bangla-podobiদেবদেবীগণের পদবি নেই কেন ? এমন একটা প্রশ্ন সকলের মনেই উঁকি মারতে পারে। প্রশ্ন উঠলে উত্তর খুঁজতে হবে, এটাই দস্তুর। চলুন, উত্তর খোঁজা যাক। বাংলাদেশ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গে বসবাসরত বাঙালি হিন্দুদের পদবিসমূহ বেশ বৈচিত্রপূর্ণ। বাঙালির বংশ পদবির ইতিহাস খুব বেশি প্রাচীন নয়। মধ্যযুগে সামন্তবাদী সমাজব্যবস্থার ফলে পরবর্তীতে ব্রিটিশ আমলে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সমান্তরালে বাঙালির পদবির বিকাশ ঘটেছে বলে মনে হয়। অধিকাংশ ব্যক্তি নামের শেষে একটি পদবি নামক পুচ্ছ যুক্ত হয়ে আছে। যেমন উপাধি, উপনাম কিংবা বংশসূচক নামকে সাধারণভাবে পদবি বলা হয়। বাঙালির মূল নামের শেষে বংশ, পরিবার, পেশা, বসতি স্থান ইত্যাদির পরিচয়বাহী উপনাম ব্যবহারের রীতি প্রচলিত আছে।

সামন্ততান্ত্রিক পদবির সঙ্গে জড়িয়ে আছে অনেক ক্ষেত্রেই জমি ও হিসাব সংক্রান্ত পদবি। তবে এই সমস্ত পদবির বেশির ভাগই বংশপরস্পরায় চলে এলেও বর্তমানে পদবির সমাজগত কোনো মূল্য নেই বললেই চলে। এখানে যেমন ধর্মীয় জাতিভেদ প্রথার প্রভাব বিদ্যমান তেমনই ঐতিহ্যবাহী পেশাকেও পদবি হিসাবে গ্রহণের রেওয়াজ বিদ্যমান। তৎকালীন সমাজে কোনো মানুষেরই পদবি ছিল না। তাই স্বাভাবিকভাবেই দেবদেবীদেরও পদবি নেই। দেবতাগণ মানুষেরই প্রতিরূপ। তৎপরবর্তী সমাজজীবনে বর্ণাশ্রম গেড়ে বসার পর পেশাভিত্তিক পরিচয় নামের সঙ্গে যুক্ত হল। পদবি তো আসলে আমাদের পেশারই পরিচয়। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য এবং শূদ্র — প্রত্যেককেই আলাদা করে চেনা যেত পদবি দিয়েই। নাহলে তো মুড়ি-মুড়কির একদর হয়ে যাবে, তাই না ? নাম ও পদবির প্রয়োগ নিয়ে মনুবাবু (বৈবস্বত মনু) কী বলেছেন দেখি : ব্রাহ্মণের নাম মঙ্গলবাচক এবং পদবি শুভসূচক, ক্ষত্রিয়ের নাম বলবাচক এবং পদবি রক্ষাবাচক, বৈশ্যের নাম ধনবাচক এবং পদবি পুষ্টিবাচক, শূদ্রের নাম নিন্দাবাহীবাচক এবং পদবি বশ্যতা বা দাসবাচক হতে হবে।পদবি থেকেই বোঝা যাবে আমার পূর্বপুরুষ কোন পেশার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এবং সামাজিক মর্যাদাই-বা কোন স্তরে ছিল। সামাজিক মর্যাদা সেইভাবেই নির্ণয় হল। বেদ, পুরাণ, জাতক বা কথাসরিৎসাগরের পাতা তন্নতন্ন করে খুঁজলেও সেখানে পদবির কোনো টিকি খুঁজে পাওয়া যাবে না। উপনিষদে কোনো কোনো নামে অবশ্য দুটি অংশ লক্ষ্য করা যায়। যেমন প্রাচীনশাল ঔপমানব, উদ্দালক আরণি । আরুণির অর্থ অরুণের পুত্র। অর্থাৎ নামের সঙ্গে ছিল পিতার পরিচয়। পিতৃপরিচয়ের মতো পুরাণকালে মাতৃপরিচয়ও স্বীকৃত ছিল।  যেমন সত্যকাম জাবালি। জাবালির অর্থ জবালার পুত্র। মহাভারতের ও রামায়ণের কোনো চরিত্রেরই কোনো পদবি ছিল না — সে অর্জুন হোক কিংবা একলব্য।

বাপের পরিচয়ে কৃষ্ণার নাম ছিল দ্রৌপদী, জন্মস্থানের পরিচয়ে পাঞ্চালী, জন্ম-ইতিহাসের পরিচয়ে যাজ্ঞসেনী। কালীদাস, বাণভট্ট, হর্ষবর্ধন, কনিষ্ক, ভাস, বরাহমিহির, আর্যভট্ট, ব্রহ্মগুপ্ত, পাণিনি, কাত্যায়ন, পতঞ্জলি, পরাশর, রাম, পরশুরাম, কৃষ্ণ, মৈত্রেয়ী, অপালা, গার্গী প্রমুখ অজস্র প্রসিদ্ধ ব্যক্তিদেরও কোনো পদবি নেই — এরা কিন্তু কেউই দেবদেবী নয়, মানুষ। সম্ভবত পদবি যুক্ত হয়েছে বল্লালসেন-লক্ষণসেনের যুগ থেকে। প্রাচীনকালের শাসকগণ “divide and rule policy” প্রয়োগ করে ভারত উপমহাদেশের বৃহৎ জনজাতিকে শত শত ভাগে বিভক্ত করে দিয়েছে। হিন্দু জাতির মধ্যে হাজার তিনেক শাখা-উপশাখা, তস্য শাখায় ভাগ করা জাতপাত আছে। ভারতে ব্রাহ্মণ জাতের সংখ্যা নাকি প্রায় ৩০০। সব ভাগই ছিল পেশাভিত্তিক।

