আজ ময়নার মেয়ের বিয়ে। আয়োজন নিয়ে মহা ব্যস্ত সে। এক মুহূর্ত অবসর নেই। মেয়েটাকে কিনে এনেছিল বৈশাখী মেলা থেকে। সেই থেকে ওর সংসারেরই সদস্য সে। নিজের সাথে মিলিয়ে নাম রেখেছে গয়না। তারপর চিকচিকে জরির একটি গয়না পরিয়েও দিয়েছিল গলায়। কিন্তু সেটা যে কবে উধাও হয়ে গেল, তা বলতেই পারছে না ময়না। এমনকি মেয়েটাও মুখ ফুটে বলছে না যে কেউ গলা থেকে খুলে নিয়েছে, নাকি খেয়ালের বশে নিজেই হারিয়ে ফেলেছে। না না, গয়না কথা বলতে পারে না এমনটি নয়। প্রতিদিনই ময়নার সাথে কত্ত কথা হয়। অবশ্য শব্দ করে কিছুই বলতে পারে না সে। শত হলেও পুতুল তো! তাই ওর মনের ভাষা বুঝে নিতে হয় ময়নাকেই। এর জন্য কোনো দুঃখ নেই ময়নার। কারণ সে জানে পুতুলরা কখনো কথা বলতে পারে না। তবে মায়ের কাছে তাদের থাকে হাজারো আবদার। এই যেমন খাইয়ে দাও, পরিয়ে দাও, আদর করো, ঘুম পাড়িয়ে দাও। এসবের কোনো কাজই বাকি রাখে না ময়না। একেবারে খাওয়া থেকে শুরু করে ঘুম পাড়ানো পর্যন্ত সবকিছু সে-ই দেখাশোনা করে।

এমন আদুরে মেয়েকে বিয়ে দিতে কিছু তো খারাপ লাগছেই ময়নার। খারাপ লাগলেই আর কী? মেয়ে যেহেতু আছে আজ নয় কাল বিয়ে তো দিতেই হবে। তবে এত বিচ্ছেদ-বিরহের মাঝেও বেশ আনন্দই হচ্ছে ওর। কারণ পাত্র হিসেবে পারভিনের ছেলেটা একেবারে রাজপুত্র। আর সবচেয়ে বড় কথা হলো পারভিনের সাথে একটা সম্বন্ধ তৈরি হোক, এমনটাই চাইছিল সে। হঠাৎ সে দিন বলা নেই, কওয়া নেই পারভিনই প্রস্তাব করে বসল ময়নার সাথে সই পাতবে। আর যায় কোথায়, দু’জনে মিলে ঠিক করল দিনক্ষণ। আরো ঠিক করল এই দিনেই হবে ওদের পুতুল বিয়ে। এতে নিজেদের মাঝে সম্পর্কটা আরো গাঢ় হবে। ব্যস, যেই কথা সেই কাজ।

আজ সেই কাক্সিত দিন। মহা ধুমধামে চলছে আয়োজন। ময়নার সখীরা সবাই উপস্থিত। উপস্থিত এক দঙ্গল ছেলেমেয়েও। বাঁশের কঞ্চি আর পাতার ছাউনি দিয়ে তৈরি করা হয়েছে প্যান্ডেল। একে ঘিরেই সবার ব্যস্ততা। এই বাটনা বাটরে, কুটনা কুটরে…। একটু বড়সড় টোপায় (খেলনা পাতিলে) ভাত চড়িয়েছে ময়না। টোপার ভেতরে যে ভাতের বদলে বালি ভর্তি, এ খবর কারো অজানা নয়। কিন্তু তবুও সবাই উদগ্রীব হয়ে আছে কখন রান্না শেষ হবে, তারপর বর আসবে। আর ক্বল-অ, ক্বল-অ ধরনের অদ্ভুত শব্দ করে খাওয়ার ভান করবে সবাই। সেই সাথে হবে ময়না-পারভিনের সই পাতাপাতি। দু’জনের মাঝে তৈরি হবে নতুন একটি সম্পর্ক। প্রতিজ্ঞা করবে পরস্পরের সুখ-দু:খ, হাসি-কান্নার অংশীদার হওয়ার। বন্ধুত্ব গড়ার সেই আনুষ্ঠানিক মুহূর্তটিকে ত্বরান্বিত করতেই এত ব্যস্ততা। আশপাশের ঝোপে বাজার করছে কয়েকজন। এরই মাঝে কাল্পনিক নানা কেনাকাটা করে ফিরেও এসেছে দুলাল। ওর ঝুলি ভর্তি ইটের সুড়কির মাংস, পাতার মাছ আর নানা ধরনের তরকারি। মেলা থেকে কিনে আনা টিনের বঁটি দিয়ে তরকারি কাটায় ব্যস্ত হয়ে গেল একজন। তারপর চুলায় ফুঁ দাওরে, আগুন জ্বালরে…।

অবশেষে রান্নাবান্না শেষ হলো ময়নাদের। এরই মাঝে খবর এলো বরযাত্রা শুরু গেছে। এক অনাবিল আনন্দে ভরে উঠল সবার চোখ। এবার ওরা ব্যস্ত হয়ে উঠল গয়নাকে নিয়ে। ইস্ লাল টুকটুকে শাড়ি পরে আছে ও। একদম চুপ মেরে বসে আছে। ময়নাও দৃষ্টি ঘুরালো ওর দিকে। ভেতরটা কেমন মোচড় দিয়ে উঠল।

এলোমেলো বাদ্যের শব্দে কানে তালা লাগার মতো অবস্থা। বরযাত্রীদের মাঝে বেশ কয়েকটি ছেলের গলায় ঝুলানো রয়েছে ঢোল। কোরবানির গরুর পর্দা ভাঙা কলসের মুখে সেঁটে প্রতি বছরই ওরা এগুলো তৈরি করে। তারপর যখন ইচ্ছা তখন বাজায়। আজ কচুর ডাঁটা দিয়ে এমনভাবে বাজাচ্ছে যেন ঢোল এবং কানের পর্দা ফাটিয়েই ছাড়বে। কাছাকাছি চলে আসতেই পারভিনের ছেলেটাকে দেখতে পেল ময়না। ইস্ কি সাজে সেজেছে ও! রাজপুত্র যে একেবারে রাজপুত্রের মতোই। মাথায় টোপর, গলায় পুঁথির মালা।
আসছে ঘোড়ায় চড়ে। আর ঘোড়াটা দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে বিয়ারিংয়ের গাড়িতে। সবাই বিপুল উৎসাহে টেনে নিয়ে আসছে গাড়িটাকে। কনে পক্ষের তৈরি পাট শোলার তোরণের সামনে এসে থামতেই হলো ওদের। তারপর দরকষাকষি। অবশেষে কাঁঠালপাতার টাকা বিনিময়ের মাধ্যমে সমঝোতা।

তোরণ উন্মুক্ত করে দাঁড়ালো ময়নারা। রাজপুত্রের মতো বর প্রবেশ করল পাতার ছাউনিতে। কোরাস তুলল এক দঙ্গল ছেলেমেয়ে ‘চম্পা ফুলের গন্ধে/জামাই আইছে আনন্দে/চম্পা ফুলের সুবাসে/জামাই আইছে আহাসে…’