রাজধানীতে আজ থেকে শুরু হচ্ছে পুরনো গাড়ির বিরুদ্ধে অভিযান। ২০ বছরের পুরনো বাস ও মিনিবাস এবং ২৫ বছরের পুরনো ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান তুলে দেওয়া হবে। ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ১৫টি দল এগুলো আজ থেকে জব্দ করবে। তবে সরকারের এ অভিযান যানবাহনের মালিক ও শ্রমিক পক্ষ মানতে নারাজ। তাদের দাবি, পুরনো গাড়ি চলতে দিতে হবে। ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান রাজধানীতে চলাচলে পর্যাপ্ত সময় ও সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। এ লক্ষ্যে কয়েকটি দাবি তুলে আগামী ২ আগস্ট সারাদেশে অনির্দিষ্টকালের জন্য ধর্মঘট ডেকেছে বাংলাদেশ ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান, লং ভেহিকেল মালিক শ্রমিক ঐক্য পরিষদ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পুরনো গাড়ির বিরুদ্ধে এর আগেও বহুবার অভিযান চালানো হয়েছে। দৃশ্যত কোনো সুফল আসেনি। বিকল্প গাড়ির ব্যবস্থা না করে বারবার এ রকম অভিযান চালানোর কারণে যাত্রীদের দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। এবারও দুর্ভোগের আশঙ্কা করছেন যাত্রীরা। তবে সরকার পক্ষ বলছে, এবার তারা আদাজল খেয়ে নামছেন। অভিযান সার্থক করার জন্য যা কিছু প্রয়োজন সবই করবেন তারা। পাশাপাশি নতুন গাড়িও নামানোর কথা বলছেন তারা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজধানীতে ব্যাপক যানজট। একই সঙ্গে পুরনো গাড়ির কালো ধোঁয়া। পরিবেশ দূষণ হচ্ছে ব্যাপকভাবে। ফলে পুরনো গাড়ি তুলে দেওয়া উচিত। তবে যাত্রীদের বিষয়টিও সরকারকে মাথায় রাখতে হবে। পুরনো গাড়ির বদলে
নতুন গাড়িও নামাতে
হবে যাত্রীদের স্বার্থে।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ-বিআরটিএর হিসাব অনুযায়ী বয়সসীমা পেরিয়ে যাওয়া এমন যানের সংখ্যা ১৩ হাজার ৭৭টি। এসব যান রাস্তা থেকে তুলে নেওয়ার সিদ্ধান্ত হলেও এখনও বিকল্প কোনো ব্যবস্থা করেনি কর্তৃপক্ষ। ফলে নগরবাসীকে তীব্র যান সংকটের মুখোমুখি হতে হবে_ এমনটিই আশঙ্কা করছেন পরিবহন বিশেষজ্ঞরা।
রাজধানীর ১৫টি পয়েন্টে ভ্রাম্যমাণ আদালত পুরনো গাড়ি রাজপথ থেকে তুলে নিতে অভিযান চালাবেন। অভিযান পরিচালনার জন্য ইতিমধ্যে ১৫ জন ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তারা ঢাকা জেলা প্রশাসকের অধীনে কাজ করবেন। এ ছাড়া বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ-বিআরটিএর অধীনেও দু’জন ম্যাজিস্ট্রেট অভিযান চালাবেন। সব অভিযানেই পুলিশ সহায়তা দেবে।
সর্বশেষ গত ২৪ জুন যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের এক সভায় রাজধানীতে চলাচলকারী বয়সসীমা পেরিয়ে যাওয়া যান তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের হিসাব অনুযায়ী এ ধরনের যানবাহনের সংখ্যা ১৩ হাজার ৭৭টি। এর মধ্যে ২৫ বছরের পুরনো ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যানের সংখ্যা নয় হাজার ৯৬৭টি। বাস-মিনিবাস রয়েছে তিন হাজার ৮১১টি।
