শহরের ব্যস্ততা এখানকার মানুষকে স্পর্শ করতে পারেনি। রেল-লাইন বা পীচ ঢালা কালো রাজ-পথ দেখা এখানকার মানুষদের জন্য অলৌকিক কিছু। আর বিমান! সেতো কল্পনাতীত ব্যাপার। উঁচু-নিচু মেঠো পথ, কোনটা প্রান্ত ছোঁয়ার আগেই বুরো ক্ষেতে কাঁদায় গড়াগড়ি খেয়ে অথবা নোঙড়া পানিতে পরনের ত্যানা ভিজে নতুন করে চলার প্রেরণা পায়। ঝাড় বাতি দূরে থাক দুটো তারের সয়যোগ স্থলে আলো জ্বলে, এমনটি ভৌতিক ব্যাপার ছাড়া কিছু নয়।

ফ্রিজ-এসি-দূরদর্শনতো ভাবাতো দিনে তারা দেখা মাত্র। সারাদিনের শ্রমে কান্ত হাড্ডিসাড় দেহ গুণা যায় বুকের পাঁজর, অর্ধাহারে কি বা অনাহারে খর-কুটার মত বয়ে চলা জীবনের কথা ভেবে দুঃখ ও কান্তি জীবন থেকে ধুয়ে ফেলার মিছে ছলে মাটির মানুষ পরম সোহাগে মাটিরে করে আপন ঘুমিয়ে পড়ে স্বজন নিয়ে, কতই শান্ত জীবন। আহা বিধি কতই নিদয়-নিষ্ঠুর, এই কষ্টে কষ্টে য়ে যাওয়া জীবনের শত্রু ঘোর। ভুয়ে গিয়ে দালান-কোটা ইস্পাতের শহর, খড়ের ছানি পাতার বেড়ায় নিয়ে আপন বহর চড়াও হয়, উড়িয়ে দেয়, গুঁড়িয়ে দেয়, থামিয়ে দেয় কষ্টে গড়া জীবনের কোলাহল। বান পাঠায়, প্লাবন পাঠায়, জলোচ্ছ্বাসও হয়, সিডর, নার্গিস আরো কত অভিনব নামে তারে কয়। এখানে সৃষ্টির সাথে স্রষ্টা বৈরী নিত্য মহারোষে।

তবুও মানুষ বাঁচে ॥

তপ্তরৌদ্রে, হাড়কাঁপা শীতে কৃষাণ ফলায় ফসল, কৃষাণীর গা ও সমঘামে ভিজে, পিছপা হয় না দেখে বাদল-ঢল। স্বামী মাড়ায়, ধানের সাথে পাল্লা দিয়ে শাড়ির আঁচলও উড়ে, ধুলো মেখে খেলে শিশুরা তার কত স্বপন নয়ন জুড়ে। পরিজন নিয়ে পুটির ঝোলে খাবে দু‘মুঠো গরম ভাত, অনেক বড় হবে বাছারা, লেখা-পড়ায় নাই কুল-জাত। আহা বিধি বাম, কষ্টে ঝরে ঘাম, ঋণের জ্বালায়, সন্তান সম আদরের ফসল যায় মহাজনের গোলায়। ভিটে-মাটি ছাড়া রিক্ত হস্ত তবুও মনে আশা, সন্তানরা একদিন বড় হবে, ঘুচিবে দূরাশা। নামাজ পড়ে না তবুও তারা আযানের সাথে জাগে, পরের ক্ষেতে শ্রম দিতে হবে, বেচিয়াছে তিন মাস আগে। দারিদ্র্যের ক্রোড়ে লুটোপুটি খায়, তবু বাঁচতে চায় বর্তমান, সুদী-মহাজনেরা রক্ত চুষতে পেতেছে ফাঁদ, করে মহাধ্যান। এখানে ব্র্যাক, প্রশিকা, পল্লী, আশা, পপি ও ইউনুসেরা, নিত্য রক্ত চুষে।

তবুও মানুষ বাঁচে ॥

এই যে দেখছ বুড়ো-বুড়ি জোয়ান ছিল একদিন, চোখের নিমিষে শেষ হয়েছে তাদের সুখের দিন। বিয়ের পরে বছর ঘুরতেই কোলে নামলো আকাশের চাঁদ, আনন্দে আত্মহারা দাম্পত্য যুগল, লোকে চাকিছে বাতাসার স্বাদ। তুলো তুলো করে খাওয়াইয়াছে তারে আদরে বাড়িছে তনয়, আহা বাছার একটু দুঃখও পরাণে তাদের না সয়। এমনি করে মাতা-পিতা বৃদ্ধ, ছেলে হল বড়, ছেলেকে বিয়ে করাবে বলে বান্ধিছে নতুন ঘর। সুশ্রী দেখে শুভ ণে করাইছে তারে বিয়া, বুড়ো-বুড়ি এবার অবসর পাবে, ভেবে আনন্দিত তাদের হিয়া। আহা বিধির খেলা, জমিয়ে সৃষ্টির মেলা, মুখ চেঁপে হাসে, সাদার ভেতর কালোর বাস, ছাই পড়ল তাদের আশে। বিয়ের পরেই পুবের সূর্য পশ্চিম আকাশে উঠে, অবহেলা আর যত অপমান বুড়ো-বুড়ির কপালে জুটে। যে সন্তান কালও মায়ের প্রতি হা করে ছিল লোকে কয়, সে সন্তান আজ কি পাষাণে হায় মা থেকে দূরে রয়। যে হাতে জোয়ান করেছে শিশু, বয়সের ভারে আজ সে হাত কাঁপে, চার হাতে গড়া দুহাত আজ বুড়ো-বুড়ির ঘাঢ়ে চাঁপে। নাড়ী ছেঁড়া ধন হল পর, কথার বন্ধু আপন, এমন জঞ্জাল ঘটবে জানলে কি কেউ রচিত বৃন্দাবন। এখানে বউয়ে জ্বালায় শ্বশুর-শাশুড়িরা বেঁচেও মরে গেছে।

তবুও মানুষ বাঁচে ॥