খোদ বলটাই ভীষণ অপছন্দের ছিল ব্রাজিলের। তাঁদের প্রায় সকলের চক্ষূশূলও বটে। অ্যাডিডাস নির্মিত ফিফা বলটির গড়ন পছন্দ করেননি ডুঙ্গা, মাইকন ও কাকারা। উপরন্তু তাদের অস্বস্তির আর একটি কারণ ছিল মাঠ। জোহানেসবার্গ সমুদ্র পৃষ্ঠের চেয়ে সতেরশ মিটার উঁচুতে। এই দুই প্রতিকূলতার সঙ্গে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করা ছিল ডুঙ্গার অন্যতম চ্যালেঞ্জ। ডুঙ্গার দল তাই এবারে অস্ট্রেলিয়ার পরেই পা রাখে জোহানেসবার্গে। অচেনা বল, অচেনা পরিবেশ। এর সঙ্গে যাতে তারা খাপ খাইয়ে নিতে পারে, সেজন্য দীর্ঘ প্রশিক্ষণ চলেছে। আর মূল খেলার আগে এই দীর্ঘ প্রশিক্ষণ ব্রাজিলিয় ছন্দ হারানোর জন্য কিছুটা দায়ী-সেকথা ডুঙ্গা খেলা শেষে নাকচ করে দেননি। বল সমস্যাটাও ছিল প্রচণ্ড। এনিয়ে তর্কও হয়েছে ফিফার সঙ্গে। ফিফা মহাসচিব জেরোমে ভেলকে বলেছিলেন, ব্রাজিল যদি ব্যর্থ হয় তাহলে তারা বলের দোষ দেবে। ডুঙ্গা ফোঁড়ন কাটতে ছাড়েননি। বলেছিলেন, যে (ভেলকে) কোনোদিন বলে লাথি দেয়নি, সে এর কি বুঝবে?” বুধবারের খেলা শেষ না হতেই শুরু হয়ে যায় চুলচেরা বিশ্লেষণ। কেন এমন হলো ব্রাজিলের? কোচ দুঙ্গা খেলা শেষ হতে না হতেই সাংবাদিকদের কবলে পড়েন। তিনি ‘চৌকস’ ‘বুদ্ধিদীপ্ত’। প্রথমেই বললেন, ব্রাজিল বিশ্বকে যে খেলা দেখিয়েছে তাতে তিনি পুরোপুরি সন্তুষ্ট নন। একইসঙ্গে তিনি অবশ্য বলেন, ‘জয়টা যে তারা পেয়েছেন সেটাও আনন্দের। তবে তাদের আরো উন্নয়ন চাই।’ এই ছিল তাঁর বুধবার রাতের মন্তব্য। কিন্তু বৃহস্পিতবার তাঁর সুর আরেকটু নিচু লয়ে এসেছে। ডুঙ্গা স্বীকার করেন, ব্রাজিল উদ্বিগ্ন ছিল। তাঁদের নার্ভাসনেসে পেয়ে বসেছিল। মেসি গোল দেননি। রুনি গোল দেননি। তাদের সঙ্গে যুক্ত হলেন রবিনহো, কাকা। শুধু তাই নয়, খেলার প্রথমার্ধ হয়ে উঠেছিল রীতিমতো সেয়ানে সেয়ানে লড়াই। স্টালেনিয় ধাঁচের লৌহ শাসনের নিগড়ে থাকা উত্তর কোরিয়া ৪৪ বছর পরে এসে সত্যিই বিস্ময় উপহার দিল। বিস্ময়ের কথা কিন্তু আগেই বলেছিল তারা। দুঙ্গাও। তাঁদের পূর্বাভাসই সত্যি হলো। তবে ব্রাজিলিয় খেলা ডুঙ্গার হাতে আর ব্রাজেলিয় নেই-সেই সমালোচনাটা কিন্তু ছিলই। প্রথমার্ধের খেলা শেষ হতে না হতেই দক্ষিণ আমেরিকার সাংবাদিকরা