তীরের দিকে ছুটে আসছে সমুদ্রের ঢেউ, সেই ঢেউয়ের মাথায় দাঁড়িয়ে আছে এক অদম্য তরুণ। অবলীলায় ঢেউয়ের পর ঢেউ পেরিয়ে অনন্ত জলরাশির দিকে ছুটে যাচ্ছে তরুণটি। বিদেশি কোনো স্পোর্টস চ্যানেলে এ রকম দৃশ্য হয়তো দেখা যায়, কিন্তু আমাদের দেশে?হ্যাঁ, সম্ভব। এ রকম একটি দৃশ্য আমাদের চোখের সামনে সম্ভব করে তুলেছেন জাফর। কক্সবাজার শহরের দক্ষিণ বাহারছড়ার ফারুক আহমদ আর গোলবাহারের ছেলে জাফর আলম। বাড়ির পাশে সমুদ্র, তাই পুকুর বা নদীতে নয়, বঙ্গোপসাগরে সাঁতার কেটে বেড়ে উঠেছেন তিনি।

প্রায় ১২ বছর আগের কথা। তখনো সার্ফিং শব্দটির সঙ্গে পরিচয় ঘটেনি; সৈকতে দাঁড়িয়ে জাফর দেখতে পেলেন এক বিদেশি পর্যটক দুই পায়ে কাঠের টুকরোর মতো কী জানি বেঁধে বড় বড় ঢেউয়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে লাফিয়ে উঠছেন আর নামছেন। মনোমুগ্ধকর সেই দৃশ্য! পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়লেন জাফর। সাঁতার কেটে তাঁর সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার চেষ্টা করলেন। বিদেশি পর্যটক এই অসম লড়াইয়ের যোদ্ধাকে দেখে অবাক। ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, সার্ফিং শিখবেন কি না। জাফর সানন্দে রাজি। অস্ট্রেলীয় ওই পর্যটক সামান্য কটি টাকার বিনিময়ে সার্ফ বোর্ডটি জাফরকে দিয়ে দেন, শিখিয়ে দেন কিছু কলাকৌশল। এরপর শুরু হয় জাফরের আসল লড়াই। সম্পূর্ণ অপরিচিত একটি ক্রীড়াশৈলী আয়ত্ত করার সংগ্রাম। জাফর বললেন, ‘উত্তাল ঢেউয়ে সার্ফ বোর্ডের ওপর দাঁড়িয়ে থাকাটা খুবই কঠিন কাজ। প্রায়ই বোর্ড থেকে ছিটকে পড়তাম। তবু হাল ছাড়িনি।’ কোনো প্রশিক্ষক নেই, দেশে নেই কোনো পূর্বসূরিও, তাই দীর্ঘ পাঁচ বছর একান্তে সাধনা করে খেলাটি আয়ত্তে আনলেন জাফর।

শুধু নিজে শিখলে তো হবে না, সঙ্গী-সাথি ছাড়া আর যা-ই হোক, খেলাধুলা অসম্ভব। তাই ২০০২ সালে গড়ে তুললেন ‘সার্ফিং বাংলাদেশ’ নামের একটি সংগঠন। শুরুতে সদস্য হলেন পাঁচজন। দলে মেয়েও ছিলেন একজন। কাঠমিস্ত্রি আবদুস সালামের ষোড়শী কন্যা নাহিদা আকতার। সার্ফিং বাংলাদেশের সদস্য হয়ে জাফরের উৎসাহ ও সহযোগিতায় ঢেউয়ের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার সাহস ও সামর্থ্য অর্জন করেছেন বাঙালি ‘অবলা’টিও।

২০০৪ সালে আমেরিকার হাওয়াই দ্বীপ থেকে কক্সবাজার সৈকতে সার্ফিং করতে আসেন ‘সার্ফিং দ্য ন্যাশনস’-এর প্রেসিডেন্ট টম বাউয়ার ও তাঁর তিন সঙ্গী। সৈকতে জাফরের সার্ফিং প্রশিক্ষণ দেখে বিস্মিত হন বাউয়ার। বাংলাদেশি সতীর্থদের জন্য শুভেচ্ছা হিসেবে দিয়ে যান তিনটি সার্ফ বোর্ড। বলেছিলেন, আবার আসবেন তাঁদের এগিয়ে যাওয়া দেখতে। সেদিন টম বাউয়ারের সঙ্গে পরিচয় না হলে হয়তো সবার অগোচরেই থাকতেন জাফর। অজানা থাকত বাংলাদেশের এক সম্ভাবনার দিগন্ত। শুরুতে পাঁচজন, ২০০৮ সালে ২৫ জন, ২০০৯ সালে ৪০ জন। ধীরে ধীরে সার্ফিং বাংলাদেশের পরিধি বিস্তৃত হতে থাকল। বর্তমানে ১৩০ জনের মধ্যে মেয়ে সার্ফারের সংখ্যা ৩৫ জন।

