ভাটিয়ালী বাংলাদেশের ভাটি অঞ্চলের জনপ্রিয় গান। দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের হাওড়-বাঁওড়বেষ্টিত এক বিশাল ভূ-খণ্ডের- নাম ভাটি অঞ্চল। নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বেশ কয়টি উপজেলা এ জনপদের অন্তর্ভুক্ত। এই অঞ্চলগুলোতেই ভাটিয়ালী গানের মূল সৃষ্টি, চর্চাস্থল এবং সেখানে এ গানের ব্যপক প্রভাব রয়েছে। বাউলদের মতে ভাটিয়ালী গান হলো তাদের প্রকৃতিতত্ত্ব ভাগের গান। ভাটিয়ালী গানের মূল বৈশিষ্টা হলো এ গানগুলো রচিত হয় মূলত মাঝি, নৌকা, দাড়, গুন ইত্যাদি বিষয়ে। সাথে থাকে গ্রামীণ জীবন, গ্রামীণ নারীর প্রেমপ্রীতি, ভালবাসা, বিরহ, আকুলতা ইত্যাদির সম্মিলন।

ষড়ঋতুর বাংলাদেশ হলেও ভাটি অঞ্চলে ঋতু মাত্র দু’টি। একটি বর্ষা, অন্যটি হেমন্ত। বর্ষায় উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ী ঢল আর বৃষ্টির পানিতে ভাটির সকল নদ-নদী ফুলে-ফেঁপে ওঠে। ফলে সমুদ্রাকৃতির এক বিশাল জলাভূমিতে পরিণত হয় ভাটির জনপদ। তখন ভাটির মানুষজন অনেকটা কর্মহীন হয়ে পড়ে। বিস্তৃত জলরাশির ওপর গ্রামগুলো জেগে থাকে দ্বীপের মতো। এ সময় যোগাযোগের জন্য নির্ভর করতে হয় নৌকার ওপর। আবার হেমন্তে দিগন্ত বিস্তৃত বিশাল প্রান্তর জুড়ে চলে চাষাবাদ। ব্যস্ততার যেন আর সীমা থাকে না।

ভাটির মানুষের জীবনসূচীও এর ঋতু বৈচিত্র্যের মতোই ব্যতিক্রম। এখানকার, জীবন-জীবিকা, সমাজ, অর্থনীতি ও সংস্কৃতি_ সবকিছু চলে প্রকৃতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে। তাই সঙ্গত কারণেই ভাটির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যও কিছুটা আলাদা বৈশিষ্ট্য মন্ডিত। বিশ্বখ্যাত ময়মনসিংহ গীতিকার পালাগানসহ ভাটি অঞ্চলে বাউল, ধামাইল, কবিগান, যাত্রাগান ও জারিগান যেমন রয়েছে_ তেমনি রয়েছে ভাটির নিজস্ব কিছু গীতরঙ্গও। যেমন ‘ভাটিয়ালী’ ও ‘সারিগান’। বাংলা লোকগানের এ দু’টি উপাদান ভাটির জনপদের নিজস্ব সম্পদ। হাওড়-বাঁওড় ও নদী-নালাবেষ্টিত ভাটিতেই এসব গানের উৎপত্তি ও বিকাশ।

‘ভাটিয়ালী’ নামকরণের ব্যাখ্যা নানা জনে নানাভাবে করেছেন। ‘ভাটি’ শব্দের আভিধানিক অর্থ_ নদ-নদীর স্বাভাবিক স্রোতের দিক, অথবা উজানের বিপরীত (নিম্নদিক)। অন্যদিকে ভাটিয়ালী শব্দের অর্থ_ সঙ্গীতের রাগিণী বিশেষ (ভাটার স্রোতে নৌকা ভাসাইয়া দিয়া যে রাগিণীতে গান গাওয়া হয়)।

‘বাংলার লোক সাহিত্য’ গ্রন্থে আশুতোষ ভট্টাচার্য বলেছেন, ‘…..একদিকে নদী কিংবা জলাভূমির বিস্তৃতি আর এক দিক দিয়া উহার অলস মন্থর গতি, এই উভয়ের সহযোগেই ভাটিয়ালীর উদ্ভব হইয়া থাকে;

