আগস্ট মাসের প্রথম দিনটি কিন্তু এবারে বন্ধু দিবস। কি করবে কিছু ঠিক করেছো? প্রিয় বন্ধুকে কোন উপহারটা দেবে? চলো আগে না হয় আজ আমরা বন্ধু দিবসের খুঁটিনাটিগুলো জেনে নিই। তারপরে নাহয় ঠিক করা যাবে কি উপহার দেয়া যায় প্রিয় বন্ধুকে।

পৃথিবীতে মানুষের শ্রেষ্ঠ সম্পদই হলো- ভালো বন্ধু। আর তাই বন্ধুত্বের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে বছরের একটি দিন বন্ধু দিবস পালন করাই যায়। তবে মানুষের সঙ্গে মানুষের বন্ধুত্ব যতো পুরোনো, বন্ধু দিবসের ধারণাটি কিন্তু ততোটা পুরোনো নয়। বন্ধু তো মানুষের আছে সেই আদ্দিকাল থেকেই। কিন্তু প্রথম বন্ধু দিবস পালন করার চিন্তা মানুষের মাথায় এসেছিলো গত শতকের প্রথম দিকে। আমেরিকার মানুষেরা এই দিবসটির প্রচলন করেছিলো। পরে ১৯৩৫ সালে দিবসটিকে সরকারিভাবেই স্বীকৃতি দিয়ে দেয়া হয়। সে বছর ওই দেশের সংসদে প্রতি বছর আগস্ট মাসের প্রথম রবিবারকে ন্যাশনাল ফ্রেন্ডশীপ ডে হিসেবে ঘোষণা করা হয়। আর তখন থেকেই দিবসটি প্রতি বছর মার্কিনীরা পালন করে আসছে। অবশ্য সারা বিশ্বেই পয়লা আগস্ট বন্ধু দিবস পালিত হয় এখন।

এমন সুন্দর একটা দিন, সে কি আর শুধু একটি দেশের গণ্ডীর মধ্যে আটকে থাকে? দিনটি দিনকে দিন জনপ্রিয় হতে শুরু করলো আর একের পর এক দেশে এই দিবসটি উদযাপিত হতে থাকলো। আর এখন তো গোটা পৃথিবীতেই দিবসটি পালন করা হচ্ছে। আমরাও তো এখন ঘটা করে দিবসটি পালন করি।

আচ্ছা, বন্ধু দিবস তো পালন করবোই, তার আগে চলো আমরা বন্ধু সম্পর্কে কিছু জেনে নেই। একজন বন্ধুকে কখন ভালো বন্ধু বলা যায়? ভালো বন্ধু হতে হলে সবার আগে প্রয়োজন বন্ধুকে বুঝতে পারার ক্ষমতা। যে তোমার সবচে ভালো বন্ধু, সে তোমাকে সবচাইতে ভালো বুঝবে। তুমি তার কাছ থেকে কেমন ব্যবহার আশা করো, সেটা বুঝে সে তোমার সঙ্গে সেভাবেই ব্যবহার করবে। বন্ধুকে বুঝতে পারার ক্ষমতার পাশাপাশি থাকতে হবে বন্ধুর প্রতি সহানুভূতি আর ভালোবাসা।

ভালো বন্ধু অবশ্যই সৎ হবে। সে তোমার কাছে কোনোকিছু তো লুকাবেই না, এমনকি তোমার সমালোচনাও করবে সে। তুমি কোনো খারাপ কাজ করলে সে তোমাকে নিষেধ করবে। তুমি কোনো ভুল করলে তা শুধরে দেবে। তোমাকে খুশি করার জন্য সে কখনোই তোমার কাছে মিথ্যা কথা বলবে না। ভালো বন্ধুরা কখনোই একজন আরেকজনকে মিথ্যা কথা বলে না।

আবার ভালো বন্ধুদের মাঝে বোঝাপড়াটাও চমৎকার হতে হয়। আর থাকতে হয় বিশ্বাস। তুমি যদি তোমার কোনো বন্ধুকে বিশ্বাসই না করতে পারো, তবে আর সে তোমার ভালো বন্ধু হলো কিভাবে?

প্রাচীন গ্রীসেও কিন্তু মানুষ বন্ধুত্ব নিয়ে খুব উৎসাহী ছিলো। সেখানকার এক মনীষী তো রীতিমতো বন্ধুত্ব নিয়ে গবেষণাই করেছিলেন। তার নাম সিসেরো। সিসেরোর মতে, বন্ধুত্বের ভিত্তি হলো সততা আর বিশ্বাস। আর বন্ধুরা যখন একজন আরেকজনের জন্য কোনো কিছু করে তখন সে কোনো প্রতিদানের আশাই করে না। তার মতে বন্ধুত্বের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো বন্ধুর ভুল ধরিয়ে দেয়া। দেখেছো, তখনো মানুষের কি দারুণ বন্ধুত্ব ছিলো!