এদিকে নিজেকে আরও পরিণত করে তুলেছেন জাফর। ২০০৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াই দ্বীপে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক সার্ফিং
প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে বিভিন্ন দেশের ১৩০ জন প্রতিযোগীর মধ্যে ষষ্ঠ স্থান অধিকার করে চমকে দিয়েছেন সবাইকে। আর ২০১০ সালে ১৭০ জন প্রতিযোগীর মধ্যে তাঁর স্থান তৃতীয়।

এবার তাঁর দৃষ্টি নিবদ্ধ প্রথম স্থানটির দিকে। সবচেয়ে বড় কথা, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে জাফরের সাফল্যের সঙ্গে তাঁর দেশটির কথাও জানছে সবাই। বাংলাদেশ নিয়ে কৌতূহলী হয়ে উঠছেন পর্যটকেরা। জাফর বলেন, ‘সার্ফিং বাংলাদেশ’ লেখা টি-শার্ট পরে আমেরিকায় ঘোরাফেরা করার সময় অনেকেই জিজ্ঞেস করেছেন, বাংলাদেশে সার্ফিং হয়? ওখানে সাগর আছে? আমেরিকার বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় সার্ফার জাফরের সচিত্র প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে, যেখানে পর্যটকদের প্রতি ছিল বাংলাদেশ ভ্রমণের উদার আমন্ত্রণ।

জাফর বাংলাদেশে সার্ফিংয়ের অমিত সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করে বললেন, ‘আমেরিকার হাওয়াই, ইন্দোনেশিয়ার বালি এবংশ্রীলঙ্কার অর্গম বে-তে সার্ফিং করেছি। কিন্তু আমাদের কক্সবাজারের সঙ্গে এর কোনোটিরই তুলনা হয় না। যেমন, হাওয়াইতে পানির নিচে প্রচুর প্রবাল পাথর, শরীর কেটে যায়। ঢেউ বড় হলেও সব জায়গাতে ঢেউ ওঠে না। অন্য সৈকতগুলোতেও নানা সমস্যা। কিন্তু কক্সবাজার সৈকত বালুতে ভরা। এ সমুদ্রে ঢেউয়ের আকৃতি যেমন বড়, তেমনি তার তীব্রতাও বেশি।কক্সবাজারের এ সুযোগ-সুবিধার কথা বিদেশে প্রচার করা গেলে এই খাত থেকে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব।’

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী, জানতে চাইলে জাফর বললেন, ‘কক্সবাজারে একটি সার্ফিং একাডেমি করার ব্যাপারে সরকারি-বেসরকারি সাহায্য পাওয়া গেলে যেমন অনেক তরুণকে প্রশিক্ষণ দেওয়া সম্ভব, তেমনি অবকাঠামোগত সুবিধা পেয়ে বিদেশি পর্যটকেরাও ভিড় করবেন এখানে। এখনই সার্ফিং করতে অনেকে আসছেন, কিন্তু তাঁদের জন্য কোনো নির্দেশিকা নেই, যোগাযোগ করার কোনো ঠিকানা নেই।’

১৯৮২ সালের ১৯ মার্চ জন্ম জাফরের। দারিদ্র্যের কারণে বেশি দূর লেখাপড়া করতে পারেননি। সার্ফিং বোর্ডে চেপে নিজের সেই সীমাবদ্ধতাকে পেরিয়ে যেতে চান তিনি। বিশাল সমুদ্রে ঢেউয়ের মাথায় দাঁড়ানো জাফর হতে পারেন বাংলাদেশের পর্যটনের সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপন। এই অদম্য তরুণকে দেখে কবিতার সেই পঙিক্তগুলোই গুঞ্জরিত হয় মনে—‘সাগর যাহার বন্দনা রচে শত তরঙ্গ ভঙ্গে/ আমরা বাঙালি বাস করি সেই বাঞ্ছিত ভূমি বঙ্গে/ বাঘের সঙ্গে যুদ্ধ করিয়া আমরা বাঁচিয়া আছি/ আমরা হেলায় নাগেরে খেলাই নাগেরি মাথায় নাচি’।

Prothom Alo