বলাবলি শুরু করেন একটা কথা। ডুঙ্গা ভায়া। এবার দুঁদে সমালোচকদের সামলাও। তাঁদের ছুরি তোমাকে এবার ফালা ফালা করবে। রোনালদিনহো, গ্যানসো ও নেমারের মতো খেলোয়াড়দের বাদ দেওয়া নিয়ে দুঙ্গা আগে থেকেই তোপের মুখে। ১৯০৭ সালের বিশ্বকাপ টিমের ক্যাপ্টেন কার্লোস আলবার্তো পেরেইরা তো ডুঙ্গার বিরুদ্ধে প্রচন্ড ক্ষোভ প্রকাশ করেন ম্যাচের একদিন আগেই। তাঁর কথায়, গ্যানসো নাম্বার ওয়ান খেলোয়াড়। তাঁর বয়স ২০। ডুঙ্গা তাঁকে বাদ দেন কম বয়স বলে। আলবার্তোর কণ্ঠে তীব্র ঝাঁঝ ও শ্লেষ ঝরে। কারণ তিনি মনে করেন বিশ্ববাসী ব্রাজিলকে পছন্দ করে ছন্দের কারণে। ছন্দটাই শেষ করে দিচ্ছেন দুঙ্গা। তিনি ব্রাজেলিয় ছন্দের বারোটা বাজাচ্ছেন। তিনি তাঁর কথার সপক্ষে প্রমাণ দেন। বলেন, দেখবেন ব্রাজিলের খেলোয়াড়রা কোনো ডেড বল নিয়ে ছোটে। ফ্রি কিক। না হয় কর্নার কিক। এছাড়া তাদের চলে না। অথচ এটা ব্রাজেলিয় ফুটবল নয়।’ তিনি আরো বললেন, আমাদের জাতীয় দল আর ব্রাজেলিয় ফুটবল খেলে না। ডুঙ্গার কড়া সমালোচক ব্রাজিলের অপর দুই সাবেক তারকা সক্রেটিস ও তোস্তাও। ডুঙ্গা তাঁদের সমালোচনাকে আপাতত পরোয়া করছেন না। সাংবাদিক সম্মেলনে দেখা গেল তিনি কূটনীতিকের মতো কৌশলী থাকার চেষ্টা করছেন। রবিনহো দ্বিতীয়ার্ধে বদলে যান। তাঁকে ভার্সাটাইল জিনিয়াস বলা হয়। কিন্তু ডুঙ্গা বলেন, তাঁর সে গুণ আছে। তবে বিভিন্ন অবস্থায় কী ধরণের কৌশল নিতে হবে তা পরিস্থতি বলে দেয়। অথচ এক বছর আগেও আমি এবিষয়টি কাউকে মানাতে পারতাম না। তাঁর চোখেমুখেও সমালোচকদের প্রতি অবজ্ঞা। বললেন, আসলে একটি হাতির মতোই আমার স্মৃতিভান্ডার। এটাই আমার বৃহত্তম ভুল! দ্বিতীয়ার্ধে ব্রাজিল তার ছন্দ ফিরিয়ে এনেছিল। দুজনকে ওঠানোর কারন ব্যাখ্যা করেন ডুঙ্গা। বিশেষ করে বলেন কাকার কথা। গত ৫ মাসেরও বেশি সময় কাকা একটানা ৯০ মিনিট খেলেননি। তাই কাকাকে তুলে নেয়া হয়। তিনি অবশ্য সেদিন অপরিহার্যও ছিলেন না। মোট শট করেছিলেন সাতটি। এরমধ্যে মাত্র একটির গন্তব্য ছিল গোলপোস্ট। পরিসংখ্যানের দিকে নজর দিলে চোখে পড়ে একটি বিষয়। সেটি হলো ছোট ছোট পাস দিয়ে খেলার নান্দনিকতা ব্রাজিল দেখিয়েছে। ব্রাজিলের ১১ জন মিলে পাস দিয়েছে ৪৯৪টি। আর উত্তর কোরিয়ার ১১ জন দিয়েছে ১৯৩টি পাস। পাস দেওয়ার ক্ষেত্রে জয়ের নায়ক মাইকনই শীর্ষে। তিনি সর্বোচ্চ ৮৮টি পাস দেন। কাকা ও রবিনহো দিয়েছেন যথাক্রমে ৪০ ও ৪৩টি। কোচ ডুঙ্গা মনে করেন, প্রথমার্ধের বড় সমস্যা ছিল পাসের গতি। দ্বিতীয়ার্ধে আলভাস,র‌্যামিরেজ ও নিলমার নামার পরে তার উন্নতি ঘটে। পরিসংখ্যান আরো একটি বিষয় নিশ্চিত করেছে, অবশিষ্ট বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন থাকা দেশটি ১৯৬৬ সালে বিশ্বকাপ থেকে পরিত্যাক্ত হলেও তারা ফুটবলটা ছাড়েনি। তাই ফিফা র‌্যাংকিং ব্রাজিলের এক আর উত্তর কোরিয়ার ১০৫ হলে কি হবে। শ্রেষ্ঠতমের সঙ্গে নিম্মতমের লড়াইটা সেভাবে বোঝা যায়নি। দেখুন পরিসংখ্যানটা। ব্রাজিল শট করেছে ২৫টি। তারা করেছে ১১টি। গোলে শট ব্রাজিলের নয়টি। তাদের দুটি। এর মানে হলো নয়টি চেষ্টায় একটি সফল। অন্যদিকে দুটি চেষ্টায় একটি সফল। একটি পরিহাসও কিন্তু ঘটে গেছে। সেটি হলো ফাউলের জন্য তারা হলুদ কার্ড পায়নি। পেয়েছে ব্রাজিল। ফাউলের রেকর্ডও এমন নয় যে, অনভিজ্ঞ দেশটি গোঁয়ারের মতো খেলেছে। ডুঙ্গা বলেন, ‘উত্তর কোরিয়ার খেলা ছিল প্রায় যথার্থ।’ সেই হিসেবে আমরা কিন্তু পর্বত ও মূসিকের সঙ্গে একটি ড্র দেখতে পাই। দুই দল সবমিলিয়ে ফাউল করেছে ১৯টি করে। কি করে এই সংখ্যাটি যে মিলল সেটা চমকপ্রদ। ব্রাজিল ফাউল করেছে নয়টি। উত্তর কোরিয়া করেছে দশটি। নয়টির মধ্যে ফ্যাবিয়ানোই করেছে এক হালি। এই ১৯টিতে রেফারি বাঁশি বাজান। কিন্তু আরো ১৯টি দুদল হজম করে। এতে বাঁশি বাজেনি। ব্রাজিল ফাউল হজম করেছে দশটি। আর উত্তর কোরিয়া করেছে নয়টি। বিশ্বকাপের আসরে রক্ত ঝরা বিরল। সেটাও কিন্তু সেদিন বেশ প্রকটভাবেই চোখে পড়লো। উত্তর কোরিয়ার ক্ষেত্রেই তা ঘটেছে। উত্তর কোরিয়া মাঠে ব্লক তৈরিতেও এগিয়েছিল। ব্রাজিল পুরো খেলায় ব্লক করেছে মোটে তিনটি। আর উত্তর কোরিয়া করেছে ১৪টি। বল নিয়ে ছোটার সময় ব্রাজিল বাধা দিয়েছে ৩১টি। উত্তর কোরিয়া দিয়েছে ৫৩ বার। বল ট্যাকল করার নৈপুণ্যেও তারা ছিল সমান সমান। ব্রাজিল ট্যাকল করেছে নয়টি। উত্তর করিয়া করেছে আটটি। গোলরক্ষক হিসেবেও উত্তর কোরিয়া কম যায়নি। তাদের গোলকিপার ২৫ টি শট মেকাবেলা করেন। গোলপোস্টের সীমানায় ফেস