আবার একেক অঞ্চলে কিন্তু বন্ধুত্বের একেক ধরনের রূপ। যেমন, রাশিয়ার কথাই ধরো; সেখানে কিন্তু যে কাউকে বন্ধু বলা হয় না। তুমি তো তোমার ক্লাশের সবাইকেই তোমার বন্ধু বলো। আবার তোমার বাবাও তো তার অফিসের সব সহকর্মীকেই বলে বন্ধু। রাশিয়ায় কিন্তু সেটা চলবে না। সেখানে কেবল তোমার বেস্ট ফ্রেন্ডকেই তুমি বন্ধু বলতে পারবে। বাকি সবাইকে তারা অন্য একটা নামে ডাকে, যার অর্থ হলো পরিচিত মানুষ।

আবার আমাদের এশিয়া মহাদেশের কথা চিন্তা করো। এখানে কিন্তু বন্ধুদের মধ্যে অমন বাছাবাছি নেই। যেই তোমার একটু পরিচিত হলো, সেই তোমার বন্ধু হয়ে গেলো। বন্ধুদেরকে ভালো নামে বলা যায় ডাকাই হয় না। বেশিরভাগ বন্ধুর ভালো নামই তো জানা হয় না। ডাকনামে বা নিজেদের বানানো নামে একজন আরেকজনকে ডাকে। তবে এখানে বন্ধুত্বটা হয় সাধারণত সমবয়সীদের মধ্যে। নিশ্চয়ই বুঝতে পারছো আমরাও এই দলেই আছি। আমরাও তো এশিয়াতেই বাস করি।

তবে পশ্চিমা বিশ্বে, অর্থাৎ ইউরোপ আর আমেরিকায় বন্ধুত্বের অবস্থা এখন খুব একটা ভালো নয়। সেখানে মানুষের বন্ধুর সংখ্যা অনেক কমে গেছে। আর আমেরিকায় তো একরকম বন্ধুর আকালই পড়ে গেছে। ১৯৮৫ সাল থেকেই নাকি সেখানে মানুষের বন্ধুর সংখ্যা কমতে শুরু করেছিলো। আর এখন নাকি ওখানকার শতকরা ২৫ ভাগ লোকের কোনো ঘনিষ্ঠ বন্ধুই নেই। অথচ বন্ধু দিবস পালন করা কিন্তু শুরু হয়েছিলো ওই আমেরিকাতেই।

বন্ধুত্বের প্রতীক কোন ফুল মনে আছে তো? ঠিক বলেছো, হলুদ গোলাপ। হলুদ রং হচ্ছে আনন্দের প্রতীক। আর হলুদ গোলাপ মানে শুধু আনন্দই নয়, প্রতিশ্রুতিও। তোমার কোনো বন্ধুকে হলুদ গোলাপ দেওয়ার মানে হচ্ছে, তুমি তোমার সেই বন্ধুটিকে অনেক ভালোবাসো। আর তুমি চাও যে সেও তোমাকে সবসময় মনে রাখুক।

বন্ধুত্বের শুধু প্রতীকই না, ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডরও আছে। কেউ যখন নিজেই কোনো কিছুর প্রতিনিধিত্ব করে তখন তাকে বলা হয় ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর। আর বন্ধুত্বের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর হলো বিখ্যাত কার্টুন চরিত্র উইনি দ্যা পুহ্। ১৯৯৭ সালে জাতিসংঘ ঘটা করে উইনিকে এই দায়িত্ব দেয়।

