রমে যুক্ত করা হয়। বিক্রয় কাজে দক্ষতা ও সদস্য অন্তভূর্তির সাফল্য অনুযায়ী একজন সদস্য ফার্ষ্ট ষ্টার থেকে শুরু করে এইট ষ্টার র‌্যাংক বা তদুর্ধ পর্যন্ত হতে পারেন। র্যাং ক অনুযায়ী পুরস্কারের মধ্যে ল্যাপটপ, বিদেশ ভ্রমন, প্রাইভেট কার, বাড়ি, বিলাসবহুল নৌযান ইয়টসহ এমনকি বিমান পর্যন্ত রয়েছে। জেলা শহরে প্রাণকেন্দ্রে শহীদি মসজিদের ঠিক পিছনেই একটি একতলা বিশাল বাড়িতে অবস্থিত তিয়ানশির কার্যালয়। সকাল থেকে গভীর রাত অবধি এখানে চলে রোগী দেখা, ঔষধ বিক্রয়, সদস্যদের মোটিভেশনসহ যাবতীয় কার্যক্রম। জেলায় সংগঠনের সার্বিক দায়িত্ব পরিচালনা করছেন সেভেন ষ্টার র্যাং কধারী মোঃ জামাল উদ্দিন । রোগী দেখা, রোগ নির্ণয় ও ব্যবস্থাপত্র প্রদানসহ অন্যান্য কার্যক্রম তিনিই করে থাকেন। কিশোরগঞ্জের জামিয়া ইমদাদীয়া মাদ্রাসার সাবেক ছাত্র মোঃ জামাল উদ্দিনের বাড়ি নেত্রকোনা জেলার মোহনগঞ্জ উপজেলার পানুর গ্রামে।

তিয়ানশির রোগ নির্ণয়ের ধরণ ও ঔষধের মান সম্মন্ধে জানতে চাইলে জামাল উদ্দিন বলেন আমি কোম্পানির নিজস্ব পদ্ধতিতে রোগ নির্ণয় করে থাকি, যা শতভাগ নির্ভূল। এখানে চিকিৎসা গ্রহন করে সকল রোগের নিরাময় সম্ভব এবং এখানকার ঔষধের কোন পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া নেই। এ ব্যাপরে ঔষধ প্রশাসন ময়মনসিংহ অঞ্চলের ঔষধ তত্ত্বাবধায়ক মোঃ ওয়াহেদুর রহমান বলেন তিয়ানশির এ ধরণের ঔষধ সামগ্রী বিক্রির কোন অনুমতি নেই। সম্পূর্ণ স্বেচ্ছাচারিতা ও প্রতারনার মাধ্যমেই এ কার্যক্রম চলছে। বাংলাদেশ ষ্ট্যান্ডার্ড এন্ড টেষ্টিং ইনষ্টিটিউশান (বিএসটিআই) কিশোরগঞ্জ জেলার পরিদর্শক পূজন কর্মকার এবং জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক আব্দুল মালেক তিয়ানশির পণ্যে কোন প্রকার অনুমোদন না থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ।

কিশোরগঞ্জ ঔষধ ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি ও সদর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান বিশিষ্ট চিকিৎসক ডাঃ আব্দুল হাই বলেন ঔষধ ও খাদ্য বিভাগ এবং বিএসটিআয়ের কোন প্রকার অনুমোদন ছড়া ঔষধ বিক্রি সম্পূর্ণ প্রতারনা। এছাড়া বাংলাদেশ মেডিকেল এন্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি) কর্তৃক নিবন্ধিত চিকিৎসক ছাড়া ঔষধ সামগ্রী ও ফুড সাপ্লিমেন্টারীর ব্যবস্থাপত্র প্রদান আইনত নিষিদ্ধ ও দন্ডনীয় অপরাধ। এ ধরনের বেআইনি কার্যক্রম বন্ধে প্রশাসনিকভাবে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন।

কিশোরগঞ্জের সিভিল সার্জন ডাঃ হোসাইন সারোয়ার বলেন চিকিৎসার নামে অবাধে ঔষধ ও ফুড সাপ্লিমেন্টারীর অবাধ ব্যবহারে মানুষের স্বাস্থ্যের মারাত্মক ক্ষতির আশংকা রয়েছে। সঠিকভাবে রোগ নির্ণয় ব্যতিরেকে এবং উপযুক্ত চিকিৎসক ছাড়া ব্যবস্থাপত্র প্রদান সম্পূর্ণরুপে বেআইনি এবং প্রতারনামূলক। এ ধরনের বেআইনি কার্যক্রম বন্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।

– কিশোরগঞ্জ প্রতিনিধি