ফজলুল করিম খান চৌধুরী। জন্ম: ১৩ বৈশাখ ১৩৪৩ বাংলা, ২৯ এপ্রিল ১৯৩৬ খৃষ্টাব্দ। গ্রাম: জাওয়ার জমিদার বাড়ী, তাড়াইল, কিশোরগঞ্জ। পিতা ততকালীন জমিদার আব্দুল করিম খান চৌধুরী মাতা: আমিরুন্নেসা খাতুন চৌধুরানী। তিনি পাঠান সোনাপতি রাহাত খান মোয়াজ্জেম-এর অধস্ত:ন পুরুষ। পাঠান সোনাপতি রাহাত খান মোয়াজ্জেম পাঠানের রাজ্য বিস্তারের সময় ১৫৩৪ খৃষ্টাব্দে বর্তমান তাড়াইল উপজেলার জাওয়ার গ্রামে বসতি স্থাপন করেন। তারই উত্তরাধীকারী জনাব ফজলুল করিম খান চৌধুরী। শৈশবেই তিনি মাতৃ হারা হন। তার শৈশব ও কৈশর কেটেছে জাওয়ার ও সিলেটের সুনামগঞ্জ জেলার ধর্মপাশা উপজেলার রাজাপুর জমিদার বাড়ীতে। সেখানে খালাদের তত্বাবধানে তিনি বেড়ে উঠেন। অত:পর কিশোরগঞ্জ ফিরে এসে আজিমুদ্দীন স্কুলে ভর্তি হন এবং মাধ্যমিক শিক্ষা শেষ করে গুরুদয়াল ও ময়মনসিং আনন্দমোহন কলেজে পড়ালেখা করেন।

তিনি হয়বতনগর জমিদার বাড়ী তথা ঈশা খাঁর অধ:স্তন পুরুষ হয়বত খাঁর বংশধর দেওয়ান মোহাম্মদ মান্নান দাদ খাঁনের জেষ্ঠ পুত্র দেওয়ান মোহাম্মদ সাত্তার দাদ খাঁনের জেষ্ঠ কণ্যা দেওয়ান খুরশিদা আক্তার খাতুন (নাজমা)-এর সহিত বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাঁর আট পুত্র তিন কণ্যা সন্তান রয়েছে।

ছাত্রাবস্থায় তিনি লেখালেখিতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেন। কবিতা, গল্প, ছড়া, ও গান লিখতে থাকেন। সাহিত্যানুরাগি মন তাকে সাংবাদিকতায় জড়িয়ে পড়তে প্রেরণা জোগায়। তিনি বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকায় সংবাদ পাঠাতেন বিশেষ করে ময়মনসিং থেকে প্রকাশিত “দৈনিক জাহান” পত্রিকায় তার উর্দু ভাষা থেকে অনুবাদকৃত “মোল্লা ও শয়তান” রম্য গল্পটি প্রচুর পাঠকপ্রিয়তা লাভ করে। সেই সাথে তিনি গল্পকার বা অনুবাদক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এককালে তিনি ভারত থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক “রাখালিয়া বার্তা” পত্রিকায় লেখালেখি করতেন। তার সীমাহীন চেষ্টা ও পরিশ্রমের ফলে সরকারী ছাড়পত্র নিয়ে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করতে তিনি সক্ষম হন ১৯৯১ খৃষ্টাব্দে। তারও পূর্বে ১৯৭৯ খৃষ্টাব্দে ছাড়পত্র ছাড়া আরও একটি সাপ্তাহিক প্রকাশ করেছিলেন, যার নাম দিয়েছিলেন “সাপ্তাহিক দূরবীন”। সে সময়ে কিশোরগঞ্জ জেলায় আর কোনও সাপ্তাহিক কিংবা দৈনিক কোনও পত্রিকাই প্রাকাশিত হত না।

“সাপ্তাহিক কিশোরগঞ্জ সংবাদ” ছাড়প্রত নিয়ে কিশোরগঞ্জ থেকে প্রকাশিত সর্ববহুল প্রচারিত সাপ্তহিক পত্রিকা হয়ে উঠে। তিনি এক্ষেত্রে পথিকৃত হয়ে উঠেন। কিশোরগঞ্জ জেলার অনেক প্রবিণ নবিন প্রধান সাংবাদিক সাহিত্যিকগণ উক্ত পত্রিকায় লিখতেন। ফজলুল করিম খান চৌধুরী সাংবাদিকতা ও সাহিত্য চর্চা উভয়টির সহিত গভীরভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন। যেহেতু নিজ সম্পাদনায় একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করতেন সেহেতু কিশোরগঞ্জ জেলায় সাহিত্যিক সাংবাদিক হিসেবে তার বিশেষ পরিচিতি রয়েছে। কিন্তু সাহিত্য চর্চায় তার যে গভীর অণুরাগ এবং এক্ষেত্রে তিনি যে সৃজনশীল কর্ম রেখে গেছেন তা এখনও অজানা রয়ে গেছে কারন সাংবাদিকাতায় ব্যাস্ত থাকার কারনে তাঁর অনেকগুলো পান্ডুলিপি বই আকারে প্রকাশ করতে পারেননি। জীবন্দশায় তাঁর জীবন ও যৌবনে একটা বিশেষ অংশ ব্যয় করেছেন সাহিত্য কর্ম ও সংবাদপত্র প্রকাশনায় এবং সাংস্কৃতিক সেবায়। যার ফলশ্রুতিতে অনেকগুলো বই ও পান্ডুলিপি তিনি রেখে যেতে সক্ষম হয়েছেন। এই গুলোর মধ্যে রয়েছে একটি কবিতার বই যার নাম “রুবাইয়াত” এই বইয়ে তিনি জীবন, জীবনতত্ত্ব, সৃষ্টিতত্ত্ব, পারলৌকিকতা ইত্যাদির এক গভীর উপলব্ধির পরশ দিয়ে গেছেন।

