মুক্তিবাহিনীর সবচেয়ে বড় অংশটি এসেছিল ছাত্রদের মধ্যে থেকে। এরা একইসঙ্গে ছিল বিভিন্ন রাজনৈতিক মতবাদের অনুসারী। সুবাদেই আদর্শগত সংঘাত এবং ভিন্ন নেতৃত্বকে অস্বীকার করার একটা প্রবণতা এদের মধ্যে খুব প্রবল। সেদিক থেকে আদর্শ গেরিলা ছিলেন মাটি থেকে উঠে আসা- কৃষক শ্রেনীর লোকজন। এদের মিথ্যে অহম ছিলো না, একজোড়া জাঙ্গলবুটের জন্য হা-পিত্যেশও তারা করেনি, খাবার না পেলে খায়নি, পরিধেয় বা বিছানা নিয়েও মাথা ঘামায়নি। স্রেফ স্বাধীনতার স্বপ্ন বুকে নিয়ে এরা মাটি কামড়ে লড়ে গেছে….  মুক্তিবাহিনী সম্পর্কে ভারতীয় সামরিক কমান্ডের মূল্যায়ন।

প্রাক-কথা:
মুক্তিযুদ্ধের মাঝপথে আচমকাই রণাঙ্গনে নতুন একটি নাম ছড়িয়ে পড়লো। মুজিব বাহিনী। নিয়মিত বাহিনীর পাশাপাশি গণবাহিনীর যোদ্ধারা যখন কাধে কাধ মিলিয়ে লড়ছে, তখন আচমকা এমন একটা বাহিনী কি কারণে কিভাবে জন্ম নিলো তা ছিল রহস্য। এরা মুক্তিযুদ্ধকালীন মুজিবনগর সরকারের নেতৃত্বাধীন ছিল না। মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক এমএজি ওসমানী কিংবা পূর্বাঞ্চলে ভারতীয় বাহিনীর অধিনায়ক জেনারেল অরোরাও এদের নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা পাননি। মূলত মার্চের আন্দোলনকে চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া ছাত্রলীগের তিন জঙ্গী ছাত্রনেতা আবদুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ, সিরাজুল আলম খান এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাগ্নে যুবলীগ নেতা শেখ ফজলুল হক মণি ছিলেন এই বাহিনীর নেতৃত্বে। ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা র’য়ের বিশেষ তত্বাবধানে ও বিখ্যাত সামরিক কর্মকর্তা মেজর জেনারেল সুজন সিং উবানের ট্রেনিংয়ে ১০ হাজার সদস্যের এই এলিট বাহিনী যতখানি মুক্তিযুদ্ধ করেছে তারও বেশী দুর্নাম কুড়িয়েছে বামপন্থী নির্মূল অভিযানে। ভিন্নমত ও ভিন্ন আদর্শের মুক্তিযোদ্ধারা ছিলেন এদের লক্ষ্য। সত্যি কি তাই! অথচ মুজিব বাহিনী সম্পর্কে জানতে গিয়ে দেখা যাচ্ছে হাসানুল হক ইনুর মতো অনেক সিলমারা বামপন্থী ছিলেন মুজিব বাহিনীর রাজনৈতিক ইনস্ট্রাকটর ও মোটিভেটর। এই যোদ্ধাদের অনেকেই শেষ পর্যন্ত যুদ্ধে নামার সুযোগ পাননি। আবার স্বাধীনতার পর এরাই পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়েছেন রক্ষীবাহিনী ও গণবাহিনীর আদলে। আলোচ্য পোস্টে বিভিন্ন প্রেক্ষিত থেকে মুজিব বাহিনীর জন্ম, সমসাময়িক প্রতিক্রিয়া, নিজেদের কোন্দল, অপপ্রচার, উবান ও সংশ্লিষ্ট ছাত্র নেতাদের বক্তব্য তুলে ধরা হয়েছে। মূল প্রয়াস অবশ্যই একাত্তরের এই রহস্যময় বাহিনী ও এর কার্যক্রম নিয়ে আলোকপাত। সিরিজ ধরে শেষ করতে পারি না বলে এক সঙ্গে পুরোটা লিখলাম। মূলত সিরিয়াস পাঠকের জন্য এই লেখা।

‘সানী ভিলা’
কলকাতা ভবানীপুর পার্কের পাশে হালকা গোলাপী রংয়ের একটি দোতলা বাড়ি। বাসিন্দাদের নাম তপু বাবু, রাজু বাবু, সরোজ বাবু, মণি বাবু, মধু বাবু। আশেপাশের মানুষ তাই জানে। কিন্তু ঠিকানা ধরে যখন কেউ সেখানে যায় তখন তার কাছে পরিষ্কার হয়ে যায় ছদ্মনামগুলো। তপু ওরফে তোফায়েল আহমেদ, রাজু ওরফে আবদুর রাজ্জাক, সরোজ আকা সিরাজুল আলম খান, ফজলুল হক মণি ওরফে মণি বাবু এবং বঙ্গবন্ধুর দেহরক্ষী মুন্সীগঞ্জের মহিউদ্দিন বা মন্টু বাবু। নয় নম্বর সেক্টর থেকে নির্দেশ পেয়ে আসা বরিশাল ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ওবায়দুর রহমান মোস্তফার জবানীতে : বাড়ির দোতলায় একটি কক্ষে তোফায়েল ভাই, রাজ্জাক ভাইসহ আরও কয়েকজন আমাকে নিয়ে বৈঠক করলেন। ঐ বৈঠকে বসে জানলাম, আগরতলায় শেখ ফজলুল হক মণিসহ ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও কৃষক লীগের ভারতে আগত সদস্যদের নিয়ে মুজিব বাহিনী গঠনের সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে আগরতলাতে হেডকোয়ার্টার করা হয়েছে। ইতিমধ্যে নাকি বেশ কয়েক হাজার মুজিব বাহিনীর সদস্য ভারতের পার্বত্য দুর্গম এলাকা টেন্ডুয়াতে (তানদুয়া) প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে ট্রেনিং নেয়া আরম্ভ করেছে।

২১ নম্বর রাজেন্দ্র রোডের ‘সানী ভিলা’ নামে এই বাড়িটির মালিক প্রয়াত চিত্তরঞ্জন সুতার। পিরোজপুরের বাটনাতলার এই অধিবাসী পাকিস্তান কংগ্রেসের সদস্য ছিলেন এবং কংগ্রেস নেতা প্রণব কুমার সেনের মেয়েকে বিয়ে করেন। ১৯৭০ সালে আওয়ামী লীগের হয়ে নির্বাচনে জয়ী হন, অসহযোগ আন্দোলনের শুরুতে ভারতে চলে যান। স্বাধীনতার পর ’৭৩ সালে আবারও নির্বাচিত হন এবং ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর বাংলাদেশ ত্যাগ করেন। আবদুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমদের ভাষ্য অনুযায়ী চিত্তরঞ্জনের মাধ্যমেই মেজর জেনারেল উবানের সঙ্গে যোগাযোগ হয় তাদের। মার্চের উত্তাল দিনগুলো শুরু হওয়ার অনেক আগেই (১৮ ফেব্রুয়ারি) বঙ্গবন্ধু উল্লিখিত চার নেতাকে এই বাড়িটির ঠিকানা দিয়ে দেন এবং চিত্তরঞ্জনের সঙ্গে দেখা করে অস্ত্র ও ভারতীয় সহায়তা নেওয়ার নির্দেশ দেন। অবশ্য ২৫ মার্চের আগে আরেকবার ডাঃ আবু হেনা ছাত্রনেতাদের প্রতিনিধি হিসেবে সুতারের কাছে পাঠানো হয় সবকিছু ঠিকঠাক আছে কিনা জানতে। মোটামুটি ‘সানী ভিলা’কেই ধরে নেওয়া যায় ‘মুজিব বাহিনী’র জন্মস্থান হিসেবে। এখানেই উবানের সঙ্গে এক বৈঠকে প্রস্তাবিত বাহিনীর খসড়া পরিকল্পনাটি জানান মণি-সিরাজ-রাজ্জাক-তোফায়েল। এই বৈঠকে সুতার ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন আসম আব্দুর রবও।