এই অবস্থার মধ্য দিয়াই মাঝি কর্মে যথার্থ অবসর লাভ করিতে পারে, এই অবসরের মুহূর্তই ভাটিয়ালীর পক্ষে অনুকূল মুহূর্ত। সেই জন্য নদীর ভাটিতে নৌকা ছাড়িয়া দিয়া অলস বৈঠাটি এক হাতে স্থির ধরিয়া রাখিয়া মাঝি এই গান গাহে বলিয়াই ইহা ভাটিয়ালী গান’।

অন্যদিকে ‘বাংলাদেশের লোকসঙ্গীত পরিচিতি’ গ্রন্থে সিরাজুদ্দিন কাশিমপুরী বলেন:

‘ভাটিয়ালী একটি সুর_ কথার বাঁধনে কোন বিশেষ গান নহে বলিয়াই আমার ধারণা’।

প্রসঙ্গত, ‘ভাটিয়ালী’ সঙ্গীত শাস্ত্রের একটি রাগীনিরও নাম। শ্রী কৃষ্ণকীর্ত্তন, মঙ্গল কাব্য এবং বৈষ্ণব ও সুফী পদেও ভাটিয়ালী রাগের ব্যবহার আছে। সে যা হোক, এটি স্বীকৃত যে নদীতে ভাটির স্রোতের সঙ্গে নৌকা ভাসিয়ে মাঝি-মালস্নারা যে গান করেন_ সর্বসাধারণের মতে সেগুলোই ভাটিয়ালী গান।

প্রেক্ষাপট বিবেচনায় ভাটিয়ালী গানে ‘নদীর ভাটির টান’ এবং ‘ভাটি অঞ্চল’ উভয়ই গুরম্নত্বপূর্ণ। ভাটি অঞ্চলের মাঝি-মাল্লা শ্রেণীর প্রানজনরাই এ গানের ধারক ও বাহক। নিকট অতীতে নদীবিধৌত ভাটি অঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল সম্পূর্ণ নৌকানির্ভর। তখন উজান স্রোত ও উজান বাতাসে নৌকা চালানো ছিল কষ্টসাধ্য বিষয়। অন্যদিকে ভাটির স্রোতের অনুকূলে নৌকা চালাতে মাঝিদের তেমন বেগ পেতে হতো না। স্রোতের টানে পাল তোলা নৌকা ভাসিয়ে দিয়ে আলতো করে বৈঠার হাল ধরে রেখে ছইয়ের ওপর অনেকটা অলস সময় কাটত মাঝিদের। আর তাই মনের আনন্দে গেয়ে উঠত ভাটিয়ালী গান। মাঝির অলস মুহূর্তের গান বলে এর সুর-লয়ও বিলম্বিত।

বিষয় ও সুরের বৈচিত্র্যতা তেমন না থাকলেও গানগুলোতে ভাবের গভীরতা ও সুরের মাধুর্য ছিল ব্যাপক। প্রায় প্রতিটি গানের সুর করম্নণ, উদাসীন ও বিবাগী। যদিও একক কণ্ঠের গান, তবুও তা মনকে দারম্নণভাবে আন্দোলিত করে, সৃষ্টি করে মধুরতম এক আবেদন। ভাটিয়ালী শোনা মাত্রই চিত্ত নদীতে বয়ে চলে ভাবের তুফান।

ভাটিয়ালী গান মানেই ভাটির প্রকৃতি, প্রেম-বিরহ ও ভাটিবাসীর দুঃখ-বেদনা এবং হতাশা-নৈরাশ্যের প্রতিচ্ছবি। রচনার দিক দিয়ে নিতানত্ম সরল এবং সংক্ষিপ্ত হলেও দূরের নদী বা হাওড় থেকে ভেসে আসা এ গানের সুর মনকে আনচান করে তুলে। হাওড়-নদীর বাতাস ও ঢেউয়ের সঙ্গে মনের গহীন কোণের আবেগ মিশে গিয়ে এক অন্যরকম ভাবালুতার সৃষ্টি করে।