কাব্য ও নান্দনিকতায় এই বইটি উচ্চতার শীর্ষে আরোহন করেছে বলে মনে হয়। গল্প লেখায় তার পারঙ্গমতা লক্ষ্য করার মত। পূর্বেই উল্লেখ করেছি যে, ময়মনসিংহ থেকে প্রকাশিত দৈনিক জাহানে নিয়মিত তার অনুবাদকৃত উর্দু গল্প “ফিত্রাতে শয়তান” বিভিন্ন পর্ব বিভিন্ন নামে যেমন, মোল্লা বেশে শয়তান, ঘোরার বেশে শয়তান, দাতার বেশে শয়তান ও অথিতির বেশে শয়তান দারুন জনপ্রিয়তা অর্জন করে। বিশেষ করে তার রচনা শৈলি বিশেষভাবে পাঠকের কাছে প্রশংসিত হয়। এছাড়া যে সব গল্প গ্রন্থ পান্ডুলিপি আকারে রয়েছে সেগুলো হচ্ছে দেওলিয়া, সুরের বাঁধন, ডাবল চান (রম্য গল্প), ভন্ড দরবেশ ইত্যাদি। কবিতা, গল্প ছাড়াও তার বেশ কয়টি নাটকের পান্ডুলিপি রয়েছে যার মধ্যে “আনার কলি”-এটি একটি ঐতিহাসিক কাহিণী অবলম্বনে রচিত এবং “নারী”-এই নাটকটি লোক কাহিণী অবলম্বনে রচিত। তাঁর অনেকগুলো অনুবাদ কর্ম রয়েছে । বিশেষ করে উর্দু ভাষা থেকে অনুবাদকৃত বেশ কয়টি গল্পের মধ্যে “ফিত্রাতে শয়তান”, তিন নারী-তিন কাহিণী”, “ছাই” উল্লেখযোগ্য।

তিনি হয়বত নগর জমিদার বাড়ীতে নিজ বাস ভবনে ১৯৯৪ সনের ৫ই জানুয়ারী ইন্তেকাল করেন। তাকে হয়বত নগর জমিদার বাড়ীর পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে। এখানেই ঘুমিয়ে আছেন চিরনিদ্রায় এক জমিদার কবি-সাহিত্যিক-সাংবদিক ফজলুল করিম খান চৌধুরী। তাঁর অনেকগুলো কবিতার মধ্যে একটি অপ্রকাশিত কবিতা এখানে উপস্থাপন করা হল:-

হৃদয়ের তার ছেঁড়া

কেমন আছি শুধায়োনা কেহ
দূর থেকে আজ মোরে
ঝড়ের সাথে করছি বসত
সারাটি জীবন ভরে।

ঘন কুয়াশায় ঘেরা এই জীবন
হৃদয়ের তার ছেঁড়া
বিঘ্নশত প্রতি পদে আজ
কাঁটাবনে পথ ঘেরা।

জীবনে শুধু দু:খের যাতনা
একি নির্মম পরিহাস!
দু:খের সাগরে সাতার কেটে
আমি চলেছি বারো মাস।

দিনের আলো দেখিনি কখনও
আঁধারে জীবন ঢাকা
সইতে পারিনা এ জীবন ভার
ভেতর বাহির ফাঁকা।

আমারে ঠকিয়ে তোমরা যারা
আছো আজ সুখের ঘরে।
আমি ঠকি নাই, জেনে রাখো শুধু
ঠঁকিয়েছো বিধাতারে।

(কিশোরঞ্জের লেখক জীবনী গ্রন্থ থেকে উপরোক্ত তথ্যসমুহ হুবহুব তুলে ধরা হলো। যার লেখক প্রিন্স রফিক খান)

কিশোরগঞ্জ ডট কম-এর জন্য লেখাটি প্রস্তুত করেছেন:  ফজলুল কাদির খান চৌধুরী (ওয়ালিদ), কবি ও প্রাবন্ধিক । সাংবাদিক, কবি ফুজলুল করিম খান চৌধুরীর ২য় সন্তান।