বিলেতে এসে এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চড়িয়ে চিটিয়ে থাকা বন্ধুদের সাথে কথা বলে মনে হলো বাংলাদেশের ৬৪টি জেলার মধ্যে যেসব জেলার লোকজন দেশের বাইরে থাকে তার মধ্যে সংখ্যার বিচারে কিশোরগঞ্জের লোকজন তুলনামূলক কম। এখানকার একটি বাংলা পত্রিকায় সাংবাদিকতা কিংবা মাতৃভুমির সেই ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড় ছোট ছোট গ্রাম গুলির প্রতি অকৃত্রিম ভালবাসার কারণেই হোক প্রবাসের কর্মব্যস্ততায় দিন শেষে বাসায় ফিরে পত্রিকাগুলো না দেখলে মনেহয় কি যেন অপূর্ণ রয়ে গেল। সেদিন দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি পত্রিকায় হঠাৎ ধনী কিশোরগঞ্জ এই শিরোনামে একটি নিউজ দেখে চোখ আটকে গেল। নিউজটা পড়ার আগে নিজের মধ্যে একটা মিশ্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হলো যদিও আমি ব্যাক্তিগতভাবে এই সাংবাদিক সম্পর্কে জানি, সে সবসময় এ রকম চমকপ্রদ, তথ্যবহল এবং বস্তুনিষ্ট সংবাদই করে থাকে তারপরও অসংখ্য চিন্তা মাথায় আসলো। খবরটা একদিকে যেমন আমাকে আন্দোলিত করেছে সাথে সাথে ব্যাথিতও করেছে। কিশোরগঞ্জ যদি সত্যি সত্যিই ধনী জেলার তালিকায় চলে আসতে পারতো তাহলে বোধহয় আমার চেয়ে বেশী খুশি কেউ হতো কিনা সন্দেহ। প্রাসঙ্গিক কারণেই উলেস্নখ্য যে সরকারের দারিদ্র মানচিত্রে কিশোরগঞ্জকে হঠাৎ ধনী এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করে চলমান স্কুলে বিস্কুট ফিডিং কর্মসূচির তালিকা থেকে এ জেলার নাম বাদ দেওয়া হয়।

হাওরের সেই দ্বীপসম ছোট কোনো অজপাড়া গায়ে জন্ম হয়েছিলো বলে দেখার সৌভাগ্য হয়েছিলো জীবন সংগ্রাম কি এবং কতটা কঠিন। যেখানে মানুষকে শুধু দু’বেলা ভাত-রুটি জোগার করার জন্যই সংগ্রাম করতে হয়না বরং নিজের কিংবা পুর্বপুরুষেরা রেখে যাওয়া বসত ভিটাকে নদী ভাঙ্গন, বন্যার উত্তাল ঢেউ থেকে রৰার জন্যও যুদ্ধ করতে হয়। জেলার প্রায় ৭ টি উপজেলা নিয়ে গঠিত এ হাওরাঞ্চলে সারাবছরে একটি মাত্র ফসল ফলে যার উপর নির্ভর করে সংসারের খরচ, সনত্দানের পড়াশুনা এবং মহাজনের ঋন কিন্তু সেই ফসলটিও যখন অকাল বন্যার পানিতে তলিয়ে যায় আর এ দৃশ্য দেখে কৃষকের চোখের পানি এবং অকাল বন্যার পানি মিশে একাকার হয়ে যায়…. পরিণতিতে তাদেরকে জীবিকার সন্ধানে আশ্রয় নিতে হয় ঢাকার কোনো বসত্দিতে কিংবা অন্যত্র। তারপরও কিভাবে কিশোরগঞ্জ জেলাকে ধনী জেলা হিসেবে আখ্যায়িত করা হলো তা অনেকের মতো আমার কাছেও বোধ্যগম্য নয়।

বিলেত মানে লন্ডন বলা যায় এ যেন প্রবাসে একখন্ড বাংলাদেশ। বাঙ্গালী হিসেবে নিজেদের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি সর্বোপরি বাঙ্গালীয়ানার কি চান আপনি এখানে… এখন আপনি সবই পাবেন এই একখন্ড বাংলায়… শুধু হরতাল ছাড়া সবই হচ্ছে এখানে… আওয়ামী লীগ, বিএনপি, সভা-সমিতি, রাস্তায় প্রতিবাদ কর্মসুচি, দলীয় কোন্দল, সংবর্ধনা, পদের জন্য লবিং, শুধু তাই নয় এখানে হয়তো রমনার বটমুল নেই কিন্তু তাই বলে বৈশাখী মেলায় হাজার হাজার মানুষের ঢল নামবেনা তা তো হতে পারেনা।

