বাল্যকালে চন্দ্রাবতীর বন্ধু ও খেলার সাথী ছিলেন জয়ানন্দ নামের এক অনাথ বালক৷ জয়ানন্দের নিবাস সুন্ধা গ্রামে৷ জয়ানন্দ তাঁর মাতুলগৃহে পালিত৷ দ্বিজ বংশীদাসের অনেক রচনায় এই দুজনার রচিত ছোট ছোট অনেক পদ রয়েছে৷ কৈশোর উত্তীর্ন হলে দুজনে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হবেন বলে স্থির করেন ৷ বিবাহের দিনও স্থির হয়৷ ইতিমধ্যে জয়ানন্দ অন্য এক রমনীর প্রেমে পড়ে যান৷ স্থানীয় মুসলমান শাসনকর্তা বা কাজীর মেয়ে আসমানীর অসামান্য রূপে মুগ্ধ হয়ে জয়ানন্দ আসমানীকে একাধিক প্রেমপত্র লেখেন৷ এই ত্রিকোন প্রেমের ফলাফল হয় মারাত্মক৷ জয়ানন্দের সাথে চন্দ্রাবতীর প্রেমের কথা জেনেও আসমানী তার পিতাকে জানান তিনি জয়ানন্দকে বিবাহ করতে চান৷ কাজী জয়ানন্দকে বলপূর্ববক ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত করে আসমানীর সঙ্গে তার বিবাহ দেন৷ ঘটনাটি ঘটে যেদিন জয়ানন্দ ও চন্দ্রাবতীর বিবাহের দিন স্থির হয়েছিল সেই দিন৷ সেদিন সন্ধ্যাবেলা চন্দ্রাবতী বিবাহের সাজে পিত্রালয়ে বসে ছিলেন৷ তখনই সংবাদ পেলেন জয়ানন্দ ধর্মান্তরিত হয়ে অনত্র্য বিবাহ করেছেন৷

এরপর শুরু হয় চন্দ্রাবতীর বিরহ বিধুর জীবন৷ তিনি পিতার কাছে অনুমতি নেন যে সারা জীবন অবিবাহিত থেকে তিনি শিবের সাধনা করবেন ৷ তাঁর পিতা তার জন্য একটি শিবের মন্দির নির্মান করিয়ে দেন৷ সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ চন্দ্রাবতীর কৈশোরকাল থেকেই ছিল ৷ তিনি বাকী জীবন শিবের উপাসনা ও সাহিত্যচর্চা করে কাটাবেন বলে স্থির করেন৷ ইতিমধ্যে বেশ কিছুকাল পরে জয়ানন্দ বুঝতে পারেন যে, আসমানীর প্রতি তার টানটা ছিল মোহ মাত্র ৷ মনের থেকে তিনি চন্দ্রাবতীকেই প্রকৃত ভালবাসেন৷ জয়ানন্দ স্থির করেন যে চন্দ্রাবতীকে তাঁর মনের কথা জানাবেন৷ আবার অনেক গবেষকের মতে জয়ানন্দ এসেছিলেন চন্দ্রাবতীর কাছে দীক্ষা নেবার জন্য৷

এক সন্ধ্যায় জয়ানন্দ ও চন্দ্রাবতীর বিচ্ছেদ হয়েছিল৷ অপর সন্ধ্যায় সেই বিচ্ছেদ মুছে গিয়ে মিলন হবে দুজনার এই আশায় জয়ানন্দ রওনা দিলেন পাটোয়ারী গ্রামে ৷ জয়ানন্দ যখন গন্তব্যস্থলে পৌঁছলেন তখন সূর্য্যাস্ত হয়ে গেছে, তখন দিন ও বাত্রির সন্ধিক্ষন৷ শিব মন্দিরের ভেতর দ্বার রুদ্ধ করে সন্ধ্যারতি ও তপজপে নিজেকে নিবদ্ধ করেছেন চন্দ্রাবতী৷ জয়ানন্দ মন্দিরের দ্বারে এসে কয়েকবার ডাকলেন চন্দ্রাবতীকে৷ কিন্তু দ্বার রুদ্ধ থাকায় এবং একাগ্রমনে ধ্যানে নিমগ্ন থাকায় সেই শব্দ প্রবেশ করল না চন্দ্রাবতীর কানে৷ ব্যার্থ প্রেমিক জয়ানন্দ তখন লালবর্ণের সন্ধ্যামালতী ফুল দিয়ে মন্দিরের দ্বারে চারছত্রের একটি পদে চন্দ্রাবতী ও ধরাধামকে চিরবিদায় জানিয়ে সেখান থেকে প্রস্থান করেন৷

অনেক পরে মন্দির থেকে বেরিয়ে চন্দ্রাবতী বুঝতে পারেন যে দেবালয় কলুসিত হয়েছে৷ দ্বার পরিষ্কার করার জন্য তিনি কলসী কাঁধে জল আনতে যান পার্শ্ববর্তী ফুলেশ্বরী (স্থানীয় নাম ফুলিয়া) নদীতে৷ ঘাটে পৌঁছেই চন্দ্রাবতী বুঝলেন সব শেষ৷ ফুলেশ্বরীর জলে নিজেকে নিমগ্ন করে প্রাণত্যাগ করেছেন জয়ানন্দ৷ প্রাণহীন দেহ ভাসছে ফুলেশ্বরীর জলে৷ এই অবস্থায় নিজের আবেগ ধরে রাখতে পারলেন না চন্দ্রাবতী৷ তিনিও প্রেমিকের সাথে পরলোকে চিরমিলনের কামনায় ফুলেশ্বরীর জলে ডুবে প্রাণত্যাগ করেন।

জয়ানন্দের গ্রাম সুন্ধা খুঁজে পাওয়া যায়নি৷ তবে ইতিহাসের স্মৃতি বিজড়িত পাটোয়ারী গ্রাম আজও আছে৷ কিশোরগঞ্জ শহর থেকে উত্তর পূর্ব্ব দিকে মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরে৷ আর আছে ফুলেশ্বরী নদীর ধাবে চন্দ্রাবতীর পূজিত শিব মন্দির৷

২৭ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যা ৭ টায় শিল্পকলা একাডেমীর জাতীয় নাট্যমঞ্চে ময়মনসিংহ গীতিকা নাট্যোৎসব – ২০১৪ উপলক্ষ্যে কিশোরগঞ্জের প্রখ্যাত নাট্য ব্যাক্তিত্ব ধনেশ চন্দ্র পন্ডিতের নির্দেশনায় শিকড় নাট্য সম্প্রদায়ের দূর্দান্ত এক উপস্থাপন ছিলো – চন্দ্রাবতী ।