যুগে যুগে পেশার সংখ্যা যত বেড়েছে জাতও তত বেড়েছে। প্রাচীন ভারতে কেউ যদি কোনো কাজে দক্ষ হয়ে উঠত এবং পেটের জন্য নিয়মিত সেই কাজ করত ব্রাহ্মণবাদের ধারক ও বাহকেরা মানে সমাজপতিরা সেই কাজটাই তার জাতপেশা বা বংশধারা বা পৈতৃক পেশা হিসাবে দেখত। সব পদবির বিশ্লেষণ এখানে সম্ভব নয়। তবু চেষ্টা করছি কয়েকটা উদাহরণ দিতে। এমনি একটি পদবি “কয়াল” বা “কইয়্যাল” (কয়াল মানে যে ধান-চাল ওজন করে, যে বিক্রয়ের জন্য ওজন করে), অর্থাৎ কয়াল পদবিধারীদের পূর্বপুরুষ যে ধান-চাল ওজন করা, যে বিক্রয়ের জন্য ওজন করার পেশার সঙ্গে যুক্ত করতেন। জনৈকা অভিনেত্রীর পদবি কয়াল। মুচিরাম গুড়ের পদবি গুড়, অর্থাৎ এদের পূর্বপুরুষ গুড় তৈরি করতেন বা বেচতেন। এরকম চিনি, দা, হাড়ি, ঢেঁকি, ঢাকি, ঢুলি, কড়াই, ঘড়া, খাঁড়া, হাতা, উকিল, গায়েন, তন্তুবায়, কর্মকার, মোদক, যোগী, স্বর্ণকার, মালাকার, ঘটক, পাঠক, জ্যোতিষী, কবিরাজ, ঘরামি, বৈদ্য, বণিক ইত্যাদি পেশাভিত্তিক পদবি আছে। মজুত থেকে মজুম, মজুত রক্ষা করেন যিনি তিনিই তো মজুমদার (অনেকের মতে মৌজার অধিকর্তা যিনি হতেন, তাঁকে বলা হত ‘মজুমদার’)। যিনি দৈনিক হিসাব রাখতেন, তাঁকে বলা হত ‘সেহানবিশ’। যিনি শান্তিরক্ষকের কাজ করতেন, তাঁকে বলা হত ‘শিকদার’ বা ‘সিকদার’। যিনি কেরানির কাজ করতেন, তাঁকে বলা হত ‘মুনশি’। বড়োবাবুর কাজ যিনি করতেন, তাঁকে বলা হত ‘মুস্তাফি’। ব্যাংকার বা মহাজনদের বলা হত ‘পোদ্দার’। যাঁরা হাবিলদারের কাজ করতেন, তাঁদের বলা হত ‘লস্কর’। দশজন সেনার উপরে যিনি থাকতেন, তাঁকে বলা হত ‘পদিক’। মুখে মুখে যা হয়ে দাঁড়ায় ‘শতিক’।  দশ শতিকের উপরে যিনি থাকতেন, তাঁকে বলা হত ‘সেনাপতি’।  দশ সেনাপতির উপরে যিনি থাকতেন, তাঁকে বলা হত ‘নায়ক’। ‘দলুই’ এসেছে দলপতি থেকে। অনুরূপ “চাকলাদার”, চাকলা মানে কতকগুলি পরগনার সমষ্টি। এই পরগনা সমষ্টির রক্ষাকর্তা চাকলাদার।

যিনি যে-গ্রামে জন্মাতেন বা বসবাস করতেন, তিনি কোথাকার, তার শিকড় কোথায়, তা জানান দিতেই নামের সঙ্গে উল্লেখ করা হত সেই জায়গার নাম। যেমন বটব্যাল ও বড়াল একই পদবি। এসেছে বোড়ো গ্রাম থেকে। কুশো গ্রাম থেকে এসেছে কুশারি। লোকমুখে পরে সেটা ‘ঠাকুর’ পদবিতে রূপান্তরিত হয়। ঘোষাল এসেছে ঘোশ বা ঘোশাল গ্রাম থেকে।  গড়গড়ে থেকে গড়গড়ি।পাকুর বা পর্কট থেকে পাকড়াশি। অম্বলু থেকে অম্বলি। পলশা থেকে পলসাঁয়ী। পোষলা থেকে পুষালী। পোড়াবাড়ি থেকে পোড়ারি। প্রাচীন যুগে অর্থাৎ হিন্দু আমলে এবং মধ্যযুগের মোঘল-পাঠান শাসনামলে ও আধুনিককালের শাসনামলে পদবিসমূহ কম-বেশি সংস্কারকৃত হয়ে বাঙালি মুসলমান সমাজে প্রচলিত হয়েছে। তবে কিছু পদবি আছে, যা বাঙালি সমাজে শুধু হিন্দুশ্রয়ী, কিছু পদবি একান্তই মুসলমানি, আবার বেশ কিছু পদবি হিন্দু-মুসলমান-নির্বিশেষে সমস্ত সম্প্রদায়েই নির্বিচারে ব্যবহৃত হয়। শেখ, সৈয়দ, চৌধুরী প্রভৃতি বংশ পদবি বাঙালি মুসলমান সমাজকে আশরাফ এবং আতরাফ এই দুই শ্রেণিতে বিভক্ত করেছিল। একদা এই তথাকথিত আশরাফ সম্প্রদায় বাঙালি মুসলমান সমাজে শ্রেণিবৈষম্য সৃষ্টি করেছিলেন। এদেশের সাধারণ মুসলমানকে বলা হত আতরাফ, যার আভিধানিক অর্থ নিচু সমাজ, নিচু বংশ, নিচু বর্গের লোক। একথা বলতে দ্বিধা নেই যে, একমাত্র পদবি চেতনাই বাঙালি মুসলমান সমাজে সীমিত অর্থে হলেও একটা সময় সামাজিক শ্রেণিবৈষম্য সৃষ্টি করে রেখেছিল। সেদিক থেকে বাংলাদেশের সামাজিক ইতিহাসের একটি দীর্ঘকাল পূর্বে পদবিই নির্ধারণ করে বাঙালি মুসলমানের সামাজিক মর্যাদা। অন্তত পদবির পরিচিতিতে বাঙালি মুসলমান ও বাঙালি হিন্দু জাতি গত ঐতিহ্যের শিকড়কে খুঁজে পাওয়া যায়। ধর্মগত বিভাগের খোলসের বাইরে বাঙালি হিন্দু ও বাঙালি মুসলমানের বংশগত ও পেশাগত ঐতিহ্যের গোড়ার কথা সন্ধান মেলে এই পদবি পরিচিতিতে।