‘জয় বাংলা বাহিনী’র উত্তরসূরী
এই পর্যায়ে এসে আমাদের কিছু চমকপ্রদ প্রাসঙ্গিক ইতিহাস জানা হয় । মুজিব বাহিনীর পেছনে যারা ছিলেন তারা একইসঙ্গে আবার সমাজতান্ত্রিক মনোভাবাপন্ন স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদেরও সদস্য, যার সূচনা সেই ১৯৬২ সালে। বলা হয় ভারতীয় গোয়েন্দা বাহিনী এই সংগঠনটির মূল পৃষ্ঠপোষকতা করে এসেছে একদম শুরু থেকেই। এদের মধ্যে আবার ফজলুল হক মণি এবং তোফায়েল আহমেদ বিষয়টি সম্পর্কে কিছুই জানতেন না। এটির অস্তিত্ব প্রকাশ হয় ১৯৭২ সালে যখন ছাত্রলীগে মতভেদ চূড়ান্ত রূপ নিয়েছে এবং সিরাজুল আলম খান তার অধীনস্তদের নিয়ে জাসদ গড়তে যাচ্ছেন। ’৬২ সালে সিরাজুল আলম, রাজ্জাক এবং কাজী আরেফ আহমেদ পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা নিয়ে কাজ করার জন্য এই বিপ্লবী পরিষদের জন্ম দেন। বঙ্গবন্ধুকে এ সম্পর্কে জানানো হয় ’৬৯ সালে তিনি ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ থেকে মুক্ত হয়ে ফেরার পর। রাজ্জাকের ভাষ্যমতে মুক্তিযুদ্ধ যখন প্রায় অনিবার্য রূপ নিতে যাচ্ছে তার আগে মণি এবং তোফায়েলকে এই পরিষদে অন্তর্ভুক্ত করেন তারা। এবং বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ১৮ জানুয়ারী (মাসুদুল হকের ভাষ্যে ফেব্রুয়ারী হবে) একান্ত বৈঠক করেন। সেখানেই তাদের নির্দেশ দেওয়া হয় সশস্ত্র সংগ্রামের প্রস্তুতি নিতে এবং চারজনকে এর কো-অর্ডিনটর হতে। পাশাপাশি তাজউদ্দিন আহমদেকেও সঙ্গে নিতে বলেন বঙ্গবন্ধু। মার্চের পর সবাই ঠিকানা মতো (সানী ভিলা) গিয়ে জানতে পারেন তাজউদ্দিন সেখানে জাননি। বরং নিজেকে প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করে মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকার গঠন করেছেন।

তোফায়েল আহমেদ জানিয়েছেন এই পরিকল্পনাটা আরো আগেই নিয়েছিলেন মুজিব। ১৯৬৯ সালে লন্ডন থেকে ফেরার পর তিনি সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য তার একটি বিশেষ পরিকল্পনার কথা জানান। আর এই উদ্দেশ্যে প্রতিমাসে ২৫ জন নির্বাচিত যোদ্ধাকে ভারতে বিশেষ ট্রেনিংয়ের জন্য পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু এর মধ্যেই সত্তরের নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা হয়ে যাওয়ায় পরিকল্পনাটি স্থগিত রাখা হয়। নির্বাচনের দায়িত্ব পান মণি-সিরাজ-রাজ্জাক ও তোফায়েল। এর মধ্যে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় নিহত সার্জেন্ট জহুরুল হকের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী পালন করে ছাত্রলীগ। আর এর একাংশ থেকে ‘১৫ ফেব্রুয়ারী বাহিনী’ নামে একটি দল মার্চ পাস্ট করে বিশ্ববিদ্যালয়সহ শহরে। এই মিছিলে ছিলেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও। তবে এই বাহিনীর কার্যক্রম সম্পর্কে ফজলুল হক মণি এবং ডাকসু সভাপতি আসম রব ও সাধারণ সম্পাদক আবদুল কুদ্দুস মাখন কিছুই জানতেন না। এর নেতৃত্ব দিয়েছিলেন নগর ছাত্রলীগ সভাপতি মফিজুর রহমান ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক হাসানুল হক ইনু। এখানে স্পষ্টতই চার নেতার মধ্যে আদর্শগত ক্ষেত্রে খানিকটা মতবিরোধের আঁচ পাওয়া যায়। আর তা স্পষ্ট হয়ে যায় সেবছরই ১২ আগস্ট ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে ৩৬-৯ ভোটে স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশের প্রস্তাবটি পাশ হয়। নুরে আলম সিদ্দিকী, মাখনসহ যারা বিরোধিতা করেন তারা সবাই শেখ মণির অনুসারী। মণি তখন ছাত্র নন, কিন্তু ছাত্রলীগের একটি অংশকে নিয়ন্ত্রণ করতেন। তার অনুসারীদের হারিয়ে সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বাধীন অংশটির এই জয় দুজনের শীতল সম্পর্ককে আরো শীতল করে দেয়। আর এর প্রভাব মুক্তিযুদ্ধের সময় মুজিব বাহিনীতে তেমন না পড়লেও স্বাধীনতার পর মারাত্মক রূপ নেয় যার প্রেক্ষিতে রক্ষী বাহিনী-গণবাহিনীর সংঘর্ষে তার ভয়াবহ প্রকাশ ঘটে। যুদ্ধকালীন সময়ে সমাজতন্ত্র এবং মুজিববাদে সমান অনুগত আবদুর রাজ্জাকই মূলত সিরাজ-মণির মধ্যেকার ভারসাম্য বজায়ে বড় অবদান রাখেন। তবে মুজিব বাহিনীর মূল পরিকল্পনায় তখনকার ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নূরে আলম সিদ্দিকী ও শাহজাহান সিরাজকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। দুজনেই মণির অনুসারী ছিলেন।

