বাঁশের শলা দিয়ে তৈরি মাছ ধরার ফাঁদের নাম চাঁই। মাছ ও কুঁচে ধরার এ ফাঁদে অসচ্ছলতাকে যেন আটকে দিয়েছেন কিশোরগঞ্জের নিকলী উপজেলার হাওর ইউনিয়ন সিংপুরের নাগরপুর গ্রামের লোকজন। ছোট এ গ্রামের লোকসংখ্যা প্রায় দেড় হাজার। এর মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি মানুষ এ কাজে বিভিন্নভাবে জড়িত। বিভিন্ন এলাকা থেকে ব্যবসায়ীরা এ শিল্পে টাকা খাটানোর জন্য এ গ্রামের চাঁই কারিগরদের কাছে ধরনা দেন।

গ্রামের প্রবীণ তালু মিয়া, আবু তালেব ও আ. আজিজ মিয়ার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সেখানকার হাজি মন্নক মিয়া, হাজি কালো মিয়া ও নসু মিয়া সত্তর বছর আগে নিজেদের প্রয়োজনে বাঁশের তৈরি ঢোলা নদীতে পেতে মাছ শিকার করতেন। এক সময় তাঁরা বিভিন্ন ধরনের চাঁই বানানোর কৌশল রপ্ত করে নেন। এরপর বিষয়টি পুরো গ্রামের মানুষ পেশা হিসেবে গ্রহণ করে। তা-ও আজ থেকে ৫০/৬০ বছর আগের কথা।

কারিগরদের কয়েকজন জানালেন, পাঁচ ধরনের চাঁই বানানো হয় এ গ্রামে। এগুলো হলো: চিংড়ি মাছের চাঁই, শিং মাছের চাঁই, টেংরা মাছের চাঁই, কুঁচে ধরার চাঁই, সাধারণ মাছের চাঁই। বাঁশ ও সুতা এসব বানানোর প্রধান কাঁচা মাল। পাশের জালালপুর, মিঠামইন ও নিকলী বাজারে গড়ে উঠেছে বাঁশের হাট। মোড়ল ও মুলি বাঁশ ছাড়া ভালো চাঁই হয় না। খালিয়াজুড়ি, অষ্টগ্রাম, বাজিতপুর, করিমগঞ্জ, তাড়াইল, মদন, ভৈরব ও কুলিয়ারচর এলাকার পাইকাররা এ গ্রামে এসে নৌকা বোঝাই করে চাঁই নিয়ে যায়। অনেক নৌকাকে ওই গ্রামের ঘাটে চাঁই নেওয়ার জন্য দিনের পর দিন অপেক্ষা করতে দেখা যায়। তাই বাজারজাত করা নিয়ে কারিগরদের মাথা ঘামানোর দরকার পড়ে না।

নদী-নালা, খাল-বিল হাওরের সুবিধা মতো স্থানে রাখা হয়। মাছ পানিতে চলাচল করতে করতে এক সময় চাঁইয়ের মধ্যে ঢুকলে আর বের হতে পারে না। একটি মুলি বাঁশ দিয়ে চারটি চিংড়ি মাছ ধরার চাঁই হয় আর একটি মোড়ল বাঁশ দিয়ে ২৫ টি কুঁচে ধরার চাঁই হয়। মাছ কিংবা কুঁচে ধরার জন্য বিভিন্ন মাপে বাঁশের শলা তুলে এগুলো রোদে শুকিয়ে তারপর শুরু হয় চাঁই তৈরির প্রক্রিয়া। বিভিন্ন ধরনের ফর্মার মধ্যে ফেলে নাইলনের সুতা দিয়ে বাঁশের শলাগুলো সেলাই করে বেড়ার মতো বানানো হয়। আর পলিথিন কাগজ বা প্লাস্টিকের ব্যাগ দিয়ে বেড়া তৈরি হয় চিংড়ি মাছ ধরার চাঁই।

চাঁইয়ের কারিগর আলাউদ্দিন (৭০) বলেন, এ গ্রামে শতাধিক ব্যবসায়ী আছে। তাঁদের অধীনে কাজ করে আট শতাধিক মানুষ। কেউ শলা তোলার কাজ করে, কেউ বা নাইলন সুতা দিয়ে শলা সেলাই কাজ করে। চাঁইয়ের আসল আকৃতি দেন আবার মূল কারিগরেরাই। একটি কারিগর সারা দিনে পাঁচটি চাঁই বানাতে পারে। তাঁর হিসাব মতে, প্রতিবছর এ গ্রামে কম করে হলেও চার লাখ চাঁই তৈরি হয়।

আলাউদ্দিন বলেন, ‘একটি চিংড়ি মাছের চাঁই তৈরি করতে সব মিলিয়ে ৬৫ টাকা খরচ হয়। আমরা বিক্রি করি ৯০ টাকায়। আমি এবার দেড় লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছি। আশা করছি, আমার এবার ৫০ হাজার টাকা লাভ থাকবে। সাধারণ মাছের চাঁই বিক্রি হয় ৭০ থেকে ৭৫ টাকায়, শিং মাছের ৫০ থেকে ৫৫ টাকায় ও টেংরার চাঁই বিক্রি হয় ৬৫ থেকে ৭০ টাকায়।’ কারিগর জুয়েল মিয়া বলেন, ‘মাত্র দুই হাজার টাকা নিয়ে এ ব্যবসায় নেমে আজ আমার নগদ পুঁজিই হয়েছে লাখ টাকার ওপরে।’

সিংপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জহিরুল ইসলাম বলেন, নাগরপুর হলো সিংপুর ইউনিয়নের একটি কুটিরশিল্প গ্রাম। সরকার যদি সুনজর দেয় তবে এ গ্রামের লোকজনকে সবাই সচ্ছল ও স্বাবলম্বী হিসেবেই চিনবে।

নিকলী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. ফজলুর রহমান বলেন, ‘চাঁই গ্রামের মানুষের জীবন কাহিনী শুনেছি। হাওরের সংগ্রামী মানুষের কাছে এ গ্রামের মানুষ যেন এক বাড়তি অনুপ্রেরণা। এ কুটিরশিল্পে সহায়তায় যা দরকার আমি তা করার চেষ্টা করব।’

লিখেছেনঃ দিলীপ কুমার সাহা, নিকলী