রওশন আলী রুশো একাধারে মানুষ গড়ার কারিগর, বীর-মুক্তিযোদ্ধা, দক্ষ সংগঠক এবং ইটনায় ইতিহাস চর্চার পথিকৃত তথা ভাটির ইতিহাসের কাণ্ডারী। জীবনের সোনালি বর্তমানকে উৎসর্গ করতে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের মাধ্যমে যে মানুষটি নিজেই ইতিহাসের অংশ, সে মানুষটিই আবার ইতিহাসের সত্যানুসন্ধানে নিজেকে ব্যপৃত রেখে উন্মোচন করে চলেছেন ইতিহাসের অনেক অজানা, দূর্লভ অথচ গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। তার অসাধ্য সাধনের মতো দৃঢ়চেতা মনোভাব, অধ্যাবসায় ও মেধা তাকে ভাটির চলমান ইতিহাসের কালপুরুষ-এর অনন্য মর্যাদা দান করেছে।

নিপূণ কারিগরের মতো তার কলমের তুলিতে তুলে আনছেন ভাটির সমৃদ্ধ ইতিহাস ও ঐতিহ্য। চার দশকেরও বেশি সময় ধরে লেখালেখি আর গবেষণার মাধ্যমে তিনি নিজেও সমৃদ্ধ সে ইতিহাস ও ঐতিহ্যের গর্বিত উত্তরাধিকারের একজন হয়ে ওঠছেন। শত প্রতিকূলতাকে জয় করে আজ তিনি ইটনা তথা ভাটির ইতিহাসের কাণ্ডারী। প্রাবন্ধিক ও ইতিহাস গবেষক রওশন আলী রুশো ১৯৫৪ সালের ২ জানুয়ারি কিশোরগঞ্জ জেলার ইটনা উপজেলার ছিলনী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম মো. আব্দুল জলিল এবং মাতার নাম উমরাজ বানু। নিজগ্রামের পাঠশালা চুকিয়ে ইটনা মহেশচন্দ্র শিক্ষা নিকেতন থেকে মাধ্যমিক পাশ করার পর ভর্তি হন কিশোরগঞ্জ গুরুদয়াল কলেজে। ১৯৭১ সালে গুরুদয়াল কলেজের একাদশ শ্রেণীর ছাত্র ১৭ বছরের কিশোর রওশন আলী রুশো মাতৃভূমির পবিত্র আহ্বানকে উপেক্ষা করতে পারেননি। সহযোদ্ধা শহীদ সিরাজুল ইসলাম বীরবিক্রম এবং অন্যান্যদের সঙ্গে পাড়ি জমান যুদ্ধক্ষেত্রের অনিশ্চিত আঙিনায়। চেহারায় ছোটোখাটো হলেও রওশন আলী রুশো’র অসীম সাহস আর আত্মবিশ্বাস অনেকের নিকটই অবিশ্বাস্য ঠেকে।

৫নং সেক্টরের ৫নং ব্যাচের হয়ে দেশকে পাকহানাদার মুক্ত করতে যুদ্ধ করেছেন বৃহত্তর সিলেট জেলার পশ্চিমাঞ্চল এবং বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার পূর্বাঞ্চলে। একজন সেকশান কমাণ্ডার হিসাবে তিনি তিনজন বিখ্যাত কোম্পানী কমাণ্ডারের সঙ্গে যুদ্ধ করেন। শহীদ জগতজ্যোতি দাস বীরবিক্রম তার প্রথম কোম্পানী কমাণ্ডার ছিলেন। তার দ্বিতীয় কোম্পানী কমাণ্ডার ছিলেন ইটনার ছিলনী গ্রামেরই সহযোদ্ধা শহীদ সিরাজুল ইসলাম বীরবিক্রম এবং সর্বশেষ কোম্পানী কমাণ্ডার ছিলেন মতিউর রহমান বীরবিক্রম। স্বাধীনতা পূর্ববর্তী সময় থেকে রওশন আলী রুশো’র লেখায় হাতেখড়ি। মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষ করা নানা ঘটনাপ্রবাহ তার লেখায় নতুন মাত্রা যোগ করে। মুক্তিকামী জনতার দেশাত্ববোধ ও সমৃদ্ধ চেতনা তার মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক লেখার মূল উপজীব্য হয়ে ওঠে।