শেখ, সৈয়দ, মোগল, পাঠান, কাজি, গাজি, শাহ, মিঞা, মির্জা, মোল্লা, খন্দকার ইত্যাদি কয়েকটি ভিনদেশি পদবি যা উপমহাদেশে মুসলমান আগমনের সঙ্গে জড়িত সে কয়টি পদবি ব্যতীত বাংলার অধিকাংশ পদবিই হিন্দু-মুসলমান-নির্বিশেষে প্রায় সকল ধর্মে ও বর্ণে দুর্লভ নয়। ব্রাহ্মণগণ বর্ণভেদ প্রচলন করেছিলেন ঠিকই, তার মানে এই নয় যে বর্তমানে পদবিরাজের মহিরূহ অবস্থার জন্য ব্রাহ্মণগণদের পুরোপুরি দায়ী করা যায় ! ব্রাহ্মণগণ শুরু করলেও শেষ করেছেন সমাজের একশ্রেণির প্রতিপত্তি এবং প্রভাবশালী অব্রাহ্মণ এবং সুবিধাভোগী সম্প্রদায়। উদ্দেশ্য ব্রাহ্মণ তথা বর্ণহিন্দুদের উচ্চতায় উঠবার লিপ্সা। সমাজের যে স্তরের মানুষ যেই ক্ষেত্রে প্রভাব-প্রতিপত্তিতে বলীয়ান হলেন, সেই ক্ষেত্রেই প্রভাব-প্রতিপত্তিহীন স্বজাতি হলেও সেইসব মানুষদেরকে ঘৃণা করতে শুরু করলেন । যে “মজুমদার” বংশে প্রতিপত্তি বেড়ে গেল সে হল কুলীন কায়স্থ, আর বাকি পিছিয়ে-পড়া “মজুমদার” হয়ে গেল শূদ্র। শূদ্র মজুমদাররাও কম যায় না, তাদের থেকেও পিছিয়ে-পড়া এবং দুর্বল মজুমদারদের কাপালিক বলে ঘৃণ্য করে দিল।নানা সময়ে পদবির বিবর্তনের ফলে পদবি এক হলেও গোষ্ঠী এক হলেও তাদের সবারই একইরকম পেশার পরম্পরা ছিল না। কোনো নির্দিষ্ট পেশাকে তুলনামূলকভাবে ছোটো বা বড়ো করে দেখা হত। নতুন আর-একটি বর্ণ বিভাজন তৈরি হত। যেমন “ঘোষ” পদবি। বলতে শুনি কায়স্থ ঘোষ, আবার গোয়লা বা গোয়ালা ঘোষ।  গোয়লা ঘোষ বর্ণভেদ নিয়মে কায়স্থ ঘোষের থেকে ছোটো, ঘৃণ্য প্রতিপন্ন করে। এই কায়স্থ ঘোষরা নিজেদেরকে কুলীন বলে দাবি করেন। কে ছোটো কে বড়ো, কে কুলীন কে মলিন, কে ব্রাত্য কে জাত্য – এ নিয়ে কায়স্থরা গর্বিত আলাপন করে। বলে — “বাংলাদেশে চার ঘর কুলীন – ঘোষ, বোস (বসু), গুহ, মিত্র। আর এদেশে (পশ্চিমবঙ্গে) তিন ঘর কুলীন – ঘোষ, বোস, মিত্র”।  ও বঙ্গের কুলীন গুহ এ বঙ্গে মর্যাদা হারিয়ে থেকে ব্রাত্য হয়ে গেল। কোন জাদুবলে গুহ বাদ পড়ে গেল কোনো কায়স্থ তা বোঝাতে পারেনি। কায়স্থরা আরও একটা মর্যাদাভিত্তিক ছড়া আওড়ে থাকে। খুব পরিচিত – “ঘোষ বংশ বড়ো বংশ, বোস বংশ দাতা। মিত্র বংশ কুটিল বংশ, দত্ত হারামজাদা”।  বুঝুন ! তৃতীয় শতক থেকে গৌড় বঙ্গে এবং পঞ্চম শতক থেকে উত্তরবঙ্গে ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতি স্থান পেয়েছে।

পাঁচ শতকের বিভিন্ন লিপি থেকে জানা যায় এই সময়ের ব্রাহ্মণদের প্রধান পদবি ছিল “শর্ম্মা” ও “স্বামী”।  ব্রাহ্মণদের “শর্ম্মা” পদবিটি এখনও বাংলায় আছে। তবে দক্ষিণ ভারতে “স্বামী” পদবি প্রচলিত। মূলত অষ্টম শতক থেকে মনুসংহিতা তথা ব্রাহ্মণ্যবাদের অনুশাসন জোরদার হয়েছে ভবদেব ভট্ট, কুমারিল ভট্ট, জীমূতবাহন, অনিরুদ্ধ ভট্ট, হলায়ুধ, শূলপাণি, রঘুনন্দন এবং শংকরাচার্যের নেতৃত্বে। কী অনুশাসন ? জাতপাতভেদ এবং জাতপাতভিত্তিক পদবি সংরক্ষণ। এই সংরক্ষণ ব্যবস্থার চূড়ান্ত রূপ হিন্দুরাজা বল্লালসেনের আমলে আমরা বাঙালিরা দেখতে পাই। তিনি শুধু সর্বজনবিদিত কৌলীন্য প্রথার সৃষ্টি করেননি, তিনি বাঙালিদের জন্য প্রচুর পদবি সৃষ্টি করলেন। শুধু কুলীন ব্রাহ্মণ বা কায়স্থ নয়, সৃষ্টি করলেন ৩৬টি জাত এবং তাদের ৩৬টি পদবি। বল্লালসেন ঘোষণা করলেন ৩০ বছর পর পর পরীক্ষা হবে কোনো ব্যক্তি বা পরিবার কুলীনের গুণাবলি রক্ষা করে চলতে পেরেছে কি না, রক্ষা করতে না-পারলে কুলীনত্ব হারাতে হবে। পরবর্তীতে রাজা লক্ষণসেন কৌলীন্য প্রথাটির চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করে দেন। আদেশ দিলেন কুলীনরা পুরুষাণুক্রমে কুলীনত্ব ভোগ করবেন, কোনো পরীক্ষানিরীক্ষা হবে না। মনে রাখতে হবে পদবি বিতরণের সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রণ কর্তা হল অবশ্যই ব্রাহ্মণ গুরু বা পুরোহিত। তারপরই রাজা, জমিদার, সমাজপতিদের। চতুর্বর্ণের চারটি বর্ণ – ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য এবং শূদ্র। কিন্তু এগুলি অনুসারে বঙ্গে এবং বাংলাদেশে কোনো নেই।

বাংলায় ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য বর্ণের অস্তিত্ব কোনো সময় তেমনভাবে ছিল না। কেন ছিল না, কেনই-বা নেই বলা সম্ভব নয়। বাংলার বাঙালিদের প্রধানত ব্রাহ্মণ ও শূদ্র-অন্ত্যজদের নিয়ে বর্ণবিন্যাস।কায়স্থ-করণ-অন্বষ্ঠ-বৈদ্য – এইসব সংকর বর্ণদেরকে শূদ্রগোষ্ঠীতে ফেলা হত। কায়স্থ ও করণ বর্ণ হিসাবে সমান ও অভিন্ন।অন্যদিকে শাকদ্বীপী ব্রাহ্মণ পিতা ও বৈশ্য মাতার সন্তানরা গ্রহবিপ্র বা গণক বলে পরিচিত এদেরই অন্য একটি শাখা হল অগ্রদানী। আর সূত পিতা ও বৈশ্য মাতার সন্তানরা হল ভট্ট ভাট (ভাটদের পাড়া ছিল ভাটপাড়া) ব্রাহ্মণ। এই তিন শ্রেণির ব্রাহ্মণ পতিত। তবে স্মৃতি পুরাণে বলা হয়েছে – বাংলায় ব্রাহ্মণ ছাড়া অন্য সকলেই শূদ্রের অন্তর্ভুক্ত। প্রথমেই দেখে নিই মনুবাবু কী বলছেন।

ব্রাহ্মণ কে, ব্রাহ্মণের মর্যাদাই-বা কতটা – এ ব্যাপারে “মনুসংহিতা”-য় মনু পরিষ্কারভাবে বলেছেন –