এ দেশে এখন ছয়টি বাংলা টিভি চ্যানেল অবিরাম সম্প্রচারিত হচ্ছে। এছাড়া ব্রিটিশ পার্লামেন্টে প্রথম বাঙ্গালী এমপি, নির্বাচিত নির্বাহী মেয়র, দেশজুড়ে অগণিত কাউন্সিলর, দেশের বাইরে প্রথম স্থায়ী শহীদ মিনার, শাপলা চত্তর, ইউরোপের সবচেয়ে বড় মসজিদ এবং সর্বোপরি এথনিক নাগরিক হিসেবে বাঙ্গালীদের সুনাম একজন বাঙ্গালী হিসেবে নিজেকে গর্বিতই মনে হয়। এ দেশ থেকে এখন অসংখ্য বাংলা পত্রিকা প্রকাশিত হয় যদিও কোন দৈনিক পত্রিকা নেই কিন্তু বাঙ্গালী অধ্যুষিত প্রায় প্রতিটি ছোট ছোট শহর থেকে সাপ্তাহিক/পাৰিক বাংলা পত্রিকা বের হয়। একজন সংবাদকর্মী হিসেবে পত্রিকা পড়া রুটিন কাজগুলোর মধ্যে একটা। আবারো সেই কিশোরগঞ্জ। সেদিন আবারো এখানকার একটি পত্রিকায় শীর্ষ সাত এই শিরোনামে একটি খবর দেখে আমার চোখ থেমে গেল। যদিও এখানকার কাগজ গুলোতে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গুরুত্বপুর্ণ খবর ছাড়া বাংলাদেশের যেসব আঞ্চলিক খবর প্রকাশিত হয় তার অধিকাংশই সিলেটের খবর। খবরটি পড়ে দেখলাম বর্তমানে বাংলাদেশ সরকারের শীর্ষস্থানীয় সাত ব্যাক্তির জন্মই কিশোরগঞ্জ জেলায়। নাম গুলো যদিও আপনারা সবাই জানেন।তারপরও আরেকবার মনে করিয়ে দিচ্ছি।

১. রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান ২. প্রধান বিচারপতি মোঃ মোজাম্মেল হোসেন ৩. স্পিকার এ্যাডঃ আব্দুল হামিদ ৪. স্থানীয় সরকারমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ৫. প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা আলাউদ্দিন আহমেদ ৬. সেনাপ্রধান জেনারেল আব্দুল মুবিন চৌধুরী ৭. মরক্কোর রাষ্ট্রদুত সাবেক আইজিপি নুর মোহাম্মদ।

ভাবতে ভালই লাগে দেশের বর্তমান শীর্ষ সাতের জেলা কিশোরগঞ্জে জন্ম হয়েছিল আমার যদিও আমি নিজেকে এর চেয়ে বেশী সৌভাগ্যবান মনে করি এই ভেবে যে আমার জন্ম হয়েছিলো ভারত উপমহাদেশের প্রথম র্যাং লার এক সময়ের ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি আনন্দমোহন বসুর গ্রামে। দেশের শীর্ষ সাতটি পদ অলংকৃত করার জন্য যদি কিশোরগঞ্জকে ধনী জেলার তালিকায় অন্তভুক্ত করা হয় তাহলে আমার কিছু বলার নাই। কিন্তু বাস্তবতা কি তাই ? এই সরকারের গত আড়াই বছওে উলেখ্য করার মতো এমনকি পরিবর্তন কিশোরগঞ্জে হয়েছে যার জন্য এই জেলাকে এখন ধনী বলে আখ্যায়িত করা যায় ? সেই শুরু থেকেই আওয়ামী লীগের সাথে কিশোরগঞ্জের এক নিবিড় সম্পর্ক তাই আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলে কিশোরগঞ্জের উন্নয়ন হবে এমনটাই অনেকে প্রত্যাশা করে। কিন্তু এক সময়ের স্রোতসীনি নরসুন্দার দিকে থাকালে যখন দেখি এ যেন এক কচু আর হেলেঞ্চা ৰেত, পৌরসভার ড্রেনও বটে, দুই পাড় থেকে যেভাবে নরসুন্দাকে চেপে ধরেছে দখলদার বাহিনী অধুর ভবিষ্যতে নরসুন্দা নামে কোন নদী থাকবে নাকি ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে সেটি কোনো আবাসিক হোটেলের নাম হয়ে যাবে তা আজ সত্যিই প্রশ্নবিদ্ধ-

রাস্তাঘাটের এমন বেহাল দশা মনেহয় কোন গর্ভবতী মহিলা রিক্সায় চড়লে হয়তোবা সিজারের টাকা বেচে যাবে, বেকারত্বের হতাশায় প্রতিটি মহল্লায় বেড়েছে মাদকের চড়াচড়ি, বেড়েছে ধনী-গরীবের বৈষম্য শুধু তাই নয় শুনি বিদ্যুৎ পরিস্থিতির চরম অবনতি হয়েছে যেমনটা দেখে এসেছিলাম গত দুই বছর পূর্বে। ভারত উপমহাদেশের প্রথম র্যাং লার, বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি, বাংলাদেশের প্রথম মহিলা কবি, বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ঈদের জামাত, বর্তমান সরকারের শীর্ষস্থানীয় সাত ব্যাক্তির জন্মস্থান এই কিশোরগঞ্জ জেলা যেন এতো পদ-পদবীর ভাড়ে নুজু। এ যেন খ্যাতির বিড়ম্বনা। শুধু পদ-পদবী আর কাগজে ধনী কিশোরগঞ্জ নয় বাস্তবে একটি আধুনিক ও উন্নত জেলা হিসেবে কিশোরগঞ্জের নাম চড়িয়ে পড়বে দেশে-বিদেশে এমনটাই প্রত্যাশা করে কিশোরগঞ্জ বাসীর সাথে আমার মতো প্রবাসীরা।

গাজী মহিবুর রহমান ,সাংবাদিক, প্রবাসবাংলা
মানচেষ্টার, যুক্তরাজ্য
Email: [email protected]