বিপ্লবী ছাত্র পরিষদের ওই ট্রাম্পের আগে জন্ম ‘জয় বাংলা বাহিনী’র। মূলত ছয় দফার ঘোষণা বার্ষিকী ৭ জুনকে সামনে রেখে এটি গঠিত হয়। ’১৫ ফেব্রুয়ারী বাহিনী’র সদস্যরা স্বাধীনতার লড়াইয়ের জন্য যথেষ্ট উপযুক্ত নয় এই বিচারে আরেকটু জঙ্গী হিসেবে এর সংগঠন। সিদ্ধান্ত হয় সেদিন শহীদ মিনার থেকে পূর্ণ সামরিক কায়দায় মার্চ পাস্ট করে তারা পল্টন ময়দান যাবেন। সেখানে শ্রমিক লীগের বঙ্গবন্ধুকে অভিবাদন জানানোর কর্মসূচী আর তাতে গার্ড অব অনার দেওয়ার কথা ছাত্রলীগের। আগের রাতে অর্থাৎ ৬ জুন ইকবাল হলে ‘জয় বাংলা বাহিনীর পতাকা’র নকশা করেন কুমিল্লা থেকে হঠাৎ ঢাকায় আসায় শিব নারায়ণ দাস। এটিই পরে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকায় পরিণত হয়। ৪২ বলাকা ভবনে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় অফিসের লাগোয়া ‘নিউ পাক ফ্যাশন টেইলার্স’ থেকে তৈরী হয় স্বাধীন বাংলার মানচিত্র সম্বলিত সেই প্রথম পতাকা যা সেলান আবদুল খালেক মোহাম্মদী। ‘জয় বাংলা বাহিনী’ পরিকল্পনা মতো মার্চ করে পল্টন যায়, কিন্তু পতাকাটি গোটানো অবস্থায় বয়ে নিয়ে যান আসম রব। মিছিলে ওড়ে ছাত্রলীগের পতাকা যা থাকে ইনুর হাতে। অভিবাদন মঞ্চে হাটু গেড়ে মুজিবকে পতাকাটি উপহার দেন রব। মুজিব সেটা খুলে দেখেন এবং আবার গুটিয়ে রবকে ফেরত দেন। এটি এরপর থাকে ইনুর হাত ঘুরে হাতে পান ছাত্রলীগ নগর সম্পাদক শেখ মোহাম্মদ জাহিদ হোসেন। ১৯৭১ সালের ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় আবার ওড়ে সেই ‘জয় বাংলা বাহিনী’র পতাকা। এরপর তা হয়ে যায় জাতির পতাকা, জাতীয় পতাকা। শেখ মুজিব জানতেন ‘জয় বাংলা বাহিনী’র অস্তিত্বের কথা। ২৩ মার্চ পাকিস্তান দিবসের বদলে প্রতিরোধ দিবস পালন করে আওয়ামী লীগ। সেদিন পল্টনে আবারও ওড়ে পতাকা। আর এদিন ধানমন্ডী ৩২ নম্বরে নিজের বাসা থেকে দর্শনার্থীদের উদ্দেশ্যে মুজিবের বক্তৃতায় আসে ‘জয় বাংলা বাহিনী’র নাম (ভিডিও ফুটেজ দেখুন)। গোটা মার্চ জুড়েই এরা ডামি রাইফেল নিয়ে ছাত্রলীগ কর্মীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে। মোটামুটি একটা মানসিক প্রস্তুতি নেওয়া হয় সশস্ত্র সংগ্রামের।

মুজিব বাহিনীর প্রেক্ষিত ও বিস্তার
ফেব্রুয়ারিতে মুজিবের সঙ্গে চার ছাত্র নেতার বৈঠকের ব্যাপারটি তাজউদ্দিনের গোচরে ছিল। কিন্তু কলকাতায় যাওয়ার পর তাদের উপেক্ষা করে একক সিদ্ধান্তে এগিয়ে যান তিনি। বিভিন্ন সূত্রে এটা আগেও অনেকবার উল্লেখ হয়েছে যে তাজউদ্দিনের এই প্রধানমন্ত্রীত্ব গ্রহণ একদমই মেনে নিতে পারেননি শেখ মণিসহ বাকিরা। বরং সিনিয়ারিটি অনুযায়ী এই ক্ষেত্রে তারা সৈয়দ নজরুল ইসলামকেই চাইছিলেন। কিন্তু সেটা পরে, তার আগে তাদের দাবি ছিলো মুক্তিযুদ্ধ চলবে একটি বিপ্লবী কমান্ড কাউন্সিলের অধীনে আর তার নেতৃত্ব দেবেন তারা চারজন- বঙ্গবন্ধু তাদেরকেই মনোনীত করে গেছেন এজন্য। গ্রহণযোগ্যতা ও অন্যান্য প্রেক্ষাপটে এই দাবিটি উপেক্ষা করা অবশ্যই আমাদের স্বাধীনতার পক্ষে গিয়েছে। যদিও সৈয়দ নজরুলের ছেলে সৈয়দ আশরাফ (বর্তমানে মন্ত্রী) এবং বঙ্গবন্ধু তনয় শেখ জামালও ছিলেন মুজিব বাহিনীর অন্যতম সদস্য। এবং উবান ও নজরুলের হস্তক্ষেপেই তাজউদ্দিনের পেছনে লাগা বন্ধ করেন মণি ও অন্যরা। উবান পরে রক্ষী বাহিনীর দায়িত্বও নেন।

তাজউদ্দিনের ব্যাপারে তাদের সবচেয়ে বড় অভিযোগটি ছিল ‘বঙ্গবন্ধু’ আর ফিরবেন না এটা ধরে নিয়ে তিনি যুদ্ধ পরিচালনা করছেন। নিজেকে সেভাবেই অধিষ্ঠিত করছেন (এই প্রচারণাটা স্বাধীনতার পর তাজউদ্দিনের বিপক্ষে গেছে)। পাশাপাশি তিনি মাওলানা ভাসানীসহ কমিউনিস্ট দলগুলোর সদস্যদেরও গুরুত্ব দিচ্ছেন। এর পেছনে আমিরুল ইসলাম ও মাঈদুল ইসলামকে (মূলধারা ‘৭১এর লেখক) দায়ী করেন তারা। তাদের আশঙ্কা জাগে যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব এসব বামপন্থীদের কব্জায় চলে যাবে। এই প্রেক্ষিতেই বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স নামে একটি বিশেষ বাহিনীর পরিকল্পনা নেন চারজন। আর তার ‘মুজিব বাহিনী’ নাম করণের পেছনে কারণ মুজিববাদ (জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্ম নিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র) কায়েম।

এ বিষয়ে উবান লিখেছেন : Because of their single-minded loyalty to Mujib and their closeness to him, they were more eager to be known as the Mujib Bahini. They had been issuing certificates of genuineness, selecting from their old colleagues. Choosing enough sacrificing, upright and faithful men from Bangladesh, they were putting pressure that they should receive unconventional training in fighting techniques unlike the commando training received by members of the Mukti Bahini. Perhaps they wanted to give leadership to such a political party which has its organisational branches in each town, thana and tehsil.’

