হাবিবুর রহমান সাহেবের সবকিছুই কেমন যেন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে৷ ইদানিং অনেক কিছুই ভুলে যান৷ অসময়ে মনে পড়ে আবার মনে পড়ে না৷ এই তো সবে সাতচল্লিশ পা দিলেন, এ বয়সে তো এ রকম হবার কথা না৷ নিজের খেয়ালীপনার কথা ভেবে ভেবে বিব্রত হন৷ আশ্চর্যের বিষয় বিব্রতকর সব কয়টি ঘটনাই তার মনে আছে৷ এই তো সেদিন টাই না বেধে গলায় ঝুলিয়ে অফিসে গিয়েছেন, শুধু তাই না বসের রুমেও গিয়েছেন কয়েকবার৷ বস অবশ্য সরাসরি এই কথা না জিজ্ঞাস করে বলেছেন কয়েকটা দিন ছুটি নিতে৷ আরেকদিন নিজের অফিসের ফ্লোর কত বেমালুম ভুলে গেলেন৷ গোল্ডেন টাওয়ারে ৩ত্‍ফ ফ্লোরে কাজ করেন৷ শুধু  ১ম  ফ্লোর থেকে ৯ম ফ্লোর পর্যন্ত লিফটে উঠানামা করছিলেন৷ শেষে একাউন্টেন্ড জামিল বৃষ্টিতে ছাতা ছাড়া বাসা থেকে বের হয়ে হেটে হেটে অফিসের গেটের কাছে এসে দারোয়ানের কথায় খেয়াল হল হাতে ছাতা নেই৷

এতক্ষন উনার ধারনা ছিল মাথায় ছাতা ধরে আছেন! অফিস থেকে সাতদিনের ছুটি নেয়া হয়েছে৷ আজ ২য় দিন৷ স্ত্রী লায়লাকে কিছু বলা হয়নি৷ মেয়েরা অল্পতে হুলস্থুল করে৷ নয়টার সময় বাসা থেকে বের হয়ে সন্ধ্যা ছয়টা অবধি পার্কে বসে থাকেন৷ বাসায় যা কিছু প্রয়োজনীয় কাজের ছেলে মনিরকে দিয়ে লায়লা আনিয়ে নেয়৷ আজ পার্কে এসেছেন ১০-১৮ মিনিটে, আমগাছের নিচের বেঞ্চিটাতে বসে আছেন৷ ইদানিং বুক পকেটে একটা ছোট্ট নোট বুকে সারাদিন কি করণীয় লিখে রাখেন৷ নোট বুকটা হাতে নিয়ে বসে আছেন আর এলোমেলো ভাবছেন৷

আমি কি পাগল হয়ে যাচ্ছি ?
আচ্ছা, আমি কেন অস্থির হচ্ছি৷ আমার তো শারীরিক সমস্যা নেই৷ প্রেসার, সুগার সব নিয়ন্ত্রনে৷ তবে সমস্যা হচ্ছে কেন?  অর্থনৈতিকভাবে নিজেকে অসচ্ছল মনে হচ্ছে না৷ অবশ্য এই মুহুর্তে মাসিক বেতন কত মনে পড়ছে না৷ এ টুকু মনে পড়ছে বস ছাড়া সবাই স্যার ডাকে, সমীহ করে৷ আমিতো মানসিক বিপর্যস্তও নই বরং ভুলে যাওয়াটাই মানসিক ভাবে বিপর্যসত করছে৷

আজ বসে থাকতে ভাল লাগছে না৷ ড্রাগ নেবো নাকি? আপন মনেই বলে উঠলেন, যদিও তিনি ধুমপান করেন না৷ পার্কের বাদামওয়ালা ছেলেটাকে ডাক দিলেন…… স্যার, কয় টেহার বাদাম দিমু?
কি সুন্দর সাদা দাঁত ছেলেটার! তার মেয়ে ঐশির কথা মনে পড়ে ঐশির বয়স চার৷ কি সুন্দর মিহি দাঁতে ইঁদুরের মত কুট কুট মেয়ের কথা মনে হওয়ায় মনটা ভাল হয়ে গেল৷ ছেলেটাকে কি জন্য ডেকেছিলেন ভুলে গেলেন, মনটা আবার খারাপ হয়ে গেল৷
স্যার, কয় টেহার বাদাম দিমু৷

ছেলেটাকে পাঁচ টাকা দিয়ে বললেন বাদাম লাগবে না৷ ছেলেটা টাকা নিয়ে নিমিশেই চলে গেল৷ তখনি মনে পড়ল কেন ছেলেটাকে জানতে চাচ্ছিলেন এই পার্কের আশে পাশে কোন প্রকার ড্রাগ ঠিক করলেন আজ দ্রুত বাসায় চলে যাবেন৷ নোট বুকে নিজের বাসার ঠিকানাটা এক ঝলক দেখে উঠে দাড়ালেন৷ বাসায় আসতে রাত নয়টা বেজে গেল৷ লায়লা দরজা খুলেই বললেন তুমি আজও আনোনি৷ মেয়েটা আজও কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে তিনি আসলে ভুলে গেছেন, চাইলেন না স্ত্রীর সাথে সমস্যাটা নিয়ে আলোচনা করতে৷ যে জিনিসটার জন্য তার মেয়ে কেঁদে কেঁদে ঘুমায় সে জিনিসটার কথা ভুলে বসে আছেন৷