সূত্র জানায়, এ নিয়ে চার বছরের মধ্যে চতুর্থবারের মতো রাজধানীর রাস্তা থেকে পুরনো গাড়ি তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এর আগে তিনবার ২০ বছরের পুরনো গাড়ি রাজধানীর রাস্তা থেকে উচ্ছেদের অভিযান চালানো হলেও কোনো ফল হয়নি। অভিযান শেষে ডাম্পিং স্টেশন থেকে আবারও রাস্তায় ফিরে এসেছে এসব যান।
বিআরটিএ থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী রাজধানীতে চলাচলকারী মোট যান্ত্রিক যানবাহনের সংখ্যা ৫ লাখ ২৭ হাজার ২৮৫টি। এর মধ্যে ব্যক্তিগত গাড়ি, যেমন_ প্রাইভেট কারের সংখ্যা সর্বোচ্চ ১ লাখ ৪২ হাজার ২৮৩টি। এছাড়াও ব্যক্তিগত পর্যায়ে জিপ ও মাইক্রোবাসের সংখ্যা ৫৮ হাজার ৬০৮টি। এ হিসাব অনুযায়ী প্রতিদিনই রাজধানীতে ব্যক্তিগত গাড়ি বাড়ে ৯৮টি। সে তুলনায় গণপরিবহন অর্থাৎ বাস-মিনিবাসের সংখ্যা বাড়ে না। এসব গাড়ির গড় বৃদ্ধি ৩ শতাংশেরও কম। ২০০৯ সালে যেখানে ব্যক্তিগত গাড়ি বেড়েছে ২৪ হাজার ৮৫৭টি, সেখানে বাস বেড়েছে মাত্র ৯১৪টি।
বিআরটির হিসাব অনুযায়ী রাজধানীতে চলাচলকারী বাস ও মিনিবাসের সম্মিলিত সংখ্যা ১৬ হাজার ৫২৭টি হলেও এর সবগুলো সচল নয়। রাজধানীতে নিবন্ধিত অনেক যান দূরপাল্লার বাস হিসেবে চলাচল করে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের হিসাব মতে, নগর পরিবহন হিসেবে চলাচলকারী বাস ও মিনিবাসের সংখ্যা সর্বোচ্চ ১২ হাজার, যা এক কোটি নগরবাসীর জন্য যথেষ্ট নয়। এর মধ্যে ২০ বছরের বেশি পুরনো গাড়ির সংখ্যা প্রায় ৩ হাজার ৮১১টি।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, মিরপুর-যাত্রাবাড়ী, মিরপুর-গুলিস্তান, গাবতলী-সায়েদাবাদ, ধূপখোলা-মোহাম্মদপুর, চিটাগাং রোড-মোহাম্মদপুর, টঙ্গী-সায়েদাবাদ, সদরঘাট-টঙ্গী, সদরঘাট-রামপুরা_ এসব রোডে চলাচলকারী গাড়ির সংখ্যা প্রায় দুই হাজার। এসব গাড়ির ৯০ শতাংশই ২০ বছরের পুরনো। গবেষণা প্রতিষ্ঠানের হিসাবে এই রোডগুলোতে প্রতিদিন যাতায়াতকারী যাত্রীর সংখ্যা প্রায় আট লাখ। এসব গাড়ি লোকাল ও স্বল্প ভাড়ায় চলাচল করায় এর যাত্রীরাও বেশিরভাগ নিম্নবিত্তের। এসব পুরনো গাড়ি বন্ধ করে দিলে চরম বিপাকে পড়বে নিম্নবিত্তের মানুষ। সর্বশেষ ‘অপারেশন ক্লিন স্ট্রিট’ এর বড় উদাহরণ।
বাংলাদেশ সড়ক দুর্ঘটনা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক শাসসুল হক সমকালকে বলেন, নতুন গাড়ি রাস্তায় না নামিয়ে পুরনো গাড়ি তুলে দেওয়ার অভিযানের ফল ভালো হবে না। তিনি বলেন, অতীতে আরও তিনবার এমন অভিযান হয়েছে। কিন্তু প্রতিবারই উল্টো ফল হয়েছে। নিম্ন ও মধ্যবিত্তের মানুষের দুর্ভোগ বেড়েছে। শাসসুল হক বলেন, আগে বিকল্প ব্যবস্থা করতে হবে তারপর পুরনো গাড়ি তুলতে হবে। তিনি বলেন, বিকল্প ব্যবস্থা না করে পুরনো গাড়ি তুলে দেওয়া হলে রাজধানীর গণপরিবহন ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে। প্রাইভেট কার সহজলভ্য হওয়ায় ও এর জন্য সহজ শর্তে ঋণ সুবিধা থাকায় মধ্যবিত্ত শ্রেণী ব্যক্তিগত গাড়ির প্রতি ঝুঁকবে। ফলে যানজট, পরিবেশ দূষণ, জ্বালানি ব্যয় বাড়বে।