হাওরের প্রত্যন্ত পল্লী থেকে নানা সীমাবদ্ধতার মাঝেও তিনি অসংখ্য সংকলন সম্পাদনা ও প্রকাশ করেছেন। এগুলোর মধ্যে রক্তবীজ (১৯৮৯), প্রতিশ্রুতি (১৯৯০), ধনু নদীর বাঁকে (১৯৯২), রক্তরেখা (১৯৯৪), নবদিগন্ত (১৯৯৫), অশান্ত ঢেউ (১৯৯৫), ঠিকানা ভাটি (১৯৯৬), বজ্রকণ্ঠ (১৯৯৭) প্রভৃতি উলেৱখযোগ্য। কিশোরগঞ্জ জেলার ৪ কৃতি পুরুষের জীবনী নিয়ে প্রকাশিত স্মারকগ্রন্থ’ ‘উন্মোচন’ এর নির্বাহী সম্পাদকের দায়িত্বও তিনি পালন করেন। এছাড়া দ্বিমাসিক ছোট কাগজ ‘দৃশ্যপট ৭১’ এবং ত্রৈমাসিক ‘আলোকিত কিশোরগঞ্জ’-এর গবেষণা প্রবন্ধের নিয়মিত লেখক হিসাবে তিনি স্বতন্ত্র একটি অবস্থান তৈরি করে নিতে সমর্থ হয়েছেন। তার প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য গবেষণা প্রবন্ধগুলো হচ্ছে ‘ভাটিয়াল মুল্লুক’, ‘ভাটি এলাকার মাটি ও মানুষ’, ‘ইটনা উপজেলার কথা’, ‘দিল্লীগড়ের উপাখ্যান’, ‘ধনু নদীর ইতিকথা’, ‘বাংলার প্রথম র‌্যাংলার আনন্দমোহন বসু’, ‘ব্যারিষ্টার ভূপেশ চন্দ্র গুপ্ত এবং মহেশচন্দ্র শিৰা নিকেতনের গোড়ার কথা’, ‘বাংলা সনের ইতিকথা’ এবং ‘চরমপত্র ও এমআর আখতার মুকুল’।

রওশন আলী রুশো ২০০৪ সালে কিশোরগঞ্জের প্রথম ইতিহাস সম্মেলনে প্রাবন্ধিক ও গবেষক হিসেবে সম্মাননা লাভ করেন। ২০০৫ সালে তিনি এশিয়াটিক সোসাইটি বাংলাদেশ কর্তৃক ‘বাংলাপিডিয়ার সাংস্কৃতিক জরীপের আঞ্চলিক গবেষক’ হিসেবে নিয়োগ পান। ২০০৮ সালে সৃজনশীল সাহিত্যকর্মের জন্য সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় কর্তৃক সম্মানীভাতা তালিকায় তার নাম অন্তর্ভূক্ত করা হয়। একজন দক্ষ সংগঠক হিসেবে রওশন আলী রুশো বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে নিজেকে সক্রিয়ভাবে নিয়োজিত রেখেছেন। বর্তমানে তিনি ইটনা উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমাণ্ডের নির্বাচিত সহ-কমাণ্ডার হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি ইটনা সাহিত্য পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি এবং কিশোরগঞ্জ সাহিত্য পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে এগুলো প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন।

এছাড়াও তিনি শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন স্মৃতি সংসদের সহ-সভাপতি এবং কিশোরগঞ্জ ইতিহাস ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা পরিষদের নির্বাহী প্রধানের দায়িত্ব পালন করছেন।

লিখেছেনঃ আশরাফুল ইসলাম