নবজাতকের কচি মুখ দেখে আনন্দে মন ভরে যায় মায়ের। শিশুর প্রথম কান্না এনে দেয় মাতৃত্বের সুখ। সন্তান বুকে নিয়ে তিনি যখন বাড়ি ফিরে যান, সূতিকাগারে পড়ে থাকে তাঁর এত দিনের কষ্ট ও দুর্ভোগ। মা হওয়ার সময় পাশে থেকে যাঁরা সহযোগিতা করেন, অনেক মা-ই ভুলে যান তাঁদের কথা। এই সহযোগীদের একজন আসমা খাতুন (৪৫)।
কিশোরগঞ্জ সদর আধুনিক হাসপাতালের প্রসূতি বিভাগে আয়া হিসেবে ১৫ বছর ধরে কাজ করছেন আসমা। ওই বিভাগে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে ভূমিষ্ঠ হওয়া নবজাতকের প্রথম পরিচর্যা তাঁর হাতেই সম্পন্ন হয়। এ পর্যন্ত প্রায় ১৫ হাজার নবজাতককে এই সেবা দিয়েছেন তিনি। এই কাজ শুধু তাঁর জীবিকার উৎসই নয়, মানসিক তৃপ্তিরও আধার। প্রতিবার প্রসূতি বিভাগ থেকে কোনো মা যখন নবজাতককে নিয়ে ফিরে যান, মায়ের হাসিমুখ শান্তি এনে দেয় তাঁর মনে। নবজাতকের প্রথম কান্নার সুর মিষ্টি ছন্দে বাজতে থাকে কানে।
পরিচ্ছন্নকর্মী হিসেবে শুরু: আছমা খাতুনের বাড়ি কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার রুপুখালী শোলাকিয়া গ্রামে। স্বামী সোহরাব মিয়া, দুই মেয়ে ও এক ছেলে নিয়ে তাঁর পাঁচজনের সংসার। আসমার ভাষ্য, স্বামী বেকার থাকায় একপর্যায়ে তাঁদের না খেয়ে মরার জোগাড় হয়েছিল। এ সময় সংসারের হাল ধরতে হন্যে হয়ে কাজ খুঁজে বেড়ান তিনি।
১৯৮৯ সালে জেলার স্বাস্থ্য বিভাগে পরিচ্ছন্নকর্মী হিসেবে চাকরি নেন। প্রথমে তিনি করিমগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যোগ দেন। দায়িত্ববোধ ও নিষ্ঠার কারণে শুরু থেকেই কর্মক্ষেত্রে সুনাম কুড়ান তিনি। জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের একাধিক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা তাঁর এই কর্তব্যবোধের কথা জানতেন। ১৯৯৫ সালে কিশোরগঞ্জ আধুনিক সদর হাসপাতালে অস্ত্রোপচার কক্ষ (অপারেশন থিয়েটার) চালু হয়। এ সময় একজন দক্ষ কর্মী হিসেবে প্রেষণে আসমা খাতুনকে অস্ত্রোপচার কক্ষে নিয়ে আসা হয়। ১৯৯৬ সালে হাসপাতালে প্রসূতি বিভাগে আয়া হিসেবে যোগ দেন তিনি। কর্মগুণে তিনি এই বিভাগের অস্ত্রোপচারের কাজে অপরিহার্য কর্মী হয়ে ওঠেন।
প্রতিদিন যা করতে হয়: অস্ত্রোপচারের আগে চিকিৎসকের ব্যবহার্য সব অস্ত্র ও যন্ত্র ট্রলিতে সাজিয়ে রাখেন তিনি। মা হতে যাওয়া রোগীকে অস্ত্রোপচারের উপযোগী পোশাক পরিয়ে তৈরি করেন। এর পর সদ্যোজাত শিশুর নাভি বেঁধে দেওয়াসহ তাঁর শুশ্রূষা তো আছেই।