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান ডবি্লউবিবির প্রকল্প কর্মকর্তা মারুফ রহমান সমকালকে বলেন, পরিবেশ দূষণ ও যানজট কমাতে পুরনো গাড়ি তুলে দেওয়া হচ্ছে। অথচ এসব পুরনো গাড়ির চেয়ে যানজট ও পরিবেশ দূষণের বেশি দায়ী ব্যক্তিগত ছোট গাড়ি। তিনি পরিসংখ্যান উপস্থাপন করে বলেন, একটি প্রাইভেট কারের চেয়ে একটি বাস প্রতিদিন দেড়শ’ গুণ বেশি যাত্রী পরিবহন করে। কিন্তু স্থান দখল করে মাত্র চারগুণ বেশি। সে হিসাবে মাথাপিছু দূষণ ও যানজট সৃষ্টি দুটিই বেশি করছে এসব প্রাইভেট কার। বাসের তুলনায় জ্বালানি খরচও বেশি করে প্রাইভেট কার।
এদিকে গতকাল পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের একটি সংগঠন ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে এক সংবাদ সম্মেলন করেছে। বাংলাদেশ ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান, লং ভেহিকেল মালিক শ্রমিক ঐক্য পরিষদ নামে এ সংগঠনটি ৬ দফা দাবিতে আগামী ২ আগস্ট থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য পরিবহন ধর্মঘট ডেকেছে।
তাদের দাবিগুলো হচ্ছে_ ঢাকা মহানগরীতে রাত আটটা থেকে সকাল সাতটা পর্যন্ত ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান, লং-ভেহিকেল চলাচলের সুযোগ দেওয়া, গাড়ির মডেলের তারিখ দেখে নয়_ চলাচলের উপযোগী সব ট্রাককে মহানগরীতে চলার অনুমোদন, অভিজ্ঞ ট্রাকচালকদের সহজ শর্তে লাইসেন্স প্রদান, রিকুইজিশনের নামে মালিক-শ্রমিকদের হয়রানি বন্ধ করা, কাগজপত্র পরীক্ষার নামে ট্রাফিক ও হাইওয়ে পুলিশের চাঁদাবাজি-নির্যাতন বন্ধ এবং সকল প্রকার সড়ক দুর্ঘটনার মামলা মোটরযান অধ্যাদেশে নেওয়া।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন বাংলাদেশ ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান, লং-ভেহিকেল মালিক শ্রমিক ঐক্য পরিষদের আহ্বায়ক রুস্তম আলী খান। লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেন, গত ২৪ জুন যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তে আজ ১৫ জুলাই (বৃহস্পতিবার) থেকে ঢাকা মহানগরীতে শুধু রাত ১২টা থেকে ভোর ৫টা পর্যন্ত ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান চলাচল করতে পারবে। এছাড়া ২৫ বছরের পুরনো ট্রাকও ঢাকা শহরে প্রবেশ করতে না দেওয়ার যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে তা অযৌক্তিক। রুস্তম আলী খান বলেন, সরকারের এ ঘোষণার পর থেকে মালিক-শ্রমিকদের মাঝে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। অনেক মালিক আজ থেকেই ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান চলাচল বন্ধ রাখার ঘোষণা দিয়েছেন। আর এর প্রভাব পড়বে দেশের পণ্য পরিবহন সেক্টরে।
লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, ঢাকা মহানগীরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রতিদিন প্রায় সাড়ে নয় হাজার ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান চলাচল করে। এগুলোর চলাচল বন্ধ হয়ে গেলে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে খাদ্য, ওষুধসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য সরবরাহ কার্যত অচল হয়ে যাবে। তাছাড়া দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে মাল বোঝাই করে ঢাকায় এনে রাত ১২টা থেকে ভোর ৫টার মধ্যে মালামাল পরিবহন করে সাধারণ মানুষের চাহিদা পূরণ কোনোভাবেই সম্ভব নয়।
সংবাদ সম্মেলনে মালিক-শ্রমিকরা দাবি করেন, যে দেশে গাড়ির যন্ত্রাংশ বানানো সম্ভব সে দেশে মডেলের অজুহাত দেখিয়ে চলাচল উপযোগী ২৫ বছরের পুরনো ট্রাক বাতিল ঘোষণা করা কোনো যুক্তিসঙ্গত সিদ্ধান্ত নয়। অথচ সরকারের বিভিন্ন দফতরে এখনও শত শত মেয়াদোত্তীর্ণ গাড়ি চলাচল করছে।
নেতৃবৃন্দ বলেন, দেশের বৃহত্তর স্বার্থে পরিবহন শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার তাগিদে তাদের দাবি রাস্তবায়নের জন্য আগামী ২৭ জুলাই পর্যন্ত সরকারকে সময় দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে এসব দাবি মানা না হলে ২ আগস্ট থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য পরিবহন ধর্মঘট পালিত হবে।
এদিকে গতকালের সংবাদ সম্মেলনে একাধিক মালিক আজ (বৃহস্পতিবার) থেকেই ধর্মঘট পালনের জন্য দাবি জানাতে থাকেন। এ সময় সংবাদ সম্মেলনে কিছুটা উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। পরে পরিষদের নেতৃবৃন্দ মালিক-শ্রমিকদের ধৈর্য ধরার আহ্বান জানান। এ প্রসঙ্গে পরিষদের আহ্বায়ক রুস্তম আলী খান সমকালকে বলেন, আমরা ন্যায়সঙ্গতভাবে সরকারের কাছে আবেদন জানিয়েছি। এ ব্যাপারে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে গত ১২ জুলাই ছয় দফা দাবির আবেদনও পাঠানো হয়েছে। সরকার দাবিগুলো বিবেচনায় নিয়ে মালিক-শ্রমিকদের প্রত্যাশা পূরণ করবে বলে আশা করেন তিনি।
সংবাদ সম্মেলনে অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন ঐক্য পরিষদের সদস্য সচিব মাহমুদুল আলম মন্টু, বাস-ট্রাক মালিক সমিতির হাজী তোফাজ্জল হোসেন মজুমদার, ঢাকা জেলা ট্রাক মালিক সমিতির হুমায়ুন কবির, আন্তঃজেলা ট্রাকচালক ইউনিয়নের মিল্লাত হোসেন, ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান মালিক সমিতির মাহবুব চৌধুরী সান্টু, আবদুল মোতালেব, আবুল হোসেন, মনির তালুকদার, বখতিয়ার সারোয়ার ও মিরাজুল ইসলামসহ মালিক-শ্রমিকরা।
এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার একেএম শহীদুল হক গতকাল বলেছেন, রাজধানীতে পুরনো বাস-মিনিবাস তুলে নিতে যে বিশেষ অভিযান শুরু হচ্ছে তা সর্বাত্মক সফল করা হবে। এ লক্ষ্যে ডিএমপির পক্ষ থেকে সব প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। মহানগর পুলিশের প্রতিটি বিভাগের ডিসি, এডিসি ও ট্রাফিক বিভাগের কর্মকর্তারাও আজ রাস্তায় থাকবেন। গতকাল বুধবার সকালে সরকারি পরিবহন পুলের কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এক আলোচনা সভা শেষে তিনি সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে ডিএমপি কমিশনার একেএম শহীদুল হক এসব কথা বলেন।

সমকাল প্রতিবেদক ১৫-০৭-২০১০