(১) “ভূতানাং প্রাণিনঃ শ্রেষ্ঠাঃ প্রাণিনাং বুদ্ধিজীবিনঃ।/বুদ্ধিমৎসু নরাঃ শ্রেষ্ঠা নরেষু ব্রাহ্মণাঃ স্মৃতাঃ”।।  (১/৯৬) অর্থাৎ, সৃষ্ট (স্থাবর জঙ্গমাদির মধ্যে) প্রাণী শ্রেষ্ঠ, প্রাণীদের মধ্যে বুদ্ধিজীবীরা শ্রেষ্ঠ, বুদ্ধিমানদের মধ্যে মানুষ এবং মানুষের মধ্যে ব্রাহ্মণ শ্রেষ্ঠ বলে কথিত।

(২) “উৎপত্তিরেব বিপ্রস্য মূর্তিধর্মস্য শাশ্বতী।/স হি ধর্মার্থমুৎপন্নো ব্রহ্মভূয়ায় কল্পতে”।।  (১/৯৮) অর্থাৎ, ব্রাহ্মণের দেহই ধর্মের সনাতন মূর্তি। তিনি ধর্মের জন্য জাত এবং মোক্ষলাভের যোগ্য পাত্র।

(৩) “ব্রাহ্মণো জায়মানো হি পৃথিব্যামধিজায়তে।/ঈশ্বরঃ সর্বভূতানাং ধর্মকোষস্য গুপ্তয়ে”।।  (১/৯৯) অর্থাৎ, জাতমাত্রেই ব্রাহ্মণ পৃথিবীতে সকল লোক অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ হন এবং সকল সৃষ্ট পদার্থের ধর্মসমূহ রক্ষার জন্য প্রভু হন।

(৪) “সর্বং স্বং ব্রাহ্মণেস্যেদ্যং যৎকিঞ্চিৎজ্জগতীগতম।/শ্রৈষ্ঠ্যেনাভিজনেনেদং সর্বং বৈ ব্রাহ্মণোঽর্হতি”।। (১/১০০) অর্থাৎ, পৃথিবীতে যা কিছু আছে, সেই সব ব্রাহ্মণের সম্পত্তি। শ্রেষ্ঠত্ব ও আভিজাত্য হেতু ব্রাহ্মণ এই সবই পাওয়ার যোগ্য।

(৫) “স্বমেব ব্রাহ্মণ্যে ভুঙতে স্বং বস্তে স্বং দদাতি চ। /আনৃশংস্যাদব্রাহ্মণস্য ভুঞ্জতে হীতরে জনাঃ”।।  (১/১০১) অর্থাৎ, ব্রাহ্মণ নিজের অন্নই ভক্ষণ করেন, নিজের বস্ত্র পরিধান করেন এবং নিজের দ্রব্য দান করেন। অন্য লোকেরা যা ভোগ করে, তা ব্রাহ্মণের দয়া হেতু করে।

আসুন, এবার ব্রাহ্মণদের পদবির উৎস খুঁজি।  মুখটি/মুখুটি – মুখোপাধ্যায় – মুখুজ্যে – মুখার্জি।   আচার্য সুনীতিকুমার বলছেন, গ্রামের নামেই ব্রাহ্মণদের পদবি ছিল।   যেমন চাটু গ্রাম থেকে চাটুতি – চট্টোপাধ্যায় – চাটুজ্যে – চ্যাটার্জি, মুখটি গ্রাম থেকে মুখুটি – মুখোপাধ্যায় – মুখুজ্যে – মুখার্জি, বন্দ্য গ্রাম থেকে বন্দ্যোপাধ্যায় – বাড়ুজ্যে – ব্যানার্জি, তেমনই ‘গঙ্গাকুলির’ থেকে গাঙ্গৌলি, গাঙ্গুলি।  মুখার্জি, চ্যাটার্জি, ব্যানার্জি, গাঙ্গুলি পদবিগুলি ইংরেজদের থেকে প্রাপ্ত হয়েছে।  পেশাগতভাবে ব্রাহ্মণের পদবির সঙ্গে আচার্য এবং উপাধ্যায় যুক্ত করে দেওয়া হল।  ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য এবং শূদ্র – এই তিন বর্ণের কাজ কী হবে ? “মনুসংহিতা”-য় মনু নির্দিষ্ট করে দিলেন। ব্রাহ্মণদের জন্য বললেন – “অধ্যাপনমধ্যয়নং যজনং যাজনং তথা।/দানং প্রতিগ্রহঞ্চৈব ব্রাহ্মণানামকল্পয়ৎ”।।  (১/৮৮) অর্থাৎ, ব্রাহ্মণদের জন্য সৃষ্টি করলেন অধ্যাপনা, অধ্যয়ন, যজন, যাজন, দান, প্রতিগ্রহ। ক্ষত্রিয়দের জন্য বললেন – “প্রজনাং রক্ষনং দানমিজ্যাধ্যয়নমেব চ।/বিষয়েষ্বপ্রসক্তিশ্চ ক্ষত্রিয়স্য সমাসতঃ”।।(১/৮৯) অর্থাৎ, ক্ষত্রিয়ের (কর্ম) সংক্ষেপে লোকরক্ষা, দান, যজ্ঞ, অধ্যয়ন ও বিষয়ে অত্যাসক্তির অভাব। বৈশ্যদের নির্দেশ দিলেন – “পশূনাং রক্ষনং দানমিজ্যাধ্যয়নমেব চ।/বণিকপথং কুসীদঞ্চ বৈশ্যস্য কৃষিমেব চ”।।(১/৯০) অর্থাৎ, পশুপালন, দান, যজ্ঞ, অধ্যয়ন, সুদে অর্থ বিনিয়োগ ও কৃষি বৈশ্যের(কর্ম)।  শূদ্রদের জন্য নির্দেশ ছিল – “একমেব তু শূদ্রস্য প্রভুঃ কর্ম সমাদিশৎ।/এতেষামেব বর্ণানাং শুশ্রূষামনসূয়য়া”।।(১/৯১) অর্থাৎ, প্রভু শূদ্রের কিন্তু একটি মাত্র কর্মের নির্দেশ দিলেন, তা হল সকল বর্ণের অসূয়াহীন সেবা। মনু বললেন, যে ব্রাহ্মণ শিষ্যের উপনয়ন করিয়ে তাকে কল্প (যজ্ঞবিদ্যা) ও রহস্য (উপনিষদ) সহ বেদ অধ্যয়ন করান, তাঁকে আচার্য বলে।