হয়ত এ কারণেই আশুতোষ ভট্টাচার্য বলতে চেয়েছেন,

‘অনত্মরের সুগভীর ভাব ও সূক্ষ্মতম অনুভূতি প্রকাশ করিবার ভাটিয়ালীর যে শক্তি, তাহা বাংলার আর কোন লোকসঙ্গীতে নাই। জীবন-দর্শনের সুগভীর বিষয়সমূহ অতি সহজেই ইহার মধ্যে প্রবেশ করিয়াছে…’।

একদিকে লৌকিক প্রেম, অন্যদিকে আধ্যাত্মিক চেতনা_ এর দুই-ই প্রতিফলিত হয়ে আসছে ভাটিয়ালী গানে। ভাটিতে বিয়ে দেয়া উজানের মেয়ে সারা বছর অপেক্ষায় থাকে কখন বর্ষা আসবে, কখন নাইওর যাবে (বেড়াতে) বাবার বাড়িতে। কারণ হেমন্ত কালে দিগন্ত জোড়া পথ হেঁটে বাবার বাড়িতে যাওয়া সম্ভব হয় না কুলবধূর।

বর্ষার পানিতে নদ-নদী ও হাওড়-বাঁওড় একাকার হয়ে উঠতে দেখে আনন্দে নেচে ওঠে তার মন। আর তখন থেকেই শুরু হয় তার দিন গোনা। দীর্ঘ সময় ধরে মা-বাবার আদর-সোহাগ বঞ্চিত ভাটির বধূর এই অপেক্ষার দিনগুলোকে ভাটিয়ালীর স্রষ্টারা তুলে এনেছেন এভাবে

‘আষাঢ় মাসে ভাসা পানি

পূবালী বাতাসে

বাদাম দেইখ্যা চাইয়া থাকি

আমারনি কেউ আসে…’।

এ গানেরই অন্য কয়েকটি চরণ_

‘…ভাগ্য যাহার ভালরে নাইওর

যায়রে আষাঢ় মাসে

উকিলের হইব নাইওর

কার্তিক মাসের শেষে..’।

এখানে লোককবি বোঝাতে চেয়েছেন- কার্তিক মাস চলে গেলে বর্ষাও শেষ হয়ে যাবে। নদ-নদী বা হাওড়ে আর তেমন নৌকা চলবে না। অন্যদিকে চাষাবাদকে কেন্দ্র করে কৃষক পরিবারগুলোর ব্যসত্মতাও বেড়ে যাবে। আর এ কারণে হয়ত গ্রাম্য বধূর বাবার বাড়িতে নাইওর যাওয়ার লালিত স্বপ্ন এবার পূরণ হবে না। আবার-

‘হায়রে! বন্ধু নাই দেশে

পত্র লইয়া যাওরে কোকিল

আমার বন্ধুর উদ্দেশ্যে…’

এ রকম সহজ সরল মনের আকুতিও প্রকাশ পেয়েছে চির ঐতিহ্যের ভাটিয়ালী গানে।

আবহমান বাংলার নদ-নদী, হাওড়-বাঁওড় যেভাবে দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে, তেমনি অন্যান্য লোকগানের মতো হারিয়ে যাচ্ছে চিরায়ত ঐতিহ্যের ভাটিয়ালী গানও। ভাটির স্রোতের টানে এখন আর আগের মতো সচরাচর পাল তোলা নৌকা চলে না। যান্ত্রিকতা গ্রাস করেছে গ্রামের শান্ত-সুনিবিড় নদ-নদীর রূপ-বৈচিত্র্যকেও। পাল তোলা নৌকার হাল ধরে গান গাওয়ার সময় কোথায় আজ, ভট ভট শব্দের ইঞ্জিনচালিত নৌকা অনেক আগেই পৌঁছে দেয় গন্তব্যে। কিন্তু তাই বলে ভাটিয়ালী সুরের গান ভাটি অঞ্চল থেকে পুরোপুরি নিঃশেষ হয়ে যায়নি আজও। নৌকা বা ছইয়ের ওপর না হলেও, বাউল-বৈষ্ণবদের বৈঠকী গানের আসরে এবং রাখাল-কৃষকদের কণ্ঠে আজও টিকে আছে কিছু ভাটিয়ালী গান।

