প্রাচীন যুগে কিশোরগঞ্জের অবস্থান কি ছিল, তা স্পষ্ট জানা যায় না। খ্রীঃ পূঃ ৩০২ অব্দে প্রখ্যাত পর্যটক মেগাস্থিনিসের ভারত ভ্রমনের অনন্য দলিল “ইন্ডিকা” গ্রন্থের মানচিত্র থেকে অবগত হওয়া যায় যে, কিশোরগঞ্জ বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চল ছিল বিশাল কামরুপ রাজের অন্তর্ভক্ত। মহাকাব্যের যুগে ( রামায়ন/ মহাভারত ) কামরুপ পরিচিত ছিল প্রাজ্যোতিষ নামে। “যোগিনীতন্ত্র” অনুসারে কামরুপ রাজ্যের এলাকা দৈর্ঘ্যে ৮০০ মাইল ও প্রশস্তে ২৪০ মাইল। “কালিকাপুরান” থেকে জানা যায় যে, কামরুপের রাজা ছিলেন নরক, যিনি ‘রামায়ন’এ বর্ণিত মহান নরপতি রামের সমসাময়িক। নরকের মৃত্যুর পর তা জ্যেষ্ঠপুত্র ভগদত্ত সিংহাসনে আরোহণ করেন।

তিনি সম্ভবতঃ ১২০০ – ১৪০০ খ্রীঃ পূঃ এর কোন এক সময়ে রাজা ছিলেন এবং কামাক্ষা দেবীর উপাসক ছিলেন। চতুর্থ শতকে উত্তর বঙ্গেও মগধ সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি ঘটে। সম্রাট সমুদ্র গুপ্তের (৩৪৬-৩৮০) এলাহাবাদ শিলালিপিতে কামরুপ (বর্তমান আসাম) গুপ্ত সাম্রাজ্যের সীমান্তস্থিত করদ রাজ্যরুপে বর্ণিত হয়েছে। পরবর্তীতে কামরুপ রাজ্যে সপ্তম শতকে মুক্ত হয়। কিশোরগঞ্জ সহ ব্রহ্মপুত্রের পূর্বতীর পুনরায় কামরুপ শাসকের অধীনে চলে আসে। তখন কাম রুপের রাজা ছিলেন ভাস্কর বর্মা। বিখ্যাত চৈনিক পরিব্রাজক ইউ এন সাঙ এ বিবরন এ রুপ সাক্ষ্য দেয়।

সম্ভবত ৬৫০ খৃঃ পর্যন্ত ভাস্কর বর্মা বৃহত্তর ময়মনসিংহ সহ এ অঞ্চল শাসন করেন। তাঁর মৃত্যুর পর পরবর্তী বংশ ধর গন দশম শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত এই অঞ্চলের শাসন কর্তা ছিল বলে জানা যায়। মৌলভী বাজার জেলায় প্রাপ্ত শ্রীচন্দ্রের (৯৩০-৯৯৫ খ্রীঃ অঃ) তাম্রলিপি থেকে জানা যায় যে বৃহত্তর ময়মনসিংহ চন্দ্রবংশের শাসনাধীন ছিল। উক্ত বংশের রাজা শ্রীচন্দ্র, তাঁর পুত্র কল্যান চন্দ্র (৯৭৫-১০০০ খৃঃ অঃ) ও পরবর্তী বংশধরগন সম্ভবত একাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি পর্যন্ত এই এলাকা শাসন করেন। একাদশ শতাব্দীতেই বৃহত্তর ময়মনসিংহ পাল রাজাদের অধীনে চলে আসে। অবশ্য শতাব্দীর শেষ দিকে এবং দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত এই অঞ্চল বর্মন বংশীয় রাজাদের অধীনে চলে গিয়েছিল।

পরবর্তী ইতিহাস সেন রাজবংশের। কিন্তু বৃহত্তর ময়মনসিংহের উপর তাদের কর্তৃত্ব পুরোপুরি প্রতিষ্ঠিত হয়নি। সময়ের আবর্তে ব্রহ্মপুত্রের পশ্চিম তীর সেন রাজত্যের অন্তর্ভুক্ত হলেও ব্রহ্মপুত্রের পূর্বতীর কামরুপ শাসন মুক্ত হয়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এ সকল রাজ্যের নেতৃতে ছিলেন কোচ, হাজং, গাড়ো, রাজবংশী প্রভৃতি আদিম সম্প্রদায়। আজকের কিশোরগঞ্জের জঙ্গলবাড়ী ছিল এই স্বাধীন ক্ষুদ্র রাজ্যের অন্যতম পীঠস্থান।
জঙ্গলবাড়ীর সাথে তুলনীয় নেত্রকোনায় খালিয়াজুড়ি মদনপুর ও সুসঙ্গ, ময়মনসিংহের বোকাইনগর এবং শেরপুরের গড়দলিপা। মুসলিম শাসনের আধিপত্য তখনো দেখা দেয়নি।