মে মাসের শুরুতে ‘সানী ভিলা’র সেই বৈঠকে উবানকে তাদের পরিকল্পনা জানান চার নেতা। পরিকল্পনাটি তার পছন্দ হয় খুবই। এখানে বলে রাখা দরকার মুজিব বাহিনীর গঠন এবং ট্রেনিংয়ের ব্যাপারটি পুরোটাই গোপনে ব্যবস্থা করা হয় আর এ ব্যাপারে ভারতীয় সেনা প্রধান এবং ওয়ার কাউন্সিল হেড জেনারেল স্যাম মানেকশ ছাড়া আর কেউই কিছু জানতেন না। এ কারণে মুজিব বাহিনীকে ‘স্যামস বয়েজ’ নামে উল্লেখ করতো ভারতীয় বাহিনী। উবান জানাচ্ছেন পরে তাজউদ্দিনকে মানেকশ সরাসরি বলেছেন যে সেনাবাহিনীর বিশেষ দায়িত্ব সম্পাদনের জন্য তিনি (মানেকশ) নিজেই গড়ে তুলেছেন এই বাহিনী। তিব্বতীদের নিয়ে গড়া স্পেশাল ফ্রন্টিয়ার ফোর্সের সফল রূপকার উবানকে দায়িত্বটা দেওয়া হয় উপর মহল থেকে। র’ প্রধান আরএন কাও যিনি একই সঙ্গে ভারতীয় কেবিনেট সেক্রেটারিয়েটের সচিবও ছিলেন এই ক্ষেত্রে উবানের ইমিডিয়েট বস। সে মাসেই (২৯ মে, ১৯৭১) ২৫০ জনের প্রথম দলটি দেরাদুনের দেড় কিলোমিটার দূরে পাহাড়ী শহর তানদুয়ায় প্রশিক্ষণ নেওয়া শুরু করে। মেঘালয়ের হাফলংয়ে আরেকটি ট্রেনিং ক্যাম্প খোলা হয়, কিন্তু একটি ব্যাচ এখানে ট্রেনিং নেয়, তারপর ক্যাম্পটি তুলে নেওয়া হয়। প্রথম ব্যাচের প্রশিক্ষণে ছিল ভারতীয় সেনা কর্মকর্তারা। এদের মধ্যে উল্লেখ্য মেজর মালহোত্রা যিনি পরে রক্ষী বাহিনীর প্রশিক্ষনেও দায়িত্ব পালন করেন। প্রথম ব্যাচের প্রশিক্ষণ শেষে তাদের মধ্যে থেকে আটজনকে বাছাই করা হয় প্রশিক্ষক হিসেবে-হাসানুল হক ইনু, শরীফ নুরুল আম্বিয়া, আফম মাহবুবুল হক, রফিকুজ্জামান, মাসুদ আহমেদ রুমী (প্রয়াত ক্রীড়া সাংবাদিক), সৈয়দ আহমদ ফারুক, তৌফিক আহমদ ও মোহনলাল সোম। পরে প্রশিক্ষকের সংখ্যা বাড়িয়ে ৫২ করা হয়, ২০ নভেম্বর ১৯৭১ মুজিব বাহিনীর ট্রেনিং বন্ধ করে দেওয়া হয়। সে পর্যন্ত ১০ হাজার মুজিব বাহিনী সদস্য প্রশিক্ষণ নেন। নেতাদের মধ্যে রাজ্জাকই প্রথম ব্যাচের সঙ্গে পূর্ণাঙ্গ সামরিক ট্রেনিং নেন, বাকিরা নেন প্রাথমিক প্রশিক্ষণ। এ ব্যাপারে প্রয়াত কামরুল ইসলাম একটি সাক্ষাতকারে তাদের প্রশিক্ষণের ধারা উল্লেখ করেন (ভিডিও ফুটেজ দেখুন)।

বাংলাদেশকে মোট চারটি সেক্টরে ভাগ করা হয় মুজিব বাহিনীর অপারেশনের জন্য। উত্তরাঞ্চলীয় সেক্টর কমান্ডার ছিলেন সিরাজুল আলম খান যার আওতায় ছিল বৃহত্তর রংপুর, রাজশাহী, পাবনা, দিনাজপুর। তার সেকন্ড ইন কমান্ড ছিলেন মনিরুল ইসলাম ওরফে মার্শাল মনি। দক্ষিণাঞ্চলীয় সেক্টর (বৃহত্তর খুলনা, যশোর, কুষ্টিয়া, ফরিদপুর, বরিশাল ও পটুয়াখালী) ছিল তোফায়েল আহমদের অধীনে, সহ অধিনায়ক ছিলেন কাজী আরেফ আহমেদ। শেখ ফজলুল হক মণির কমান্ডে ছিল পূর্বাঞ্চলীয় সেক্টর (বৃহত্তর চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, নোয়াখালী, সিলেট এবং ঢাকা জেলার কিছু অংশ), তার সহ-অধিনায়ক ছিলেন রব ও মাখন। আবদুর রাজ্জাকের দায়িত্বে ছিল কেন্দ্রীয় সেক্টর যা গঠিত ছিল বৃহ্ত্তর ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল এবং ঢাকা নিয়ে। তার সহ-অধিনায়ক ছিলেন সৈয়দ আহমদ। চার নেতা ছিলেন জেনারেল সমমর্যাদার, তাদের যাতায়তের জন্য হেলিকপ্টার বরাদ্দ ছিল, প্রত্যেক সেক্টরের জন্য আলাদা অর্থ বরাদ্দ ছিল যা বন্টনের দায়িত্ব ছিল নেতাদের হাতে।

আলাদা ওয়ারলেস সিস্টেম আলাদা কোডের অধীনে মুজিব বাহিনী ছিলো আদপে সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক আদর্শের একদল মুক্তিযোদ্ধা। বিভিন্ন সাক্ষাতকারে এর নেতারা বলেছেন পাঁচ বছর মেয়াদী একটি পরিকল্পনা নিয়ে এই বাহিনী গঠন করা হয়। প্রাথমিক পরিকল্পনায় ছিল দেশের মধ্যে ছোট ছোট পকেট তৈরি। সেসব পকেটে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য নিরাপদ আশ্রয়স্থল বানানো। প্রতিটি থানায় (পরে উপজেলা) ৫ জনের একটি সেল তৈরি করা হতো যার দায়িত্বে থাকতেন একজন সংগঠক ও তার সহকারী। আশ্রয়স্থলের জন্য একজন নেতা থাকতেন এবং বাকি দুজনের দায়িত্ব ছিলো বাহকের। এরপর সেখানে যোদ্ধারা আশ্রয় নিয়ে লড়াই শুরু করবেন, প্রতিবিপ্লবী ও দালালদের হত্যা করবেন। আর মুক্তাঞ্চল তৈরী হওয়ার পর তার রাজনৈতিক নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা হবে মুজিববাদের ভিত্তিতে যা আদপে আওয়ামী লীগ এবং আমাদের স্বাধীনতারও চার মূলনীতি। জুনের মাঝামাঝি ২২৩টি থানা মুজিব বাহিনীর আওতায় চলে আসে। এ বিষয়ে আরো বিস্তারিত বলেছেন হাসানুল হক ইনু। তার বক্তব্য অনুযায়ী সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যেই তারা ধাপে ধাপে এগোনোর পরিকল্পনা নেন। এই উদ্দেশ্যে প্রতিটি থানায় একজন কমান্ডারের অধীনে দশজন ট্রেনিংপ্রাপ্ত মুজিব বাহিনী সদস্যের একটা দল করা হবে। এদের একজন রাজনৈতিক কমান্ডারও থাকবে যার কাজ দলকে রাজনৈতিকভাবে উদ্বুদ্ধ করা। একই পদ্ধতিতে জেলা পর্যায়েও কমান্ড গঠন করা হয় এবং সেখানেও রাজনৈতিক কমান্ডার হিসেবে একজন নিয়োগ পান।

