বৈশাখের বিভিন্ন রুপ দেখেছি, মারাত্বক ভয় পেয়েছি, কি ভীষন অভিজ্ঞতা, বৈশাখ মাসে কাল বৈশাখীকে সবাই ভয় পায়, ভয়ংকর রুপে আবির্ভূত তার তান্ডব লীলা। কিন্তু এই অভিজ্ঞতা সকল ভয়ংকর কে যে হার মানায় তা নিশ্চিত। পহেলা বৈশাখে নতুন বছর কে বরণ করা দেখতে গিয়েছিলাম-আমি, সোহেল, বাবুল আমরা তিন বন্ধু, আমরা তিনজনই আমাদের কারো বাসায় কাউকে না বলেই রওনা হয়ে গিয়েছিলাম-রমনার বটমূলে নববর্ষের অনুষ্ঠান দেখার জন্য। অনেক দিন শুনে এসেছি ছায়ানট নামের একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন বিশাল আয়োজন করে থাকে রমনার বটমূলে। নতূন বছর কে বরণ করার জন্য সেই আকর্ষনীয় অনুষ্ঠান সরাসরি উপভোগ করার লোভ সামাল দিতে পারিনাই, আমারা কেউই জানতাম না জানত আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল অনেক বড় এক অশনী সংকেত।

আমি বাসায় কাউকে না বলেই পূর্ব পরিকল্পনা মোতাবেক ফজরের নামাজ শেষ করে বাসা থেকে বের হই। সোহেলের বাসার নিচে গিয়ে দেখি সোহেলও আমার উদ্দেশ্যে বাসা থেকে বেরুচ্ছে-দুই বন্ধু মিলে বাবুলের টি,এস,সির সামনে অপেক্ষা করলাম। অনেকক্ষন অপেক্ষার পর বাবুল এসে গেলো-এসেই বলল দোস্ত’ আমাদের অনেক দেরি হয়ে গেছে, তাড়াতাড়ি চলো নাহলে সামনে বসতে পারবোনা আমরা বললাম হ্যাঁ চলো। তখনও ভোরের আলো সারা আকাশ জুড়ে পরিস্কার করেনি এই পৃথিবীটাকে।

হীম শীতল বাতাস প্রকৃতিকে আরো আকর্ষনীয় করে তুলছিল। নতুন বছরেও শুরুতে মনের মধ্যেও মৃদু তরঙ্গ বইছিল আগামীর। আমরা তিন বন্ধু মিলে হাঁটছিলাম সামনের দিকে রমনার বটমূলের উদ্দেশ্যে। হাটঁতে হাটঁতে আমরা তিন বন্ধু যখন রমনা পার্কে পৌঁছায় তখন মাইকে টুং টাং শব্দ হচ্ছিল-দুর থেকে মিষ্টি কন্ঠে নববর্ষের আহব্বান জানিয়ে-
“এসো হে বৈশাখ এসো এসো”

গান করছিল একদল শিল্পী। আমরা তিন বন্ধু মিলে মূল মঞ্ঝের অনেক পিছন থেকে বাম দিক দিয়ে সামনের দিকে এগুচ্ছিলাম কাছে আসার জন্য। হঠাৎ শুনলাম গুড়ুম গুম শব্দ, চারিদিক ছুটোছুটি অফ! একি ভয়ানক আতংক।

কি হয়েছে কিছু বুঝার আগেই মনে হলো আমি মাথা ঘুরিয়ে পড়ে গেলাম,আমকে কেউ লাথি মারছে,আমার বুকের উপর দিয়ে যে যেভাবে পারে দৌড়াচ্ছে, ছুটাছুটি করছে। কোথায় সোহেল? কোথায় বাবুল? এই কি? কে শুনে কার কথা,তারপর কিছুই মনে নেই-যখন জ্ঞান ফিরলে তখন নিজেকে আবিস্কার করলাম ঢাকা মেডিকেলের বারান্দায়।তখন বাজে রাত দশটা, আমার মত শ-খানেক লোক ছেলে বুড়ো শুয়ে আছে,কাতরাচ্ছে মাগো বাবাগো বলে।ডাক্তার নার্স কিছু অপরিচিত লোকে কানের কাছে শো শো ভোঃ ভোঃ শব্দ কাছে এসে জানতে চাইলো এই ছেলে তোমার নাম কি? বাসা কোথায়? বাসার ফোন নাম্বার কত? কাকে ফোন দিব ইত্যাদি।

আমি কিছু বলার আগেই আবার জ্ঞান হারিয়ে ফেলি।আবার যখন জ্ঞান ফিরে তখন জানতে পারি-আমি যেখানে পড়ে ছিলাম তার ১৫-১৭ ফিট দূরেই পর পর তিনটি বোমা ফোটেছিল। আমি ছিটকে পড়েছিলাম,আর উপর দিয়ে আতংকিত লোকজন দৌড়ে হেঁটে প্রানে বেঁচেছিল। মাটিতে পড়ে আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি এবং পুলিশ ও কিছু অপরিচিত লোক আমাকে মুমুর্ষ অবস্থায় ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে আসে।

অনেক রাতে যখন আবার আমার জ্ঞান ফিরে তখন কর্তব্যরত ডাক্তার কে আমার বাসার ঠিকানা দেই। পরবর্তীতে কিছুক্ষন পর বাবা আসেন। আমাকে স্যালাইন দিয়ে রাখা হয়েছিল আমার কিছুই মনে নেই। আমি শুধু সোহেল কোথায় ? বাবুল কোথায় করছিলাম।পরে জানতে পারি ওদের কিছুই হয়নি। বোমা ফাটার শব্দে ওরা পিছন থেকে দৌঁড়ে গিয়ে নিরাপদ স্থানে চলে গিয়েছিল। সারা দিন আমার জন্য রমনা এলাকায় ছুটাছুটি করেছে। এদিক ওদিক খুঁজেছে, ভয়ে বাসাতেও জানায়নি। ভেবেছে হয়তো কিছুক্ষনের মাঝেই দেখা হবে এদিক ওদিক কোথায় আছি। তাদেরও কেটেছে লোমহর্ষক মুহুর্ত শুধু ওরাই জানে। ওরাতো ভেবেছিল আমি বোধ্য মরেই গেছি, কিন্তু না আমি মরিনি আমার খুব বেশি ক্ষতি হয়নি। আর যারা পা হারিয়েছে, যাদের মাথা ফেটেছে, বুকের রক্ত ঝরেছে তাদের কে খুব কাছে থেকে দেখেছি ঢাকা মেডিকেলে।

যদিও বাবা আমাকে পরের দিন বাসায় নিয়ে চলে আসেন। তার পরও মানুষের কি ভীষন অসহায়ত্ব, ভয় আতংক, খুব কাছে বলেই এখনও বৈশাখের আগমনের অনুষ্ঠান “নববর্ষ বরণ” এর ২০০১ সালের রমনা বটমূলের বোমা হামলার অগ্নিস্বাক্ষী হিসেবে সেই পহেলা বৈশাখের কথা মনে পড়ে-তখন মনে হয় সেই নতুন বছরের মত আমিও নতুন জীবন পেয়েছিলাম এক আচমকা তান্ডব হতে। মৃত্যুর ঘন্টা খুব কাছাকাছি এসেও ফিরে গেছে , আজও একে একে নতুন রঙ্গে- ঢঙে বৈশাখ  আসে আর আমার কেবলই মনে হয় আমি সত্যিই খুব ভাগ্যবান।

রাজকুমার