কর্নাটক থেকে বাংলায় আগত ভট্ট-ব্রাহ্মণেরা এই পেশা গ্রহণ করে ভট্টাচার্য (ভট্ট + আচার্য) হলেন।  সেনরাও কর্নাটক থেকেই এসেছে। বর্মনরা এসেছে কলিঙ্গ (অধুনা ওড়িশা) থেকে।মনু বললেন, যে ব্রাহ্মণ জীবিকার জন্য বেদের অংশমাত্র বা বেদাঙ্গ অধ্যয়ন করান, তিনি উপাধ্যায় হবেন। এই পেশা গ্রহণ করে বন্দ্য + উপাধ্যায় = বন্দ্যোপাধ্যায়, মুখু + উপাধ্যায় = মুখোপাধ্যায় ইত্যাদি।  চক্রবর্তী কিন্তু ব্রাহ্মণদের পদবি নয়, উপাধি।  উপাধি থেকেও সৃষ্টি হয়েছে প্রচুর পদবি।  যেমন রায়, চৌধুরী, সরকার, হাজারী, তালুকদার, হালদার, খাঁ।  ইংরেজ আমলেও অনেকগুলি উপাধির প্রচলন হয়েছিল পদবি হিসেবে। যেমন রায়সাহেব, রায়বাহাদুর, নাইট বা স্যর। ছিল ‘মহামহোপাধ্যায়’ খেতাবও।  এটা এতটাই লোভনীয় ও সম্মানজনক ছিল যে, নামের পরে পদবি হিসাবে নয়, প্রাপকরা তাঁদের নামের আগেই ব্যবহার করতে শুরু করেছিলেন।“ঠাকুর” বাঙালি পদবি বা উপাধি, “ঠাকুরমশাই” শব্দটি থেকে সাধিত শব্দ। তদানীন্তন কোনো কোনো বাঙালি ব্রাহ্মণ পরিবারের যেমন, কুশারি অথবা ভট্টাচার্য পদবিবিশিষ্ট মানুষদের সম্মান করে “ঠাকুরমশাই” বলে ডাকত। এই ডাকার ফলে পরে তা ‘ঠাকুর’ রূপে বদলে গিয়েছিল।  নিম্মবর্ণের লোকেরা উচ্চ আধ্যাত্মিক তথা ব্রাহ্মণ পদবিধারী কোনো ব্যক্তিকে শ্রদ্ধা প্রকাশ করে “ঠাকুর “বলে ডাকা হয়। কারও কারও মতে অবশ্য কারও নামের শেষাংশ থেকে নয়, ‘ভারত’ শব্দের আদি অর্থ ছিল ‘গল্প’। তা থেকে ‘ভর্ত্ত’।  পরে মুখে মুখে তা ‘ভট্ট’ হয়ে যায়। ‘দেব’ শব্দটি কিন্তু ইতিহাস-খ্যাত ক্ষত্রিয় রাজাদের নামেই দেখা যেত। এই দেব শব্দেরই অপভ্রংশ রূপ দে।  আবার গোড়ায় ফিরে যাওয়া যাক। সে রকম নামের কেউ বিখ্যাত হয়ে গেলে তাঁর পরবর্তী প্রজন্মরা নিজেদের ওই বিখ্যাত লোকের উত্তরাধিকারী বোঝানোর জন্য নিজের নামের সঙ্গে সেই বিখ্যাত লোকের নামের শেষাংশটা জুড়ে দিতেন। যেমন বাণভট্ট, আর্যভট্ট। এঁরা অত্যন্ত প্রভাবশালী স্ব্স্ব ক্ষেত্রে বিখ্যাত মানুষ ছিলেন, এঁদের পরম্পরা অনুসারে উত্তসুরীদের সকলে চিনত। তাই তাঁদের নামের পাশে পুর্বপুরুষের নামের দ্বিতীয় অংশ ব্যবহার করতেন।

এইভাবে বাণভট্ট বা আর্যভট্টের উত্তরসুরীরা তাদের নামের পর ভট্ট লিখতে শুরু করেন। এই ভট্টরাই পরবর্তীতে ভট্টাচার্য ( ভট্ট + আচার্য )। যেমন ঈশ্বরঘোষ বা অনন্তঘোষ, অশ্বঘোষ।এভাবেই বিশ্ববসু বা পৃথ্বীবসু থেকেই ‘বসু’ পদবির উৎপত্তি। বিষ্ণুশর্মা থেকে শর্মা, কৃষ্ণস্বামী থেকে স্বামী, চন্দ্রবর্মা থেকে বর্মা পদবির আবির্ভাব।মহাবল, ইন্দ্রবল জাতীয় নাম থেকে ‘বল’ । পরহিতভদ্র, শান্তরক্ষিত, কমলশীল, বুদ্ধগুহ, বিশুদ্ধসিংহ, ধনগুপ্ত, কল্যাণমিত্র, জগৎমিত্র বিমলমিত্র থেকে এসেছে যথাক্রমে ভদ্র, রক্ষিত, শীল, গুহ, সিংহ, গুপ্ত, মিত্র পদবি।একইভাবে এসেছে ধর, দেব, দত্ত, সেন, সোম, চন্দ্র, যশ বা দাস। এই সময়ে দেখুন – আনন্দশংকর, রবিশংকর, অমলাশংকর, মমতাশংকর, তনুশ্রীশংকর ইত্যাদি।

আমি তো ছোটোবেলায় “শংকর” পদবি জানতাম, পরে জনেছি পদবি নয় এটি নামের অংশ। ডিগ্রি বা পদমর্যাদাও পদবিতে যুক্ত হল। “মুন্নাভাই এমবিবিএস” নতুন কিছু নয়। এই কিছুকাল আগেও অনেকেই নামের পাশে বি এ, এম এ, বি এড লিখতেন। তেমনই তারও বহু আগে যাঁরা একটা বেদ পাঠ করতেন, তাঁদের বলা হত পণ্ডিত। বাংলার বাইরে যা হয়ে যায় পাণ্ডে। যাঁরা দুটো বেদ পাঠ করতেন, তাঁদের বলা হত দ্বিবেদী। বাংলার বাইরে যাঁরা দুবে হিসাবে পরিচিত। তিনটে বেদ পাঠ করতেন যাঁরা, তাঁদের বলা হত ত্রিবেদী। বাংলার বাইরে এঁরাই হয়ে যান তেওয়ারি। চারটে বেদ যাঁরা পড়তেন, তাঁদের বলা হত চতুর্বেদী। বাংলার বাইরে তাঁরাই চৌবে। তবে হ্যাঁ, বংশের কোনো একজন পণ্ডিত হলে, তাঁর পরবর্তী প্রজন্মের কেউ তিনটে বেদ পড়লেও তিনি কিন্তু আর ত্রিবেদী বা তেওয়ারি হয়ে উঠতে পারতেন না। তাঁকে পণ্ডিত পদবি নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হত। তেমনই দুটি বা তিনটি বা চারটে বেদ পড়া কারও বংশধর যদি একটিও বেদ না পড়তেন, তাঁরাও শুধুমাত্র উত্তরাধিকার সূত্রেই ওই পূর্বের পদবিই ব্যবহার করবেন। তৎকালীন ওড়িশা, বর্তমানে মেদিনীপুরের পদবি “পাঁজা” এসেছে পাঞ্জা থেকে।