‘আরে মন-মাঝি তোর বৈঠা নেরে

আমি আর বাইতে পারলাম না

আমি জনম ভইরা বাইলাম বৈঠা রে

তরী ভাইট্যায় বয় আর উজায় না… ‘,

অথবা

‘আরে ও, সুজন নাইয়া

কোন্ বা দেশে যাওরে তুমি

সোনার তরী বাইয়া…’

প্রভৃতি গানগুলো এখনও আমাদের স্মরণ করে দেয় নদীমাতৃক বাংলার কথা। ‘সারিগান’ ভাটি অঞ্চলের আরেক জনপ্রিয় সঙ্গীত ধারা। বিষয়বস্তুর দিক থেকে সারিগানের সাথে ভাটিয়ালীর নিকট সাদৃশ্য আছে। উভয় গান একই ধরণের পেশার সঙ্গে জড়িত। সারিগানও নৌকা-নদী-মাঝিকে আশ্রয় করে রচিত হয়েছে। ভাটিয়ালীর মতো লৌকিক প্রেম, রাধা-কৃষ্ণের প্রেমলীলা ও আধ্যাত্মিকতা সারিগানেও প্রচলিত। তবে সুর-তাল-লয়, আবেগ-উচ্ছ্বাসের মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য পরিলক্ষিত। আগেই বলা হয়েছে- ভাটিয়ালী মাঝি-মাল্লাদের অবসর মুহূর্তের গান- যা একক কণ্ঠে গাওয়া হয়। এর সুরের টান দীর্ঘ, লয় ধীর ও প্রলম্বিত। এতে সাধারণত বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার নেই। সুর করম্নণ। অন্যদিকে সারিগান একটি কর্মসঙ্গীত। কর্মের সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। এটি গাওয়া হয় সমবেতভাবে এবং তাল ও বাদ্যযন্ত্র সহযোগে। এর লয় দ্রুত এবং সুর অনেকটা রসাত্মক ও উৎসাহব্যঞ্জক। ধারণা করা হয়, সারিগান ভাটিয়ালী থেকে প্রাচীন।

ব্যবসা-বাণিজ্যের কাজে বা গনত্মব্যে পৌঁছতে মাঝি-মালস্নাদের যখন গৃহ-সংসার ছেড়ে হাওড় বা নদীবক্ষে কেটেছে দিনের পর দিন তখনই উদ্ভব হয়েছে এ ধরনের গান। ভাটিয়ালীতে হতাশা, বৈরাগ্য বা বিরহ-বিচ্ছেদের সুর প্রতিফলিত হলেও সারিগান তাদের এনে দিয়েছে প্রাণচাঞ্চল্য, কর্মোৎসাহ। তাই একই নৌকায় বা ছইয়ের ওপর বসে কর্মজীবীরা ভাটিয়ালীর সুরে যেমন ডুবেছেন বা মজেছেন, পরক্ষণে আবার কর্মস্পৃহা ফিরে পেতে সমবেত কণ্ঠে সারিগানও গেয়েছেন তারা। ভাটিয়ালীর মতো সারিগানও শুধু নৌকার ছইয়ের ওপর সীমাবদ্ধ থাকেনি। ধান-পাটের ক্ষেত নিড়ানো, ছাদ পেটানো প্রভৃতি কাজেও শ্রমিক শ্রেণীর লোকজন কর্মোদ্দমের তাগিদে সারিগান গাইতেন।