মুজিব নগরে প্রতিক্রিয়া ও প্রাথমিক সংঘাত

সে সময় কলকাতা থেকে আওয়ামী লীগের প্রচারপত্র হিসেবে বের হতো সাপ্তাহিক জয় বাংলা। কিন্তু আলোড়ন তুললো শেখ মণির সম্পাদিত সাপ্তাহিক বাংলার বাণী। একদল তরুণ সাংবাদিকের এই পত্রিকাটি অল্প সময়ে গ্রহণযোগ্যতা পেল পশ্চিমবঙ্গের সাংবাদিক মহলে। পাশাপাশি রুষ্ট হলেন মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি ওসমানী। কারণ বাংলার বাণীতে বাংলাদেশের যে কোন রণাঙ্গনে মুক্তিযোদ্ধাদের যেসব সাফল্যের খবর ছাপা হতো তাতে মুক্তিযোদ্ধা বা মুক্তিবাহিনী না লিখে মুজিব বাহিনী লেখা হতো। মুক্তি বাহিনীর সদর দপ্তরে জনসংযোগ কর্মকর্তা নজরুল ইসলামের ভাষ্যে : বাংলার বাণীতে যেদিন প্রথম মুক্তিবাহিনীর স্থলে মুজিব বাহিনী লেখা হলো, সেদিন জেনারেল ওসমানী আমাকে একান্তে ডেকে নিয়ে খুবই কড়া ভাষায় বললেন, নজরুল সাহেব, মুজিব বাহিনী কি? ওসব কারা লিখছে? কেন লিখছে? আপনি এ সম্পর্কে তদন্ত করে জানাবেন আর বলবেন যেন ভবিষ্যতে মুজিব বাহিনী আর না লেখা হয় এতে করে আমাদের নিয়মিত বাহিনীতে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়। তটস্থ নজরুল নিজেও বাংলার বাণীতে লিখতেন, কিন্তু ওসমানীকে জানাননি। দিন কয়েক পর নজরুল জানালেন তার তদন্তের ফল। বললাম, স্যার এই পত্রিকা শেখ ফজলুল হক মণি সাহেবের। এ কথা বলতেই জেনারেল সাহেবের উন্নত গোফগুলো নুয়ে গেলো। এরপর হু বলে একটা গম্ভীর ধরণের শ্বাস ফেলে বললেন, ঠিক আছে। খানিকপর ওসমানীর মুখ থেকে বেরুলো : সব কিছুতে একটা ডিসিপ্লিন আছে। এখানে আমরা রং তামাশা করতে আসিনি। বিদেশের মাটিতে আমরা যে বিশৃংখলা ও অনৈক্য দেখাচ্ছি, তা জাতির জন্য মঙ্গল নয় নজরুল সাহেব। এতে আমাদের সম্পর্কে এদের ধারণা খুব খারাপ হবে। আর আমাদের এই অনৈক্য ও বিশৃংখলার কথা কি মনে করেন কলকাতার এই চার দেয়ালের ভেতরে বন্দী থাকবে? শত্রুপক্ষ এর সুবিধা নিশ্চয়ই নেবে। আপনি-আমি এখানে বসে বসে নানান বাহিনী গঠন করি, আর যে ছেলেটি বাংলাদেশের পথে-জঙ্গলে কিংবা নদীতে ট্রিগারে আঙুল লাগিয়ে নিজের জীবনকে বাজী রেখে শত্রু হননের অপেক্ষায় বসে রয়েছে, তার কথা কি আমরা চিন্তা করি? বিষয়টি আমি প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টিতে আনবো।

ওসমানীর সংশয় একেবারে অমূলক ছিলো না। কাছাকাছি হওয়ায় প্রচারণায় সবচেয়ে বেশী লাইনেজ পেতো মেজর জলিলের নয় নম্বর সেক্টর। এ নিয়ে জিয়াউর রহমান সহ অন্য সেক্টর কমান্ডাররা অসন্তুষ্ট ছিলেন। নজরুল লিখেছেন : সেদিনের মেজর জিয়াউর রহমান একজন সেক্টর কমান্ডার, একবার কলকাতায় এসে আমাকে বলেছিলেন আপনি তো শুধু মেজর জলিল সাহেবের সেক্টর নিয়ে বেশি ব্যস্ত থাকেন। আমাদের দিকেও একটু খেয়াল-টেয়াল রাখবেন। মুক্তিযুদ্ধের শেষার্ধে জিয়াকে যখন এক নম্বর সেক্টরের দায়িত্ব ছেড়ে একটি ব্রিগেড গঠন করার নির্দেশ দেওয়া হয়, জিয়া তা পালন করলেন ঠিকই কিন্তু তার দলের নাম রাখলেন ‘জিয়া বাহিনী’। এমনিতে ওসমানী ‘মুজিব বাহিনী’ নিয়ে ভীষণ ক্ষিপ্ত ছিলেন, জিয়ার এই পদক্ষেপ আগুনে ঘি ঢাললো। ওসমানী জিয়ার বিরুদ্ধে সামরিক কমান্ডকে অস্বীকার করার অভিযোগ এনে তার নেতৃত্ব কেড়ে নিয়ে তাকে গ্রেপ্তারের নির্দেশ দিলেন। সিদান্তটি সত্যি কার্যকর করা হলে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অবস্থা কি হতো ভাবতেই শিউরে উঠি, তবে তা হয়নি প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিনের বিচক্ষণতার কারণে। তিনি ওসমানীর সিদ্ধান্তটি বাতিল করে আরো দুটি বাহিনী গঠন করার পাল্টা নির্দেশ দিলেন। ‘খালেদ বাহিনী’ ও ‘শফিউল্লাহ বাহিনী’র জন্ম এভাবেই। আমরা যাদের জেড ফোর্স, কে ফোর্স ও এস ফোর্স হিসেবে চিনি।

আসা যাক তাজউদ্দিনের প্রতিক্রিয়ায়। তিনি বিরক্ত হলেও নিরূপায় ছিলেন। তবে উবান লিখেছেন অন্যভাবে : অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার মানেই অপরিহার্যভাবে মি. তাজউদ্দিন। তিনি মুজিব বাহিনী নেতাদের দু চোখে দেখতে পারতেন না। এবং তাদের প্রতিটি অভিযোগকে বাজে কথা বলে উড়িয়ে দিতেন। ‘মুজিব বাহিনী’ নামে একটি সংগঠন মাঠে নেমেছে এটা প্রথম জানাজানি হয় আগস্টের শুরুতে যখন বিভিন্ন সেক্টরে মুক্তি বাহিনীর সঙ্গে মুজিব বাহিনীর পরিচয়গত সংঘাত সৃষ্টি হয়। ২ নম্বর সেক্টরে খালেদ মোশাররফের বাহিনীর চ্যালেঞ্জে পড়েন ভারতীয় সেনাবাহিনীর পোষাক পড়া অত্যাধুনিক অস্ত্রসহ ৪০ জন মুজিব বাহিনী সদস্য। পরে উচ্চ পর্যায়ের হস্তক্ষেপে এটির সমাধান হয়। এছাড়া নয় নম্বর সেক্টরেও ঘটে এমন ঘটনা। মেজর জলিল এক সাক্ষাতকারে বলেছেন : ‘আমার সেক্টরে হিঙ্গেলগঞ্জ ফিল্ডে যারা মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, তারা ২২ জনকে গ্রেপ্তার করেন। তারা তখন ভেতরে অনুপ্রবেশ করছিল। সেখানে তাদের চ্যালেঞ্জ করা হয়। এক ভদ্রলোক নিজেকে ক্যাপ্টেন জিকু (জাসদ নেতা নুরে আলম জিকু) বলে পরিচয় দেন। তাকেও গ্রেপ্তার করা হয়।’