করেন নয়টি। ব্রাজিলের গোলরক্ষক ১১ শট মোকাবেলা করেন। গোলপোস্টে ফেস করেন দুটি । তবে সঙ্গতকারণেই সমগ্র উত্তর কোরিয়া এবং কোরিয়ার বাইরে যেখানে তাদের উদ্বাস্তু জনগোষ্ঠী সেখানে আনন্দের বাণ ডেকেছে। বিশ্বের অন্যতম পারমাণবিক বোমার অধিকারী নিষিদ্ধ দেশটিতে ফুটবল নিছক খেলা নয়। মারাদোনা ঈশ্বরের হাত দিয়ে গোল করেছিলেন কেন? একটি ব্যাখ্যা হলো, ফকল্যান্ড যুদ্ধের শত্র”পক্ষ ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিতে। উত্তর কোরিয়া ফুটবল খেলে কেন? তার জবাব কিন্তু মারাদোনার চেয়ে কম মারা�ক নয়। দেশটির বর্তমান শাসক কিম জঙ ইল। তিনি ক্ষমতায় আসার আগে ঘোষণা দিয়েছিলেন, ‘আমরা যখন ফুটবলে দক্ষতা অর্জন করতে পারবো, অন্যদেশকে টেক্কা দিতে পারেবো, তখন আমরা আমাদের দেশের প্রকৃত ক্ষমতা দেখাতে পারবো।’ এলিস পার্কে যখন খেলা চলে তখন উত্তর কোরিয়ায় রাত সাড়ে তিনটা। ফিফা অনেকটা দয়া করে ফ্রি তাদের টিভি নেটওয়ার্ককে অনুমতি দিয়েছিল বিশ্বকাপ দেখাতে। তবু সেদেশের মানুষ লাইভ দেখতে পেরেছে কিনা তা সন্দেহ করি। কারণ প্রেসিডেন্ট কিম গতবছরেই দেশে বিশ্বকাপ কভারেজ নিষিদ্ধ করেছিলেন। শর্ত দিয়েছিলেন যদি উত্তর কোরিয়া জেতে তাহলেই শুধু দেখানো যাবে। দেশটির তুখোড় তারকা জং। ভালো খেলেছেন। আপনারা তাঁকে ফুঁপিয়ে কাঁদতে দেখেছেন। মাইকনও কেঁদেছিলেন। কিন্তু তার কারণ ভিন্ন। সারা বিশ্ব দেখেছে তাঁর কান্না। খেলার মাঠে এসেছিলেন তাঁর মা মিসেস রি। সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে এর কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘বিশ্বকাপের আসরে দেশের জাতীয় সঙ্গীত বাজছে। সে তাঁর জীবনে এই প্রথম বিশ্বকাপে এসেছে। সবমিলিয়ে তাঁর পক্ষে আবেগ সামলানো সম্ভব হয়নি।’ অবাক কান্ড ঘটে মিডিয়া সেন্টারে। বুধবার রাতেই সাংবাদিকরা ঘিরে ধরেন কোচ কিম জং-হুনকে। কিন্তু প্রশ্ন গড়াচ্ছিল উত্তর কোরিয়ার অবস্থা সম্পর্কে। ফিফার একজন কর্মকর্তা হঠাৎ হাজির। তিনি তাঁর ভাষায়, কোচকে রাজনৈতিক প্রশ্ন করা নিষিদ্ধ করলেন। বললেন, রাজনীতি নয়, ফুটবল নিয়ে কথা বলুন। এই ঘটনায় বিদেশি সাংবাদিকদের অনেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করলেন।