মোঘল আমলে পাঞ্জা ছাপ দেওয়া কোনো বাদশাহি সনদপ্রাপ্তি বা ভূমি দানের স্মৃতিকেই বংশ গৌরব হিসাবে ধরে রাখার জন্য পাঞ্জা ছাপ থেকে পাঞ্জা এবং তা থেকে পাঁজা পদবির সৃষ্টি। পায়রা মানে কিন্তু কবুতর নয়। শীতের প্রথমে খেজুর গাছের রস থেকে গুড় বানাতে হলে গাছটির গুঁড়ি খানিকটা কেটে কলসি ঝুলিয়ে দিতে হয়। নিয়ম হল, পর পর তিন দিন গুঁড়ি কাটা যাবে ও রস গ্রহণ করা যাবে। তার পর তিন দিন বিশ্রাম। এই বিশ্রামের পর প্রথম যে দিন আবার গুঁড়ি কাটা হবে, তার রস থেকে যে গুড় তৈরি হয়, তাকে বলা হয় পায়রা।  অর্থাৎ পহেলা বা পয়লা শব্দ থেকেই পয়রা, পয়ড়্যা ও পায়রা। “মান্না” এসেছে হয়তো মান্য থেকে। ধনবান বা ধনাঢ্য থেকে এসেছে আঢ্য।  পরে আড্ডি। ভুঁইয়া হল ভৌমিকের অপভ্রংশ রূপ। শা এসেছে সাধু বা সাউ থেকে। “সাধু”-র সঙ্গে খাঁ উপাধি যুক্ত হয়ে সাধুখাঁ হয়েছে। ‘তা’ এসেছে হোতা থেকে। হোমক্রিয়ার পুরোহিত, যার আদি রূপ হোত্রী। যেমন অগ্নিহোত্রী।  ভড় শব্দের অর্থ মালবাহী বড় নৌকো বা বার্জ। আবার ভড় হচ্ছে প্রাচীন গৌড়ের একটি অঞ্চলের নাম। কারও কারও মতে, “ভড়” এসেছে ভদ্র থেকে। ঢোল পদবিধারীরা ছিলেন আসলে সান্যাল। এঁদের যৌথ পরিবারটি ছিল বিশাল। প্রায় দুশো জনের মতো।  খাবারের সময় ঢোল বাজিয়ে সবাইকে ডাকা হত।  অন্য পরিবার থেকে পৃথকভাবে চিহ্নিত করার জন্যই এঁদের নামকরণ হয় ঢোল-সান্যাল। পরে সান্যাল উঠে শুধু ঢোল হয়ে যায়। কোনো কোনো পরিবার পরম্পরায় ঢোল উঠে গিয়ে সান্যালও রয়ে গেল। ‘লাহা’ এসেছে সুবর্ণরেখার নিকটবর্তী অঞ্চলে লাক্ষা চাষ করা থেকে। ‘রাহা’ বোধ হয় এরই অপভ্রংশ রূপ। ‘নাহা’ও তাই। তবে নাহার আর-এক অর্থ ছোটো নদী বা খাল।  তা থেকেও নাহা এসে থাকতে পারে।

১৫১০ সালে আনন্দভট্ট রচিত ও ১৯০৪ সালে এশিয়াটিক সোসাইটি অফ ইন্ডিয়া কর্তৃক প্রকাশিত “বল্লাল চরিত” নামক বইয়ে হিন্দু সমাজে পদবি প্রচলন সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরা হয়েছে (তথ্যসূত্র : সমাজদর্পণ ১৫ বর্ষ, সংখ্যা ১২ ; জুন ১৯৯৯)।  ওই গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে, গৌড়ের বৈদ্যবংশীয় রাজা বল্লালসেন(১১৫৮-১১৭৯ সাল) নিজ সহধর্মিণী থাকা অবস্থায় অধিক বয়সে পদ্মিনী নাম্নী এক সুন্দরী ডোম নর্তকীকে বিয়ে করেন। এতে দেশজুড়ে রাজার সুনাম বিনষ্ট হয় এবং এ কুকীর্তি নিয়ে প্রজারা সমালোচনা শুরু করে দেন।  রাজা এই কলঙ্ক থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য সকল সম্প্রদায়ের প্রজাদের এক সম্মিলিত ভোজ অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। কিন্তু, সকল সম্প্রদায়ের লোকেরা উপস্থিত থাকলেও নমশূদ্র বিপ্রগণ এই ভোজ অনুষ্ঠানে যোগদানে বিরত থাকেন, অথাৎ রাজার এই কুকীর্তিকে সমর্থন করে তারা ভোজসভায় অংশ নেয়নি। রাজা তাদের ব্যবহারে অসন্তুষ্ট হন এবং নমশূদ্র লোকদের চাকরিচ্যূত করেন। শুধু তাই নয়, রাজা তাদের চণ্ডাল বলে গালাগাল করে নগর-বন্দর থেকে উৎখাতও করে দেন। অন্যদিকে ভোজসভায় অংশগ্রহণকারী সম্প্রদায়ভুক্তরা রাজার সকল কর্মকাণ্ডকে সমর্থন দিয়ে রাজার অনুগ্রহ লাভ করতে যত্নবান হন। রাজাও এসব সম্প্রদায়কে সাহায্য করেন এবং অনেক সম্প্রদায়কে কৌলীন্য বা পদবি দান করেন। এভাবেই বল্লালসেন পদবি বৈষম্য সৃষ্টি করে হিন্দুসমাজে বিষাক্ত বীজ বপন করেছিল যা বর্ণভেদকে আরও শক্তিশালী করে। বল্লালসেনের পরবর্তী বংশধর লক্ষ্মণসেনের ভূমিকাও ছিল লজ্জাকর। এই বর্ণভেদ আজও আমাদেরকে দুর্বল করে রেখেছে। সেনরাজারা বাঙালি ছিলেন না। তবুও, পদবি-বৈষম্য সৃষ্টি করে বাঙালিদের শাসন করাই ছিল তাদের মূল উদ্দেশ্য।

অষ্টম শতকে বাংলাদেশে চরম নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলার পর গ্রাম সভা ও বিশিষ্ট নাগরিকরা সাধারণ একজনকে সম্রাট পদে বসিয়ে দিয়েছিলেন, যার নাম ‘গোপাল’। কিন্তু এই গোপালের নামের শেষাংশ ধরে রাখবার প্রচেষ্টায় উত্তরাধিকাররা ক্রমান্বয়ে সকলেই নামের শেষে গোপাল এর ‘পাল’ অংশকে পদবি হিসাবে ব্যবহার করতে থাকেন, পরে তাই ঐতিহাসিক “পাল” বংশের সূত্রপাত ঘটে। বল্লালসেনের আমলে ছত্রিশটি জাত সৃষ্টি করে ছত্রিশটি আলাদা মর্যাদা তৈরি করা হয়েছিল।  সমাজে এভাবে ছত্রিশটি প্রধান পদবিরও সৃষ্টি হয় পেশাগুণে। এর পর ৩৬টি জাতে আরও হাজার রকম বিভাজন ঘটে এবং হাজার হাজার পদবির সৃষ্টি হয় বাংলার সমাজে। এই সব হাজার হাজার পদবির উত্তরাধিকারত্ব লাভ করেছে ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সকল বাঙালি বৌদ্ধ, বাঙালি হিন্দু এবং বাঙালি মুসলমান। তাই দেখি চৌধুরী, তালুকদার, বিশ্বাস, মজুমদার, খান, মলি, মুন্সি, সরকার, সরদার প্রভৃতি প্রায় সকল পেশাগত সামাজিক পদবি রয়েছে হিন্দু, মুসলমান ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ে প্রায় সমানভাবে।বাঙালি হিন্দু বা মুসলমান কিংবা খ্রিস্টান অথবা বৌদ্ধসমাজে পদবি এসেছে বিচিত্রভাবে।  মুসলিমদের আরও কয়েকটি পদবি বিশ্লেষণ করে দেখা যাক।  চলুন।