ফ্রেন্ডশীপ ব্যান্ড তো চেনোই। নিশ্চয়ই এরমধ্যেই একগাদা ফ্রেন্ডশীপ ব্যান্ড বানিয়েও ফেলেছো বন্ধুদের জন্য। নয়তো খুব খুঁজে খুঁজে গোটাকয় সুন্দর সুন্দর ব্যান্ড কিনে রেখেছো বন্ধু দিবসে বন্ধুদের তাক লাগিয়ে দেয়ার জন্য। মজার ব্যাপার কি জানো, এই ফ্রেন্ডশিপ ব্যান্ডের ধারণাটিও এসেছে আমেরিকা থেকেই। আমেরিকার আদিবাসীদের মধ্যে অনেক আগে থেকেই বন্ধুত্বের স্বীকৃতি স্বরূপ ব্যান্ড দেয়ার এই রীতি চালু আছে। তারা তাদের বন্ধুদের জন্য ব্যান্ড তৈরি করে। আর যাকে ব্যান্ড দেয়া হয়, সেও কখনোই ব্যান্ডটি খোলে না। একসময় ব্যান্ডটি আপনাআপনি নষ্ট হয়ে খসে যায়। আর যদি তাদের বন্ধুত্বে ফাটল দেখা দেয়, দেরি না করে তৎখনাৎ ব্যান্ডটি খুলে ফেলে দিয়ে বুঝিয়ে দেয়, তোমার সঙ্গে আমার আড়ি। তবে অনেক আদিবাসী গোষ্ঠীর মধ্যে ব্যান্ডটি নিয়ে কিছু বিশ্বাসও প্রচলিত আছে। তারা বিশ্বাস করে ব্যান্ডটি পরার আগে কোনো কিছু চাইলে তা সত্যি হয়। তবে তার জন্য তোমাকে অপেক্ষা করতে হবে। যতোদিন তোমার হাতে ব্যান্ডটি থাকবে, ততোদিন ইচ্ছা পূরণ হবে না। যেদিন ব্যান্ডটি আপনাআপনি খুলে যাবে, সেদিনই ইচ্ছাপূরণ হবে। বুঝতেই পারছো, এটা নিছকই একটা বিশ্বাস। তুমি আবার ব্যান্ড পরার আগে কোনো কিছু চেয়ে বসো না যেনো। পরে হয়তো না পেয়ে শুধু শুধু কষ্ট পাবে।

তবে ল্যাটিন আমেরিকায় কিন্তু আরো একটা বন্ধু দিবস পালন করা হয়। বিশেষ করে আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল আর উরুগুয়েতে ঘটা করেই ২০ জুলাই পালন করা হয় বন্ধু দিবস। এই দিবসটির উদ্যোক্তা এনরিক ফেব্রারো নামের এক আর্জেন্টাইন ভদ্রলোক। তিনি ছিলেন একাধারে একজন শিক্ষক, ডেন্টিস্ট আর মিউজিশিয়ান। মানুষের প্রথম চাঁদে অবতরণের দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখতেই তিনি এইদিনে বন্ধু দিবস পালনের চিন্তা করেন। কারণ সেদিনের নীল আর্মস্ট্রং, মাইকেল কলিন্স আর এডউইন অলড্রিনের চাঁদ বিজয়কে উপলক্ষ করে সারা পৃথিবীর মানুষই যেনো বন্ধুর মতো একসঙ্গে উৎসব করতে শুরু করেছিলো। আর্জেন্টিনার বুয়েন্স আয়ার্সের স্থানীয় সরকার এক ডিক্রি জারি করার মাধ্যমে এদিনটিকে সরকারিভাবে বন্ধু দিবস বলে স্বীকৃতিও দিয়েছে। তবে আর্জেন্টাইন সরকার এখনো দিনটিকে জাতীয়ভাবে স্বীকৃতি দেয়নি। কি করে দেবে বলো, বছরে একই দিবস তো আর দুইবার পালন করা যায় না!

তাই বলে তো আর মানুষ বসে থাকবে না। আর্জেন্টিনায় তো বটেই, প্রতিবেশী দেশগুলোর মানুষও দিনটি উদযাপন করতে শুরু করে দিয়েছে। বন্ধুর জন্য বছরের দুইটি দিন উৎসর্গ করতে তো কারো অসুবিধা হওয়ার কথাই না। আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েন্স আয়ার্সে তো সেদিন রীতিমতো উৎসবই শুরু হয়ে যায়। তুমি চাইলেও সেদিন কোনো রেস্টুরেন্ট খালি পাবে না। কি করে পাবে, এক সপ্তাহ আগে থেকেই যে সবাই রেস্টুরেন্টগুলো ভাড়া করে রাখে, বন্ধুরা মিলে পার্টি দেয়ার জন্য!

৮ জুন আবার আরেকটা বন্ধু দিবস আছে। তবে সেটা সব বন্ধুদের জন্য না, কেবল বেস্টফ্রেন্ডদের জন্য। ৮ জুন হলো বেস্ট ফ্রেন্ড দিবস। অনেকটা রাশিয়ানদের বন্ধুর মতো।

তো বন্ধু দিবস সম্পর্কে তো অনেক কিছুই শুনলে, এবার তুমিই ঠিক করো এবারের বন্ধু দিবসে তোমার প্রিয় বন্ধুদেরকে কি দিবে? হলুদ গোলাপও দিতে পারো, উইনি দ্যা পুহ্র ছবি কি শোপিসও দিতে পারো, কিংবা নিজের হাতে ব্যান্ড বানিয়ে তাও দিতে পারো। তবে একটা জিনিস কিন্তু মনে করে ঠিকঠাক রেখো। বন্ধুর প্রতি তোমার ভালোবাসা যেনো কখনো কমে না যায়।