এই অবস্থায় মুজিব নগর সরকারের সঙ্গে কলকাতার হিন্দুস্তান ইন্টারন্যাশনাল হোটেলে একটি ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে বসেন মুজিব বাহিনীর নেতারা। ভারত সরকারের পক্ষে ইন্দিরা গান্ধীর বিশেষ প্রতিনিধি ডিপি ধর এতে অংশ নেন আর মুজিব নগর সরকারের তরফে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন। সেপ্টেম্বর মাসে আরেকটি বৈঠক হলেও প্রথমবারই একটি আপোষরফায় আসে দুপক্ষ। বৈঠকে শাহজাহান সিরাজকে দেওয়া হয় মুজিব বাহিনী ও তাজউদ্দিন সরকারের মধ্যে লিঁয়াজো রাখার দায়িত্ব। এ বৈঠকেই সিদ্ধান্ত হয় সীমান্ত থেকে ২০ মাইল পর্যন্ত মুক্তি বাহিনী নিয়ন্ত্রণ করবে, তারপর থেকে ভেতরের দিকের দায়িত্ব নেবে মুজিব বাহিনী। তাদের অপারেশন সম্পর্কে তারা কাউকে জানাতে বাধ্য থাকবে না, তবে শুধুমাত্র স্থানীয় সেনা ইউনিট কমান্ডারই জানবেন তাদের অনুপ্রবেশে কথা, তার অনুমতিই নিয়েই তারা ভেতরে প্রবেশ করবেন। ওসমানী, তাজউদ্দিন কিংবা অরোরা কারোই এই বাহিনীর ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকবে না, তবে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারগুলো তাদেরকে জানানো হবে।

মুজিব বাহিনীর যুদ্ধ : উদ্দেশ্য বামপন্থী নির্মূল!

এখানে উল্লেখ না করলেই নয় মুক্তিবাহিনীর রিক্রুটের জায়গাগুলোতে (যুব শিবির) আওয়ামী লীগের নেতারা স্ক্রিনিংয়ের দায়িত্বে ছিলেন। তাদের কাজ ছিল মুক্তিবাহিনীতে যেন আওয়ামী ঘরানার বাইরে কোনো রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রবেশ না ঘটে। কিন্তু তারপরও তা ঠেকানো যায়নি।

উবান লিখেছেন : Young men had been coming in their thousands at this time to have training, but there was no satisfactory procedure to find out the sincerity and motive of all those who were coming for the purpose of training. For this the training camps had to depend on the certificates given by the National Assembly members (MNA) appointed by the provisional government about the sincerity of the trainees. MNAs used to issue the certificates, blindly based on the list prepared by the Bengali officers, but some of these trainees had a future political motive. As a result, a few groups vanished with their weapons into the deep interior of Bangladesh, while some others would return after hiding their weapons and report that the weapons had been captured and gone out from their hands. To put an end to these unhappy activities, a fullproof solution was put forward, but the senior officials did not accept it, because, being in higher positions, they considered their knowledge to be superior too.’

উবান জুলাইয়ের দিকে ব্যক্তিগতভাবে এনিয়ে উচ্চপর্যায়ে অভিযোগ করেছিলেন। তার অভিযোগ ছিলো জিয়া এবং খালেদ মোশাররফসহ বেশ কজন সামরিক অফিসারের বিরুদ্ধে তার অভিযোগে উল্লেখ করেন যে মুক্তিবাহিনীতে এদের প্রশ্রয়ে কিছু নকশালপন্থী এবং চীন পন্থী পাকিস্তানি এজেন্টের অনুপ্রবেশ ঘটেছে। তার সেই অভিযোগে (ইমেজ ফাইল দেখুন) রাশেদ খান মেনন ও তার ভাইদের নাম উল্লেখ করা হয়। পাশাপাশি জিয়া-খালেদরা ব্যক্তিগত বাহিনী তৈরি করছেন যার মাধ্যমে স্বাধীনতার পর ক্ষমতা দখল করার মতলব আঁটছেন। সে সময় কমরেড ফরহাদের নেতৃত্বে ছাত্র ইউনিয়নের সদস্যরা আলাদা ভাবে ট্রেনিং নিচ্ছিলেন। নিচ্ছিলেন চীনা পন্থী ন্যাপ ভাসানীর সদস্যরাও। এ সময় বারবার সর্বদলীয় একটি বিপ্লবী সরকার গঠনের জন্য চাপ দেওয়া হচ্ছিল তাজউদ্দিনকে। এ ব্যাপারে অবশ্য ইন্দিরারই অমত ছিল। কারণ বিশ্ববাসীর কাছে বাংলাদেশ কেসটি ছিল নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের ক্ষমতা না দিয়ে উল্টো হত্যা নির্যাতনের মাধ্যমে দেশছাড়া করার। মুজিব নগর সরকার ছিলো তার আদর্শ প্রতিরূপ। সেখানে সর্বদলীয় বিপ্লবী সরকার মানে পাকিস্তানের গৃহযুদ্ধ কিংবা ভারতের উস্কানিতে বিচ্ছিন্নতাবাদের অপচেষ্টা জাতীয় থিওরিগুলোকে প্রতিষ্ঠা দেওয়া।

মুজিব বাহিনীর নেতারাও এনিয়ে বারবার অভিযোগ করেছেন যে ভারত সরকার নকশালপন্থী-চীনপন্থীদেরও ট্রেনিং দিচ্ছে এবং এ ব্যাপারে তাদের অপছন্দের কথাও তারা উবানকে জানিয়েছেন। উবান এ প্রসঙ্গে জানিয়েছেন তার লেখায়:

These four leaders inform us that many undesirable persons similar to the Naxalites are making inroads (into the Mukti Bahini) in Bangladesh and are getting training and weapons. They warn that these weapons will not be used against the Pakistanis; rather, they are being hidden in Bangladesh so that they can be used after independence in support of movements similar to the Naxalite one. In fact, they mention the names of the pro-Chinese communist leaders who are connected to some army officials of Bangladesh and through whose approval a large number of communist cadres were being recruited and trained and armed with weapons. The matter was brought to the notice of the authorities confidentially, but the result was nil.

The young leaders have seen Bangladesh’s Naxalite men gossiping with the Indian officials in an aristocratic hotel of India. Perhaps the Naxalites lived in such hotels. The young leaders knew that during military rule in East Pakistan those people had been their worst enemies. It was originally against them that the youth organisation of the Awami League was established. The young leaders failed to understand why India was partial towards their identified enemy.

So they mistakenly concluded that the goal of our government was to enable a communist party to stand on solid ground in Bangladesh. They also came to know through a reliable source that the Marxist workers and Moulana Bhasani’s followers were getting separate training and weapons.