“মির” বা “মীর” শব্দটি এসেছে আরবি থেকে।  আরবি শব্দ ‘আমীর’-এর সংক্ষিপ্ত রূপ হচ্ছে মীর। সেই অর্থে “মীর” অর্থ দলপতি বা নেতা, প্রধান ব্যক্তি, সরদার ইত্যাদি। জিতে নেয়া বা জয়ী হওয়া অর্থে মীর শব্দের ব্যবহার হত। তবে মীরবংশীয় লোককে সম্ভ্রান্ত এবং সৈয়দ বংশীয় পদবিধারীর একটি শাখা বলে গবেষকগণ মনে করেন। “মিঞা” মুসলিম উচ্চপদস্থ সামাজিক ব্যক্তিকে সম্বোধন করার জন্য ব্যবহৃত সম্ভ্রমসূচক শব্দ। এক অর্থে সকল মুসলমানের পদবিই হচ্ছে মিঞা । অনুরূপ, বাঙালি হিন্দুর ‘মহাশয়’-এর পরিবর্তে বাঙালি মুসলমান “মিয়া” শব্দ ব্যবহার করে থাকে। “সৈয়দ” পদবি মূলত এসেছে নবি-নন্দিনী হজরত ফাতেমা ও হজরত আলির বংশধর থেকে। প্রায় দেড় হাজার বছর আগের এই বংশের সঙ্গে কোনো যোগসূত্র না থাকলেও বাংলাদেশের অনেক মুসলমান পরিবার সৈয়দ বংশ পদবি ব্যবহার করে নিজেদের সম্ভ্রান্ত ও কুলীন (খানদান ?) মুসলমান বলে দাবি করে থাকেন। “শেখ” আরবি থেকে আসা পদবি। সম্ভ্রান্ত মুসলমানদের সম্মানসূচক বংশ পদবি শেখ। যিনি সম্মানিত বৃদ্ধ অথবা যিনি গোত্রপ্রধান, তাকেই বলা হত শেখ। হজরত মোহাম্মদ (সঃ) সরাসরি যাকে বা যাঁদের ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করেছিলেন, তিনি বা তার বংশধরও “শেখ” হিসাবে অভিষিক্ত হতেন অথবা শেখ পদবি লাভ করতেন।

বাঙালি মুসলমান সমাজে যারা শেখ পদবি ধারণ করেন, তারা এ রকম ধারণা পোষণ করেন না যে, তারা বা তাদের পূর্বপুরুষরা এসেছিলেন সৌদি আরব থেকে। “মোল্লা” শব্দের অর্থ করা হয়েছে মুসলমান পুরোহিত। বস্তুত এভাবে মসজিদে নামাজ পরিচালনার কারণেও অনেকে মোল্লা উপাধি পেয়েছিল এবং তার পর থেকেই মোল্লা পদবির ব্যবহার শুরু হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে, মোল্লা হচ্ছে তুর্কি ও আরবি ভাষার “মোল্লা” থেকে আসা একটি শব্দ, যার আভিধানিক অর্থ হচ্ছে পরিপূর্ণ জ্ঞানবিশিষ্ট মহাপণ্ডিত ব্যক্তি। অন্য অর্থে মুসলিম পণ্ডিত বা ব্যবস্থাপক বা অধ্যাপক হলেন মোল্লা। পরবর্তীকালে মসজিদে নামাজ পরিচালনাকারীমাত্রই “মোল্লা” নামে অভিহিত হতে থাকে। এখান থেকেই সাধারণত বংশ-পদবি হিসাবে তা ব্যবস্থার হওয়া শুরু হয়। তাঁরা সকল জ্ঞানের জ্ঞানী না-হওয়া সত্ত্বেও মোল্লা পদবি ধারণ করে। সেইজন্য বোধহয় ‘মোল্লার দৌড় মসজিদ পর্যন্ত’ প্রবাদের উৎপত্তি হয়েছে। বাঙালি মুসলমানের পদবি ব্যবহারের উদ্যোগ খুব বেশি প্রাচীন না হলেও, তাতে কম করে হলেও হাজার বছরের স্মৃতি জড়িয়ে আছে। বাঙালির বংশ-পদবিগুলির মধ্যে রয়েছে কিছু আঞ্চলিক পদবি, শুধু অঞ্চল থেকেই তার জন্ম ও ব্যবহার। কিছু পদবি আছে একেবারে বাঙালির জাতীয়। সারা বঙ্গ জুড়েই তার প্রসার। কয়েকটি অবশ্য ধর্মীয় পদবি আছে, যা হিন্দু-মুসলমানদের একান্ত নিজস্ব। তবে জনপ্রিয় পদবিগুলির বেশিরভাগই ধর্মনিরপেক্ষ এবং একান্তভাবে বাঙালির সম্পদ। সেই কারণেই সব পদবিধারী মানুষকে সব অঞ্চলে দেখা যায় না। উদাহরণ দিতে পারি – “বেরা”, “মাইতি” পদবিধারীগণ সাধারণত মেদিনীপুরে বাসিন্দাদের ভেতর পাওয়া যায়। আবার “পায়রা” “পট্টনায়ক” পদবিধারীরা ওড়িশায়। হিন্দু হল, মুসলিম হল – এবার বৌদ্ধদের পদবি নিয়ে সামান্য আলোকপাত করে এই আলোচনায় ইতি টানব।