তবে ভাটি অঞ্চলে সারিগান সবচেয়ে বেশি প্রচলিত ‘নৌকা বাইচ’- এ। যা এখনও মাঝে মাঝে অনুষ্ঠিত হয়। নৌকা বাইচে ব্যবহৃত নৌকাকে নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ ও সুনামগঞ্জের ভাটি অঞ্চলে বলা হয় ‘দৌড়ের নাও’। আবার নাও দৌড়ানির জন্য যে গান গাওয়া হয়- তাকে বলা হয় ‘হাইর গান’। প্রসঙ্গত ‘হাইর’ শব্দটি ‘সারি’ শব্দেরই বিকৃত রূপ(সারি>সাইর>হাইর)। এক সময় ভাটির প্রতিটি অঞ্চলে বর্ষাকালে নৌকা বাইচের প্রতিযোগিতা হতো। বিশেষ করে হিন্দু সমপ্রদায় অধু্যষিত এলাকাগুলোতে শ্রাবণী পূজার(মনষা পূজা) পরদিন নৌকা বাইচ ছিল অত্যাবশকীয় অনুষঙ্গ। নদীতে মূর্তি বিসর্জনের পর গ্রামের বা পাড়ার লোকজন একত্রিত হয়ে নেমে পড়তেন নৌকা বাইচে। প্রতিযোগিতার উদ্দেশে বিশেষ ধরণের নৌকাও বানানো হতো গ্রামে গ্রামে। জোতদার বা অবস্থা সম্পন্ন গৃহস্থরা ছিলেন এ সবের প্রধান পৃষ্ঠপোষক। আবার গ্রাম-বাসী চাঁদা তুলেও বানাতেন দৌঁড়ের নৌকা। ময়ূরের রং-এ রাঙানো হতো নৌকাগুলো। হাওড় বা নদীর বুক চিরে নৌকাগুলো যখন ছুটে চলত_ তখন মনে হতো কোন এক ময়ূরী যেন নেচে যাচ্ছে পেখম মেলে।

নৌকা বাইচ অনুষ্ঠিত হয় নির্দিষ্ট কিছু নিয়ম অনুসরণ করে। যেমন: বাইচে যাওয়ার আগেই নির্ধারণ করে দেয়া হয় প্রত্যেকের দায়িত্ব-কর্তব্য। বাইচের দিন ঘাট থেকে ছাড়ার আগে নৌকার গলুই ধুয়ে-মুছে জলঘটসহ তেল ও সিঁদুরের ফোঁটা এঁকে উলুধ্বনি দিয় মঙ্গল কামনা করেন হিন্দু রমণীরা। মুসলমানরা দেন শিরনি-পড়া। পীর-ফকিরদের কিছু তন্ত্র-মন্ত্রও যোগ হয় এ-সবের সঙ্গে। প্রতিযোগিতার সময় নৌকার পাছায় (শেষ প্রানত্মে) বড় বৈঠা নিয়ে থাকেন একজন খাঁড়ালি। নৌকার হাল ধরার মূল দায়িত্বটি বর্তায় তার ওপর। তার অগ্রভাগে বৈঠা হাতে বসেন ছয়জন মূল বাইচা। তাদের সামনে থেকে একেবারে নৌকার আগা পর্যনত্ম সার বেধে পাতি বৈঠা নিয়ে বসেন আরও অনেকে।

নৌকার একেবারে মাথায় বৈঠা হাতে দাঁড়িয়ে পেছনের সকলকে দিক নির্দেশনা দেন একজন। মাঝখানে দাঁড়িয়ে ঝাঁঝ (কাঁসার তৈরি বাদ্যযন্ত্র) হাতে বয়াতী দরাজ গলায় ধরেন সারিগান। মাচায় বসে বাদ্য-বাজনা বাজান আরও কয়েক জন। তদের সঙ্গে সমবেত কণ্ঠে গেয়ে চলেন অন্যান্য বাইচালরাও। প্রত্যেকটি বৈঠা ওঠা-নামা করে সারি গানের তালে তালে। মূলত গানের তালই নিয়ন্ত্রণ করে বাইচালদের। তাদের তালমিশ্রিত বৈঠার টানের ওপরই নির্ভর করে জয়-পরাজয়। গানের সুর কখনও বেতাল হলে অথবা কোন কারণে গান থেমে গেলে সঙ্গে সঙ্গে থেমে যায় বৈঠার টানও। এতে পিছিয়ে যায় নৌকা। বলা যায়, প্রতিযোগিতায় বাইচালদের (মাঝিদের) শক্তি-সাহস ও প্রাণচাঞ্চল্য এনে দেয় সারিগান। দু’টি সারি গানের উদাহরণ দেয়া যাক:

‘হিজল কাঠের নৌকাখানি পাতলা পাতলা গুড়া

বাইচের চুটে দৌড়ের নাও শূন্যে দিবে উড়া

নাওরে শূন্যের ভরে উড়াল দিয়া যাও….’।

অথবা

‘বাঁশি বাজে বাজে রইয়া রইয়া

গৃহে যাইতে মন চলে না প্রাণ বন্ধুরে থইয়া

কদমতলায় বাজে বাঁশি রাধারে শোনাইয়া

পায়ে ধরি থামাও বাঁশি নাগর কানাইয়া ‘

গান দু’টিতে উল্লেখ্যিত

‘নাওরে শূন্যের ভরে উড়াল দিয়া যাও’ অথবা ‘ বাঁশি বাজে বাজে রইয়া রইয়া

গৃহে যাইতে মন চলে না প্রাণ বন্ধুরে থইয়া’-

এ ধরনের মরাপদগুলো ঠিক রেখে বয়াতীরা মূল গান গেয়ে চলেন। তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে মরাপদ বা দিশা গেয়ে যান বাইচালরা। এভাবেই তাদের ছন্দের তালে হেলে-দুলে এগিয়ে চলে নৌকা। নৌকা বাইচ শেষ হলেও সারিগান শেষ হয় না। জয়-পরাজয় নির্ধারণের পর বিজয়ী বাইচালরা আবার মনের আনন্দে গান গাইতে গাইতে ছুটে বেড়ান গ্রাম-গ্রামান্তর। সেখানেও থাকে আরেক ধরনের আনুষ্ঠানিকতা। জিতে যাওয়া নৌকা ভিড়ানো হয় প্রত্যেকের বাড়ির ঘাটে ঘাটে। হিন্দু মেয়ে-বধূরা নৌকার গলুইয়ে তেল-সিঁদুরের ফোঁটা ও ধান-দূর্বা দিয়ে উলুধ্বনি দেন। এর সঙ্গে দেন নগদ টাকা, চাল, ধান, পান-চিনি অথবা নারকেল, কলা, জাম্বুরা প্রভৃতি ফল-মূল। বাইচালরা তখন সে বাড়ির লোকদের গুণকীর্ত্তন করে আবার সারি গান ধরেন_

‘অমুক পাড়ার(পাড়ার নাম) অমুক বাবু (গৃহ কর্তার নাম) বড় ভাগ্যবান

পান চিনি খাওয়াইয়া করলো টাকা দান

সখি হায় মরির্ত্তে’

আবার বিজয়ী নৌকার মালিকের গুণকীর্তনও কম হয় না। ঘাটে নৌকা থামানোর সঙ্গে সঙ্গে গ্রামবাসী দেখতে চান নৌকার মালিককে। মালিক তখন ওই বাড়িতে ওঠে সকলের সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন। দেউড়ীর আড়াল থেকে সে দৃশ্য অবলোকন করেন নতুন বৌ-ঝি’রা। নৌকার বাইচালরা তখনও গেয়ে চলেন_

‘খলাপাড়ার কাচু মিয়া বড় ভাগ্যবান

সোনার একটা মেডেল দিয়া বাড়াইছে সম্মান

মান বাড়িবে গুণ বাড়িবে সকল আলস্নার দান

জীবন দিয়া রাখবো মোরা তালুকদারের মান’।

এভাবে টানা কয়েক দিন ধরে গান গাইতে গাইতে, বৈঠা চালাতে চালাতে শেষ হয় নৌকা বাইচের পর্ব। এরপর বিভিন্ন বাড়ি-গ্রাম থেকে সংগৃহীত টাকা, চাল, ধান প্রভৃতি দিয়ে এবং নৌকার মালিকের দেয়া অনুদানে গরম্ন-খাসি জবাই করে আয়োজন করা হয় বড় খানা-পিনার। সেই খানাপিনার পর্বটিও শেষ গানের মধ্য দিয়ে।