এ বিষয়ে উবান তুলে ধরেছেন এ বিষয়ে এক কথোপকথনে আরএন কাওর মন্তব্য :

Moulana Bhasani’s Naxalites are getting their training in a different venue. They had not been put in my custody, because he was certain I would not keep any such promise and the young leaders would very soon find out where those trainees were. This would cause a very serious disturbance. কাও বরং এর দায় চাপিয়েছেন তাজউদ্দিন সরকারের উপরই : We have done nothing against the wishes of the provisional government of Bangladesh and they think Bhasani’s men are a very valuable resource against the Pakistanis. How can we disregard their advice? Tell your young leaders that even if they do not like it they have to swallow it. In the overall planning we will support them only as a key branch, but not as an entity possessing an independent political leadership. We cannot do anything if they do not walk on the right path. Let them go to the dogs.

এ পর্যায়ে এসে পড়ে ‘মুজিব বাহিনী’র বামপন্থী নির্মূল অভিযান বিষয়ে প্রচারণা। এক্ষেত্রে এটি উল্লেখ না করলেই নয় মুজিব বাহিনীর রাজনৈতিক মোটিভেশনে সমাজতন্ত্র ছিল প্রধান বিষয়, এবং তাদের ৮০ ভাগই ছিলেন বাম ধারায় উৎসর্গকৃত। পরবর্তীতে জাসদ গঠনে এরাই নিয়েছিলেন মূল ভূমিকা। তারপরও এই অভিযোগ উঠেছে, বিশেষ করে ঢাকার অদূরে সাভারে সিরাজ শিকদারের সর্বহারা পার্টির সেকেন্ড ইন কমান্ডসহ ৫ সদস্যকে হত্যা করে মুজিব বাহিনীর সদস্যরা। বলা হয় শেখ মণির নেতৃত্বাধীন অংশই এই বিষয়ে অগ্রবর্তী ভূমিকা পালন করেছেন। পাশাপাশি এও আমাদের মনে রাখা দরকার দেশের ভেতরে থাকা চীনপন্থী সমাজতান্ত্রিক দলগুলোর কয়েকটি শুরুতে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অবস্থান নিলেও গণচীনের মনোভাবের প্রেক্ষিতে তারাও অবস্থান পাল্টায় এবং মুক্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামে। সর্বহারা, মতিন-আলাউদ্দিন গ্রুপ, তোয়াহা গ্রুপ সবার সঙ্গেই এই সংঘর্ষ চলতে থাকে। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অভিযোগটি এসেছিল যে তাজউদ্দিনকে হত্যা করতে তারা একজন ঘাতক পাঠায় মুজিবনগরে যে আত্মসমর্পন করে। অভিযোগটি বানোয়াট এবং মুজিব বাহিনীর ভাবমূর্তি নষ্ট করার জন্য করা হয়েছিল বলে সাক্ষাতকারে জানিয়েছেন দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা।

মুজিব বাহিনী তাহলে কি যুদ্ধ করেছে? নাকি আওয়ামী লীগ বিরোধী আর কম্যুনিস্ট নিধনেই নিয়োজিত থেকেছে। প্রসঙ্গতই উল্লেখ করা যেতে পারে আবদুর রাজ্জাকের ভাষ্য : এ অভিযোগ সঠিক নয়। আমরা কমিউনিস্টদের হত্যা করার নির্দেশ দেইনি। আমাদের বৈঠকে এ ধরনের কোন প্রশ্নই ওঠেনি। কোন সিদ্ধান্ত নেয়ার প্রশ্ন আসলে আমাদের চারজনের বৈঠক হতো। হ্যাঁ, আমাদের সিদ্ধান্ত ছিল যদি অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের বাহিনী আমাদের আক্রমণ করে তাহলে প্রথমে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবো। এড়াতে না পারলে প্রতিরোধ করবো। কিন্তু কমিউনিস্ট বাহিনীর সঙ্গে কোনো সংঘর্ষ হয়নি। আর কমিউনিস্ট বাহিনী তো ভেতরে ঢুকতেই পারেনি। তখন তো তারা ট্রেনিংই নিচ্ছে। কমিউনিস্ট বাহিনী আসলে যুদ্ধে যেতেই পারেনি। আমাদের বাহিনী ট্রেনিং নিয়ে ভেতরে ঢুকেছে।

এখানে বোঝা যাচ্ছে রাজ্জাক কমিউনিস্ট বাহিনী বলতে বুঝিয়েছেন দেশের বাইরে থেকে ট্রেনিং নিয়ে অনুপ্রবেশ করা বামদলীয় মুক্তিযোদ্ধাদের কথা। কিন্তু যারা ভেতরে ছিলো তাদের ব্যাপারে তার কোনো মন্তব্য নেই। বরং মুজিব বাহিনী আসলে যে দীর্ঘ মেয়াদী যুদ্ধ পরিকল্পনার ফসল সেটা পরিষ্কার করেছেন একই বক্তব্যে : আমরা তো সর্বাত্মক যুদ্ধ করতে পারিনি। আমাদের পরিকল্পনা ছিলো মুজিব বাহিনী প্রথমে ভেতরে ঢুকবে। তারপর অস্ত্রশালা তৈরি করবে। এরপর আশ্রয়স্থল গড়ে তুলবে। তারপর সংগঠন গড়ে তুলবে। মুজিব বাহিনীর সংগঠন। এরপর থানা কমান্ড করবে। থানা কমান্ড করার পর প্রথম কার্যক্রমটা হবে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সহযোগী অর্থাৎ রাজাকারদের ওপর হামলা চালাবে, তাদের সরবরাহ লাইনের ওপর হামলা চালাবে। গেরিলা কৌশলে ওদের দূর্বল করে দেবে।

সর্বশেষ হলো, ওরা যখন দূর্বল হয়ে পড়বে, তখন পাকবাহিনীর ওপর আঘাত হানো। আমরা তখন এ কাজই করছি। প্রাথমিক কাজ আমাদের মোটামুটি হয়ে গিয়েছিল। আমাদের ট্রেনিংপ্রাপ্ত সদস্যরা যেখানে যেতে পেরেছে, সেখানেই থানা কমান্ড হয়ে গেছে। আমরা জনগনের সাথে মিলে যুদ্ধ করছি। কিছু কিছু রাজাকারও খতম হচ্ছে। কিন্তু মূল জায়গাটা মানে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সামনে না পড়লে যুদ্ধ করিনি। দু-চার জায়গায় সামনে পড়ে গেছি, লড়াই হয়েছে। আমরা তো যুদ্ধ শুরুই করিনি। আমাদের তো পাঁচ বছরের পরিকল্পনা। প্রথম বছর কী করবো, তৃতীয় ও চতুর্থ বছরে কী করবো। তারপর সরকার গঠন করবো। এই ছিল আমাদের সামগ্রিক পরিকল্পনা। আমরা যদি সফল হতাম, তাহলে কোন ঘাস থাকতো না। আগাছা থাকতো না। সমাজদেহ থেকে সব আগাছা উপড়ে ফেলতাম। প্রতিবিপ্লবীদের থাকতে হতো না। হয় মটিভেট হয়ে এদিকে আসতে হতো, নইলে নিশ্চিহ্ন হতে হতো।