খাবার পর্ব শেষ করে বারান্দায় বসলেন৷ লায়লা দরজার পাশে দাড়িয়ে তোমার মেয়ে তো তোমার কাছে আকাশের চাঁদ চায়নি, তুমি এনে দিচ্ছনা কেন? তুমি তো এ রকম ছিলে না৷ নিজে না পার কাউকে দিয়ে আনিয়ে নিলেই পার৷ মেয়েটা শুধু শুধু তোমার জন্য কষ্ট পাচ্ছে৷ লায়লা চলে গেলে নোট বুকটা মেলে ধরলেন৷ মেয়েটা কি চেয়েছিল৷ মনে করতে পারলেন না, নোট বইয়ের কোথাও লেখা নেই৷

নোট বইয়ে লিখলেন- কাল যদি ঐশি যা চেয়েছে এনে দিতে না পারি তবে বাসায় এক গ্লাস হরলিক্স খেয়ে ঘুমুতে গেলেন৷ মাঝে মাঝে লুকিয়ে মেয়ের হরলিক্স খান যদি অবস্থার উন্নতি হয়৷ ঘুম থেকে উঠে নোট বইটা দেখলেন৷ নোট বইয়ের লেখা শেষ পৃষ্ঠা ছিঁড়ে পকেটে নিলেন৷ হাত মুখ ধুয়ে ২০০ টাকা নিয়ে বাসা থেকে বের হলেন৷ কোথায় যাবেন জানেন না৷ সায়দাবাদ বাসস্টপে এসে বাসে উঠলেন৷ বাসের গন্তব্য সমর্্পকে তিনি কিছুই জানেন না৷ বাসের জানালায় চোখ আটকে আছে৷ কোন কিছু ভাল লাগলেই নেমে পড়বেন৷ হাত ঘড়িতে দেখলেন ১০.১৫ মিনিট বাসের জানালা দিয়ে খন্ড খন্ড ছবি চলে যাচ্ছে অবিরত৷ জানালা দিয়ে গাছপালা ঘেরা একটি গ্রাম দেখে ভাল লাগল৷ হেল্পারকে বলে নেমে পড়লেন৷ মহাসড়ক ছেড়ে ক্ষেতের আল ধরে ঐ গাঁয়ের দিকে চললেন৷ একটি মেহগনি গাছের ছায়ায় বিষন্ন মনে সূর্যের দিকে মুখ করে বসলেন৷ ইচ্ছা করছিল বাসায় ফিরে যেতে কিন্তু ঠিকানা মনে করতে ভাবছেন মেয়েটা কি চেয়েছিল, ভাবতে ভাবতে চোখের পাতা ভারি কোথা হতে যেন এক লোক গাছের ছায়ায় এসে বসল৷

আপন মনে কথা বলতে শুরু করল, যেন সে একা আশে পাশে কেউ নেই ! ইশ্! মাইয়াডা কি আউস কইরা লাল শাড়ি চাইছিল, দিতে পারলাম না৷ কপালদোষে বটতলার পুকুরে ডুইব্যা মরল৷ লোকটি হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল৷ যেভাবে এসেছিল সে ভাবেই চলে গেল৷ হঠাত্‍ রহমান সাহেবের তন্দ্রা ভাঙ্গল৷ অনুভব করলেন চোখের কোণে জল৷ আশে পাশে কোন মানুষজন নেই৷ এতক্ষন তিনি স্বপ্ন দেখছিলেন নাকি আসলেই কেউ একজন তারপাশে এসে বসেছিল বুঝতে পারলেন না৷

ঠিক করলেন বটতলার ঘাটে বসবেন৷ মোটামুটি সব গ্রামেই ১/২ টা বটগাছ থাকে, এখানেও বটগাছ থাকতে পারে তবে বটগাছের সাথে উঠে দাড়াঁতে গিয়ে বুঝতে পারলেন তীব্র ক্ষুদা আর ক্লান্তি তে শরীর ভারি হয়ে এসেছে৷ মানুষের কাছে জিজ্ঞেসা করে বটতলার পুকুর খুঁেজ বের করলেন৷ সত্যিই এই গ্রামে বটতলার পুকুর পাবেন ভাবেন সূর্য ডুবতে শুরু করেছে৷ পুকুর ঘাটে বসেই শান্তি শান্তি ভাব অনুভব করলেন৷ ক্লান্তিতে চোখ বুঝে এল৷
কত সময় চোখ বুঝেছিলেন খেয়াল নেই৷ চোখ খুলেই অবিভূত হয়ে গেলেন, সন্ধ্যা পেরিয়ে এখন রাত৷ চারপাশে তারার মতো জোনাকিদের মেলা! আনন্দে চোখে পানি এসে গেল৷ বাচ্চাদের মত জোনাকি ধরে ধরে বুক পকেটে ভরতে লাগলেন৷

আশ্চর্য ! মেয়েটা তার কাছে কয়েকটি জোনাকি পোকা রহমান সাহেব বুক পকেটের মুখ চেপে ফিরছেন৷ ক্ষুদা আর শারীরিক ক্লান্তি চলে গেছে৷ হঠাত্‍ খেয়াল হল সব কিছুই মনে করতে পারছেন, প্রফুল্ল অনুভব করলেন৷ মনে হচ্ছে পথ ফুরাতে চায় না ৷ প্রতিটি সিঁড়ির ধাপে পা ফেলেন আর বুকের ভেতর তীব্র চিনচিনে ব্যাথা অনুভব করছেন৷ ব্যাথায় যতই বুক পকেট ভর্তি জোনাকি পিষে ফেলার ইচ্ছা জাগে, ভালবাসায় ততই পকেট আকড়ে দরজার সামনে এসে কলিংবেলে হাত রাখলেন৷ তীব্র ব্যাথায় পকেট চেপে ধরে মেঝেতে পড়ে গেলেন৷

এখনো লায়লা দরজা খুলছে না কেন?
কেন জানি মনে হচ্ছে এ দরজা আর কখনোই খুলবে না৷

 

মো: আকরামুল ইসলাম (নভেল)