আবহমান বাংলার লোক সংস্কৃতির অন্যান্য উপাদানের মতো নৌকা বাইচ বা সারিগানের ঐতিহ্যও আজ হারিয়ে যেতে বসেছে। এক সময় নৌকা বাইচ বা সারি গানকে কেন্দ্র করে পুরো গ্রামাঞ্চল জুড়ে যে উৎসবের ঢেউ লাগতো_ এখন তার ছিটে-ফোঁটাও নেই।

বাংলাদেশে ভাটিয়ালী গানের শিল্পী, রচয়িতা, সংগ্রাহক ও গীতিকারদের মধ্যে অন্যতম হলেন, মিরাজ আলী, উকিল মুন্সী, রশিদ উদ্দিন, জালাল খাঁ, জং বাহাদুর, শাহ আবদুল করিম, উমেদ আলী।

ভাটির গ্রামাঞ্চলে এখন খুব কমই নৌকা বাইচ বা সারিগানের আয়োজন দেখা যায়। মাঝে মাঝে কিছু আয়োজন হলেও এর আনুষ্ঠানিকতার দিকগুলো থাকে অতি সামান্য। বলাবাহুল্য, লোকায়ত বাংলার এই আয়োজনগুলো রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা পায়নি কখনও। বরং আকাশ সংস্কৃতির আগ্রাসন, অপসংস্কৃতি, মৌলবাদ, যন্ত্রনির্ভর জীবন-জীবিকা, প্রকৃতির ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রভৃতি গিলে খাচ্ছে আমাদের সবকিছু। আগের ভাটি অঞ্চল যেমন নেই, তেমনি ভাটির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যও নেই আগের মতো। অথচ, লোক সংস্কৃতির এসব উপাদানই ছিল ভাটির প্রাণ। ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সকল মানুষের মেলবন্ধন রচিত হতো এসব লৌকিকতার মধ্য দিয়েই। এগুলোর মধ্যেই নিহিত নদী-মাতৃক বাংলার পরিচয়।

কিছু ভাটিয়ালী গনের লিংকঃ

অকূলেতে ভাসাইলাম রে নাও – ইন্দ্রমোহন রাজবংশী

আমায় ভাসাইলি রে – রুনা লায়লা

আরে ও ভাটিয়াল গাঙের নাইয়া – আব্বাসউদ্দীন আহমেদ

উজান গাঙের নাইয়া – নীনা হামিদ

ও আমার দরদী আগে জানলে – ফেরদৌসী রহমান

ও নাইয়া তুমি কোথায় – নীনা হামিদ

ও মাঝি নাও ছাইড়া দে – সাবিনা ইয়াসমীন

ও মাঝি নিঠুর মাঝি রে – বেবী নাজনীন

ওরে সুজন নাইয়া রে – কবিতা কৃষ্ণমূর্তি

কলকল ছলছল নদী করে টলমল – সাবিনা ইয়াসমীন

কে যাও ভাটির দেশের নাইয়া – আব্দুল আলীম

কে যাস রে ভাটি গাঙ বাইয়া – ফাতেমা তুজ জোহরা

ঘাটে লাগাইয়া ডিঙা পান খাইয়া যাও – আনুশেহ আনাদিল

ছাড়িলাম হাছনের নাও রে – তপন রায়

পাল তুলে দে রে নৌকায় – আইয়ূব বাচ্চু

পূবালী বাতাসে বাদাম তুইল্যা – বারী সিদ্দিকী

মন মাঝি তোর বৈঠা নে রে – রুমানা ইসলাম

মাঝি তুমি মাঝ গাঙে নাও বাইয়া যাও – রুনা লায়লা

মাঝি বাইয়া যাও রে – কিরণ চন্দ্র রায়

হেঁইও রে হেঁইও – আব্বাসউদ্দীন আহমেদ