বাঙালি বৌদ্ধরা বড়ুয়া (এরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ), রাজবংশী, সিকদা, মুৎসুদ্দি, তালুকদার, চৌধুরী ও সিংহ পদবি করে থাকে।  আরাকানি শাসনামলে আরাকানি পদবিও ব্যবহার করত।  বর্তমান সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি বৌদ্ধদের মধ্যে ব্যবহৃত বড়ুয়া পদবিটা শুধু চট্টগ্রামের ও আসাম-ত্রিপুরায় যথাক্রমে বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণরা ব্যবহার করে না, বিশ্বের অনেক অঞ্চলের অনেক সম্প্রদায়ে এ শব্দটা ভিন্ন ভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়। তবে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে উপরোক্ত পদবিগুলি বৌদ্ধরা ব্যবহার করতে থাকে মূলত ব্রিটিশ শাসনামল থেকে।  বৌদ্ধধর্মে কোনো ধরনের বর্ণপ্রথা না-থাকার কারণে বিভিন্ন শাসকের শাসনামলে শাসনকার্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে শাসকের কাছ থেকে সুযোগসুবিধা নিয়ে বা সুযোগসুবিধা নেওয়ার জন্য বিভিন্ন পদবি গ্রহণ করেছে, এখনও স্বেচ্ছায় অনেকে পদবি পরিবর্তন করছে। অন্যদিকে মেয়েরা যেন পদ্মপাত্রে জল, সর্বদাই করছে টলমল। প্রাক-বিবাহে এক পদবি, বিয়ের পরে অন্য পদবি, বিবাহ বিচ্ছিন্ন হলে ফের পিতার পদবি, পুনর্বিবাহে আবার আর-এক নতুন পদবি ।  যখন নারী যে পাত্রে থাকে, তখন সে সেইরূপ ধারণ করে। এজন্যই কি বিবাহের “পাত্র” চাই ? অথচ একদা এমন সময় তো ছিল যখন পুরুষরা পদবিধারী হলেও মেয়েরা নয়। বিবাহিত স্ত্রীলোকের নামকে স্বামীর পরিচয়যুক্ত করা সারা ভারতবর্ষে কোথাও কোনোকালেই ছিল না। কে বা কারা যে এসব প্রচলন করল কে জানে ! মেয়েদের নামের সঙ্গে যুক্ত করা হত দাসি, অথবা দেবী। সরলা দাসি, ভগবতী দেবী ইত্যাদি। পরিশেষে বিনীত নিবেদন, মানুষের সৃষ্ট এ জাত ও পদবি একজন মানুষের সঙ্গে অন্য মানুষের অনেক দূরত্ব সৃষ্টি করেছে । এতে হিন্দুসমাজের অপূরণীয় ক্ষতি সাধিত হয়েছে । অসংখ্য নিম্নশ্রেণি ও বর্ণের হিন্দুরা ধর্ম ত্যাগ করেছে ।

একজন মানুষ তার কর্মগুণে স্বীকৃতি লাভ করুক, এটা আজ সকলের প্রত্যাশা হোক। সূর্য ও চাঁদ যেমন ধনী-গরিব-বর্ণ-জাত-নির্বিশেষে সমান আলো বিতরণ করে, তেমনই সকলকে সমান সামাজিক মর্যাদা যেন আমরা দিতে পারি ।যেমন ইসকনের দীক্ষা অনুষ্ঠানে দীক্ষাপ্রাপ্ত ভক্তরা তাদের সবাই সামাজিক পদবি বিসর্জন দিয়ে ‘দাস’ পদবি গ্রহণ করছেন । সকলপ্রকার ভেদাভেদ ও অস্পৃশ্যতা ভুলে একে অন্যের আপনজনে পরিণত হয়েছে ।  সমাজ সামান্য সামান্য করে হলেও বদলাচ্ছে। এখন আর নাপিতের ছেলে নাপিত হয় না, তাঁতির ছেলে তাঁতি হয় না। তারাও এখন উপযুক্ত শিক্ষাদীক্ষা লাভ করে তথকথিত উচ্চবর্ণের একচেটিয়া পেশায় থাবা বসিয়েছে।  নাপিতের ছেলে নাপিত না-হয়ে কোনো রাষ্টায়ত্ত ব্যাংকের ম্যানেজার হলেও ব্রাহ্মণের পুত্রকন্যারা আবার নাপিতের পেশা বেছে নিচ্ছেন, যার আধুনিক নাম বিউটিপার্লার। ধোপার পুত্রকন্যাদের ধোপার পেশা না-করে আইপিএস অফিসার হতে বাধা নেই যেমন, তেমনই উচ্চবংশীয় পুত্রকন্যারা লন্ড্রি ইন্ডাস্ট্রিতে যুক্ত হচ্ছেন। ইত্যাদি। এইভাবে সামাজিক মর্যাদার কিছুটা করে পরিবর্তন হচ্ছে বইকি। পেশাভিত্তিক পরিচয়ের উপর ভিত্তি করে সামাজিক মর্যাদা একসময় নিষিদ্ধ হয়ে যাবে, যাবেই।

 রবীন্দ্রনাথ তাঁর “নামের পদবী” (১৯৩১) প্রবন্ধে বলেছেন – “……মেয়েরই হোক, পুরষদেরই হোক পদবী মাত্রই বর্জন করবার আমি পক্ষপাতী।  ভারতবর্ষে অন্য প্রদেশে তার নজীর আছে…”। বিবেকানন্দ এক প্রশ্নের উত্তরে বলেছেন – “জাতপাতের কুসংস্কারের সঙ্গে ধর্মপালনের কোনো সম্পর্ক নেই।  জাতপাত হল সামাজিক ক্ষমতার অপববহার সৃষ্টি”।  আচ্ছা, আমরা যারা ভারতীয় তাদের পদবি এমন হলে কেমন হত –- এই ধরুন আমার নাম অনির্বাণ ভারত, আপনার নাম সাত্যকী ভারত। ওর নাম কোয়েল ভারত।  তার নাম আয়েসা ভারত। আমার পাশের পাড়ার প্রতিবেশীর নাম সিরাজুল ভারত, রাজ্জাক ভারত।  দেশের পরিচয়ে আমাদের সকলের পরিচয় হোক। থাকবে না বনেদি কিংবা কুলীনপনার দম্ভ, থাকবে না অন্ত্যজদের কুঁকড়ে যাওয়া, ন্যূব্জ হওয়া। মানুষের পরিচয় শুধুই মানুষ। ভেবে দেখুন সকলেরই ধর্মহীন, জাতপাতহীন একটা পদবি হলে মন্দ হবে না।

লিখেছেনঃ – অনির্বাণ বন্দ্যোপাধ্যায়
তথ্যসূত্র : (১) ঋগবেগ, (২) মনুসংহিতা, (৩) নিম্নবর্গের ইতিহাস – গৌতম ভদ্র ও পার্থ চট্টোপাধ্যায়, (৪) প্রাচীন ভারত : সমাজ সাহিত্য –- সুকুমারী ভট্টাচার্য, (৫) আমাদের পদবির ইতিহাস __ লোকেশ্বর বসু, (৬) সংস্কৃতির ধর্ম : ধর্ম ও সংস্কৃতি __ নন্দগোপাল সেনগুপ্ত, (৭) পদবির উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশের ইতিহাস –- খগেন্দ্রনাথ ভৌমিক, (৮) হিন্দু জাত-পাত পদবির ভবিষ্যৎ — নীলকণ্ঠ ঘোষাল, (৯) সনাতন ভাবনা ও সংস্কৃতি ব্লগ, (১০) ধম্মইনফো ব্লগ, (১১) সামহোয়্যারইন ব্লগ।