কিশোরগঞ্জ সদর হাসপাতালে কর্মরত অবেদনবিদ (অ্যানেসথেসিস্ট) এম এ ওয়াহাব বলেন, হাওরবেষ্টিত কিশোরগঞ্জ সদর আধুনিক হাসপাতালের প্রসূতি বিভাগে বলতে গেলে ২৪ ঘণ্টাই অস্ত্রোপচার হয়। প্রয়োজনের তুলনায় প্রশিক্ষিত জনবল কম থাকায় এই অস্ত্রোপচারে আসমা একজন অপরিহার্য কর্মী। যখন প্রয়োজন তখনই তিনি অস্ত্রোপচার কক্ষে হাজির হয়ে যান। এ ব্যাপারে আজ পর্যন্ত হেরফের হয়নি। তাঁর এই কর্মস্পৃহা হাসপাতালে সবার কাছে এক বিস্ময়।
অন্য রকম কিছু ঘটনা: গত ১১ জুন রাত ১২টার দিকে করিমগঞ্জ উপজেলার জয়কা গ্রাম থেকে দরিদ্র কৃষক সুমন মিয়া অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী কুলসুম বেগমকে (২২) নিয়ে হাসপাতালের জরুরি বিভাগে আসেন। সেখান থেকে প্রসূতি ওয়ার্ডে কুলসুমকে ভর্তি করা হয়। রোগীর অবস্থা সংকটাপন্ন দেখে কর্তব্যরত সেবিকা ফরিদা ইয়াসমিন রাত আড়াইটার দিকে প্রসূতি বিশেষজ্ঞ শশাঙ্ক কুমার সূত্রধরের বাসায় ফোন করেন। তিনি এসে জরুরি অস্ত্রোপচারের আয়োজন করেন। কিন্তু অস্ত্রোপচার কক্ষে তখন সার্জন, অবেদনবিদ, একজন সেবিকা ও আসমা ছাড়া আর কেউ ছিলেন না। অথচ তখন আরও চিকিৎসক ও সহযোগীর প্রয়োজন। এত রাতে আর কাউকে পাওয়াও যাচ্ছিল না। শেষে আসমা অভয় দিলেন, ‘আপনারা শুরু করেন স্যার, অন্য কাজগুলো আমি করে দেব।’
আসমা অস্ত্রোপচারের যন্ত্রপাতি দিয়ে ট্রলি সাজালেন। অবেদনবিদ চিকিৎসককে সাহায্য করলেন। সহকারী সেবিকা ও ঝাড়ুদারের কাজও তিনি সুন্দরভাবে করে দিলেন। অস্ত্রোপচার সফল হলো।
কুলসুম বেগম বলেন, তাঁর ও শিশুর জীবন রক্ষার পেছনে আসমার সহযোগিতা বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। তিনি বলেন, ‘আমার প্রথম শিশুর প্রথম কান্না আমি শুনতে পাইনি। প্রথম কান্নার সুর শুনেছেন আসমা। তাই তাঁর নামের প্রথম অক্ষর দিয়ে ছেলের নাম রাখব।’
স্টাফ নার্স ফরিদা ইয়াসমিন বলেন, ‘আসমার জীবনে এমন ঘটনার অনেক নজির রয়েছে। শুধু গভীর রাত নয়, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে যেকোনো সময় তাঁর ওপর আমাদের নির্ভর করতে হয়।’
শোলাকিয়া এলাকার নার্গিস বেগম জানান, চার বছর আগে হাসপাতালে সন্তান প্রসব করার সময় তাঁর ও গর্ভের শিশুর অবস্থা সংকটাপন্ন ছিল। হাসপাতালে জনবল সংকট ছিল তীব্র। সার্জন সাহস পাচ্ছিলেন না অস্ত্রোপচারে। আসমার উৎসাহে তিনি কাজ শুরু করেন এবং সফল হন।’