শেষ লাইন ক’টিই আসলে বলে দেয় সব কথা। মুজিববাদী সমাজতন্ত্র যা গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র হিসাবে তার দ্বিতীয় বিপ্লব তথা বাকশালে উল্লেখ করেছিলেন মুজিব, তা মার্কসবাদী-লেনিনবাদী বা মাওবাদী ঘরানায় কতখানি গ্রহণযোগ্য ছিলো তা পরের ব্যাপার। কিন্তু এই দলগুলো স্বাধীনতার পরও যুদ্ধ চালিয়ে গেছে ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ ঠেকানোর নামে। তাদের তখনকার থিসিসগুলো শেষ পর্যন্ত নিজেরাই ভ্রান্ত বলে স্বীকার করেছে এর বর্ষীয়ান নেতারা। তোয়াহার মতো কমরেড জিয়ার জনদলকে সর্মথন দিয়ে এমপিও হয়েছেন। লিন বিয়ানের লেখা যে জনযুদ্ধ পড়ে নকশালবাদীরা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন তিনি চিহ্নিত হয়েছেন মাও সেতুংকে হত্যার মাধ্যমে অপসারণের ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে, তাকে এবং সে সময় গণচীনের রাজনৈতিক আদর্শের প্রচারণায় থাকারা (চার কুচক্রী) সবাই প্রতিবিপ্লবী আখ্যা পেয়েছেন। শেষ বিচারে সবই ভুল দর্শনে ভুল যুদ্ধ বলে রায় পেয়েছে, জনগনের সঙ্গে থাকার বদলে জনবিচ্ছিন্ন যুদ্ধ হিসেবে।

এক্ষেত্রে না বললেই নয় যে মুজিব বাহিনীর বিরুদ্ধে যে অপপ্রচার তার সবকটিই শেখ মণির অংশটির বিরুদ্ধে। অধ্যাপক আহসাবউদ্দীন আহমেদ নামে একজন ‘ইন্দিরা গান্ধীর বিচার চাই’ নামে একটি বই উৎসর্গ ১৬ জন বামপন্থীর উদ্দেশ্যে যার ১৪ জনকে নাকি মুজিব বাহিনী সদস্যরা হত্যা করেছেন। এরা সবাই মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন এবং চট্টগ্রামের বাঁশখালী থানার নাপোড়া পাহাড়ের ঘুমন্ত অবস্থায় ব্রাশ ফায়ারে হত্যার শিকার হন। একইভাবে সাতক্ষীরার তালা উপজেলায় কাজী জাফর-মেনন গ্রুপের কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলা সমন্বয় কমিটির নেতা সৈয়দ কামেল বখতের হত্যার দায়ও মুজিব বাহিনীর ওপর চাপিয়েছেন তার বড়ভাই দীদার বখত (এরশাদের প্রতিমন্ত্রী)। নরসিংদীতে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গেও লড়াইয়ে এক পর্যায়ে সমঝোতা করেন সিরাজুল আলম খান ও আবদুর রাজ্জাক। এছাড়া পাকবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে বন্দী ও রাঙ্গামাটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকা স্বপন চৌধুরীকে (ছাত্রলীগের সম্মেলনে সমাজতান্ত্রিক স্বাধীন বাংলা প্রস্তাবনার উদ্যোক্তা) গুম করার অভিযোগও ওঠে শেখ মণি গ্রুপের বিরুদ্ধে।

এসব বিষয়ে অভিযোগগুলো বেশীরভাগই এসেছে স্বাধীনতার পর জাসদে যোগ দেওয়া নেতাদের তরফে এবং তখন তাদের প্রতিপক্ষ হিসেবে বড় ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন শেখ মণি। স্বাধীনতার পর পর যখন মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র সমর্পণের অনুরোধ করে ভারতীয় বাহিনী ও দেশে ফেরা বাংলাদেশ সরকার, তখন এই মণিই রূখে দাঁড়ান এই বলে যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশে না ফেরা পর্যন্ত তার দলের কোনো সদস্য অস্ত্র নামিয়ে রাখবে না। প্রয়োজনে গৃহযুদ্ধ হবে। ডিপি ধরের সঙ্গে তার এমন কথোপকথন এসেছে উবানের বইয়ে।

‘Bangladesh is now free. Under the sacrificing Prime Minister Tajuddin, the provisional government has started the work in full swing. The new government of Bangladesh has directed the return of all illegal weapons and the very first of those who were told to do it were the boys of the Mujib Bahini. Sheikh Moni was furious about this.’

He made a definite complaint to me about the dicta adopted by Tajuddin. Among them were his staying in power and preparing a leftist force. He even showed me a group of armed communist youths in the corridors of the Hotel Intercontinental who had black bands tied around their foreheads. ‘I was a witness to a hot debate between Sheikh Moni and Shree D. P. Dhar in connection with the surrender of weapons. Moni told Shree Dhar they would not surrender their weapons before Sheikh’s arrival in Dhaka and, if necessary, they would wage a civil war’ Moni later said to me that his observation hitherto has confirmed that Shree Dhar was a sworn enemy of his country.

শেষ কথা :
মুজিব নগর সরকারের অলক্ষ্যে গড়ে ওঠা ‘মুজিব বাহিনী’ শেষ বিচারে একটি ফ্রাংকেস্টাইন হিসাবেই আত্মপ্রকাশ করেছে, যার প্রমাণ মিলেছে স্বাধীনতার পর। মুজিব নগর সরকারকে বিরক্ত না করে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ব্যস্ত থাকা কিংবা অনুগতদের আদর্শিক লড়াইয়ে উদ্বুদ্ধকরণ কিংবা সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিয়ে র’য়ের নীলনক্সার বাস্তবায়ন- যেভাবেই এর মূল্যায়ন করা হোক না কেন আদপে মুক্তিযুদ্ধকালে এর কার্যক্রম খোদ ভারতীয় বাহিনীর কাছে ‘রহস্যঘেরা’। যারা এ নিয়ে মুখ খুলেছেন বা লিখেছেন সেখানেও বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে তার রাজনৈতিক আদর্শ, রাজনৈতিক পরিচয়। তারপরও একদম কিছু না জানার চেয়ে কিছুটা জানা, জানার পর খুটিনাটি ব্যবচ্ছেদ ও নিজস্ব অনুসিদ্ধান্ত প্রয়োগের স্বাধীনতা পাঠকমাত্রই রাখেন। আমার পোস্টের উদ্দেশ্যও তাই, সে সুযোগটা আপনাদের দেওয়া।

তথ্যসূত্র :
মাসুদুল হক : বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ‘র’ এবং সিআইএ
সুজন সিং উবান : ফ্যান্টমস অব চিটাগং : দ্য ফিফথ আর্মি ইন বাংলাদেশ
নজরুল ইসলাম : একাত্তরের রণাঙ্গন অকথিত কিছু কথা
ওবায়দুর রহমান মোস্তফা : মুক্তিযুদ্ধে নবম সেক্টর ও আমার যুদ্ধকথা
সিরাজউদ্দীন আহমেদ : প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ
মুক্তিযুদ্ধ কোষ (তৃতীয় খন্ড) এবং ভারতীয় সেনাবাহিনীর দলিলপত্র
আমার ব্লগ ক্যাটেগরি: মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১

ছবি : উবানের সঙ্গে মুজিব বাহিনীর চার নেতা (বা থেকে রাজ্জাক, তোফায়েল, উবান, শেখ মণি ও সিরাজ), তেনদুয়া ক্যাম্পে মুজিব বাহিনীর সদস্যদের শপথ (সবার ডানে ইনু), মুজিব বাহিনীর সনদপত্র, ভারতীয় বাহিনীর দুটো দলিলের কিয়দাংশ।

মূলঃ অমি রহমান পিয়াল-এর ব্লগ