২০০৮ সালে তাড়াইলের এক কৃষকের স্ত্রী মদিনা বেগম মুমূর্ষু অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি হন। একটি কন্যাশিশুর জন্ম দিয়ে মা মারা যান। কিন্তু সন্তানকে নিতে বাবা আর হাসপাতালে আসেননি। শিশুটিকে লালন-পালনের দায়িত্ব নেন আসমা। কিছুদিন পর কিশোরগঞ্জ শহরের ব্যবসায়ী দুলাল মিয়া শিশুটিকে নিতে আগ্রহ প্রকাশ করেন। পরে হাসপাতালের কর্মকর্তাদের জানিয়ে দুলাল মিয়ার পরিবারকে শিশুটিকে লালন-পালনের জন্য দেন আসমা। আসমা বলেন, ‘দুলাল মিয়া মাঝেমধ্যে বাচ্চাটিকে নিয়ে আসেন। খুব ভার লাগে। বাচ্চাটি আদর-স্নেহের মধ্যে বড় হচ্ছে।’
কাজের স্বীকৃতি: কিশোরগঞ্জ আধুনিক সদর হাসপাতালের প্রসূতি বিভাগে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে বছরে গড়ে প্রায় দুই হাজার শিশুর জন্ম হয়। এই অস্ত্রোপচারে আসমার বিশেষ অবদানের জন্য বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) জেলা শাখা ২০০৯ সালে পুরস্কৃত করে আসমাকে। গত বছর বিজয় দিবসে তাঁকে এই সমিতির পক্ষ থেকে নগদ অর্থ, ক্রেস্ট ও সনদপত্র দেওয়া হয়।
২০০৮ ও ২০০৯ সালে প্রসূতি সেবায় বিশেষ অবদানের জন্য ইউনিসেফ কিশোরগঞ্জ সদর আধুনিক হাসপাতালকে জাতীয়ভাবে পুরস্কৃত করে। গত ১৩ জুন ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০০৯ সালের পুরস্কার হিসেবে ক্রেস্ট ও প্রশংসাপত্র তুলে দেন সিভিল সার্জন দীন মোহাম্মদের হাতে।
সিভিল সার্জন দীন মোহাম্মদ জানান, প্রসূতি সেবায় জাতীয় পর্যায়ে দুইবার এই হাসপাতাল পুরস্কৃত হয়েছে। এ পুরস্কার আসমার জন্যই পাওয়া। তাঁকে ২৪ ঘণ্টাই পাওয়া যায় বলে প্রসূতি সেবায় এই হাসপাতাল বিশাল অবদান রাখতে পেরেছে।
চিকিৎসকেরা যা বলেন: কিশোরগঞ্জ সদর হাসপাতালের প্রসূতি বিভাগের প্রধান সুফিয়া খাতুন বলেন, ‘প্রসূতি বিভাগে জনবল সংকট থাকায় অস্ত্রোপচার কক্ষ কার্যত আসমাকেই সামলাতে হচ্ছে। অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে জন্ম নেওয়া এ পর্যন্ত প্রায় ১৫ হাজার শিশুর প্রথম পরিচর্যা আসমা করেছে।’
প্রসূতি বিশেষজ্ঞ শশাংক কুমার সূত্রধর বলেন, ‘প্রায় দেড় দশক হাসপাতালে কাজ করছি। আসমা ছাড়া অস্ত্রোপচার হয়েছে—এমন ঘটনা বিরল। ১৫ হাজার শিশু তাঁর হাত দিয়েই হাসপাতাল থেকে সুস্থ দেহে ফিরে গেছে। এমন নজির দেশে দ্বিতীয়টি খুঁজে পাওয়া যাবে না বলে আমার বিশ্বাস।’
জেলা বিএমএর সাধারণ সম্পাদক নৌশাদ খান জানান, তাঁর সম্পর্কে বলতে গেলে কয়েক হাজার শব্দের প্রয়োজন। তবে এটুকু বলতে পারি, তাঁর অনুপস্থিতিতে গোটা প্রসূতি ওয়ার্ড বিপাকে পড়ে যাবে।